আজকে আমরা শিল্পী আমিনুল ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী গ্রন্থের অন্তর্গত।
শিল্পী আমিনুল ইসলাম
জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান বাদে বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে এস এম সুলতান অধিক নন্দিত এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বিপরীতে আমিনুল ইসলাম সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত ও সমালোচিত। এটার কারণ হলো মোট দু’টি একটা হলো পাশ্চাত্যের অনুকরণপ্রিয়তা, আর অন্যটি হলো উভয় সম্বন্ধে এদেশের শিল্পরসিক ও শিল্পানুরাগী এবং জনসাধারণের ভ্রান্ত ধারণা।
অনেকে আমিনুলকে পাশ্চাত্যের অনুকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। আবার অনেকে তাকে নতুন নতুন ধারার প্রবর্তনকারী হিসেবে অভিহিত করে থাকেন । কেউ কেউ তার স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা সম্বন্ধে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন, আবার অনেকে তা করেন না। আবার অনেকে তাকে নতুন নতুন পথের দিশারী হিসেবে উচ্চ প্রশংসা করেন ।
এমতাবস্থায় কার মত সঠিক আর কারটা সঠিক নয় সেটা বিচার করা শিল্পানুরাগী ও জনসাধারণের জন্য কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমিনুল সম্বন্ধে যথেষ্ট বিতর্ক ও বিভ্রান্তি দেখা যায়। অবশ্য এখনই যে তার সম্বন্ধে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে তা নয়, ভবিষ্যত তার বিচার করবে, যা অন্য সব কবি ও শিল্পীর ক্ষেত্রে হয়েছে বা হয়ে থাকে । তবে বর্তমানে তার মোটামুটি সঠিক মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। কারণ বর্তমান মূল্যায়নের উপর ভবিষ্যত মূল্যায়ন আংশিকভাবে নির্ভরশীল ।
জনমনে যতই বিতর্ক ও বিভ্রান্তি থাকুক না কেন, ঢালাও প্রশংসা পান আর না-ই পান, সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না । তার শিল্পচরিত্র এবং শিল্পকর্ম পরীক্ষা করলে মনে হয় যে, তার মধ্যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই, সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং আপন সিদ্ধান্তে অটল । তাই বলে যে তার কাজের ভেতর কিছুটা সম্পর্কহীনতা ও অসঙ্গতি ধরা পড়ে না, সে কথাও ঠিক বলা যায় না।
আমিনুলের সমস্ত কাজ সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করলে উর্ধ্ব লক্ষ্যের প্রবণতা দেখা যায়। অর্থাৎ এক ধারা থেকে অন্য ধারা, এক মতবাদ থেকে অন্য মতবাদ এবং এক পদ্ধতি থেকে অন্য পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াতে রূপান্তরিত না হয়ে আকস্মিকভাবে অন্যদিকে মোড় ঘুরেছেন । ফলে কাজের মধ্যে একদিকে যেমন ধারাবাহিকতা পুনঃ পুনঃ ব্যাহত হয়েছে অন্যদিকে তেমন দক্ষতা ও উৎকর্ষ বিঘ্নিত হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এ বিষয়টা বিশ্লেষণ করলে তার ভেতর বুদ্ধিজীবী অস্থিরতা প্রতীয়মান হয়।
অবশ্য তার কাজের ধারা ও ধরন যাই হোক না কেন, পক্ষপাতহীনভাবে যদি বিচার করা যায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, পাশ্চাত্যের অনুকরণ করা যদি সমালোচনা ও নিন্দার কারণ হয় তাহলে কেবল আমিনুল কেন এককভাবে অপরাধী হবেন? অনুকরণকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন? আর বিশেষভাবে এস এম সুলতান কেন প্রশংসার শিখরে অবস্থান করবেন? আর বিমূর্তবাদীদের মধ্যে মোহাম্মদ কিবরিয়াই বা কেন পুষ্পমাল্যে ভূষিত হবেন?
