শিল্পী কামরুল হাসান

আজকে আমরা শিল্পী কামরুল হাসান সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী গ্রন্থের অন্তর্গত।

 

বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী সূচিপত্র

 

শিল্পী কামরুল হাসান

ঈর্ষাপরায়ণতা সর্বকালে পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে নিন্দিত । মানুষের মধ্যে যে ষড়রিপু অবিরাম কাজ করছে, ঈর্ষা তার অন্তর্ভুক্ত। ঈর্ষাপরায়ণতার বিরুদ্ধে পৃথিবীর সকল ধর্মেই উপদেশ আছে। কারণ ঈর্ষাপরায়ণতা মানুষের মানবিক গুণাবলী আংশিকভাবে খর্ব করে এবং মানুষের অমঙ্গল করে। তৎসত্ত্বেও এটার একটা বিপরীত নিকও আছে।

বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে ঈর্ষাপরায়ণতা অনেক সময় নেতিবাচকভাবে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অনুপ্রেরণা জোগায়, অমৃতের কাজ করে। এটা হলো ব্যতিক্রমধর্মী ক্রিয়া। যেসব ব্যক্তির মধ্যে এই ব্যতিক্রমধর্মী ক্রিয়া দেখা যায়, তারা নব নব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অম্লান ও অমূল্য অবদান রেখে যান। কামরুল হাসান তেমন একজন ব্যক্তিক্রম ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, জয়নুল আবেদিনের প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা ও গগনচুম্বি খ্যাতি কামরুলের মধ্যে যে ঈর্ষার উদ্রেক করে তাই তার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য দেয়। আর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাই তার মধ্যে অমৃতের কাজ করে, যা তার সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মধ্যে ক্রমে ক্রমে বিকশিত হতে থাকে ।

তৎকালীন বাংলাদেশের মতো একটা মধ্যবিত্ত অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও শিল্পবিহীন সমাজে শিল্প চেতনা ও শিল্পবোধ গড়ে তোলার জন্য জয়নুলের নাম যেমন অমর অক্ষয় হয়ে থাকবে তেমনি এই শিল্প আন্দোলন গড়ে তোলায় কামরুল হাসানের অমূল্য অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বপ্রথম শিল্প আন্দোলন গড়ে তোলার পেছনে যে কয়জন শিল্পীর অবদান আছে তাদের মধ্যে কামরুল হাসান অন্যতম ।

শিল্পী হিসেবে কামরুলের সঠিক স্থান নির্ণয় করতে হলে নিরপেক্ষভাবে তার শিল্পকর্মের দোষ-গুণ বিচার করে মূল্যায়ন করতে হবে। তা না হলে তার সঠিক মর্যাদা দেয়া সম্ভব হবে না । এ কথা সত্য যে, সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করা এবং শৈল্পিক উৎকর্ষ ও দক্ষতা অর্জন করা দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। প্রচারণার মাধ্যমে সাময়িকভাবে সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। তবে এটাও সত্য যে, শৈল্পিক উৎকর্ষ ও দক্ষতা অর্জনের সাথে সাথে সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায়।

কামরুল হাসানের সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তার কারণ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তার বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠনমূলক কাজ এবং রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠিয়ে দিয়েছিল। তার কর্মজীবনের শুরুতে অর্থাৎ চল্লিশ দশকের শেষ এবং পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে তিনি কিশোর-কিশোরীদের সমন্বয়ে ‘মুকুল ফৌজ’ নামে একটা সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন।

পরবর্তীতে তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন । ষাট দশকের মধ্যভাগ থেকে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফার সমর্থনে আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মঠ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গণ্য হতে থাকেন । কারণ তিনি ভারতের বঙ্গ প্রদেশের কোলকাতা মহানগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই লালিত পালিত হয়ে ওঠেন ।

ভারত বিভক্তির প্রায় এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলার ঢাকা মহানগরীতে স্থানান্তরিত হয়ে আসেন । একজন পেশাদার শিল্পী হিসেবে তাকে খাটো করে দেখা যায় না বা তার অবদান অস্বীকার করা যায় না ।

কামরুলের কাজগুলো মনোনিবেশ সহকারে পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি আকস্মিকভাবে রাতারাতি এমন উৎকর্য ও দক্ষতা অর্জন করেননি যা শিল্পরসিকদের চমৎকৃত করেছে। বরঞ্চ ধীরে ধীরে তার শৈল্পিক মেধা ও উৎকর্ষ বিকশিত হয়েছে।

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

শিল্পরসিক ও জনসাধারণের মনে জয়নুল আবেদিনও কামরুল হাসানের স্থান নির্ণয় সম্বন্ধে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন জেগে ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে, কে কার থেকে বড়? কে কত মহান? এমন প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক কিছু নয় । কিন্তু সকলের একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, লাল ও সবুজ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন রং। একটার সাথে অন্যটার তুলনা করা চলে না । লালকে লাল এবং সবুজকে সবুজ হিসেবে যদি দেখি তাহলেই আনন্দ পাই ।

কিন্তু যখনই তুলনা করি তখন শুধু যে নিজেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হই তা নয়, অবমূল্যায়নও করা হয়, ঠিক তেমন কামরুলকে যদি জয়নুল বা অন্য কোনো শিল্পীর সাথে তুলনা করি তাহলে শুধু যে নিজেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হই তা নয়, বিভ্রান্তিও সৃষ্টি হয় । তাই এটা বলা যথেষ্ট যে, প্রত্যেক শিল্পী আপন আপন বৈশিষ্ট্যে মহীয়ান।

জয়নুল আবেদিন ছিলেন মানবতাবাদী, মানবপ্রেমিক। আর কামরুল ছিলেন প্রকৃতিবাদী, সৌন্দর্যের উপাসক, প্রকৃতিপ্রেমিক। জসীমউদ্দীন যেমন পল্লীকবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কামরুলকে তেমনী পল্লীশিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না। বাংলাদেশের পল্লী ও প্রকৃতি কামরুলের মন ও অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কামরুল সারা জীবন ধরে প্রকৃতির রূপ, রস, বর্ণ ও গন্ধের অনুসন্ধান ও উপাসনা করেছেন। প্রকৃতির সৌন্দর্যের ভূতি গান গেয়েছেন। হয়তো প্রকৃতি প্রেমের কারণেই তিনি বাংলাদেশের গ্রামকে ভালোবেসেছেন।

কলস কাঁখে গাঁয়ের বধূ নিরতা পল্লী তন্বী তরুণী, তরঙ্গায়িত ধান ক্ষেতের উপর ভাসমান চিত্র-বিচিত্র মেঘমালা, প্রশান্ত আকাশের নিচে সুবিস্তৃত শ্যামল ভূমির মধ্য দিয়ে আঁকা-বাঁকা অসংখ্য নদ-নদী, পাল তোলা নৌকা, বৃক্ষ- লতা, অবহেলিত জংলি ফুল, পশুপক্ষী ঘুরে ফিরে তার কাজের মধ্যে বারবার আবির্ভূত হয়েছে, যা তার শিল্পকর্মের মধ্যে পল্লী সঙ্গীতের ব্যাঞ্জনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে ।

কামরুলের সমস্ত কাজের মধ্যে মোট দু’টি বিষয়ের প্রাধান্য দেখা যায়; একটি হলো নারী সৌন্দর্য আর অন্যটি হলো, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তবে তার নারী প্রতিকৃতি ও প্রতিমূর্তির মধ্যে বিশেষ কোনো রমণীর ছায়া বা প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় না । অর্থাৎ বিশেষ কোনো নারীর রূপ তার শিল্পকর্মের মধ্যে স্থান পায়নি। তার শিল্পকর্মের মধ্যে সার্বিকভাবে নারী সৌন্দর্য প্রাধান্য পেয়েছে। কোনো ব্যক্তি নয়।

নারী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপস্থাপনার মধ্যে তার কাব্যিক ও রোমান্টিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। বস্তুত তিনি নারী ও প্রকৃতিকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন ও সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন । তার নারী প্রতিমূর্তিগুলো স্বশরীরী মানবী ছিল না, সেগুলো লালসা ও কামনা মুক্ত শুধু কবির কল্পনামাত্র। অনুরূপভাবে তার কাছে প্রকৃতি কোনো জড়বস্তু বা পদার্থ ছিল না, প্রকৃতি ছিল সজীব, তার কল্পনার জগৎ, যে জগতে তিনি প্রফুল্লচিত্তে একাকী বিচরণ করতেন । এদিক থেকে বিচার করলে তাকে একজন আদর্শবাদী রোমান্টিক শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

কামরুল হাসান কোলকাতা মহানগরীর পরিবেশে লালিত-পালিত হয়ে ওঠেন। হয়তো আধুনিক সভ্যতায় মহানগরের কৃত্রিমতা ও পরিবেশ তার অবচেতন মনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তারই ফলস্বরূপ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশের অকলুষিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার তরুণ মনে গভীর রেখাপাত করে । যে জন্য তার মনে প্রকৃতি প্রেম অঙ্কুরিত হয়, যা পরবর্তী জীবনে পরিপূর্ণভাবে পুষ্পায়িত হয়ে উঠে ।

