আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় কাঠের তৈরি শিল্পকর্ম
কাঠের তৈরি শিল্পকর্ম
কাঠের তৈরি শিল্পকর্ম
প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে কাঠ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি হয়ে আসছে। পোড়ামাটির ফলকচিত্রের মাধ্যমে আমরা যেমন আমাদের প্রাচীন শিল্পকর্মের নিদর্শন পাই, ঠিক তেমনি পাই কাঠের মূর্তি, কারুকার্যখচিত স্তম্ভ, থাম, তোরণ, দরজা, আসবাবপত্র ও অন্যান্য ব্যবহারিক জিনিসে। আমাদের জাতীয় জাদুঘর ও অন্যান্য স্থানীয় ঐতিহাসিক জাদুঘরে এরকম অনেক নিদর্শন আছে।
যে-কোনো মেলায় গেলেই আমরা কাঠের তৈরি হরেক রকমের পুতুল, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি নানা প্রকার খেলনা দেখতে পাই। এক সময় আমরাও হয়তো এরকম কিছু কাঠের তৈরি খেলনা, যেগুলো দিয়ে খেলা করতে খুবই মজা পাই। যদি নিজের হাতে কাঠ দিয়ে এমনি একটি পুতুল, খেলনা কিংবা অন্য কোনো সুন্দর জিনিস তৈরি করতে পারি তাহলে খুব আনন্দ হবে। এবার কাঠ, বাঁশ দিয়ে পেনসিল বক্স ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস তৈরি করার পদ্ধতি জেনে নিই।
প্রাথমিক পর্যায়ে কাঠের পুতুল, পশুপাখি ইত্যাদি তৈরি করার জন্য খুব নরম কাঠই সবচেয়ে উপযোগী। নরম কাঠ সহজেই নিজের ইচ্ছেমতো কাটতে পারব। আমাদের দেশে সহজে ও কম দামে যেসব কাঠ পাওয়া যায় তার মধ্যে শিমুল ও কদম কাঠই সবচেয়ে নরম ও সুলভ। তাই পুতুলের জন্য শিমুল কিংবা কদম কাঠ জোগাড় করি। কিছু-কিছু কাজের জন্য ‘প্লাই-উড’ (Ply- Wood) ব্যবহার করতে হবে। ‘প্লাই-উড’ হলো পাতলা পাতলা কাঠ একটির ওপর আরেকটি বসিয়ে জোড়া দিয়ে তৈরি করা তক্তা।
উপকরণ
কাঠের জিনিস তৈরি করার কিছু হাতিয়ার
কাঠের শিল্পকর্মের জন্য কাঠই যে প্রধান উপকরণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার যেসব কাজ করব তার জন্য শিমুল ও কদম কাঠ কিংবা এরকম নরম কোনো কাঠ, ‘প্লাই-উড’ পেলিগাম কিংবা আইকা আঠা, শিরীষ কাগজ, ভাঙা কাচের টুকরো, চাইনিজ লেকার কিংবা এনামেল রং ইত্যাদি। হাতুড়ি, বিভিন্ন ধরনের বাটালি, ধারালো শক্ত ছুরি, হাত করা, লোহা কাটার করাত ‘হ্যাক- স্য’ (Hack saw) ফ্রেট-স্য (Frat Saw) স্কেল, তুলি ইত্যাদি। ‘ফ্রেট-স্য’ হলো পাতলা কাঠে নকশা নির্মাণের জন্য ফ্রেমে আঁটা অতি সরু করাত বিশেষ
কাঠের পুতুল
কাঠ দিয়ে প্রথমে খুব সহজ একটা পুতুল তৈরি করি। ঝুড়ি মাথায় একটি নারী। এই পুতুলের জন্য ৩ সেমি পুরু, ৩ সেমি. চওড়া ও ১৫ সেমি. লম্বা এক টুকরো নরম কাঠ নিই। কদম কিংবা শিমুল কাঠ এরকম কাজে খুব উপযোগী। ধারালো বাটালি দিয়ে ঠেলে ঠেলে প্রথমে কাঠের শির চারটি মেরে দিই। এবার খুব সাবধানে আস্তে আস্তে কেটে যাই, যতক্ষণ না কাঠের টুকরোটি সরু রুলারের মতো আগাগোড়া সমানভাবে গোল হয়ে যায়।