উপর্যুক্ত তিনজনকে তুলনামূলকভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, সুলতানের মধ্যে মধ্যযুগের পাশ্চাত্যের মহান শিল্পীদের অনুকরণ প্রবণতা উৎকৃষ্টভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর মোহাম্মদ কিবরিয়ার, বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তরকালের কাজের ভেতর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্ক রথকো ও বেন নিকোলসনের অনুকরণ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় । এদিক দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশের সকল শিল্পীকে (কেবল কয়েকজন ব্যতীত) বিশেষ করে বিমূর্তবাদী, অনুকরণকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় । অতএব, কেবল আমিনুলকে অনুকরণকারী হিসেবে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে অবশ্যই অবিচার করা হবে ।
পক্ষান্তরে, তার কাজগুলো সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করলে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি কেবল পাশ্চাত্যের বিমূর্ত ধারা, মতবাদ, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া, মাধ্যম প্রভৃতি অনুসরণ করেছেন । অর্থাৎ তিনি যেটা যেমন বুঝেছেন সেটা সেভাবে নিজের মতো করে নিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন । এদিক থেকে বিচার করলে তাকে ঠিক অনুকরণকারী বলা যায় কিনা। সেটা বিবেচনার বিষয়। সুতরাং তাকে অনুকরণকারী হিসেবে আখ্যায়িত না করে। আনায়নকারী হিসেবে মূল্যায়ন করাই অধিক যুক্তিসঙ্গত ।
শিল্পের অগ্রগতি ও প্রগতিশীলতার সময় বৈদেশিক প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ বিশেষ সময় বা যুগে বিশেষ বিশেষ মতবাদ ও ধারা প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ সময়ে বিশেষ শিল্পদর্শন গড়ে ওঠে। শুধু চিত্রকলা নয়, সাহিত্য, সংগীত, রাজনীতি, দর্শন প্রভৃতি সকল বিষয়ে এ কথা একইভাবে প্রযোজ্য। অতএব, আমিনুল যদি যুগের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে অনুকূল স্রোতে সাঁতার দিয়েই থাকেন তাতে এমন কিছু দোষণীয় বা নিন্দনীয় কাজ করেননি ।
তার বিষয়ে যে বিষয়টা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় সেটা হলো, সার্বিকভাবে এদেশের শিল্প আন্দোলন এবং বিশেষভাবে বিমূর্ত শিল্প আন্দোলন গড়ে তোলার পেছনে তার অমূল্য অবদান রয়েছে। এ কথা অকপটে স্বীকার করতে সংকোচ বা দ্বিধা করা। উচিত হবে না। বিশেষ করে যে সময় তিনি এদেশের মাটিতে বিমূর্ত শিল্প আন্দোলন শুরু করেন সে সময় বিমূর্ত শিল্পের জন্য খুবই অনুপযোগী ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিমূর্ত আন্দোলনের একজন অগ্রনায়ক হিসেবে তার উপর দিয়ে সমাজের সর্বস্তর থেকে সমালোচনার যে প্রবল ঝড় বয়ে যায়, সে ঝড়ের ঝাপটা সামলানো সহজ কথা নয়।
তার সমসাময়িক অনেকেই, যেমন- হামিদুর রহমান, মুর্তজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, নভেরা আহম্মেদ প্রমুখ শিল্পী সেই ঝড়ের ঝাপটা সামলাতে না পেরে এদেশ থেকে একরকম আত্ম-নির্বাসিত হয়ে যান। কিন্তু আমিনুল অত্যন্ত সাহসিকতা ও নির্ভীকতার সাথে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে, বলতে গেলে একাকী সংগ্রাম করতে থাকেন । এর ভেতর দিয়ে তার শিল্পী চরিত্রের যে দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের পরিচয় পাওয়া যায় তা একদিকে যেমন শ্রদ্ধার দাবি রাখে অপরদিকে তেমন বর্তমান ও ভবিষ্যতের শিল্পীদের জন্য শিক্ষণীয় ও গ্রহণীয় অনেক কিছু আছে ।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তার শিল্পী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং শিল্পকর্ম সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে; প্রথমত, অনুসন্ধিৎসু মন এবং দ্বিতীয়ত, উচ্চাকাঙ্ক্ষা । এই দু’টি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় তার ভেতর অমৃতের কাজ করেছে। অনুসন্ধিৎসার কারণে তিনি সবসময় নতুন নতুন পথের সন্ধান করে ফিরছেন। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে তিনি সবসময় নব নব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আত্মউৎঘাটন, আত্ম- উপলব্ধি ও আত্ম-প্রকাশের চেষ্টা করেছেন ।। সবসময় নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার ও উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন ।