উন্মুক্ত প্রশান্ত আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ শ্যামল ভূমি, নির্জন বনানী, দোয়ালিত শস্যক্ষেত, চিত্র-বিচিত্র মেঘমালা, বৈচিত্র্যময় সবুজের সমারোহ, গাঁও-গ্রামের সহজ- সরল অনাড়ম্বর জীবন, স্রোতস্বিনী নদীর কুল কুল শব্দের ছন্দময় ধ্বনি যে সঙ্গীত সৃষ্টি করে, এসব কিছু একত্রে মিলিতভাবে তাকে যেমন মুগ্ধ করেছিল তেমন অনুপ্রেরণাও জুগিয়েছিল, যা তার কাজের মধ্যে সঞ্জীবনী সৃষ্টি করেছে ।

পল্লী ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার দিক থেকে বিচার করলে তাকে কি জসীমউদ্দীন, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ এবং রুশ শিল্পী রাসকিনের সাথে তুলনা করলে হয়তো ভুল হবে না । প্রকৃতি প্রেমের জন্য স্বাভাবিকভাবে পশু-পক্ষীর প্রতি তার অনুরাগ দেখা যায় ৷ হয়তো গ্রামকে ভালোবাসার জন্যই তার মধ্যে লোকশিল্পের প্রতি অনুরাগ জন্মে।

প্রকৃতি অনুরাগী হিসেবে তার ও এস এম সুলতানের মধ্যে ঐক্যতান পাওয়া যায়। সুলতানের নিসর্গ ও পল্লী পরিবেশের হুবহু বাস্তব প্রতিচিত্রণ প্রবণতা প্রামাণ্যধর্মী। কিন্তু কামরুলের কাজের মধ্যে কেবল তার কল্পনাপ্রসূত প্রকৃতির রূপকল্প (Image)-এর উপস্থাপনা দেখা যায় । সুলতানের মধ্যে প্রতিটি বস্তু দুটিয়ে খুটিয়ে দেখা ও অনুপুঙ্গ বর্ণনার প্রাধান্য অধিক সেখানে কামরুলের কাছে প্রকৃতির সামগ্রিক রূপকল্প প্রাধান্য পেয়েছে ৷ বস্তুর স্বতন্ত্র অবস্থান হ্রাস পেয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।

জয়নুল আবেদিন ও কামরুলের মধ্যে মতবাদ, আঙ্গিক ও চরিত্র বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে যদিও অনেক পার্থক্য ও বৈষম্য দেখা যায় তথাপি দু’টি বিষয়ে উভয়ের ম ঐক্যতান খুঁজে পাওয়া যায়। একটি হলো, লোকশিল্পের প্রতি অনুরাগ ও স্বদেশ প্রেম এবং অন্যটি হলো “জীবনের জন্য শিল্প’ এই শিল্প দর্শনে বিশ্বাস। যে জন্য উভয়ের মতো ও পথ ভিন্ন হলেও লক্ষ্য ছিল অভিন্ন।

উভয়েই সচেতনভাবে লোক-আঙ্গিক ও পাশ্চাত্যের বিমূর্ত আঙ্গিকের মধ্যে সংযোজন করে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র মৌলিক ও জাতীয় আঙ্গিক উদ্ভাবনের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। অবশ্য যদিও তারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি অর্থাৎ বিশেষ কোনো শিল্পদর্শন ও জাতীয় আঙ্গিক উদ্ভাবন ও প্রতিষ্ঠা করতে সফল হননি তবুও তাদের কাজের মধ্যে এদেশের মানুষ ও মাটির গন্ধ পাওয়া। যায়।

পঞ্চাশ দশকের প্রায় মধ্যভাগ থেকে কামরুল একদিকে এদেশের লোকশিল্প ও অন্যদিকে পাশ্চাত্যের বিমূর্ত শিল্প থেকে রস গ্রহণ করে সচেতনভাবে উভয়ের মধ্যে সংমিশ্রণ করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। ঐ সময় থেকে লোক-আঙ্গিক তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়, যা আজ আমাদের কাছে অতি পরিচিত। 1

শিল্পরসিক ও দর্শকরা তার কাজগুলোকে প্রায়শ ‘লোকশিল্প’ বা ‘লোক-আঙ্গিক’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। কিন্তু এটা ভ্রান্ত ধারণা। কারণ পরী সম্বন্ধীয় বিষয়বস্তু বা রূপবন্ধ চয়ন ও উপস্থাপনা এবং লোক আঙ্গিকের সংমিশ্রণ বা প্রভাব থাকলেই সেটা লোকশিল্প বা লোক আঙ্গিক হয় না। বিশেষ করে নগর পরিবেশে বাস করে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী কখনো লোকশিল্প সৃষ্টি করতে পারে না ।

আনকোরা, অমার্জিত, অদক্ষতা, গ্রাম্য সরলতা, সহজ সরল আকার এবং প্রতিষ্ঠিত রূপবন্ধ, যা রূপান্তরিত না হয়ে বংশ পরম্পরায় উত্তরসূরিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী অনুকরণ করে থাকেন, তাই লোকশিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়, যা পরবর্তীকালে ঐতিহ্যে পরিণত হয়। লোকশিল্পের এসব বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রাখলে কামরুলের কাজগুলোকে লোকশিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না ।

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

অবশ্য তার কাজের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য ও স্বদেশিকতা বিরাজমান । সেদিক থেকে বিচার করলে তার স্বতন্ত্র আঙ্গিক স্বীকৃতি ও মর্যাদার দাবি রাখে। তার বিশেষ করে এসব কাজকে বিশেষ কোনো শ্রেণীভুক্ত করা দুরূহ। সুতরাং এগুলোকে স্বাতন্ত্র্যবাদী শিল্প হিসেবে বিবেচনা করাই শ্রেয়। অবশ্য শিল্পকর্মকে শ্রেণীভুক্ত করা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সমাজ ও পরিবেশ সচেতনতা, স্বাতন্ত্র্য, মৌলিকতা, শৈল্পিক উৎকর্ষ ও দক্ষতা প্রভৃতি বিষয় শিল্পবিচারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এদিক থেকে তিনি সৃজনশীল শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদার দাবিদার।

কোনো কোনো শিল্প সমালোচক ও শিল্পানুরাগী, বিশেষ করে কামরুল অনুরাগীরা, তাকে আহ্লাদ করে ‘পটুয়া’ বলে অভিহিত করে থাকেন । এমন কি তিনি নিজেও নিজেকে ‘পটুয়া’ বলে দাবি করতে গর্ববোধ করতেন । বলা বাহুল্য, এটা শুধু বুদ্ধিজীবী সৌখিনতা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। বস্তুত তার কাজগুলো পরীক্ষা করলে তার মধ্যে এদেশের লোক-আঙ্গিক, বিশেষ করে পটশিল্পের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের চেয়ে পাশ্চাত্যের আধুনিকতার প্রভাবই অধিক পরিলক্ষিত হয়।

বিশেষভাবে তার নারী রূপকল্প ও নার প্রতিমূর্তিগুলো এবং সার্বিক অলঙ্করণ ও শোভাপ্রদকরণের মধ্যে যথাক্রমে পাবলো পিকাসো ও মাতিসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তার অলঙ্করণ ও শোভাপ্রদকরণ কোনোক্রমেই এদেশীয় হতে পারে না, কোনোভাবেই পাশ্চাত্য প্রভাবমুক্ত নয়, এটা পাশ্চাত্য দেশীয় ।

পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তার কাজগুলোকে পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করলে তার মধ্যে ক্রমরূপান্তরের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অন্য বিমূর্তবাদী শিল্পীদের মতো তার রূপান্তরের মধ্যে শূন্যতা বা অসঙ্গতি ধরা পড়ে না । উপরস্তু, বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে তার শৈল্পিক চেতনা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও উৎকর্ষ ধীরে ধীরে অগ্রগতি লাভ করেছে । তার স্বতন্ত্র মৌলিক আঙ্গিক উদ্ভাবনের পূর্বের কাজগুলো ছিল ৰাস্তবধর্মী। যেমন- বানর, কাক, মোরগ-মুরগী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বিষয়বস্তু হিসেবে কাক-এর চয়ন ও উপস্থাপনার মধ্যে আপাতভাবে তার ও জয়নুলের মধ্যে সাদৃশ্য দেখা গেলেও ভাবের দিক থেকে উভয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য ও বৈষম্য রয়েছে । জয়নুলের কথায়, ‘মিন ওপারচুনিস্ট’ অর্থাৎ হীন-স্বার্থপরতা, শোষণ, অনাহার, অভিশাপ, হতাশা প্রভৃতির প্রতীক হিসেবে জয়নুলের কাজের মধ্যে কাকের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। কিন্তু কামরুলের কাক ছিল তার বিপরীত- স্নেহ-মমতা, প্রেম- ভালোবাসা প্রভৃতির প্রতীক হিসেবে কামরুল কাকের ব্যবহার করেছেন ।

আর প্রকৃতিকে ভালোবাসেন বলেই তিনি প্রকৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পশুপাখি ভালোবাসেন, যা উদাহরণ হিসেবে পূর্বোক্ত অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে । তার পশুপাখিরা কোনো বন্য জীবন না, তারা গৃহপালিত, শান্তশিষ্ট, প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতার প্রতীক। যেমন— বানর শীর্ষক ছবির মধ্যে এক জোড়া বানর দম্পতি গ্রীষ্মের সময় গাছের ছায়ায় বসে পরম আদরে একে অপরের গায়ের উকুন বেছে দিচ্ছে কাকদ্বয় শীর্ষক ছবির মধ্যে দুটো কাক (নারী ও পুরুষ) খররোদে নারিকেল গাছের একটা পাতার উপর বসে আছে। নারিকেলের পাতার ছায়ায় বিশ্রাম করছে । পরস্পর

