আজকে আমরা শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী গ্রন্থের অন্তর্গত।
শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক
“Abdur Razzak, a leading artist of Bangladesh is versatile in expressing himself in painting. grafic arts and sculpture” নজরুল ইসলামের এই উক্তির সত্যাসত্য যাচাই না করে একেবারে নীরবে মেনে নেয়া যায় না (কনটেমপরারি আর্ট সিরিজ অব বাংলাদেশ-১০) । নজরুল ইসলামের মতে ‘A Living Artist’ কথাটা গ্রহণ করা যায় না। কারণ এদেশের শিল্প-আন্দোলনে আব্দুর রাজ্জাকই একমাত্র অগ্রগামী শিল্পী নয়। শিল্প-আন্দোলনের অগ্রগামী ভূমিকায় যে কয়জন শিল্পী রয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক তাদের মধ্যে অন্যতম একজন।
সার্বিকভাবে শিল্প-আন্দোলনের নায়ক হলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং তার সমসাময়িকরা, যাদের নাম এ গ্রন্থের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। আর বিমূর্ত শিল্প-আন্দোলনের ভূমিকায় বা প্রবর্তক হিসেবে আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, মুর্তজা বশীর, মোহাম্মদ কিবরিয়া, রশীদ চৌধুরী প্রমুখ শিল্পীগণ রয়েছেন। রাজ্জাক তাদের পরের সারিতে। অতএব, নিঃসন্দেহে বলা যায়, আব্দুর রাজ্জাক অগ্রগামীদের অন্যতম একজন ।
তার কর্মকাণ্ড সামগ্রিকভাবে পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করলে তার ভেতর বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য একেবারে নিতান্ত না বলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংকোচ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের টানাপোড়ন বলাই ভালো। জয়নুল আবেদিন ও হামিদুর রহমানের ভেতর দেশজ শিল্পশৈলী ও পাশ্চাত্যের আধুনিকতার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়ন দেখা যায়, রাজ্জাকের মধ্যেও ঠিক সেই একই অবস্থা লক্ষ্য করা যায় । তাই বলে রাজ্জাকের মধ্যে যে কিছু বিভ্রান্তি নেই সে কথা একেবারে নিশ্চিত করে বলা যায় না।
নজরুলের কথা “Expressing himself in grafic art and sculpture has passed through the stages of academic, Realistic. Semi – abstract and Abstract” বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজ্জাক ধাপে ধাপে না এগিয়ে বাস্তববাদ ও বিমূর্তবাদের মধ্যে দোদুল্যমান হয়ে রয়েছেন । এক কথায় বলতে গেলে, না দেশজ শিল্পশৈলী সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারছেন, না পাশ্চাত্যের আধুনিকতা মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারছেন ।
নজরুল ‘একাডেমিক’ বলতে ঠিক কি বুঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট না। তবে তিনি যদি মহাবিদ্যালয়ের অনুশীলন বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে বলার কিছু নেই। তবে ‘Academism’ বলতে যা বুঝায় সে অর্থে বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনের ক্ষেত্রে ‘Academism’ গড়ে ওঠার সুযোগই হয়নি কোনো দিন। কারণ শিল্প-আন্দোলনের আরম্ভ থেকেই পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ধারা এবং বিমূর্তবাদকে ভিত্তি করে নানা রকম পরীক্ষা- নিরীক্ষা চলতে থাকে।
আবার রাজ্জাক সম্বন্ধে নজরুলের “Primarily an abstract artist” কথাটাও গ্রহণযোগ্য না। কারণ রাজ্জাক মূলত বাস্তববাদী, জয়নুল আবেদিনের একমাত্র বিশ্বস্ত অনুগামী বলা যায়। বিশেষ করে তার অনেক কাজ আছে যার মধ্যে জয়নুলের প্রবল প্রভাব স্পষ্ট ধরা পড়ে। সুতরাং, নজরুলের বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ট অবকাশ আছে । যাহোক, নজরুলের প্রসঙ্গ এখানে স্থগিত রেখে মূল বিষয় রাজ্জাকের শিল্পকর্ম নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক ।
পূর্ব আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায়, মাধ্যম, আঙ্গিক, ধারা ও ধরন ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অন্তর্দ্বন্দ্ব ও উভয় সংকটের ভেতর রয়েছেন । কি করা যায়, কোথা থেকে কোনদিকে কিভাবে অগ্রসর হওয়া যায় ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অন্তর্দ্বন্দ্বের টানাপোড়নের মধ্যে রয়েছেন। অর্থাৎ এখনো পর্যন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছেন।