আমিনুলের মধ্যে উপযুক্ত মনস্তাত্ত্বিক বিষয় দু’টি পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, পাবলো পিকাসোর চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও কর্মজীবন তার উপর দারুণ প্রভাব ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে । এমন মনে হয় যে, তার জীবনে পিকাসো আদর্শ শিল্পী হিসেবে গণ্য হয়েছেন । কিন্তু সচেতনভাবে হোক আর অসচেতনভাবেই হোক, আশ্চর্যের বিষয় যে, তিনি পিকাসোর কর্মজীবন অনুকরণ করলেও তার কাজের ভেতর পিকাসোর কোনো প্রভাব বা প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় না।
উপরন্তু, তিনি সব সময় নিজের স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ এক কথায় লিখা যায়, পিকাসোর কর্মজীবন অনুকরণ বা অনুসরণ করেছেন, তার শিল্পকর্ম নয় । তিনি কেবল তারপরেও তাকে এই অর্থে অনুকরণকারী বলা যায়, তিনি যেসব মতবাদ, ধারা, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া, মাধ্যম প্রভৃতি অনুসরণ ও চর্চা করেছেন তার একটাও নিজস্ব কল্পনা প্রস্তুত নয় বা উদ্ভাবনা নয়। সবই পাশ্চাত্য থেকে আনয়ন করেছেন ।
পূর্ব উত্থাপিত প্রশ্নের সূত্র ধরে বলা যায়, সুলতান এবং কিবরিয়া পাশ্চাত্যের অনুকরণকারী হওয়া সত্ত্বেও কেন এবং কেমন করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠলেন? কিবরিয়া কেমনভাবে নন্দিত ও সমাদৃত হলেন? আমিনুল কেন এত বিতর্কিত এবং সমালোচিত হলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে দু’টি প্রধান কারণ দেখা যায়; একটি হলো তাদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য আর অন্যটি হলো, তাদের বুদ্ধিমত্তা কর্মকাণ্ডের অর্থাৎ কাজের ধারা ও ধরন। তাদের তিনজনের মধ্যে তুলনামূলকভাবে সংক্ষেপে চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও কাজের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করলে বিষয়টা সহজে বোঝা যাবে।
সুলতানের সচেতন উদাসীনতা, মানসিক অস্থিরতা, খামখেয়ালি স্বভাব, ভবঘুরে জীবন, বাহ্যিক আচার-ব্যবহার এবং বেশ-ভূষা আর কাজের বৈশিষ্ট্য হিসেবে আত্মনিষ্ঠ (Subjective) বাস্তবধর্মী চিত্রকর্ম, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ যুগের মহান শিল্পীদের এবং খ্রিস্টীয় ভাবধারা অনুকরণে ছবির ভেতর পরীর ব্যবহার উপস্থাপনা, যা এদেশের জনসাধারণের প্রচলিত ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
স্বল্পভাষী কিবরিয়ার অত্যন্ত নম্র, বিনয়ী ও লাজুক স্বভাব জনসাধারণের মনে কিছুটা প্রচলিত কাব্যিক ধারণা সৃষ্টি করেছে। তার কাজের দিক থেকে বলা যায়, বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তরকালে বিমূর্ত প্রকাশবাদী কাজের দুর্বোধ্যতা ও অবোধগম্যতা, যা বুদ্ধিজীবী ভীতির কারণে শিল্পরসিক ও শিল্পানুরাগী, একদিকে নিজের অজ্ঞতা গোপন অপরদিকে জ্ঞান প্রচারের জন্য তাকে উচ্চ প্রশংসা করতে থাকেন। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কিবরিয়া একই মতবাদ ও মাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করেছেন । যেজন্য শৈল্পিক দক্ষতা ও উৎকর্ষ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন । এ কথা অস্বীকার করা যায় না।
কিন্তু আমিনুল তাদের বিপরীত। সুদর্শন আমিনুলের বিংশ শতাব্দীর যুগোপযোগী বাস্তবধর্মী জীবনযাত্রা, পরিচ্ছন্ন ফিটফাট পোশাক, চটপটে কর্মঠ ও স্পষ্টবাদিতা শিল্পরসিক ও জনসাধারণের প্রচলিত ধারণার পরিপন্থী।