পরস্পরকে পরম স্নেহে সোহাগ করছে। বস্তুত আলোচিত শিল্পকর্ম দুটোর মধ্যে সমস্ত প্রাণী নির্বিশেষে সকলের মধ্যে যে স্নেহ-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা রয়েছে তারই প্রতিনিধিত্ব করছে। এর মধ্য দিয়ে কামরুলের অকৃত্রিম প্রকৃতি অনুরাগ ও হৃদয়ের উষ্ণতা প্রতিফলিত হয়েছে। এ কাজ দুটো দেখলে মনে যে অনাবিল শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি অনুভূত হয়, তা অমূল্য। যারা প্রকৃতি, পশুপাখি ভালোবাসে না তাদের হৃদয়ে এমন অনুভূতি জাগা সম্ভব নয় ।

তেল মাধ্যমে আঁকা ‘মোরগ-মুরগী’-এর মধ্যে তার দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় । এই ছবির মধ্যে বাস্তববাদ থেকে ক্রমরূপান্তরের মধ্যে দিয়ে প্রতিচ্ছায়াবাদের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এটার মধ্যে তিনটি মোরগ-মুরগির উপস্থাপনা করা হয়েছে ।

অগ্রভূমিতে একটা মোরগ মাটি থেকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে। তার মধ্যে শান্ত, তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠেছে । তার পাশে একটা মুরগি ঘাড় বাঁকা করে পিছন দিকে দেয়ালের উপর একটা আক্রোমনোদ্যত মোরগের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা তিন সঙ্গী। কিন্তু দেয়ালের উপর আক্রোমনোদ্যত মোরগের আকস্মিক আক্রোশের কারণ ঠিক বুঝতে না পেরে কিছুটা হতবাক হয়ে গেছে। তাকে অন্য মোরগের সাথে দেখে সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে । কিন্তু অগ্রভূমিতে মোরগটা তাদের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে শান্তভাবে আপন মনে খেয়ে যাচ্ছে । তার দারুণ ক্ষুধা লেগেছে, কোনদিকে খেয়াল করার সময় নেই।

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

বস্তুত এই ছবিটায় মোরগ-মুরগির উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সমস্ত প্রাণিকুলের মধ্যে যে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ঈর্ষা, ক্রোধ, ভালোবাসা এবং অধিকার বোধ বা প্রভুত্বের বাসনা রয়েছে তারই প্রতিনিধিত্ব করছে। মোরগ-মুরগির ভঙ্গির মধ্য দিয়ে তিনি মানব তথা সমস্ত প্রাণিকূলের মনস্তাতিত্ত্বক দিক অতি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ।

তিনটি মোরগ-মুরগির দ্বারা তিনি সমস্ত ক্যানভাস বা পরিসরকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন; অগ্রভূমি, মধ্যভূমি ও পশ্চাদভূমি। দেয়ালের উপর দিয়ে প্রশান্ত আকাশের কিয়দাংশ দেখা যাচ্ছে। দেয়ালের উপর সামান্য আলো-ছায়া দ্বারা সমস্ত রচনার মধ্যে আলো-বাতাসের সুন্দর অনুভূতি জাগে। মৌনী সবুজ দেয়াল হালকা নীল আকাশের বিপরীতে লাল মোরগ-মুরগিগুলো বেরিয়ে এসেছে। যার ফলে আয়তন, গভীরতা, দূরত্ব এবং রঙের সুন্দর পরিদৃশ্য সৃষ্টি হয়েছে ।

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা জন্মায় । এই অভিজ্ঞতা থেকেই বিভিন্ন সময় দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনবোধের পরিবর্তন হয় । কামরুলও এই স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে ছিলেন না। তাই তার প্রকৃতি ও পশুপাখির ভালোবাসা মানব সৌন্দর্যপ্রীতি ও সমাজ সচেতনতায় রূপান্তরিত হয়।

তাই বলে সৌন্দর্যপ্রীতির জন্য তিনি কল্পনাবিলাসী ছিলেন না, কাব্যময়তাও ছিল না, আবার সৌন্দর্যের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার সন্ধানও করেননি । অথবা জয়নুল আবেদিনের মতো সামাজিক অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দারুণ আক্রোশে ফেটে পড়েননি, আক্রমণ করেননি বা কষাঘাত করেননি । তার নিজস্ব ভাষায় বলা হলো এখানে “I have always been fascinated by the enduring varieties and subtleness of human figure and form ” অতএব, তিনি বাঁচার জন্য

দৈনন্দিন জীবন-সংগ্রাম বা জীবনের জটিলতর সমস্যা উদ্ঘাটনের চেষ্টাও করেননি । বস্তুত নারীর চিরন্তন বৈচিত্র্য এবং নমনীয় আকার তাকে মুগ্ধ করে। উদাহরণ হিসেবে প্রতিবেশী (The Neighbours), গ্রাম (The Village), মা ও সন্তান (Mother and Child), গল্প (Gossip) প্রভৃতি উল্লেখ্য ।

প্রতিবেশী শীর্ষক ছবির মধ্যে তিনি মধ্যবিত্ত সমাজ পরিবেশ উপস্থাপন করেছেন । এটা পুরনো ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজজীবনের একটা সুন্দর আলেখ্য বলা যায় । এই শিল্পকর্মটি দেখলে সেকালের ঢাকা শহরের স্মৃতি মনের মধ্যে উকি দেয়। সংকীর্ণ পলি পথের দু’পাশে পুরনো বাড়ি গিজগিজ করছে, একটার দেয়াল ঘেঁষে আরেকটা বাড়ি, আলো-বাতাস ঢোকে না। ভরা দুপুরেও সূর্যের আলো ক্ষণিকের জন্য জোনাকির আলোর মতো জ্বলে ওঠে, সব সময় ছায়াচ্ছন্ন, স্যাঁতসেঁতে ভাব । আলো বাতাসের অভাবে ভবনগুলোর ইটের স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের উপর শেওলা জন্মেছে, কোথাও কোথাও ইটে নোনা ধরে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ছে ।

বিকালে একটু বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের জন্য প্রতিবেশী দুই বধূ দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু সময়ের জন্য অবসর কাটাচ্ছে। সারা দিন পরে বিকালের একটু অবসর কাটানোর জন্য দু’জনে মুখোমুখি হয়ে গল্প করছে। হলুদ শাড়ি পরিহিতা বধূ কাঠের রেলিংয়ের উপর দু’হাত আলগোছে রেখে ধীরস্থিরভাবে প্রতিবেশিনীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে।

তার ভঙ্গির ভেতর দিয়ে বোঝা যায়, সে স্বল্পভাষিণী । তার বিপরীত দিকের বারান্দায় লাল শাড়ি পরিহিতা প্রতিবেশিনী কাঠের রেলিংয়ের উপর ভর দিয়ে কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে অনর্গল কথা বলে চলেছে। কোনো সময় তার মাথার ঘোমটা খুলে পড়েছে সেদিকেও খেয়াল নেই। বিশেষ করে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে আমরা যেসব আদর্শ ও মুখরা নারী চরিত্রের সাথে পরিচিত হই । এই শিল্পকর্মে তেমন দু’জন রমণীর মুখোমুখি হই ।

টেমপারা রঙে আঁকা গ্রাম শীর্ষক শিল্পকর্মের ভেতর কলসী কাঁখে একজন যুবতী, গ্রামের বধূ ও নদীর তীরবর্তী গ্রাম্য পরিবেশের রূপক-অলঙ্করণ দেখতে পাই। গাঁয়ের একজন যুবতী কলসে পানি ভরে বাড়ি ফিরছে। পশ্চাদভূমিতে প্রশস্ত নদী মসৃণভাবে করে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা বিমুগ্ধকারী শিল্পকর্ম।

নারী রূপকল্পটি নিচ থেকে উপর পর্যন্ত সমস্ত পরিসর জুড়ে নিয়েছে। একেবারে কাছ থেকে দেখানো হয়েছে। মধ্যভূমিতে তার ডানদিকে ঘন বন ও বামদিকে দু’টি তালগাছ এবং পশ্চাদভূমিতে নদীর মধ্যে দুটো নৌকা। নারীমূর্তি এবং বস্তুগুলোকে অলঙ্করণ করে সমস্ত পরিসরকে এক সমতল সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু নারীমূর্তি ও বস্তু এবং নদী ও আকাশের দিগন্তরেখা টেনে পরিপ্রেক্ষিত দেখানো হয়েছে।

যেজন্য দ্বি ও ত্রি-আয়তন ধারণার মধ্যে সংঘাতের মধ্য দিয়ে সমন্বয়ের প্রচেষ্টা দেখা যায় । অবশ্য এটা বোঝা যায়, দ্বি-আয়তন এক সমতল সৃষ্টির চেষ্টা করলেও অসচেতনভাবে ত্রি-আয়তন ধারণা থেকে মুক্ত হতে পারেননি । বস্তুত এই দ্বি ও ত্রি- আয়তনের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত তার পরবর্তী সব কাজের মধ্যে বিদ্যমান ।