অনিশ্চয়তার কারণে কখনো জয়নুল আবেদিনের অনুসরণ প্রবণতা, কখনো স্বতন্ত্র আঙ্গিক উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা, কখনো বাস্তববাদ আবার কখনো বিমূর্ত প্রকাশবাদের মধ্যে দোদুল্যমান হয়ে রয়েছেন । আর দু’টানা মনোভাবের জন্যই কখনো জলরং, কখনো তেল রং, কখনো ছাপচিত্র আবার কখনো ভাস্কর্যের মধ্যে টানা হ্যাঁচড়া চলছে। যেজন্য কোনো কোনো শিল্প সমালোচক তার কাজকে কখনো ‘বহুমুখীনতা’ আবার কখনো ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ বলে অভিহিত করে থাকেন।
বলাবাহুল্য, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তার যাত্রা সেখান থেকে এখনো পর্যন্ত বেশিদূর এগুতে পারেননি । তিনি প্রায় ষাট বছরে পৌঁছেছেন । কিন্তু এখনো পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছেন।
এ কথা সত্য যে, মাধ্যম, ধারা ও ধরন নিয়ে তার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকলেও কাজের মধ্যে তার কোনো ছাপ পাওয়া যায় না। যখন যা করেছেন তাতে দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন । তবে জলরং এবং ভাস্কর্যে বাস্তবধর্মী কাজে তার স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাব বেশি। তার কাজগুলোকে উপকরণের দিক থেকে বাস্তবধর্মী ও বিমূর্ত এবং মাধ্যম হিসেবে জলরং ও ছাপ চিত্র এবং ভাস্কর্য মোটামুটি এই দু’ ও তিন শ্রেণীতে যথাক্রমে ভাগ করা যায়।
এখানে তার কাজ শুরু থেকে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো। তার একেবারে প্রথম দিকের কিছু কাজ নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক; যেমন- কালি-কলমে আঁকা অনুশীলন (Study) ১৯৫৪, আত্ম-প্রতিকৃতি (Self-portrait) ১৯৫৫ ও ১৯৫৭ যথাক্রমে মিশ্র মাধ্যম ও এনগ্রেডিং, অন্দর মহল বা অভ্যন্তর (Interior) এবং দণ্ডায়মান মূর্তি (স্ট্যাডিং ফিগার) ১৯৫৬ ও ৫৭ মিশ্র মাধ্যম নৌকা তৈরি (Boat-building) এবং ককসেস বাজার জলরং ১৯৫৯ ও ৬৫, মাথা (Head) ড্রাই পয়েন্ট ১৯৫৭, বহিষ্কার (Expulsion) এগ টেমপারা ১৯৫৭ প্রভৃতি কয়েকটা এখানে উদাহরণ হিসাবে আলোচনা করা হলো ।
অনুশীলন একটা রেখাচিত্র, পেন্সিলে আঁকা, যার ভেতর তিনি নদীর ঘাটের দৃশ্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বৈশাখ মাসের খররৌদ্রে কয়েকটা নৌকা ঘাটে বাঁধা রয়েছে। মধ্যাহ্নর খররৌদ্রে ঘাট নির্জন । কেবল নৌকার কয়েকজন শ্রমিক এবং একটা ছাগল এই নির্জনতা ভঙ্গ করেছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি শুকিয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে ।
নদীর ঘাটে প্রশস্ত বালুচরের উপর বাঁশ ও কাঠের গুঁড়ি সাজানো রয়েছে । এটা একটা বাণিজ্যিক ঘাট । দূর আকাশে কুণ্ডলি কুগুলি মেঘ দেখা যাচ্ছে । খররৌদ্রে নদীর তীরে একটা ছাগল বাঁধা রয়েছে । গরমে ছাগলটা পানির পিপাসায় ছটফট করছে। দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে সে সীমিত আয়তনের মধ্যে পানি খুঁজছে পিপাসা মিটানোর জন্য কিন্তু কোথাও ধারে কাছে এক ফোঁটা পানি নেই । কয়েকজন লোক প্রয়োজনের তাগিদে এই ঝাঁঝালো রোদের মধ্যেও কর্মরত রয়েছে ।
মিতব্যয়ী রেখা ও আলো-ছায়ার ব্যবহারে বৈশাখ মাসের খররৌদ্রের তাপ সহজে অনুভব করা যায় । দূর আকাশে কুণ্ডলি মেঘ থেকে আসন্ন ঝড়ের আভাস পাওয়া যায় । কিন্তু খররোদে নদীর ঘাটে বাঁধা ছাগলটা তার বাস্তব বহির্ভূত কল্পনার সাক্ষ্য দেয় । কারণ নদীর ঘাটে কেউ ছাগল বাঁধে না বা ছাগল চরে না, বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ মাসের গরমে । তবে সব কিছু মিলিয়ে এটা একটা সুন্দর রেখাচিত্র বলা যায় ।
দণ্ডায়মান মূর্তি কালি-কলমে আঁকা একজন বিবস্ত্র নারীর প্রান্তরেখা চিত্র (Contour drawing) । কেবল প্রান্তরেখা দ্বারা নারীদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এবং নমনীয় কমনীয় ভাব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে, যার মধ্য দিয়ে তার নারী দেহের পেশী সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা এবং ‘Formal drawing’ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্য আরেকটা রেখাচিত্রের মধ্যে একজন স্থূলদেহী নারীর ঈষৎ স্ফীত তলপেট ও ঝুলে পড়া স্তন থেকে বোঝা যায় যে, সে একজন জননী ।
আত্ম-প্ৰতিকৃতি দু’টো এনগ্রেডিং মাধ্যমে আঁকা ছাপচিত্র। দু’টো ছবির মধ্যেই প্রচলিত অঙ্কনরীতি এড়িয়ে কিছুটা অলঙ্করণ করা হয়েছে, যার ভেতর এলগ্রেকোর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তার রেখা ও ছাপচিত্রের যে বৈশিষ্ট্য সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো, মিতব্যয়ী রেখা এবং স্বল্প ছায়ার (Middle tone) ব্যবহার । মিতব্যয়ী রেখা ও স্বল্প ছায়ার ব্যবহারে আকার, ঘনত্ব ও গভীরতা ফুটে উঠেছে ।
বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্পীদের মতো রাজ্জাকও জলজ মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্য ও দক্ষতার প্রমাণ রাখেন। অবশ্য তেলরং ব্যবহারেও আশাব্যঞ্জক। তার তেল চিত্রগুলোতে অধিকাংশ স্পন্দনশীল রং ব্যবহার করেন। কিন্তু তার ইদানীংকালের তেল চিত্রগুলো দেখলে অসমাপ্ত মনে হয়, যদিও স্বাক্ষরিত ।
যেহেতু বাংলাদেশ একটা নদীমাতৃক নিমভূমি অঞ্চল সেহেতু নৌকা এদেশের আর্থ- সামাজিক এবং জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এদেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠীর জীবন নৌকার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। বস্তুত স্বনির্ভরশীলতা এবং আর্থ- সামাজিক ও জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে নৌকার গুরুত্ব ও অবদান অনস্বীকার্য। তাই এদেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী নৌকা তৈরি ও মেরামত, নৌকা চালনা, মালামাল বহন, মাছ ধরা প্রভৃতি বিভিন্ন কাজে জীবিকার একমাত্র এবং প্রধান উপায় হিসেবে নৌকার উপর নির্ভরশীল ।
তাছাড়াও বন্যার সময় অনেকে নৌকায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায়। আর বেদেদের জীবনই তো নৌকাসর্বস্ব । সমাজের এই শ্রেণী রাজ্জাকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তার জলরঙে আঁকা নৌকা নির্মাণ এখানে উল্লেখ করা হলো ।
শুষ্ক মৌসুমে আগে থাকতেই বর্ষার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় । নৌকা তৈরি আর নৌকা মেরামত । নৌকা নির্মাণ শীর্ষক ছবিতে সেই প্রস্তুতি দেখা যায় । নদীর পাড়ে একটা নৌকা তৈরির কারখানায় কয়েকজন মিস্ত্রী একটা নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত রয়েছে। তারা নদীর পাড়ে একটা দোচালা ঘরের নিচে সকালের ঝিরঝিরে বাতাসে নৌকা তৈরি করছে । নৌকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ, তক্তা চারদিকে পড়ে রয়েছে। নির্মাণাধীন নৌকার চারপাশ বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঠেকানো দেয়া রয়েছে। দোচালা ঘরের ফাঁক দিয়ে। পশ্চাদভূমিতে নদীর মধ্যে কয়েকটা নৌকা দেখা যাচ্ছে ।
নৌকার নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে । কেউ নৌকার পাটাতন ঠিক করছে, কেউ হাতুড়ি দ্বারা পিটিয়ে তারকাঁটা বসিয়ে কাঠের জোড় লাগাচ্ছে, কেউ নৌকার গায়ে বাইরের পাশে আলকাতরা লাগাচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু বিশ্রাম করার সময় একটু ধূমপান করার জন্য ঘরের খুঁটিতে নারিকেলের তৈরি একটা হুক্কা ঝুলিয়ে রেখেছেন। (যা আমাদের দেশে গ্রামের লোকদের কাজে প্রিয় ও প্রচলিত) ।
আলোচিত কাজটা জলরঙে আঁকা । রঙের ব্যবহার ও আলো-ছায়া দেখে মনে হয় ফাল্গুন মাসের কোনো এক সময় হবে। নৌকায় ব্যবহৃত স্বচ্ছ হলুদ ও তামাটে রং দেখে মনে হয় যে, তক্তাগুলো যেন সদ্য রান্দা মেরে মসৃণ করা হয়েছে । তবে অগ্রভূমিতে পড়ে থাকা দু’টো তক্তা এবং সামনের খুঁটিতে ঝুলানো হুক্কা সতর্কভাবে ঝুলানোর ফলে কৃত্রিমতা ধরা পড়েছে । দিগন্তরেখা নৌকার কিনারার একটু নিচে স্থাপন করা হয়েছে । কিন্তু দিগন্তরেখার উপরের ঘরের চালের রেখা নিম্নগামী না হয়ে ঊর্ধ্বগামী হয়েছে । ফলে পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে কিছুটা অস্পষ্টতা দেখা যায় । অবশ্য এই সামান্য ত্রুটি মার্জনীয় ।
জলরঙে আঁকা কক্সেসবাজার ছবিটা পাহাড়ের পাদদেশে নির্জন সমুদ্র সৈকতের একটা দৃশ্য । বঙ্গোপসাগর তীরে পাহাড়ের পাদদেশে সৈকতের উপর এখানে ওখানে কিছু পাথর বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। বামদিকে বঙ্গোপসাগরের কিয়দাংশ দেখা যাচ্ছে । পাহাড়ের পাদদেশে অগ্রভূমিতে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে আগাছা জন্মেছে, গুল্ম-লতায় ঢাকা পাহাড় সবুজের সমাহার। কিন্তু পাহাড়ের খাদ সৃষ্টি, আলো-ছায়া, আকার-গঠন, অগ্রভূমি এবং পাহাড়ের অনুপঙ্খ বর্ণনার মধ্যে অস্পষ্টতার কারণে এলোমেলো ভাব দেখা যায়। অবশ্য এটা স্বাভাবিক।
কারণ চট্টগ্রাম ও সিলেট বাদে বাংলাদেশ একটি নিম্ন সমতল ভূমি, কোথাও পাহাড় নেই। যেজন্য দেশের শিল্পীদের পাহাড় সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা না থাকাই স্বাভাবিক । দৈবাৎ কখনো কয়েক দিনের জন্য পাহাড়ি অঞ্চল ভ্রমণ করলে তো আর পাহাড় দেখা হলো না। পাহাড়কে জানতে হলে, বুঝতে হলে দীর্ঘদিন সেখানে বাস করতে হবে, নিরীক্ষণ করতে হবে। অবশ্য অনভিজ্ঞতার জন্য রাজ্জাককে দোষারোপ করা যায় না।