আর তার বুদ্ধিমত্তা কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে বলা যায়, প্রথমত, তিনি যুগের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে অসময়োপযোগী, সম্পর্কহীন হয়ে পড়েন; দ্বিতীয়ত, প্রগতিশীলতার নামে আপন সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি উদাসীন ও অবজ্ঞা; তৃতীয়ত, বিশেষ করে ষাট দশকের মধ্যভাগ থেকে তার কাজের ভেতর এদেশের মানুষ ও মাটির প্রতিফলন পাওয়া যায় না অর্থাৎ সামাজিক সচেতনতার অনুপস্থিত; চতুর্থত, সৃজনশীলতা, প্রগতিশীলতা, আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা ও বিভ্রান্তি; পঞ্চমত, মতবাদ ধারা, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার স্বল্প স্থায়িত্ব এবং এক থেকে অন্যে দ্রুত পরিবর্তনের ফলে কোনোটিতে পরিপক্কতা, দক্ষতা ও উৎকর্ষ অর্জন করতে সবসময় সক্ষম হননি।
অবশ্য কিছু যে ব্যতিক্রম নেই তা বলা যায় না। তার বুদ্ধিমত্তা ও কর্মজীবন বিশ্লেষণ করলে তার মধ্যে বুদ্ধিজীবী অস্থিরতা, চঞ্চলতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে বিশেষ কোনো মতবাদ, ধারা, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই থেমে গিয়ে হঠাৎ অন্য নতুন কিছু শুরু করেছেন।
এমনও হতে পারে যে, কোনো এক ধারা ও প্রক্রিয়ায় কাজ করে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন যে, সেখান থেকে কেমনভাবে আরো অগ্রসর হতে হবে বা কোনদিকে অগ্রসর হতে হবে সে বিষয়ে বিভ্রাপ্তি ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হওয়ার কারণে হঠাৎ থেমে গিয়ে অন্য কোনো নতুন ধারা বা প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। যেজন্য তার কাজের ভেতর শৈল্পিক ও নান্দনিক বিষয়ের ধারাবাহিকতা বারে বারে ব্যাহত হয়েছে।
আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে, তিনি এদেশের শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনা না করে পাশ্চাত্য থেকে যা আমদানি করেছেন সেসব ঠিক সেইভাবেই এদেশে প্রবর্তন ও প্রচলন করার চেষ্টা করেছেন। ফলত তিনি সবসময় বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়েছেন। যাহোক, তার কাজগুলো বিচার করে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, তিনি এদেশে তার সময় থেকে অগ্রবর্তী এবং পাশ্চাত্য থেকে অনেক পশ্চাদবর্তী । ফলে তিনি এদেশেও বিতর্কিত ও সমালোচিত এবং পাশ্চাত্যেও অস্বীকৃত ।
আমিনুলের গঠনকালীন অর্থাৎ পঞ্চাশ দশকের কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, পাশ্চাত্যের উত্তর প্রতিচ্ছায়াবাদ এবং পিকাসোর ঘনকবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি পঞ্চাশ দশকে এদেশে ঘনকবাদ প্রবর্তন ও প্রচলনের চেষ্টা করেন। তখন আমিনুল বয়সে ছিলেন তরুণ এবং শিল্পী হিসেবেও বিশেষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলেন না।
ফলে ঘনকবাদের মূল বিষয় অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক বিষয়টা না বুঝে ঘনকবাদ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন । ফলে জ্যামিতিক আকারে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন । অতএব, এগুলোকে ঘনকবাদ বললে ভুল হবে। এই কাজগুলোকে ঘনকবাদের অপভ্রংশ বা জ্যামিতিক আকার বলাই সমীচীন হবে।
এতে একটা সুফল হলো যে, তার স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা অক্ষুণ্ণ থাকল এবং এক নতুন দিকের দিক নির্দেশনা পাওয়া গেল । তার ঐ সময়ের কাজের মধ্যে মাত্র কয়েকটি এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হলো— যেমন, ‘নৌকাগুলো (Boats)’, ‘নৌকার মাঝি (Boatsmen )’, ‘নিপীড়িত জনগণ (The distressed people)’ ‘পুরনো ঢাকা (Old Dhaka)’ প্রভৃতি।
উল্লেখিত কাজগুলোর ভেতর শৈল্পিক অর্থাৎ কলা-কৌশল ও নান্দনিক সমস্যার সাথে বিষয়বস্তুর উপরও সমভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়। যার মধ্যে তিনি উপরিভাগের সর্বময় নকশা (Surface Design) সৃষ্টি করেন।