গোল করে কাটার পর কাঠের টুকরোটির ব্যাস হলো মোটামুটি ৩ সেমি. আর লম্বা রইল ১৫ সেমি.। স্কেল দিয়ে প্রথমে ঠিক সাড়ে সাত সেন্টিমিটার মেপে কাঠের চারপাশ ঘুরিয়ে দাগ দিই। দাগের ওপরে নিচে দুপাশেই সাড়ে সাত সেন্টিমিটার করে কাঠটি দুভাগ হয়ে গেল। এবার মাঝের দাগ থেকে ওপরের দিকে প্রথমে সাড়ে তিন সেন্টিমিটার তারপর আর আড়াই সেন্টিমিটার মেপে চারদিক ঘুরিয়ে দাগ দিই।
দেখি, পেনসিলের দাগ দিয়ে কাঠটি মোট চারভাগে ভাগ হয়ে গেল। প্রথম ভাগে দেড় সেন্টিমিটার এবং চতুর্থ ভাগে সাড়ে সাত সেন্টিমিটার। লোহা কাটার করাত বা ‘হ্যাক-স্য’ দিয়ে পেনসিলের সব কয়টি দাগ বরাবর কাঠের চারদিকে ঘুরিয়ে সামান্য গভীর করে কাটি। কাটার গভীরতা যেন চারদিকেই সমান হয়। ছবিটি ভালো করে লক্ষ করি এবং ছবিতে প্রদর্শিত নিদর্শন অনুযায়ী ধারালো বাটালি দিয়ে ঠেলে কাঠের চারদিক ঘুরিয়ে খাঁজ কাটি।
খাঁজ কাটার জন্য প্রয়োজন হলে ধারালো ছুরিরও ব্যবহার করতে পারি। সব কয়টি খাঁজ কাটা হয়ে গেলে মোটামুটিভাবে একটি পুতুলের আদল এসে গেছে। ঝুড়ি মাথায় কোনো নারীর মতো। শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে পুতুলটিকে মসৃণ করি। মসৃণ করার পর ঝেড়ে মুছে পুতুলটিকে পরিষ্কার করে নিই যাতে এর গায়ে কাঠের কোনো কণা বা ধুলা লেগে না থাকে। ছুতোর মিস্ত্রির কুঁদন যন্ত্র (Turning implement) ব্যবহার করে এরকম একটি পুতুল পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যেই তৈরি করা যায়। ভবিষ্যতে কোনোদিন এই যন্ত্রের ব্যবহার শিখতে পারলে খুব সহজে অল্প সময়ে এরকম অনেক কিছু তৈরি করতে পারব।
কাঠখণ্ড থেকে ধীরে ধীরে পুতুলের রূপ দেয়া হয়েছে
এবার পুতুলটি রং করার পালা। কী কী রং লাগাব পুতুলের গায়ে? পুতুলের মুখে ও শরীরে হালকা হলুদ রং, শাড়ির জন্য লাল রং, শাড়িতে সাদা রঙের নকশা আর কালো ও সাদা রং মিলিয়ে পাড়। তারপর কালো রং দিয়ে চুল, নাক ও চোখ, লাল রং দিয়ে ঠোঁট আর বাদামি রঙের ঝুড়ি। পরে আরও কিছু পুতুল তৈরি করে আমাদের পছন্দমতো বিভিন্ন রং লাগাতে পারব। সবুজ শাড়ি, নীল শাড়ি, বেগুনি শাড়ি কতরকম রং লাগানো যাবে।
অন্য কোনো রং লাগাবার আগে পুতুলের সারা শরীরে হালকা হলুদ রং লাগিয়ে ভালো করে শুকিয়ে নেবার পর শাড়ি, চুল ও চোখ-মুখের রং দেব। রং করার জন্য মোটা ও সরু দুরকমের তুলি ব্যবহার করব। মোটা তুলি দিয়ে ঝুড়ি, চুল, মুখ, শরীর ও শাড়িতে রং লাগানোর পর সরু তুলি দিয়ে নাক, চোখ, ঠোঁট, শাড়ির পাড় ও নকশা আর ঝুড়ির বুনন আঁকব।