তার কাজগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিল্পশৈলী ও নান্দনিকভাবে তিনি মার্জিত ভাষার অধিকারী। দণ্ডায়মান প্রতিমূর্তি (Standing Figure), অব্যন্তর (Tnterior), আত্ম-প্রতিকৃতি (Self-portrait), মাথা (Head) মাত্র কয়েকটি তার মার্জিত শিল্পশৈলীর দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হলো ।
মিশ্র মাধ্যমে আঁকা দণ্ডায়মান প্রতিমূর্তি শীর্ষক ছবিতে একজন অর্ধ-বিবসনা যুবতী। (বিকিনি বা সাঁতারের পোশাকে) এক পায়ের উপর ভর দিয়ে ঊর্ধ্বাঙ্গ ডানদিকে ঘুরিয়ে দর্শকের সোজাসুজি দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত দু’টো উঁচু করে ভাঁজ করে মাথার পিছন দিকে ধরে আছে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গির ভেতর একটা ছন্দায়িত রেখা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিমূর্তির একপাশে অন্ধকারের মধ্যে সামান্য আলোকিত অংশ এবং আলোকিত অংশে কিছু ছায়াংশ একদিকে গভীরতা সৃষ্টি করেছে অপরদিকে দেহভঙ্গিকে আরো ছন্দায়িত করে তুলেছে ।
অভ্যন্তর বা অন্দর মহল মিশ্র মাধ্যমে আঁকা একটা উৎকৃষ্ট মনোরম শিল্পকর্ম । এ ছবিটার মধ্যে অতি সতর্কভাবে হিসাব করে পরিবেশ ও আলো-ছায়ার নাটক সৃষ্টি করা হয়েছে । এটা একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের শয়ন কক্ষ। ঘরের ভেতর এদিক-ওদিক জিনিসপত্র যত্ন করে সাজানো রয়েছে, যেমন মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখতে দেখা যায়। কিন্তু বিছানার চাদরটা কিছুটা খাটের উপর থেকে ঝুলে পড়েছে মেঝের উপর ।
গৃহিণী নির্জন ঘরে একাকিনী চুপ করে বসে আছে খাটের উপর, পা দু’টো সামনের দিকে প্রসারিত, হাত দু’টো কোলের উপর আলগোছে রাখা । তার বসার ভঙ্গিতে সহজ স্বাচ্ছন্দ্য অথচ কিছুটা উদাসীন ভাব ফুটে উঠেছে। সংসারের কোনো সমস্যা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। অন্যমনস্কতার জন্য আজ বিছানার চাদরটা পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখতে ভুলে গেছে ।
এ ছবিটার মধ্যে খুব হিসাব করে সামান্য আলোকিত অংশ ব্যবহার করা হয়েছে । ফলে আলো-ছায়ার সুন্দর নাটক সৃষ্টি হয়েছে। পেছনের দেয়ালে স্বল্প আলোর আভার বিপরীতে নারীমূর্তিটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে । বালিশের উপর এবং ঝুলন্ত বিছানার চাদরের উজ্জ্বল আলোতে নারীমূর্তি আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছে । ছায়াংশ এমন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে, মনে হয় ঘরের মধ্যে অনেক জিনিসপত্র সাজানো রয়েছে। পিকাসোর আঁকা আলিঙ্গন শীর্ষক ছবির সাথে রাজ্জাকের অভ্যন্তর-এর মধ্যে সামঞ্জস্য বা প্রভাব দেখা যায়, যার মধ্যে পিকাসো ঘরের মধ্যে আলিঙ্গনাবদ্ধ একটা দম্পতিকে দেখিয়েছেন ।
আত্ম-প্রতিকৃতি মিশ্র মাধ্যমে আঁকা। আত্ম-প্রতিকৃতি অঙ্কনের মধ্যে তার আত্ম- বিশ্বাস ও আত্ম-প্রত্যয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবুও এটার মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা
যায় । কারণ মুখাবয়ব বাস্তবধর্মী কিন্তু গলাটা কিছুটা অলঙ্করণ করা হয়েছে । আলো- ছায়ার ব্যবহারে অস্পষ্টতা দেখা যায়। ডানদিকের চোয়ালের উপর উজ্জ্বল আলো এবং ডান বাহু এত বেশি আলোকজ্জ্বল হয়েছে যে, কপালের আলো অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে। যদিও বোঝা যায়, পেছন দিক থেকে তীব্র আলো পড়ছে। কিন্তু প্রতিফলিত আলো উজ্জ্বল হওয়ার কারণে আলো-ছায়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে ।
একইভাবে ১৯৫৭ সালে আঁকা আত্ম-প্রতিকৃতিটা আরো বেশি অলঙ্করণ করা হয়েছে । মুখাবয়ব উভয় দিক থেকে চেপে লম্বাটে ধরনের করা হয়েছে। তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গলাটা আরো লম্বা করা হয়েছে, যার ভেতর এল গ্রেকো’র প্রভাব বিদ্যমান। যাহোক, এই প্ৰতিকৃতি দু’টো ভালো ছাপছিত্র হিসেবে গণ্য করা যায়। তিনি পাশ ফিরে দর্শকের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সোজাসুজি দর্শকের চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন ।
তার চাহনি, মুখের গাম্ভীর্য এবং দাঁড়ানোর ভঙ্গির ভেতর দিয়ে তারুণ্যের দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট ফুটে উঠেছে । আলোকোজ্জ্বল পশ্চাদভূমি তারুণ্যের সজীবতাকে আরো সজীব করে তুলেছে ।