তিনি সবকিছুকে মোট তিনটি জ্যামিতিক আকারে রূপ দিয়েছেন; চতুবর্গ, আয়তক্ষেত্র ও ত্রিভুজ আলোছায়া দ্বারা আকার গঠন না করে বস্তুর কাঠামো এবং অভ্যন্তরীণ গঠন অনুসারে আকার গঠন করেন । যেমন— নৌকার আকৃতি ও কাষ্ঠ খণ্ড, ছৈ, পাল ইত্যাদির কাঠামোগত আকৃতি অনুযায়ী আকার গঠন করেন এবং মানবদেহের কঙ্কাল ও পেশীর গঠন অনুযায়ী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জ্যামিতিক আকার গঠন করে এক সমতল সৃষ্টি করেন। সমস্ত আকারগুলোকে কালো রঙের সরল রেখা দ্বারা দুই-তৃতীয়াংশ, কখনো বা চতুর্দিক বেস্টন করে ইটের গাঁথুনির মতো একটার পর একটা সাজানো হয় । ফলে একটা বৃহৎ এককের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকগুলো একক সৃষ্টি হয় ।
তার প্রথমদিকের কাজের মধ্যে স্পন্দনশীল রঙের প্রাধান্য দেখা যায়। যেমন— লাল, হলুদ এবং পরিপূরক (Complimentary) রঙ হিসেবে সবুজ ও মাঝে মাঝে নীল রঙের সদ্ব্যবহার দেখা যায় । অর্থাৎ তিনি মৌলিক চারটা রঙের মধ্যে তার প্যালেট সীমাবদ্ধ রাখেন। রঙের ব্যবহারে দেখা যায়, তিনি এক রঙ অন্য রঙের সাথে মিশিয়ে মিশ্র ফলাফল সৃষ্টি করার পরিবর্তে প্রত্যেকটা রঙের আপন আপন স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা অর্থাৎ ইনটেনসিটি বজায় রেখে ব্যবহার করেছেন ।
বিশেষ করে লাল ও হলুদ রঙের ব্যবহারে তার স্বাচ্ছন্দ্য ও পারদর্শিতা উল্লেখযোগ্য । পরবর্তীতে আমিনুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার সমসাময়িক মোহাম্মদ কিবরিয়া এবং কাইয়ুম চৌধুরী জ্যামিতিক আকারে বিষয় বস্তুর উপস্থাপনা করেন। কিবরিয়াকে আবার আব্দুল বাসেত এবং শাহতাব অনুসরণ করেন। কিন্তু কিবরিয়া আমিনুল থেকে ভিন্নভাবে জ্যামিতিক আকার গঠন করেন।
আমিনুলের সমস্ত সরলরেখার পরিবর্তে কিবরিয়া কাজের মধ্যে সরল ও বক্র রেখার সমন্বয়ে ছন্দায়িত আকার গঠন করতে দেখা যায় । আমিনুলের ক্ষুদ্র আকারের বিপরীতে কিবরিয়া স্থূল আকার গঠন করেন। আর কাইয়ুম চৌধুরী আমিনুলের মতো সরলরেখা দ্বারা চৌকষ আকার গঠন করেন। তবে কাইয়ুমের চৌকষ আকারগুলো আমিনুলের চেয়ে স্কুল ।
কিন্তু আমিনুল এই ধারায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই ষাট দশকের শুরুতে ভিন্ন দিকে মোড় ঘোরেন। ফলে একদিকে তার ব্যক্তিগত উৎকর্ষ ও অপরদিকে এই ধারার অগ্রগতি ও উন্নতি ব্যাহত হয় এবং অল্পকাল পরেই লুপ্ত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নিত্যকার শিল্প-সমালোচকের অভাবে এই ধারাকে চিহ্নিত করার জন্য কোনো নামকরণ করা সম্ভব হয়নি এবং জাদুঘর বা চিত্রশালার অভাবে আর ঐ সময়ের কাজের নমুনা সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি ।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কোনো জাতীয় জাদুঘর ও জাতীয় চিত্রশালা না থাকায় এবং শিল্পকর্ম নিয়মিত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কোনো শিল্পীর কাজেরই ধারাবাহিকতা, পরিবর্তন, বিবর্তন, অনুধাবন ও পর্যালোচনা করা সম্ভব না। যে কারণে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের গতি, প্রকৃতি ও বিবর্তন পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করে মূল্যায়ন করার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে ।
ষাট দশকের শুরু থেকেই আমিনুলের কাজে আকস্মিক পরিবর্তন দৃষ্টি আকর্ষণ করে । তিনি পূর্বের জ্যামিতিক আকারে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা করার পরিবর্তে সম্পূর্ণ নিরাকার অর্থাৎ বিমূর্ত কাজ শুরু করেন। যার মধ্যে শুধু রঙ দ্বারা মূর্তকরণ ছাড়া আর কিছুই রইল না; যেমন— কালার সিম্ফনি, রীদম ইন কালার, সিম্ফনি অব কালার প্রভৃতি মাত্র কয়েকটি উদাহরণ হিসেবে এখানে উল্লেখ করা হলো । অবশ্য আমিনুল জ্যামিতিক আকার ত্যাগ করলেও কিবরিয়া, কাইয়ুম চৌধুরী, আব্দুল বাসেত ও শাহতাব উদ্দীন ঘাট দশকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত এই ধারার রেশ টেনে নিয়ে যান ।