সরু তুলি দিয়ে সব কাজ করতে গেলে রং সমানভাবে লাগবে না । কৌটার চাইনিজ লেকার বা এনামেল রং বেশি ঘন হলে সামান্য তারপিন মিশিয়ে একটু পাতলা করে নেব কিন্তু বেশি পাতলা করব না। রং করা শেষ হলে দেখব সুন্দর একটা পুতুল তৈরি হয়েছে।
কাঠের ঘোড়া
পুতুল ও পাখির মতো খুব সহজেই একটি ঘোড়া তৈরির চেষ্টা করি। ঘোড়ার জন্য ২ সেমি. পুরু, ১০ সেমি. চওড়া ও ১৬ সেমি. লম্বা এক টুকরো নরম কাঠ নিই। কাঠের দুপিঠ ঘষে মসৃণ করি। কাঠের সমান মাপের কাগজের ওপর ছবি দেখে অনুরূপ একটি ঘোড়ার ছবি আঁকি। কার্বন কাগজ দিয়ে কাঠের ওপর ঘোড়ার ছবির ছাপ তুলি। ছাপের রেখা বরাবর ‘ফ্রেট-স্য’ দিয়ে কেটে ঘোড়াটি আলাদা করে ফেলি।
কাঠের ঘোড়া তৈরি
ছবিতে ঘোড়ার নির্মাণ- কৌশলের পর্যায়গুলো ক্রমানুসারে দেখানো হয়েছে। ক্রমান্বয়ে এক – একটি পর্যায়ের ছবি মন দিয়ে দেখি এবং তা অনুসরণ করে প্রয়োজনমতো সোজা ও বাঁকা মুখের বাটালি দিয়ে ঠেলে ঠেলে একটু একটু করে কেটে কিছুটা গোলাকৃতি করি। তারপর ঘোড়ার কেশরের অংশটি দুপিঠ থেকে কেটে কেটে পাতলা করে আধা সেন্টিমিটারের কাছাকাছি নিয়ে আসি। কান দুটি বাদ দিয়ে কেশর পাতলা করব।
লেজের অংশটি কেটে পাতলা করে এক সেন্টিমিটারে করব। মাথার কপালের দিকটা পুৰ্ব থাকবে কিন্তু মুখের দিকটা কিছু পাতলা হয়ে যাবে। মুখের নিচে গলার দিকটা মুখের থেকে সামান্য পাতলা ও কিছুটা গোলাকৃতি করি । সামনের দুটি পা বোঝাবার জন্য পারের অংশের দুপিঠে সামান্য খাজ কেটে দিই। পেছনের পা দুটির জন্যও তা-ই করি। কান দুটির মাঝখানটা কেশরের সীমারেখা পর্যন্ত সামান্য কেটে আলাদা করে দিই।
যখনই যেখানে কাৰ্টৰ দুপিঠ থেকে সমানভাবে কাটব, তাহলে ঘোড়া যে পাশ থেকেই দেখি না কেন দুপাশ সমান দেখব। ১ সেমি, গুরু, ৫ সেমি. চওড়া ও ১১ সেমি. লম্বা এক টুকরো কাঠের ওপর চারপাশে সমান ছেড়ে ঘোড়াটিকে দাঁড় করিয়ে নিচ দিক থেকে সামনের ও পেছনের পা বরাবার সন্তু তারকাটা মেরে আটকিয়ে দিই। এখন ঘোড়াটিকে যেখানেই রাখি না কেন সামান্য নড়াচড়াতেও পড়ে যাবে না।
শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে ঘোড়াটিকে মসৃপ করে চাইনিজ লেকার কিংবা এনামেল রং দিয়ে আমার পছন্দমতো রং করে নিই।
কাঠের নকশী
কাঠ কেটে তৈরিকৃত নকশা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যায়। একবার নকশা কাটার কৌশলটা আয়ত্ত করতে পারলে তা প্রয়োগ করে হরেক রকম জিনিস তৈরি করতে পারব। নকশা কেটে যেমন ঘরের সাজসজ্জার জিনিস তৈরি করতে পারব তেমনি আসবাবপত্র, দরজার প্যানেল ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের শোভাবর্ধনের কাজেও ব্যবহার করতে পারব।
কাঠ কেটে নকশা তৈরি