শিশুটা জলরঙে আঁকা মা ও সন্তান শীর্ষক ছবির মধ্যে দেখা যায় যে, একজন জননী ঘরের মেঝেতে একটা কাঠের চৌকির উপর বসে তার শিশুসন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছে। দুধ পান করে মায়ের কোলে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। মায়ের মুখ সার্থক মাতৃত্বের আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তার পশ্চাদপটে ঘরের বেড়ায় নানারকম জিনিসপত্র ঝুলানো রয়েছে, বামদিকে একটা টুলের উপর একটা মাটির ‘সখের হাঁড়ি’ রাখা আছে। তার ডানদিকে জানালার ভেতর দিয়ে উদীয়মান সূর্য দেখা যাচ্ছে ।

গল্প শীর্ষক তেলচিত্রের ভেতর দিয়ে আমরা আবার শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যে পুনরায় ফিরে আসি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তিনজন প্রতিবেশিনী নারী বাড়ির অন্দর মহলের বারান্দায়, একটু খোলা জায়গায় একত্রে বসে গল্প করছে ।

নারী প্রতিমূর্তির উপস্থাপনায় তিনি এদেশের কুমারদের বা শিশুদের তৈরি মাটির পুরুলের ঢঙের সাথে পাশ্চাত্যের আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। নারী রূপকল্পের মুখাবয়বও গাঢ় মাটির পুতুলের ঢঙে গঠন করা হয়েছে। কিন্তু দৈহিক গঠনের মধ্যে পাশ্চাত্যের আধুনিকতার ছাপ রয়েছে। এটা ধূসর বর্ণে আঁকা একরঙা ছবি ।

তার গঠনকালীন সময়ের আলোচিত কাজগুলোর মধ্যে আমরা দেশের গ্রাম ও শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সামাজিক এবং ঘরোয়া পরিবেশের চিত্র দেখতে পাই । বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, তিনি এগুলোর মধ্যে দেশজ লোক-আঙ্গিক, বিশেষ করে পট শিল্পর সাথে পাশ্চাত্যের আধুনিকতার মধ্যে সফলভাবে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।

স্পষ্টত বোঝা যায়, তিনি সচেতনভাবে তার পূর্বগামী জয়নুল আবেদিন এবং ভারতের যামিনী রায়ের প্রভাবমুক্ত থেকেছেন । কিন্তু তিনি তার পূর্বোক্ত দু’জনের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হলেও পাশ্চত্যের পিকাসো ও মাতিস দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছেন । বিশেষ করে সমস্ত পরিসরকে শোভাপ্রদ করে এক সমতল সৃষ্টি ও সারফেস ডিজাইন সৃষ্টি করা এবং নারী রূপকল্পর মধ্যে যথাক্রমে মাতিস ও পিকাসোর প্রভাব প্রবল ।

রূপকল্প ও রূপবন্ধগুলো অতিরিক্ত অলঙ্করণ করার ফলে ঐতিহ্যবাহী লোক আঙ্গিকের বৈশিষ্ট্য একেবারে লোপ পেয়েছে। তৎস্থলে পাশ্চাত্যের আধুনিকতা প্রাধান্য পেয়েছে। কেবল মা ও সন্তান শীর্ষক ছবির মধ্যে মাটির তৈরি ‘সখের হাঁড়ির মধ্যে লোক-আঙ্গিকের বৈশিষ্ট্য বজায় রয়েছে। পিকাসো ও মাতিসের প্রবল প্রভাব থাকা সত্ত্বেও তার স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা ক্ষুণ্ণ হয়নি। পাশ্চাত্যের দারুণ প্রভাব থাকা সত্ত্বেও নিজস্ব স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা অক্ষুণ্ণ রাখা কোনো সহজ ব্যাপার নয় ।

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

তার তিন রমণী শীর্ষক তেলচিত্রের মধ্যে গ্রামের দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনজন তরুণী বাড়ির বাইরে কলস কাঁখে দাঁড়িয়ে একটু গল্প করছে। বাড়ির প্রয়োজনীয় পানি আনার জন্য তারা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। পথিমধ্যে তিন বান্ধবী দাঁড়িয়ে একটু গল্প-গুজব, হাসি-তামাসা করে আনন্দ উপভোগ করছে, যা গৈ-গ্রামে সচরাচর আমাদের দৃষ্টিতে পড়ে । কেউ দেখে, কেউ দেখে না । কিন্তু শিল্পীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।

এ কাজটা আধা-বিমূর্ত চঙে আঁকা। বিশেষ লক্ষণীয় যে, চারটি বৈষম্যমূলক প্রাথমিক রং, যেমন- লাল, হলুদ, নীল ও সবুজ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দৃষ্টিনন্দন দিক থেকে খুব চমৎকারভাবে সমন্বয় ও আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। তার লাল, নীল ও হলুদ শাড়ি পরিহিতা তরুণীদের পশ্চাদপটে কলাগাছের সবুজ পাতা, তার সাথে যুক্ত হয়েছে স্থূল ভঙ্গুর কালো রেখা। এখানে স্পন্দনশীল ও নিরপেক্ষ রঙের সুন্দর বৈষম্যমূলক সমন্বয় ( Harmonious Contrast) সৃষ্টি হয়েছে, যা তার নন্দনরোধ ও দক্ষতার প্রমাণ । সম্ভবত এটাকে তার স্বতন্ত্র আঙ্গিক উদ্ভাবনের প্রথম ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা যায়।

পঞ্চাশ দশকের শেষভাগ থেকে তিনি জলরং ব্যবহারে এক বিশেষ নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন । এই পদ্ধতি প্রায় অর্ধযুগ সময় অর্থাৎ ষাট দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত স্থায়ী হয় । এই বিশেষ পদ্ধতিতে কাজ করার জন্য তিনি হ্যান্ড-মেড কাগজ বা কেন্ট কাগজ সমস্ত পরিসর ভরে রচনা না করে কেবল দু’টি সমতলে ভাগ করেন, কখনো কাগজের একেবারে নিচে আবার কখনো প্রায় মধ্যখানে, প্রথমে শুধু পানির প্রলেপ দেন।

কাগজ ভিজে স্যাঁতসেঁতে থাকতে থাকতে তিনি জলরং তার উপর ছেড়ে দেন। রং আপন গতিতেই এদিক ওদিক গড়িয়ে ছড়িয়ে যায় কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই । কখনো কখনো দু’টি রং পরস্পর পরস্পরের সাথে আংশিকভাবে মিশে আভা সৃষ্টি করে, বুনোট সৃষ্টি করে। রং কাগজের উপরে প্রলেপ না হয়ে কাগজের বুনোটের মধ্যে মিশে কাগজেরই অংশ হয়ে যায়। প্রায় দু’দশক পরে আব্দুস সাত্তার তার স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল শীর্ষক ধারাবাহিক কাজে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন।

কামরুল যখন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে বসে এই নতুন পদ্ধতি পরীক্ষা- নিরীক্ষা করছেন, ঠিক সেই সময় ষাট দশকের শুরুতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেলেন ফ্রাঙ্কেনথেলার ঠিক একই পদ্ধতিতে অ্যাক্রিলিক রং খুব তরলভাবে গুলিয়ে আনকোরা ক্যানভাসের উপর ছেড়ে দেন। রং ক্যানভাসের উপরে প্রলেপ না হয়ে বুননের মধ্যে চুইয়ে প্রবেশ করে ক্যানভাসেরই অংশে পরিণত হয়ে যায়। এ কথা ভাবতে বিস্ময় হয়।

যে, পৃথিবীর দু’গোলার্ধে দু’জন শিল্পী পরস্পর পরস্পরকে চেনেন না, একে অপরের কাজের সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই, অথচ একই সময় একই পদ্ধতিতে কাজ করেন । পার্থক্য হলো যে, কামরুল কাগজের উপর জলরং ব্যবহার করে বিষয়ভিত্তিক কাজ করেছেন আর আনকোরা ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিক রং দিয়ে হেলেন বিমূর্ত কাজ করেছেন ।

তার এই বিশেষ ধরনের পদ্ধতিগত পরীক্ষামূলক কাজে এদেশের বিশুদ্ধ নিসর্গ প্রাধান্য পায় । কদাচিৎ দু-একটি মানব রূপকল্প ও নৌকার রূপবন্ধ ছাড়া প্রকৃতিই একমাত্র বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য পায় । এখানে একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, এই বিশেষ ধরনের পদ্ধতিতে তিনি প্রকৃতির বাস্তব প্রতিচিত্রণের পরিবর্তে কেবল নিসর্গীয় রূপকল্পের আভাস দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে এখানে কয়েকটি বিষয়ন্ত্রর উল্লেখ করা হলো : যেমন— তরঙ্গায়িত ধান ক্ষেতের উপর ভাসমান চিত্র-বিচিত্র মেঘমালা, শ্যামল।

ভূমির বুক চিরে আকাবাঁকাভাবে প্রবাহিত নদ-নদী, খাল-বিলের মধ্যে ধান ক্ষেতের পাশে নোঙর করা নৌকা, নদীর চরে নৌকা বাঁধা, কুণ্ডলী কুণ্ডলী মেঘের ফাঁক দিয়ে ধান ক্ষেতের উপর পতিত সূর্যের কিরণ, মেঘের নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়া বলাকার ঝাঁক, ধান ক্ষেতের পেছনে অন্তগামী সূর্য, এমনি আরো কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য। বিষয়বস্তুর বৈচিত্রের সাথে উপস্থাপনা, বাচনভঙ্গি ও পদ্ধতিগত কলা-কৌশলের জন্য যেমন বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে তেমন অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছে ।