পঞ্চাশ দশকের শেষ ভাগে আমিনুলের মধ্যে আরেকটা উন্নতি দেখা যায় । তিনি মোজাইক মাধ্যমে কিছু সুন্দর সুন্দর বাস্তবধর্মী শিল্পকর্ম রচনা করেন। পাকিস্তানের জালাল উদ্দীন আহম্মেদ লিখেছেন Aminul has tried his hand at everything from canvas paintings to woodcuts, lithograph, etching, but his special effort is his fluent acquired felicity for mosaic and frescoes on which he has recently concentrated with great enthusiasm. (আর্ট ইন পাকিস্তান, অধ ৬, পৃ. ১৪৯, অনু: ২)। এখানে উদাহরণ হিসেবে Girl with pigeon এবং Friends মাত্র দু’টি মোজাইকের উল্লেখ করা হলো ।
Girl with pigeon শীর্ষক মোজাইকের মধ্যে একজন তন্বী তরুণী মেঝের উপর উপুড় হয়ে দু’হাতের কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে অর্ধশায়িতাবস্থায় রয়েছে। তার হাত দুটো দু’দিকে ফাঁক করে খোলা। একটা শ্বেত কবুতর উড়িয়ে দিচ্ছে। কবুতরটা মুক্তি পেয়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে।
ভাবের দিক থেকে এ ছবিটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। কারণ মেয়েটার যত্ন ভালোবাসা পাওয়া সত্ত্বেও কি কবুতরটা অসুখী ছিল? তাই সহসা সুযোগ পেয়ে মেয়েটাকে ছেড়ে উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। না
কি মেয়েটা ইচ্ছে করে তার প্রাণপ্রিয় পাখিটাকে মুক্তি দিয়েছে? সে কি পাখিটা ফিরে পাওয়ার আশায় সাময়িকভাবে মুক্তি দিয়েছে, নাকি তাকে চিরমুক্তি দিয়েছে? সে কি পাখিটাকে ফিরে পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করবে? কবুতরটা কি আবার তার কাছে ফিরে আসবে? নাকি তাকে ছেড়ে চিরবিদায় নিয়ে উড়ে যাচ্ছে? পাখিটা কি বন্ধনের মধ্যে মুক্তির আনন্দ পেতে চায় নাকি মেয়েটার মধ্যে বন্ধনের স্বাদ পেতে চায়? এ নিয়ে শিল্পরসিক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হলেও মেয়েটার হাতের ভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, সে ইচ্ছে করেই পাখিটাকে মুক্তি দিয়েছে মনের আনন্দে উন্মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানোর জন্য।
আর এই মুক্তির ভেতর দিয়ে সে বন্ধনের ব্যথা উপলব্ধি করতে চায়। এ বন্ধন সেই বন্ধন যে বন্ধনে মানুষকে সমস্ত স্বার্থপরতা, ঈর্ষা, সংকীর্ণতা, লালসা, কামনা, বাসনা থেকে মুক্তি দিতে পারে । এই বিয়োগান্তক নাটক সৃষ্টির ভেতর দিয়ে আমিনুলের দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা ও আদর্শবাদের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এদিক থেকে বিচার করে আমিনুলকে একজন রোমান্টিক, আদর্শবাদী দার্শনিক শিল্পী হিসেবে অভিহিত করলে ভুল হবে না ।
ভাবের দিক থেকে বিতর্কিত হোক আর নাই হোক, এটা নিঃসন্দেহে একটা সুন্দর মোজাইক শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করা যায়। বিষয়বস্তুর চয়ন, উপস্থাপনা, আকার গঠন প্রভৃতি সবকিছু মিলিয়ে সহজ সরলভাবে রয়েছে, যা সরাসরি দর্শকের মন স্পর্শ করে । বস্তুত তিনিই একমাত্র শিল্পী যিনি সর্বপ্রথম মোজাইক শিল্পের সাথে এদেশবাসীকে পরিচিত হওয়ার সুযোগ দেন। কিন্তু তখন এদেশে মোজাইক শিল্পের একেবারেই চাহিদা ছিল না । তাছাড়া ব্যয়বহুল বটে ।
যেজন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে তিনি নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। তবে তার কাজগুলো দু’দশক পরে প্রায় আশির দশকে এদেশে মোজাইক শিল্পের পথ প্রশস্ত এবং সুযোগ ও সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করে দেয়, যা বর্তমানে অনেক তরুণ শিল্পীদের মধ্যে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
তেল মাধ্যমে তিনি বিমূর্ত কাজ করলেও মোজাইকগুলো প্রায় সবই বাস্তবধর্মী ছিল । অবশ্য কিছু যে বিমূর্ত ছিল না, তা নয়; যেমন- ঢাকার ডিআইটি মার্কেট-এর দেয়ালে করা মোজাইকের কথা উল্লেখ করা যায়।