উচ্চ শিক্ষার্থে রাজ্জাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। ঐ সময় তিনি পাশ্চাত্যের শিল্পকর্মের সাথে চাক্ষুস পরিচয়ের সুযোগ পান। সম্ভবত ঐ সময় তিনি ইতালির রেনেসাঁ যুগের মহান শিল্পীদের শিল্পকর্ম অধ্যয়ন করার সুযোগ পান এবং খ্রিস্টধর্ম দ্বারা প্রভাবান্বিত হন, যা তার ঐ সময়ের কিছু কাজের ভেতর প্রতিফলিত হয় । নির্বাসন শীর্ষক ছবিটা তারই একটা উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হিসেবে এখানে উল্লেখ করা হলো ।
বিষয়বস্তুর চয়ন, উপস্থাপনা, ভাব, আঙ্গিক ট্রিটমেন্ট প্রভৃতি সব কিছু মিলিত ভাবে টেমপারা মাধ্যমে আঁকা এটা একটা ব্যতিক্রম কাজ বলা যায় । আদম ও হাওয়ার বেহেস্ত বা স্বর্গ হতে ফেরেস্তা কর্তৃক বহিষ্কারের দৃশ্য, এ ছবির মূল বিষয়বস্তু।
একজন ফেরেস্তা আদমকে বেহেস্ত থেকে বহিষ্কারের জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দিচ্ছে । আদম ভীতসন্ত্রস্তভাবে ফেরেস্তার আদেশ মোতাবেক হাওয়াকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্গ থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন । হাওয়া তার কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত ও বিষণ্ন, বিমর্ষভাবে আদমের আগে আগে চলেছেন । অন্য ফেরেস্তাগণ ভিড় করে দাঁড়িয়ে তাদের বিদায় নিয়ে যেতে দেখছেন ।
আদম ও হাওয়ার পেছনে আলোকোজ্জ্বল পশ্চাদভূমি এবং অগ্রভূমি এবং চারদিকের ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকার যথাক্রমে বেহেস্তের আনন্দমুখর সুখময় জীবন এবং অনিশ্চিত অন্ধকার পৃথিবীর জরাজীর্ণ দুঃখময় জীবনের ইঙ্গিত দেয় । ভাবের দিক থেকে বক্তব্য স্পষ্ট এ ছবিটা দেখলে রবীন্দ্রনাথের স্বর্গ হতে বিদায় কবিতার দু’টি চরণ মনে পড়ে “থাক স্বর্গে হাস্যমুখে কর সুধা পান/ দেবগণ, স্বর্গ তোমাদেরই সুখস্থান/মোরা পরবাসী”।
ফেরেস্তার এক হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানোর ভঙ্গি এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ভেতর উদ্ধত কঠোর আদেশের ভাব ফুটে উঠেছে। আদম ও হাওয়া সম্পূর্ণ বিবস্ত্রাবস্থায় দর্শকের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে। আদম বামদিকে মুখ ঘুরিয়ে ভীতসন্ত্রস্তভাবে ফেরেস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। হাওয়া ডান হাত বুকের উপর রেখে লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করছেন, মাথাটা ডানদিকে কাত করে আছেন ।
তার মোট ভঙ্গির মধ্যে কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ, লজ্জাবোধ এবং নগ্নতা সম্পর্কে সচেতনতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তাদের বিপরীত দিকে কয়েকজন ফেরেস্তা ব্যথিত হৃদয়ে তাদের বিদায় জানাচ্ছে। সবকিছু মিলিতভাবে এ ছবিটার মধ্যে রেনেসাঁ যুগের খ্রিস্টান শিল্পীদের ধর্মীয় আদর্শ এবং আঙ্গিকের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল । রেনেসাঁ যুগের খ্রিস্টান শিল্পীদের অনুকরণের চেষ্টা অনেকটা সফল হয়েছে বলা যায় ।
আদম-হাওয়ার ডানদিকে দাঁড়ানো সাদা কাপড় পরিহিত ফেরেস্তা রমণীর চেহারার মধ্যে খ্রিস্টান শিল্পীদের আঁকা মাতা মেরির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য এটা অস্বাভাবিক বা অসঙ্গত না। কারণ খ্রিস্টধর্মের আদর্শ ভিত্তি করে যখন বিষয়বস্তু চয়ন ও উপস্থাপন করা হয়েছে তখন মাতা মেরির প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক।
একটা বিষয় বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে যে, রেনেসাঁ যুগের খৃস্টান শিল্পীরা ফেরেস্তার প্রতীক হিসেবে ডানা সংযুক্ত শিশু উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু রাজ্জাক ডানাবিহীন পূর্ণবয়স্ক নর-নারী ফেরেস্তা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন । এখানে আমরা রেনেসাঁ যুগের একজন খ্রিস্টান শিল্পীর কল্পনা এবং বিংশ শতাব্দীর একজন শিল্পীর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য দেখতে পাই। তবে রেনেসাঁ যুগের খ্রিস্টীয় আদর্শ সম্বন্ধে রাজ্জাকের স্পষ্ট ধারণা আছে, তা বোঝা যায় ।
সাদা পোশাক পরিহিত ফেরেস্তা এবং আদেশকারী ফেরেস্তার পায়ের স্টকিং পরার মধ্যে মানবীয় ভাব এবং আদম-হাওয়ার নগ্নতা প্রকাশ পেয়েছে। ফলে আদম হাওয়ার মধ্যে মানবীয় কুলষতা ফুটে উঠেছে। হাওয়ার দেহভঙ্গির মধ্যে বটিসেলি’র আঁকা Appearance of Venus এবং আদমের মধ্যে পোলাগুলোর আঁকা আদম-এর সামান্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