এখানে একটা বিষয় বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে যে, এসব কাজের মধ্যে নারী রূপকল্প অর্থাৎ নারী সৌন্দর্য একেবারেই স্থান পায়নি। হয়তো সাময়িকভাবে তিনি নারী সৌন্দর্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন । এমন হতে পারে যে, প্রকৃতির রূপ, রস, বর্ণ ও গন্ধ তাকে মুগ্ধ করে, যার কাছে সাময়িকভাবে হলেও নারী সৌন্দর্য ম্লান মনে হয়েছে। তাই নারীবর্জিত। তাই বলে নারীর প্রতি বৈরী বা উদাসীন ছিলেন, সে কথা বলা যায় না

১৯৬৫ সালে তার প্রার্থনা শীর্ষক কালি-কলমে আঁকা রেখাচিত্রটা হঠাৎ বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এই রেখাচিত্রে দেখা যায়, একজন বৃদ্ধ মুসলমান জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে নামাজের মধ্য দিয়ে সে পরম শক্তিশালী ও করুণাময় আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করছে । সে তার অতীতের কৃত পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছে। সর্বশক্তিমান করুণাময় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সে জীবনের আত্মতৃপ্তি ও প্রশান্তি ফিরে পেতে চায় ।

নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটা অবশ্যই কামরুলের একটা ব্যতিক্রমধর্মী কাজ। যার মধ্যে ইসলামী আদর্শ ও ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে । তবে কেবল এই একটা কাজ ছাড়া আর কোনো কাজের মধ্যে ইসলামী আদর্শ বা ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখা যায় না। কেবল এই রেখাচিত্রটা দেখলে মনে হয় যে, কামরুল একজন ইসলামে বিশ্বাসী ধর্মপ্রাণ শিল্পী ছিলেন।

কিন্তু কেবল একটা রেখাচিত্রের উপর ভিত্তি করে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করা ঠিক হবে না। কারণ এটা অবশ্যই বিতর্কিত । আমরা যারা কামরুলকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, তার কাছে কামরুলের সমস্ত কথা ও কাজের মধ্যে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, তিনি আর যাই হোন না কেন, নিঃসন্দেহে একজন নাস্তিক, কট্টর ইসলামবিরোধী ছিলেন।

তার আকস্মিক এই রেখাচিত্র আঁকার কারণ সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দু’টি সম্ভাবনা দেখা যায়, তিনি ইসলামবিরোধী নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও শৈশবে তার শিশুমনের গভীরে ইসলামের একেশ্বরবাদের যে বীজ রোপিত হয়েছিল, অবচেতনভাবে সেই বিশ্বাস, ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যর্থ প্রয়াশ পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, সম্ভবত এই রেখাচিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি অবচেতন মনে তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন।

বিশেষভাবে জয়নুল আবেদিনের সমতুল্য সুখ্যাতি ও মর্যাদা লাভের জন্য সব সময় মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছেন । কেবল জয়নুল আবেদিনের মৃত্যু তার এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়। বিশেষ করে তার এই রেখাচিত্রটাকে বুদ্ধিজীবী কপটতা হিসেবে আখ্যায়িত করলে হয়তো ভুল হবে না। কিন্তু তাই বলে রেখাচিত্র হিসেবে এর গুরুত্ব কিছু কম নয়।

১৯৬৫ সালের পর থেকে তার রাজনৈতিক তৎপরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফার সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদ এবং তার কারামুক্তি এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রভৃতি রাজনৈতিক কর্মকার ও আন্দোলনের সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি আত্মগোপন করে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের কোলকাতা মহানগরীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন । কোলকাতায় থাকাকালীন সময় তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েন ।

ঐ সময় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সজ্জা পরিকল্পনা (Lay- out) প্রস্তুত করেন । শস্য-শ্যামল বাংলাদেশে উদীয়মান সূর্যকে কেবল লাল ও সবুজ মাত্র এই দু’টি রঙের মধ্যে দিয়ে সুন্দর প্রতীকী উপস্থাপনা। কেবল দু’টি রঙের মধ্যে দিয়ে একটা দেশকে যে এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন ও অনুভব করা যায় তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। জাতীয় পতাকা ছাড়াও ঐ সময় তিনি পাকসেনাদের বর্বরতা ও পৈশাচিকতার উপর কিছু ব্যঙ্গ প্রাচীরপত্র আঁকেন।

এসব প্রাচীরপত্রের মধ্যে বিশেষভাবে এটি সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। যার মধ্যে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে একজন রক্তপিপাসু নরখাদক দানব হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন । এই বিশেষ ব্যঙ্গচিত্রটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে আওয়ামী লীগের সপক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে অত্যন্ত সহায়ক হয় ।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথেই তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন । সম্ভবত কোলকাতায় অবস্থানকালে তার মধ্যে জন্মভূমির প্রতি মমত্ববোধ পুনরায় নবায়িত হয়ে ওঠে । ফলে স্বাধীনতা উত্তরকালে তার মধ্যে ভারতপ্রীতি জাগরিত হয়ে ওঠে, যা আশি দশকে প্রায় স্পষ্টভাবে কোনো কোনো সমালোচক ও বিশ্লেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

তিনি নিজেকে যামিনী রায়ের অনুগামী হিসেবে গর্বের সাথে আত্মপ্রচার শুরু করেন । ‘যামিনী রায় যেখানে শেষ করেছেন, আমি সেখান থেকে শুরু করেছি— তার এই স্বগোক্তি আত্মপ্রচারণা তার মতো একজন শিল্পীর পক্ষে শুধু লজ্জাজনক নয়, নিজেকে হেয় করা হয় । কিন্তু তার কাজগুলো পরীক্ষা করলে তার স্বগোক্তি ভুল প্রমাণিত হয় । তার কাজের মধ্যে বিশেষভাবে যামিনী রায় এবং সার্বিকভাবে লোক আঙ্গিকের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় না । তৎস্থলে পাশ্চাত্যের আধুনিকতার প্রবল প্রভাবের কথা আগেই আলোচনা করা হয়েছে।

১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তার কিছু রেখাচিত্র (পাঠ ও লাইনো খোদাই ছাপচিত্র) বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসব ছাপচিত্রের মধ্যে কিছু কিছু ছাপচিত্রে তারিখ উল্লেখ আছে। আর অনেকগুলোতে নেই। কিন্তু কাজের ধরণ পরীক্ষা করলে মনে হয় যে, এগুলো ঐ একই সময়ের কাজ । এগুলোতে কেবল স্বাক্ষর করেছেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বছর আগে ১৯৭০ সালে কালি-কলমে আঁকা অঙ্কন শীর্ষক ঘোড়া একটা সুন্দর রেখাচিত্র। সরু ছন্দায়িত গতিশীল রৈখিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এটা একটা সুন্দর রেখাচিত্র। কিন্তু ঘোড়ার বুকের পাজরের এবং পেটের নিচের প্রান্ত রেখা (Contour) অতিরিক্ত গাঢ় হওয়ার জন্য অসঙ্গত মনে হয় এবং দৃষ্টি বিঘ্নিত হয় । স্বাধীনতা উত্তরকালে তার রেখাচিত্র ও ছাপচিত্রগুলোর রৈখিক বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য লক্ষণীয়। স্বাধীনতাপূর্ব ভুল দৃঢ় ভঙ্গুর রেখা স্বাধীনতার পরে সূক্ষ্ম ছদায়িত গতিশীল রেখায় পরিণত হয় ।

রৈখিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আলো-ছায়া, ঘনত্ব, আয়তন ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ের রেখাগুলো অনেক বাঙ্ময়, ভাব প্রকাশ। যেমন, অঙ্গন (মা ও সন্তান), রায় বেঁশে, বাউল, গরুগুলো ও কৃষ্ণ সুন্দর (Black Beauty) । এগুলোর মধ্যে কেবল অঙ্কন (মা ও সন্তান) শীর্ষক রেখাচিত্রে তারিখ উল্লেখ দেখা যায়, ১৮-৬-৭৩। অন্যগুলোতে তারিখ উল্লেখ না থাকলেও রৈখিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বোঝা যায়, এগুলো ঐ একই সময় আঁকা।

প্রথম রেখাচিত্রের মধ্যে দেখা যায়, একজন মা তার শিশুকন্যাকে আহ্লাদ করছে । শিশুকন্যা আহ্লাদের সাথে তার মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের কানে ফিস ফিস করে কিছু আবদার জানাচ্ছে। মা সয়েহে তার আবদার মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এখানে লক্ষণীয় যে, কামরুলের শিশু এখনে আর নবজাতক মায়ের কোলের শিশু নেই, সে এখন ছয়/সাত বছর বয়সের কিশোরী এই রেখাচিত্রের রৈখিক বৈশিষ্ট্য ও আঁকার ঢংয়ের দিক থেকে পাবলো পিকাসোর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

রায় বেঁশে-এর মধ্যে এদেশের একটা ঐতিহ্যবাহী বিস্তৃত লোক উৎসবের উপস্থাপনা দেখা যায় । একজন ঢুলি ঢোল বাজাচ্ছে, তার সাথে একজন কাঁশারী সংগ‍ করছে । তাদের চারদিকে ঘিরে কৃষকেরা ঘুরে ঘুরে নৃত্য করছে । কৃষকেরা খালি গায়ে লুঙ্গি কাছা মেরে ঢোলের তালে তালে নৃত্য করছে।