ষাট দশকের প্রারম্ভ থেকে তার কাজের মধ্যে দারুণ পরিবর্তন দেখা গেল । তার ঐ সময়কার এবং পরবর্তী কাজ বুঝতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প আন্দোলনের অগ্রগতি ও উন্নতি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা থাকা দরকার । তা না হলে তার আধুনিক ও অত্যাধুনিক কাজগুলো বোঝা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প আন্দোলন সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে পাশ্চাত্য দেশগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দ্রুত গতিতে নব নব আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে শিল্প আন্দোলনের ক্ষেত্রেও নতুন নতুন উদ্ভাবনা ও সম্ভাবনার উন্মেষ ঘটে । ফলে নতুন নতুন মতবাদ, ধারা, মাধ্যম, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া উদ্ভাবন শুরু হয়ে যায়, যা কালক্রমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আর দ্রুত রূপান্তরের ফলে সমস্ত মতবাদ, ধারা, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া স্বল্পমেয়াদি হয়, কোনোটাই ঠিক যেন দানা বাঁধতে পারেনি । সেই ঢেউ আমিনুলকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
তিনি ক্যানভাসের উপর তুলি দিয়ে রঙ লাগানোর পরিবর্তে সূতিবস্ত্র, চট ইত্যাদির ব্যবহার শুরু করেন । এসব বস্ত্র টুকরা সরাসরি সিনথেটিক বা এমালশন রঙের বড় বড় টিনের মধ্যে ডুবিয়ে রঞ্জিত করে নিয়ে ম্যাসোনাইড বার্ডের উপর এমনভাবে সংযুক্ত করেন যে, ছোট বড় নানারকম ভাজ সৃষ্টি হয়। আবার কখনো রঞ্জিত বস্ত্ৰ ম্যাসোনাইড বোর্ডের উপর মসৃণভাবে সংযুক্ত করে তার উপর খাবলা খাবলা রঙ এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন ।
কখনো আবার পুরু মোটা করে লাগানো রঙের মধ্যে তুলির উল্টো পাশ দিয়ে অথবা কোন কঠিন পদার্থ দিয়ে আঁচড় কেটে কেটে হিজিবিজি রেখা সৃষ্টি করেন । পুরু রঙের মধ্যে মোটা তুলি দিয়ে গভীরভাবে আঁচড় কেটে ক্যানভাসের এক প্রাপ্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত নিজের নাম উৎকীর্ণ করেন । কোনো সময় তার, তারকাঁটা, তারের জাল ইত্যাদি কাঁচা রঙের মধ্যে বসিয়ে দেন। এবড়ো থেবড়ো অমসৃণ উপরিভাগের উপর আলো পড়ে আলোছায়ার নাটক সৃষ্টি হলো ।
তার এসব কাজ আমাদের জন্য কোনো বাণী বা তথ্য বহন করে না । তবে এগুলো বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের বিশেষ এক সময়ের তথ্য হিসেবে গণ্য করা যায়। সেদিক থেকে এসবের গুরুত্ব কিন্তু কম না । এসব কাজগুলো এখন কোথায় কেমনভাবে কি অবস্থায় আছে সে সম্বন্ধে কিছু বলা সম্ভব না। এখানে সকলকে একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, বিংশ শতাব্দীর চারুশিল্পের ধারা ও ধরন এবং দার্শনিক মতবাদ প্রচলিত ধারণা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও ভিন্ন।
সুতরাং, এসবের মধ্যে কোনো বাণী বা তথ্য বা দার্শনিক ভাব উদঘাটনের চেষ্টা করা বাতুলতা মাত্র। এসব কাজ পরোক্ষভাবে কিছুটা কারিগরির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এগুলোকে সাধারণত মূর্তকরণ এবং পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াগত শৈল্পিক সমস্যার ধারাবাহিক কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে । যেজন্য দু’চারটে কাজ সবসময় পৃথকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। এগুলোকে সামগ্রিকভাবে বিচার করতে হয়।
আমিনুলের কাজগুলো পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা করলে তার ভেতর অস্থিরতার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় । তিনি ঠিক কি করতে চান তা যেন নিজেও ঠিকভাবে জানেন না, যা সার্বিকভাবে বিংশ শতাব্দীর সব শিল্পীর মধ্যে দেখা যায়। অতএব, তার ঐসব কাজ বুঝতে হলে বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলার প্রকৃতি, ধারা ও ধরন এবং অত্যাধুনিক অগ্রগতি ও উন্নতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
তবে তার সম্বন্ধে এ কথা বলা যথেষ্ট যে, তিনি বিশেষ কোনো পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াতে সন্তোষজনক দক্ষতা ও উৎকর্ষ অর্জন করার আগেই হঠাৎ থেমে গিয়ে অন্যদিকে মোড় ঘুরেন । তার দ্রুত ও বারংবার পরিবর্তন প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে নিমপ্লিখিত কারণগুলো দেখা যায়।