জলজ মাধ্যমের পাশাপাশি ছাপচিত্রে রাজ্জাকের পারদর্শিতা উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে ড্রাই-পয়েন্ট । মাথা শীর্ষক মাত্র একটি প্রতিকৃতি এখানে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হলো । এটা একজন বালকের সুন্দর প্রতিকৃতি। তিনি সামান্য কয়েকটা আঁচড় দিয়ে বালকের শিশুসুলভ নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন । এ ছবিতে তিনি অতিরিক্ত আলো এবং যৎসামান্য ছায়া (Tone) ব্যবহার করেছেন। হালকা ছায়াংশ, ইংরেজিতে যাকে বলে Middle tone’, আলো ও আঁধারের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করেছেন।
১৯৫৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তার তেলরঙে আঁকা কিছু কাজের মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেল। ঐ সময়কার কাজের মধ্যে বাস্তবতার সাথে সাথে আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটে। ঐ সময়কার কাজের মধ্যে আইওয়ার নিসর্গ (Landscape in Aiwa) এবং অনুশীলন শীর্ষক মাত্র দু’টো ছবি এখানে আলোচনা করা হলো ।
প্রথম ছবিতে শরৎকালে কোনো এক রৌদ্রজ্জল দিনে আইওয়ার একটা নির্জন গ্রামের দৃশ্য চিত্রায়িত করা হয়েছে । দোচালা টিনের ছাদওয়ালা বাড়িগুলো একটার পরে একটা সারিসারি দাঁড়িয়ে আছে । যত দূর চোখ যায় একটার পর একটা টিনের চাল দেখা যায়। ঘন বসতিপূর্ণ একটা গ্রাম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ফিটফাট একটা বসতি । রাস্তার পাশে পুরনো যুগের একটা রাস্তার বাতি যুগের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ।
একেবারে সামনে অগ্রভূমিতে সারিসারি কতকগুলো গাছ । তার ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যমান আলোক উদ্ভাসিত গ্রাম পথচারীদের মন কেড়ে নেয় । মনে হয় যেন কোনো অজানা আগম্ভক হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য অপলক দৃষ্টিতে এই মনোরম দৃশ্য দেখছে। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টটা অত্যাধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য বহন করে, যা তাদের ঐতিহ্য প্রীতির পরিচয় দেয় ।
আড়াআড়িভাবে লম্বা ক্যানভাসে বিষয়বস্তুর উপস্থাপন করা হয়েছে। এটা একটা ‘Panoromic’ রচনা রচনাশৈলীর দিক থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে আঁকা ফ্রাডারিক এডউন চার্চের নায়াগ্রা এবং ১৯৫০ ও ১৯৫৭ সালে আঁকা যথাক্রমে জ্যাকসন পলোক ও বার্নেট নিউম্যানের Autuma Rhythem ও তীর হিরোইকাস সাবলিমিস-এর সাথে সামঞ্জস্য পাওয়া যায় । যাকে উইলমার্ডিং-এর ভাষায়: “A sense of panoromic scale and range, an awareness of plaintitude and over-expanding frontiers” বলা যায়।
ক্যানভাসের উপর ও নিচের অংশ অর্থাৎ গাছের পাতা ও ছায়াচ্ছন্ন মাটি গাঢ় রঙে আঁকা । তার মধ্যে আড়াআড়ি ভাবে আলোকোজ্জ্বল গ্রামটি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে শরতের স্বচ্ছ রোদে গ্রামটা ঝলমল করছে। হলুদ ও তামাটে রঙের পাতা শরতের বিদায় এবং শীতের আগমন ঘোষণা করছে। কিন্তু গ্রামটা একেবারে নীরব, নিস্তব্ধ, কোথাও জন প্রাণীর সাড়া নেই । নিঃসঙ্গ ও একাকিত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এটা স্বাভাবিক ।
কারণ তখন রাজ্জাক ছিলেন তরুণ। তাই সাগর পাড়ে ভিন দেশে নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব অনুভব করাই স্বাভাবিক।
অনুশীলন ছবিতে একজন মাতালের উপস্থাপন করা হয়েছে । একজন লোক চেয়ারে বসে, তার সামনে টেবিলের উপর রাখা মদের বোতল, একটা খালি অন্যটা অর্ধেক খালি। সে নেশায় চুর হয়ে আছে । তবু অর্ধশূন্য বোতলের দিকে তাকিয়ে ভাবছে আরো পান করবে কিনা । নেশার ফাঁকে শূন্য বোতলটা টেবিলের উপর পড়ে মৃদুভাবে এদিক- ওদিক গড়াচ্ছে । নেশায় তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে। কিন্তু সে হতাশাগ্রস্ত না, ছুটির দিনে চিত্ত-বিনোদনের জন্য সে মদ খাচ্ছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্য সমাজ জীবনের একটা দিক সুন্দরভাবে ফুটে উঠে।
রাজ্জাক ধীর-স্থির, গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তি বলে মনে হয় । কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে বা অন্তর্দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম বলে মনে হয় না। উভয় সংকটের ফলে তিনি বাস্তববাদ ও বিমূর্তবাদের মধ্যে দোদুল্যমান হয়ে রয়েছেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত হয়তো তিনিও জয়নুল আবেদিনের মতোই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, দেশজ শিল্পশৈলী দ্বারা শিল্পের অগ্রগতি ও উন্নতি সম্ভব না, শিল্পোত্তরণের জন্য পাশ্চাত্যের বিমূর্তবাদ ছাড়া আর কোনো গতি নেই । তাই সত্তর দশকের পর থেকে তিনি বিমূর্ত প্রকাশবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন ।