মনে হয় এ উৎসব চৈত্র বা বৈশাখ মাসে হয়ে থাকে । প্রতিটি নরমূর্তির দেহভঙ্গির ভেতর দিয়ে সঙ্গীত ও নৃত্যের অকৃত্রিম আনন্দ প্রকাশ পেয়েছে । নৃত্যের ছন্দময় গতি এবং নৃত্যরত মূর্তিগুলো রচনার চারদিকে এবং চুলি ও কাশারী বাদককে কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করার ফলে আবর্ত সৃষ্টি হয়েছে । রচনার দিক থেকে মাতিসের Four Danceres-এর প্রতিধ্বনি বলা যায় ।

বাউলের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে এদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত ও তাদের জীবন দর্শনের উপস্থাপনা করা হয়েছে। বাউলরা সংসার বিবাগী আধ্যাত্ম চেতনায় মগ্ন । এমনি একজন বৃদ্ধ বাউল একতারা বাজিয়ে সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে স্রষ্টার আরাধনা করছে। আমাদের সকলের জানা আছে যে, এদেশের লোকসঙ্গীতের মধ্যে বাউল গান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গরুগুলো’র মধ্যে দু’টি গরু ঘাস খেয়ে তৃণাচ্ছাদিত মাঠের উপর বসে বিশ্রাম করছে । একটা শালিক একটা গরুর পিঠের উপর বসে ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে আঠাল খাচ্ছে। কালোর মধ্যে সাদা রেখার আঁচড় কেটে কেটে গরুর আকার আকৃতি গঠন ও ঘাস আঁকা হয়েছে। গরুর চারদিকে ঘাস। সবকিছু মিলে দ্বি-আয়তন সারফেস ডিজাইন সৃষ্টি হয়েছে । ঘাসের ছোট ছোট আঁচড় দ্বারা সুন্দর বুনোট তৈরি হয়েছে।

কৃষ্ণ সুন্দর (Black Beauty)-এর মধ্যে একজন কালো মেয়েকে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে এ কথা বলা হয়তো অবাস্তর হবে না যে, অধিকাংশ মানুষের মধ্যে বর্ণ সংকীর্ণতা রয়েছে। পাশ্চাত্যের বর্ণবাদ ছাড়াও আমাদের দেশে কম বেশি প্রায় সকলের মধ্যে ‘কালোর প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়ে থাকে। কিন্তু কালোর মধ্যেও যে অপরূপ সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, কালো মেয়ের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সেটাই কামরুল আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন । তার কৃষ্ণ সুন্দর ছবিটা দেখলে রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতার কথা মনে পড়ে।

প্রকৃতপক্ষে, বস্তুর মধ্যে সৌন্দর্য নেই, দর্শকের দৃষ্টির মধ্যেই সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। ব্যক্তির নন্দনবোধ, সৌন্দর্য চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সৌন্দর্য নিহিত । পঞ্চাশ দশকে তার কাক শিরোনামের ছবির ভেতর কালোর’ যে স্তুতি করতে দেখি সত্তর দশকের মধ্য ভাগে আবার তার পুনরাবৃত্তি দেখি কৃষ্ণ সুন্দর এর মধ্যে। কালোর মধ্যে যে অপরূপ রূপ, যে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তা সাধারণ চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তা কামরুলকে আকৃষ্ট করেছে ।

১৯৭৪ সালে আঁকা প্রতিমূর্তি বা রূপকল্প (Image) শীর্ষক কয়েকটি কাজ রয়েছে । সুতরাং বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হলো । যেমন, প্রতিমূর্তি-১, প্রতিমূর্তি-২, ইত্যাদি । প্রতিমূর্তি-১-এর মধ্যে গুণটানার দৃশ্য অর্থাৎ নদীমাতৃক জীবনের উপস্থাপনা করা হয়েছে। একজন লোক উজান স্রোতে নৌকার গুণ টেনে নিয়ে যাচ্ছে । স্রোতের গতি, বোঝাই নৌকার ওজন এবং শ্রমের ক্লান্তি বোঝানোর জন্য নরমূর্তিটাকে অতিরিক্তভাবে সামনের দিকে ঝুকানো হয়েছে।

এ কাজটা জয়নুলের গুণ টানা’র অনুকরণ বলা যায়। তবে আঙ্গিকের দিক থেকে ভিন্ন। কিন্তু জয়নুলের গুণ টানার মধ্যে যে শ্রমের ক্লান্তি এবং রচনার মধ্যে যে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে এবং ভারসাম্য বজায় আছে কামরুলের মধ্যে তার অভাব রয়েছে । কামরুলের গুণের দড়ি ঢিলা হয়ে নিচের দিকে ঝুলে পড়ার জন্য উত্তেজনা একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে এবং শ্রমের ক্লান্তিও নেই ।

এমন মনে হয় যে, একজন লোক গুণ টানার পরিবর্তে একটা লাঠি দু’হাত দিয়ে ধরে কাঁধের উপর রেখে দৌড়াচ্ছে। অবশ্য এ কথা বোঝা যায় যে, সমালোচকের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে গুণের দড়ি চিলা করে নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন । বিশেষ করে গুণ টানার সময় পায়ের উপর যে চাপ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, পায়ের ভঙ্গিতে তার পরিবর্তে দৌড়ানোর ভঙ্গি ফুটে উঠেছে। অতএব, বলা যায়, বিষয়বস্তুর ভাবের ও উপস্থাপনার দিক থেকে তিনি সফল হতে পারেননি ।

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে তার কিছু ছাপচিত্র ও রেখাচিত্র বিশ্লেষকদের জন্য অত্যন্ত কৌতূহল উদ্দীপক । এগুলো কিছুটা পরাবাস্তবধর্মী এবং বিষয়বস্তুর দিক থেকে অত্যন্ত অর্থবোধক। এগুলোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমকালীন সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি এবং তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন পাওয়া যায়। বিশেষ করে এই কাজগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করতে হলে বাংলাদেশের সমকালীন সামাজিক এবং তার ব্যক্তিগত জীবনের উপর আলোকপাত করা প্রয়োজন। তা না হলে এ কাজগুলোর অন্ত নিহিত ভাব বা অর্থ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় বা বোঝা কঠিন হতে পারে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকালে মূল্যবোধের অবক্ষয় যেমন- অপহরণ ও ধর্ষণ, মদ্যপান ও ইন্দ্রীয়পরায়ণতা প্রভৃতি সমাজজীবনে দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়। নহ উত্থিত বিত্তশালী সমাজ একদিকে যেমন নীতি জ্ঞানহীনভাবে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠল অপরদিকে তেমন ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। ফলে একদিকে ধনী শ্রেণী প্রাচুর্যের আতিশয্যে ব্যাভিচারে গা ভাসিয়ে দিল অপরদিকে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ পরি শ্রেণী ভাত-কাপড়ের অভাবে অনাহারে রাস্তায় পড়ে মারা গেল ।

দেশের সামাজিক নৈরাজ্য এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সাথে সাথে কামরুলের ব্যক্তিগত জীবনেও বিপর্যয় নেমে আসে। এ সবই মিলিতভাবে তার মনে যে গভীর চাপ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল তাই এই কাজগুলোর ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন— ছাপচিত্র প্রতিমূর্তি-২, প্রতিমূর্তি-৩, প্রতিমূর্তি-৪ এবং মৎস স্বপ্ন (Fish Dream) এবং রেখাচিত্র অঙ্কন-১, অঙ্কন-২ ইত্যাদি ।

প্রতিমূৰ্ত্তি—২ শীৰ্ষক ছাপচিত্রটা পরাবাস্তবধর্মী। বিষয়বস্তুকে আড়াআড়িভাবে দীর্ঘ রচনা । বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার দিক থেকে রচনাকে দু’টি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। রচনার প্রায় মধ্যখানে আড়াআড়িভাবে বামদিক থেকে ডানদিকে কতকগুলো কচ্ছপ সারি বেঁধে যাচ্ছে । কচ্ছপের সারি দ্বারা বিষয়বস্তুকে দুটো স্তরে ভাগ করা হয়েছে । উপরের স্তরে ধনী সমাজের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রতিফলিত হয়েছে।

কয়েকজন রমণী উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে, তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে মদের গ্লাস, নেশায় চূর হয়ে আছে। রচনার একেবারে ডান কোণায় একজন স্যুট পরিহিত পুরুষ, চোখে চশমা, তার মুখাবয়ব কোনো জন্তুর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। শায়িত নারীমূর্তির প্রায় মাঝখানে একটা ভুতুম পেঁচা উড়ে আসছে, যা অমঙ্গলের ইঙ্গিত দিচ্ছে ।

রচনার নিচের স্তরে দুর্ভিক্ষপীড়িত কঙ্কালসার বুভুক্ষু জনতা দেখানো হয়েছে। বামদিকে একটা কঙ্কাল থেকে একটা কালো হাত একজন বুভুক্ষুকে গলা টিপে হত্যা করছে । রচনার একেবারে ডান কোণায় দুটো কচ্ছপ অনাহারে মৃত ব্যক্তিদের শবদেহ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা থেকে সমকালীন সামাজিক অবস্থা ও দুর্ভিক্ষের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় ।