কাঠ কেটে নকশা তৈরি করার আগে নকশাটি কাগজে এঁকে নিতে হবে। যত বড় নকশা তৈরি করতে চাই ঠিক তত বড় করে পছন্দমতো একটি নকশা আঁকি। প্রথম প্রথম একটু মোটা ধরনের নকশা দিয়ে কাজ আরম্ভ করি। কাজের কৌশল আরম্ভ করার পর ক্রমে ক্রমে অনেক সূক্ষ্ম নকশাও তৈরি করতে পারব। নকশার ভেতরের ও বাইরের অপ্রয়োজনীয় কাঠ কেটে ফেলে দিয়ে নকশা তৈরি করতে হবে।
অসাবধানতাবশত যাতে নকশার কাঠ কাটা না পড়ে তার জন্য নকশার ভেতরের অপ্রয়োজনীয় এলাকা পেনসিল বা বলপেনের রেখা দিয়ে ভর্তি করে দিলে অপ্রয়োজনীয় অংশ সহজে চোখে পড়বে, ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না ।
নকশা কাটার জন্য তিন বা চার পরত -এর ভালো প্লাইউড অথবা মোটামুটিভাবে আধা সেন্টিমিটার পুরু ভালো নরম কাঠ নিই। শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে কাঠের দুপিঠ সামান্য মসৃণ করি। কার্বন কাগজ বসিয়ে কাঠের ওপর কাগজে আঁকা নকশার ছাপ তুলি। বলপেনের রেখা দিয়ে ভর্তি করে নকশার ভেতরের অপ্রয়োজনীয় এলাকা চিহ্নিত করি। সরু তুরপুন দিয়ে অপ্রয়োজনীয় এলাকার প্রত্যেকটিতে এর সীমারেখার খুব কাছাকাছি জায়গায় ‘ফ্রেট-স্য’ ঢোকাবার জন্য একটি করে ছিদ্র করে নিই।
আয়োজন সবই শেষ হলো। এবার নকশা কাটার পালা । শিল্পকলা শিক্ষকদের কাছ থেকে ‘ফ্রেট-স্য’ ব্যবহার করার নিয়ম ভালো করে জেনে নেব। ‘ফ্রেট-স্য’ খুব পাতলা কাঠে নকশা নির্মাণের জন্য ফ্রেমে আঁটা অতি সরু করাত বিশেষ। ফ্রেমে আঁটা করাতটি ফ্রেম থেকে খোলা যায়, আবার ফ্রেমে আটকানো যায়, খুব টান করা যায়, একটু ঢিলেও করা যায় । দুপাশে কান লাগানো নাট ঘুরিয়ে এসব করা যায়। এবার নকশা কাটতে চেষ্টা করি।
করাতের সামনের মাথা ফ্রেম থেকে আলগা করে কাঠের অপ্রয়োজনীয় এলাকার একটি ছিদ্রের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে মাথাটি আবার ফ্রেমে আটকিয়ে নিই। নাট ঘুরিয়ে করাতটি যথাসম্ভব টান করে নিই। মাত্রাতিরিক্ত টান করতে গেলে করাত ছিঁড়ে যেতে পারে, আবার ঢিলে থাকলে কাঠ কাটার সময় ভেঙে যেতে পারে। তাই খুব সাবধানে কাজ করব। এবার অপ্রয়োজনীয় এলাকার সীমারেখা বরাবর ‘ফ্রেট-স্য’ চালিয়ে অপ্রয়োজনীয় অংশটি কেটে আলাদা করে ফেলি।
একটি অংশ কাটা শেষ হলে করাতের মাথা ফ্রেম থেকে আলগা করে করাতটি বের করে আনি এবং আরেকটি অপ্রয়োজনীয় অংশের ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়ে আটকিয়ে নিই। এভাবে প্রত্যেকটি অপ্রয়োজনীয় অংশ কাটার পর নকশার বাইরের সীমারেখা বরাবর ‘ফ্রেট-স্য’ চালিয়ে পুরু নকশাটি কেটে বের করে ফেলি। নকশা তৈরি হলো । এবার শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে অমসৃণ জায়গাগুলো ও একটি পিঠ ভালোভাবে মসৃণ করে নিই ।
কাঠের রং বাজায় রেখে স্বচ্ছ বার্নিশের প্রলেপ দিয়ে নিই। নকশাটি গৃহ সজ্জার কাজে বা আসবাবপত্রের শোভাবর্ধনের জন্য ব্যবহার করা যাবে।
আরও দেখুন :