তার বিমূর্ত কাজগুলো পরীক্ষা করলে কি ফোর্ড স্টিল এবং মার্ক রথকোর মিশ্র প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এসব কাজ সাধারণ দর্শকদের জন্য বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কারণ তিনি কি বিমূর্ত ধারায় নিঃসর্গ উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন, নাকি পদার্থ বিজ্ঞান মোতাবেক রং নিয়ে পরীক্ষা করছেন, নাকি বুনোট সৃষ্টি করছেন, নাকি কেবল স্পন্দনশীল রং দিয়ে বিমূর্তকরণ করছেন? সোজা কথা হলো, স্পষ্টভাবে কিছুই বোঝা যায় না ।
এগুলো ঠিক রঙিন স্বপ্নিল জগৎও না আবার গতিময়তাও বলা যায় না । তবে দ্রুত তুলি চালনা থেকে মনে হয় যে, তুলির আঁচড় দ্বারা বিভিন্ন ধরনের বুনোট সৃষ্টি করা এবং স্পন্দনশীল রং দিয়ে কেবল মূর্তকরণই প্রধান উদ্দেশ্য। এ কথা বলা যায় যে, তুলির আঁচড় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে স্বার্থকতা সৃষ্টি হয়েছে ।
তার বিমূর্ত কাজগুলোর মধ্যে কেবল রচনা-৩য় (কম্পোজিশন-৩য়) শীর্ষক একটি কাজ এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। মনে হয় এ ছবিতে তিনি কোনো এক বর্ষা রাতে একটা গ্রামের দৃশ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন । ঘোর অন্ধকার বর্ষা রাতে ঘর-বাড়ি, গাছপালা সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, কিছুই দেখা যায় না। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, ঘন ঘন বিদ্যুত চমকাচ্ছে। বিজলীর আলোতে টিনের চাল, নালা- ডোবার পানি ক্ষণিকের জন্য ঝলসে উঠছে, আবার সব অন্ধকার ।
১৯৬৩ সাল থেকে তিনি ভিন্ন দিকে মোড় ঘুরলেন। এবার ভাস্কর্য জগতে প্রবেশ করলেন । তবে চিত্রকলা বাদ দিলেন না। বলা যায়, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য পাশাপাশি চললো। কিন্তু দু’নৌকায় পা দিলে যে অবস্থা, না এদিক না ওদিক, মাঝখানে টলমল অবস্থা। অবশ্য ভাস্কর্যেই তার দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেও বাস্তব ও বিমূর্তের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়।
বাস্তবধর্মী কাজে যদিও তিনি দক্ষতার প্রমাণ রেখেছিলেন তবুও বিমূর্তার গোলক ধাঁধা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না। তৎকালীন পূর্ব- পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন । শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি নিজেও কিছু ভাস্কর্য করেন। তার বাস্তবধর্মী ও বিমূর্ত কিছু ভাস্কর্য যথাক্রমে চুল আঁচড়ানো, মুক্তিযোদ্ধা, ফরম ইন উড, সিমেন্ট উড এন্ড ওয়েলডেড মেটাল প্রভৃতি মাত্র কয়েকটা উল্লেখ করা হলো।
বিমূর্ত কাজগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, আপন সংজ্ঞার বিরুদ্ধে জোর করে করছেন। কি করছেন? কেন করছেন? সে বিষয়ে অস্পষ্টতা ও অসচেতনতা স্পষ্ট ধরা পড়ে ।
চুল আঁচড়ানো ভাস্কর্যে একজন মহিলা মেঝের উপর বসে আপন মনে চুল আঁচড়াচ্ছে । আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রতিদিন প্রতি বাড়িতে বিকালে এ দৃশ্য আমাদের কাছে অতি পরিচিত।
নারী মূর্তিটার উপরিভাগ কোথাও মসৃণ কোথাও এ্যাবড়ো-থেবড়ো বুনোট সৃষ্টি করা হয়েছে । পতিত আলো কোথাও ছায়াংশের সাথে মিশে গেছে, কোথাও বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে । মুখাবয়ব অপরিকল্পিতভাবে এ্যাবড়ো-থেবড়ো করার ফলে এমনভাবে আলো- ছায়া সৃষ্টি হয়েছে যে, প্রসাধন করার সময় মেয়েদের মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি ও আনন্দ ভাব থাকে তার পরিবর্তে বিরক্তি ভাব ফুটে উঠেছে ।
আকার গঠন ও বুনোট থেকে বোঝা যায়, তিনি ফরাসি ভাস্কর রেদো’র অনুকরণ বা অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন । কিন্তু রেদো এমনভাবে এ্যাবড়ো-থেবড়ো বুনোট সৃষ্টি করেছেন যে, বিশেষ এক নির্দিষ্ট কোণ থেকে আলো পড়লে ছায়াংশে ও গাঢ় ছায়াংশে আলো প্রতিফলিত হয়ে অপূর্ব নাটক সৃষ্টি করে । কিন্তু রাজ্জাক এমনভাবে এ্যাবড়ো-থেবড়ো বুনোট সৃষ্টি করেছেন যে, মনে হয় মূর্তিটা ভেঙে গেছে, আয়তন, ঘনত্ব, গভীরতা অনুভূত হয় না।