এখানে একটা বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে, কামরুল অন্তত, অমঙ্গল, দুর্ভিক্ষ, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রভৃতির প্রতীক হিসেবে কচ্ছপের মতো শান্ত, ভীরু, নিরীহ প্রাণী উপস্থাপন করেছেন । অবশ্য কচ্ছপ নিজেই অমঙ্গল ডেকে আনে না বা প্রতীক নয় । তার মতো শান্ত নিরীহ প্রাণীও ক্ষুধার তাড়নায় মানুষের শবদেহ ছিঁড়ে খেতে বাধ্য হচ্ছে, এটাই শিল্পীর বক্তব্য

‘প্রতিমূর্তি-৩’ শীর্ধক ছাপচিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এটার মধ্যে শান্ত, নিরীহ পশুপাখি যেমন- বাদুড়, পায়রা, বক ও শিয়াল এবং হিংস্র জীবন যেমন বিষধর সাপ ও কুমিরের উপস্থাপনার ভেতর দিয়ে বৈষম্য ও বৈপরীত্য সৃষ্টি করা হয়েছে। একদিকে দুর্ভিক্ষ অনাহার এবং অপরদিকে সামাজিক সহিংসতা ও নৈরাজ্যর প্রতীক হিসেবে এই সব পশুপাখি ও জীবজন্তু ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রতিমূর্তি-৩ এর মধ্যে দেখা যায়, একটা অজগর ও জাত সাপ পরস্পর জড়াজড়ি করে আছে। তাদের সামনে একটা কুমির তাদের দিকে মুখ করে আছে। কুমিরের সামনে একটা বক ঠোঁটে মাছ ধরে আছে এবং তার উপরে একটা কবুতর ভয়ে উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। অজগরের পিঠের উপর একটা বাচ্চা বাদুড় বসে আছে, সে খাবারের জন্য মুখ হা করে মা বাদুড়ের দিকে তাকিয়ে চিটি করছে। মা বাদুড়টা খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে এসে অজগরের পিঠের উপর বসছে বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য । অজগরের লেজের নিচে কয়েকটা বাদুড় ঝুলছে এবং তার উপরে একটা ধূর্ত ক্ষুধার্ত শিয়াল লোলুপ দৃষ্টিতে বাচ্চাটার দিকে চেয়ে ওতপেতে আছে ধরার অপেক্ষায় ।

প্রতিমূর্তি-৪ এর মধ্যে দেখা যায়, একটা শিয়াল, তার মুখ কিছুটা কুমিরের মতো, অর্থাৎ দো-আঁশলা হিংস্র জানোয়ার। তার সামনে তার একটা বাচ্চা খাবারের জন্য মুখ হা করে তার দিকে চেয়ে আছে। দো-আঁশলা জন্তুর নিচে একটা জাত সাপ ফণা উঁচু করে আছে । তার মাথার উপর একটা টেরোডাকটাইল পাখি ঠোঁট হা করে আছে। মা- পাখির পিঠের উপর দুটো বাচ্চা বসে খাবার জন্য মুখ হা করে চিঁচিঁ করছে। সাপটার নিচে কয়েকটা গরু শুয়ে আছে।

একেবারে নিচে বাম কোণায় একটা শকুন গরুগুলো ছিড়ে খাবার জন্য এগিয়ে আসছে। আমরা সবাই জানি, শকুন মরা গরু খায় । কিন্তু এ শকুনটা এতই ক্ষুধার্ত যে, সে জীবন্ত গরু ছিঁড়ে খাবার জন্য এগিয়ে আসছে। দো- আঁশলা জন্তুর উপরে দূর আকাশে একটা উড়ন্ত পায়রা ও বাদুড় । রক্তশোষক বাদুড়টা, ইংরেজিতে যাকে বলে ভ্যাম্পায়ার, পায়রাটাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে এবং পায়রাটা প্রাণ ভয়ে মরিয়া হয়ে উড়ে পালাবার চেষ্টা করছে ।

মৎস স্বপ্ন শীর্ষক ছাপচিত্রে আমরা একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে দেখতে পাই । কিন্তু কামরুলের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ জয়নুলের দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মতো কঙ্কাল নয়, সে রুষ্ট- পুষ্ট, সুঠামদেহী বলিষ্ঠ । তার মুখাবয়ব ও দৈহিক গঠন বর্বর আদি মানব মনে হয় । সে লোলুপদৃষ্টিতে মুখ হা করে মাছটার দিকে চেয়ে আছে। মাছটা প্রাণভয়ে করুণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে, যদি তার মনে দয়ার উদ্রেক হয়, তাকে মুক্তি দেয় । কিন্তু সে ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার তাড়না যেখানে তীব্র দয়া-মমতা সেখানে স্থান পায় না ।

অঙ্কন-১ ও ২ রেখাচিত্রের মধ্যে কিছু অর্ধ-পরিচিত হিংস জীবজন্তুর মাথা, অমঙ্গলের প্রতীক হুতুম পেঁচা উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি হিংস্র জন্তু আক্রমণের জন্য মুখ হা করে আছে, বিষাক্ত দাঁত দেখা যাচ্ছে । রচনার নিচে একটা মানব রূপকল্পর পার্শ্ব প্রতিকৃতি, ভয়ে চীৎকার করছে। মূল রচনার বাম দিকে একটা নৃত্যরত নরমূর্তি । তার পেছন থেকে লেজের মতো বেরিয়ে নিচের দিকে নেমে এসেছে একটা জাত সাপ ।সাপটা ফণা তুলে আক্রমণের জন্য জিহ্বা বের করে শত্রু বা শিকারের আণ নিচ্ছে ।

দ্বিতীয়োক্ত রেখাচিত্রের মধ্যে নর-নারীর একটা প্রতিকৃতির চারদিকে রেখা টেনে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। প্রতিকৃতির ডানদিকে উপরে পুরনো যুগের একজন জমিদার বা নবাব দাঁড়িয়ে আছে, তার কোমরে একটা তরবারি ঝুলছে। তার নিচে একটা টিয়া পাখি । প্রতিকৃতির সংলগ্ন নিচে আড়াআড়িভাবে একটা আয়তক্ষেত্রকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে । একেবারে বামদিকে একটা বাঘের মাথা (রয়েল বেঙ্গল টাইগার), মাঝখানে একটা টিয়া পাখি, একেবারে বামদিকে একটা শিয়াল ও শাপলার রূপবন্ধ। একেবারে নিচের আড়াআড়ি আয়তক্ষেত্রের মধ্যে একটা কুমির ও শাপলার রূপবন্ধ।

জানা যায়, ঐ সময় কামরুলের ব্যক্তিগত জীবনেও বিপর্যয় নেমে আসে। তার দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের যবনিকা পতন হয়, সমস্ত অর্থ-সম্পত্তি, জীবনের সমস্ত সঞ্চয় হারিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়ে যান। দেশের বিরাজমান সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতির সাথে ব্যক্তিগত জীবনের বিপর্যয় যুক্ত হয়ে তার মনে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে ভাই উপরিউল্লিখিত কাজগুলোর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে । এই কাজগুলোর মধ্যে দু’টি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে । প্রথমত, অনাহার, দ্বিতীয়ত, সমাজ থেকে সৃষ্ট তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জীবন-জগতের প্রতি দারুণ আক্রোশ।

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

আমরা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কামরুলের হৃদয়ে যে ক্ষত দেখতে পাই, ৭০ দশকের শেষে তা শুকিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে দেখি। ১৯৭৮ সালে আঁকা গোপন চিঠি রেখাচিত্রের ভেতর তার প্রমাণ পাওয়া যায় । যার মধ্যে একজন রমণী নিরিবিলিতে বসে একটা চিঠি পড়ছে।

প্রায় দু’দশক পরে কামরুল আবার নারী সৌন্দর্যের দিকে ফিরে তাকান । কিন্তু তার এবারের রমণীরা পঞ্চাশ দশকের তন্বী-তরুণী, স্বাস্থ্যবর্তী যুবতীদের তুলনায় ইন্দ্ৰীয়সুখ বর্ধনকারী অর্থাৎ স্কুল দীর্ঘাঙ্গিনী ( Voluptuous)। তার পঞ্চাশ দশকের স্বাস্থ্যবতী যুবতী নারীদের পুষ্ট সুঢৌল স্তন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে ছোট আকার হয়ে যায় এবং নিাঙ্গ অধিক গুরুত্ব পায় ।

পঞ্চাশ দশকের গ্রাম্য লাজুক, নম্র, শাড়ি পরিহিতা যুবতীরা সত্তর দশকের শেষভাগ থেকে একেবারে বিবস্ত্র হয়ে এলোকেশিনী নারী হয়ে আমাদের সামনে বেরিয়ে এসেছে। তার এসব বিবস্ত্র নারী মূর্তিগুলো পরীক্ষা করলে মনে হয় যে, সম্ভবত বার্ধক্যে তার মধ্যে ইন্দ্রীয়পরায়ণতা বৃদ্ধি পায়। যার আংশিক উপশম হিসেবে তিনি বিবস্ত্র নারীমূর্তি উপস্থাপন করেন। সহজে বোঝা যায়, তিনি বিবসনা নারীমূর্তি উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে কোন পৌরাণিক কাহিনী বা আধ্যাত্মিকতা বা কিংবদন্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেননি।