কি করছেন, কেন করছেন, কোনদিক থেকে আলো পড়লে কি ফলাফল পাওয়া যাবে সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণার অভাবের জন্য কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়নি । আকার ভঙ্গুর এবং বিকৃতকরণ ও বুনোট থেকে বোঝা যায়, তিনি কিছুটা জোর করে প্রতিনিধিত্বশীলতার ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টা করেছেন ।
মুক্তিযোদ্ধা একটি ভালো ভাস্কর্য হিসেবে ধরা যায়। আমাদের দেশে মার্বেল পাথর দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য । তাই আমাদের দেশের আবহাওয়া বিচার করে তিনি সিমেন্ট মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সরল ও স্পষ্ট আকার গঠন দ্বারা তার আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে। সামন্তস্যপূর্ণ আকার ও মসৃণ বুনোট সৃষ্টির ফলে আলো ক্রমশ ছায়াংশের সাথে মিশে ‘Soft tone’ সৃষ্টি করেছে।
বিষয়বস্তু হিসেবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা এক হাতে রাইফেল ও অন্য হাতে গ্রেনেড নিয়ে পাক-শত্রুসেনাদের আক্রমণের অপেক্ষায় নির্ভীকচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গির মধ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও দারুণ আক্রোশ ফুটে উঠেছে। মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সে তার রক্তের শেষ বিন্দু পর্যন্ত শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । দেশকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে যে কোনো বিরোধিতা, বাঁধা-বিপত্তির মোকাবিলা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মাতৃভূমির আসন্ন স্বাধীনতার আশা তার মধ্যে অদুর্দমনীয় সাহস সঞ্চার করেছে।
মূর্তিটা পেডেস্টালসহ মোট ৪০ ফুট উচ্চ উচ্চতার দিক থেকে এটা পৃথিবীর একটা অন্যতম উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হিসেবে গণ্য করা যায়, যা প্রাচীন মিশরের গুন্ড কিংডম ও নিউ কিংডম-এর সময়কার ভাস্কর্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কিন্তু তার বিমূর্ত ভাস্কর্যগুলো হতাশাব্যঞ্জক। তিনি কি করতে চান, কেন করছেন সে বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। ভাসাভাসাভাবে কেবলমাত্র পাশ্চাত্যের কয়েকজন ভাস্করের কাজ অনুকরণের চেষ্টা করেছেন। যেমন, Form in Wood ও রচনা মাত্র দু’টি এখানে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হলো।
তার কাজগুলো পরীক্ষা করলে মনে হয় যে, তিনি কখনো মদিগ্লানি এবং কখনো হেনরি মুরের অনুকরণের চেষ্টা করেছেন । কিন্তু মদিগ্লানির ভাস্কর্যগুলো তার চিত্রকলার সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ। রাজ্জাকের বাস্তবধর্মী ও বিমূর্ত ভাস্কর্যের মধ্যে গরমিল রয়েছে। চিত্রকলার সাথে তো মিলের প্রশ্নই ওঠে না। এগুলো একই শিল্পীর কাজ বলে আদৌ মনে হয় না। এমন কি একই শিল্পীর বিভিন্ন স্তরের কাজ বলেও মনে হয় না।
ইতালি এবং গ্রেট ব্রিটেন উভয়ই পাহাড়ি অঞ্চল । দৃষ্টি বাঁধা পেয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ধীরে ধীরে উঠতে উঠতে একেবারে মাথার উপরে আকাশে অর্থাৎ মহাশূন্যে বিলীন। হয়ে যায় । এই ঊর্ধ্বমুখীতাই মদিগ্লানির কাজের বৈশিষ্ট্য বলা যায় । একইভাবে হেনরি মুরের (বিশেষ করে চল্লিশ দশকের শেষের দিকের) কাজের মধ্যে প্রকৃতি সচেতনতা দেখা যায় । এ্যাবড়ো-থেবড়ো পাহাড়ের গা ।
উঁচু-নিচু প্রস্তর খণ্ডের মধ্যে ছোট বড় খাদ । পাহাড় গাত্রের কোথাও বা গুহা রয়েছে, আবার কোথাও সুড়ঙ্গ রয়েছে। দৃষ্টি কোথাও অন্ধকার গুহার মধ্যে হারিয়ে যায়। আবার কোথাও সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে ভেদ করে এপাশ থেকে ওপাশ দৃষ্টি চলে যায়। আলোচিত উভয় শিল্পীর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, প্রকৃতি তাদের কাজের উৎস হিসেবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ পাহাড়ি অঞ্চল না ।
তাহলে রাজ্জাকের কাজের উৎস ও অনুপ্রেরণা কোথায়? তার ‘Welded Metal’-এর তৈরি রচনা শীর্ষক ভাস্কর্যের মধ্যে ঘোড়ার লেজের মতো একটা আকৃতি হঠাৎ উপরের দিকে উঠে গেছে। তার কী দরকার ছিল? আর এটার অর্থই বা কী?
যাহোক, মোট কথা হলো, রাজ্জাক যদি অন্তর্দ্বন্দ্ব ও চিরন্তন বৈষম্য অর্থাৎ দোদুল্যমান ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন তা হলে আশা করা যায়, তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন। তার কাজগুলো পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, মুর্তজা বশীরের মতো তার কাজের মধ্যে তার ব্যক্তিগত জীবনবোধ প্রতিফলিত হয়।
আরও দেখুনঃ