কেবল নারী সৌন্দর্যই সরাসরি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন । আমাদের মতো এমন একটা ধর্মপোড়া, রক্ষণশীল সমাজে বিবস্ত্র নারীমূর্তি উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তিনি দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তার নারীরা ইন্দ্রীয় সুখবর্ধনকারী হওয়া সত্ত্বেও দর্শকদের মনে যৌন আবেদন বা কৌতূহল সৃষ্টি করে না।

নারী সৌন্দর্যের দিক থেকে বিচার করলে মনে হয় যে, নারীদেহে স্তনের সৌন্দর্য অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, তাই আশি দশকে তার নারীদের স্তনের গুরুত্ব হারিয়ে ছোট হয়ে যায়।

তৎপরিবর্তে নিম্নাঙ্গ অধিক গুরুত্ব পায়। এদিক থেকে তার নারীরা প্রতিজ্ঞায়াবাদী রেনোয়াঁ এবং আংশিকভাবে ম্যানের সাথে তুলনীয়। যেমন- স্নানরতা তরুণীর কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। এই সময় থেকে তার প্যালেটেরও পরিবর্তন হতে দেখা যায়। পঞ্চাশ ও ষাট দশকে প্রাথমিক ও কালো রঙের পরিবর্তে ইন্ডিয়ান রেড, নীল (Prussian blue), মাঝে মাঝে সেরুলিয়ান ব্লু, স্বচ্ছ সবুজ রং বেশি প্রাধান্য পায়। কালো সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হয়।

স্নানরতা তরুণী চিত্রে দেখা যায়, একজন ষোড়শী তরুণী সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে পুকুরে গোসল করছে। পুকুরের কিনারা বুনো কচুগাছে এবং নানারকম গুলু-লতায় আচ্ছাদিত। বিশেষ করে এই কাজটির মধ্যে বিষয়বস্তুর চয়ন, উপস্থাপনা ও তরুণীর পানির মধ্যে দাঁড়াবার ভঙ্গি ও দৈহিক গঠনের দিক থেকে রেনোয়ার অনুকরণ বলা যায়। তবে আঙ্গিক ও টিটমেন্টের দিক থেকে তার স্বতন্ত্রতা বজায় থাকে ।

আশির দশকের শুরু থেকে তিনি পুনরায় তেল মাধ্যমে গুরুত্ব দেন এবং অধিক সময় ব্যয় করেন। এ সময় নারী সৌন্দর্যের পাশাপাশি নিসর্গ ও গ্রাম্য জীবনের উপস্থাপনা দেখা যায়। আশি দশকের শুরু থেকে তেল মাধ্যমে তার আরেকটা প্রবণতা দেখা যায়, যা বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেটা হলো, পাশ্চাত্যের উৎকট অনুকরণ প্রবণতা। আশি দশকের প্রথমার্ধে তার কিছু কিছু কাজের মধ্যে পিকাসোর বিশেষ এক সময়ের কাজ, পিকাসোর দ্বিতীয় স্ত্রী ডোরা মারকে কেন্দ্র করে পিকাসো যেসব প্রতিকৃতি এবং নারী প্রতিমূর্তি আঁকেন এবং

শিল্পী কামরুল হাসান
উকি গোয়াশ ৭৫ x ৩৭ সেমি ১৯৬৭

 

গোধার তাহিভিবাসীদের কিছু কাজের অনুকরণ পীড়াদায়ক। বিশেষ করে তার মতো একজন প্রবীণ অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিল্পীর মধ্যে পাশ্চাত্যের অনুকরণপ্রিয় বা শিল্পরসিক ও সমালোচকদের জন্য বেদনাদায়ক বৈকি ।

সম্ভবত ১৯৮৪ সালে তুলি কালি ও জলরং মাধ্যমে তার আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে তার মৌলিকতা ও স্বতন্ত্রতা এবং শৈল্পিক উৎকর্ষ ও দক্ষতা উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে। তার শেষোক্ত এই শিল্পকর্মগুলো আপন বৈশিষ্ট্যের ও মাধুর্যে মহীয়ান। যাকে Pure Orientalism’ অর্থাৎ বিশুদ্ধ প্রাচ্যবাদ বলে অভিহিত করা যায় । এই কাজগুলো তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। এ কথা বলা হয়ত ভুল হবে না যে, তিনি জয়নুলের আঙ্গিকরে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন, যা চীনা ও জাপানি চিত্রকলার সাথে তুলনা করা যায়। তার এই কাজগুলোকে বাংলাদেশের ষড়ঋতুর প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক শিয় (Commercial Art) গড়ে তোলায় এবং ঐতিহ্যবাহী লোক রূপবন্ধ পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিতকরণে তিনি যে অগ্রগামী নায়কের ভূমিকা পালন করেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সত্য বলতে কি, সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে বাণিজ্যিক শিল্প সম্বন্ধে কারো স্পষ্ট কোনো ধারণাই ছিল না এবং মান এত অনুন্নত ছিল যে সে কথা উল্লেখ না করাই ভালো। তিনি সর্বপ্রথম এদেশে বাণিজ্যিক শিল্পর প্রবর্তন ও প্রচলন ও মান উন্নয়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান।

ঐ সময় তার আঁকা অনেকগুলো প্রাচীরপত্র, বইয়ের প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন এর মান এত উন্নত হয় যে, সেগুলো যে কোনো বৈদেশিক বাণিজ্যিক শিল্পের সাথে সমতুল্য হিসেবে গণ্য করা যায়। বিশেষ করে এদেশের লোক নকশার পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিতকরণে তার অবদান অমর হয়ে থাকবে। বইয়ের প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন অঞ্চনেও তিনি নিজস্ব স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা উদ্ভাবন করেন, যা পরবর্তীতে তার উত্তরসুরিরা যেমন কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, প্রাণেশ মণ্ডল, সমরজিত রায়, রফিকুন নবী এবং অন্য শিল্পীদের অনুপ্রেরণা জোগায় এবং পথের সন্ধান দেয়।

তারা বিশ্বস্ততার সাথে তাকে অনুগমন করেন। পরবর্তীতে অবশ্য তারা প্রত্যেকে নিজস্ব আঙ্গিক উদ্ভাবনে সক্ষম হন। তবুও অদ্যাবধি পর্যন্ত তারা কামরুলের প্রভাব বলয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পেরেছেন কিনা সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না ।

ষাট দশকের প্রথমার্ধে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপনার পদ ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থায় প্রথমে নকশাবিদ পরে প্রধান নকশাবিদ এবং তারও পরে নকশা কেন্দ্রের পরিচালকের পদে উন্নীত হন। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থায় কর্তব্যরত থাকাকালে তিনি বাংলাদেশের লোকশিল্প এবং পাশ্চাত্যের বিমূর্ত ধারার মধ্যে সংমিশ্রণ করে লোক রূপবন্ধকে আধুনিকীকরণে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা করেন। তার পরিশ্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই আজ এদেশের লোক নকশা আধুনিকতার মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এ কথা বলা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, তিনি এক সম্রান্ত মুসলমান পরিবারে।

জন্মগ্রহণ করলেও ‘ক্যালকাটা ইনস্টিটিউট’-এ দু’বছর অধ্যয়ন করার পরে তিনি বিদ্যালয় ত্যাগ করে অধ্যয়ন স্থগিত রাখতে বাধ্য হন। জীবন সংগ্রামে বাঁচার তাগিদে জীবিকা অর্জনের জন্য তিনি কিছুদিন কোলকাতার এক বাণিজ্যিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকরি গ্রহণ করেন । পুতুলের চোখ, নাক ও মুখ আঁকার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত হয়। সম্ভবত ঐ সময় থেকে তার তরুণ অবচেতন মনে লোকশিল্পের প্রতি অনুরাগ অঙ্কুরিত হয়, যা পরবর্তীতে পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে।

জয়নুল আবেদিন যখন কোলকাতা আর্ট ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করেন, কামরুল তখন ঐ ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নরত ছিলেন। জয়নুল কলম ও কালো কালি মাধ্যমে ১৯৪৩ সালের মহামন্বন্তরের যে হৃদয়বিদারক দুর্ভিক্ষের উপস্থাপন করেন তা সারা বিশ্বকে মর্মাহত ও মোহিত করে, যা জয়নুলের জন্য বিশ্বখ্যাতি এনে দেয়। সম্ভবত ঐ সময় থেকে কামরুলের তরুণ মনে জয়নুল গভীরে রেখাপাত করেন।

একজন আদর্শ ব্যক্তি ও মহান শিল্পী হিসেবে জয়নুলের প্রতি কামরুলের তরুণ মনে যে ভক্তি ও শ্রদ্ধা জন্মে সেই থেকে নিজেকে জয়নুল আবেদিনের সমতুল্য শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার মনে অদম্য আকাঙ্ক্ষা জন্মে। যার ফলে তিনি কখনো প্রত্যক্ষ এবং কখনো পরোক্ষভাবে সারা জীবন জয়নুলকে অনুসরণ করে চলেন।

বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সামাজিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগ, সমাজকল্যাণকর্ম প্রভৃতি দিক দিয়ে জয়নুলকে অনুসরণ করেন। এমনকি মৃত্যুর পরেও জয়নুলের পাশে নিজের স্থান করে নেন। জয়নুল আবেদিনের কবরের পাশেই কামরুল হাসান এখন চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ।

 

শিল্পী কামরুল হাসান
স্নান তেলরং ১৫০ x ৭৫ সেমি ১৯৬৬

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

শিল্পী কামরুল হাসান

 

আরও দেখুনঃ

Leave a comment