১. নতুন নতুন উদ্ভাবনা ও সম্ভাবনার পথ সৃষ্টির জন্য বুদ্ধিজীবী অস্থিরতা এবং নিজেকে বহুমুখী প্রতিভাবান শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অদম্য বাসনা;
২. নিজেকে পিকাসোর সমতুল্য আসনে উন্নীতকরণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা,
৩. পাশ্চাত্য চিত্রকলা সম্বন্ধে বিশ্লেষণাত্মক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ও অস্পষ্টতা:
৪. সৃজনশীলতা ও প্রগতিশীলতা সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণার কারণে অতিরিক্ত প্রতীচ্য প্রীতির ফলে পাশ্চাত্যের উপর নির্ভরশীলতা ও অনুকরণ প্রীতি এবং এক ধরনের অনিশ্চয়তা তাকে বিতাড়িত করে নিয়ে বেড়ায় ।
উপর্যুক্ত কারণগুলোর আলোকে বলা যায়, কোথা থেকে কোনদিকে কেমনভাবে অগ্রসর হতে হবে সে বিষয়ে অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয় । ফলত তার কোনো এক সময়ের কাজের সাথে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কাজের ভেতর সম্পর্কহীনতা ও অসঙ্গতি বিশ্লেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।
মোটকথা হলো, ষাট দশকের শুরু থেকে তার মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন প্রবণতা, দ্বন্দ্ব, দ্ব্যর্থকতা, অনুকরণ প্রবণতা তার সমস্ত চিন্তা-চেতনা ও কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে । এতে তার দক্ষতা ও উৎকর্ষ কতটা অর্জিত হলো সেটা বিতর্কিত বিষয় ।
তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, সার্বিকভাবে এদেশের শিল্প আন্দোলন এবং বিশেষভাবে বিমূর্ত আন্দোলনে বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন, যা পরবর্তী দশকে উত্তরসূরিদের অনুপ্রেরণা ও উৎস হিসেবে কাজ করেছে। যেজন্য স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে অপরের কাছ থেকে গ্রহণ করার মনমানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ এক কথায় বলতে হয়, সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়ে শিল্পের বিচারে এদেশবাসীর দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা ব্যাপকতা ও উদারতা সৃষ্টি হয়েছে ।
স্বাধীনতা উত্তরকালে তিনি কিছু দিন পরাবাস্তবধর্মী কাজ করেন। এই আঙ্গিকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার প্রচেষ্টা করেন। এসব চিত্রকর্মের ভেতর দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের হৃদয় বিদারক ঘটনার উপস্থাপনার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্বল উপস্থাপনা, সুষ্ঠু রচনাশৈলীর অভাব এবং অদক্ষ ট্রিটমেন্টের জন্য তিনি সফল হতে পারেননি। কারণ পরাবাস্তব তার সংজ্ঞার পরিপন্থী। তার এ কাজগুলোর ভেতর ঠিক মুক্তিযুদ্ধের আভাস পাওয়া যায় না । তৎপরিবর্তে ভীতিকর মায়া বা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয় ।
যাহোক, এরপরে তার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ধারাবাহিক দর্পণ কোলাজ এবং কাগজ কোলাজ । মাধ্যম, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার সাথে অন্তর্নিহিত ভাব ও বিষয়বস্তু ও সমগুরুত্ব লাভ করে । এ কাজগুলো পরীক্ষা করলে মনে হয়, দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাসংকুল জীবন-জগতকে যেভাবে তিনি উপলব্ধি করেছেন সেই মহান সত্য তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন।
এ কাজগুলোর মধ্যে একদিকে এক মহান সত্যের উপলব্ধি এবং অপরদিকে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় পাশাপাশি মূর্ত হয়ে উঠেছে। তার ধারাবাহিক দর্পণ ও কাগজ কোলাজের ভেতর স্বার্থপর, আমি বহু হতে চাই, সময়ের অতিক্রম মাত্র কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো-
স্বার্থপর শীর্ষক কলাজ সম্বন্ধে আমিনুলের নিজের ভাষ্য হলো, পৃথিবীর সমস্ত মানুষই স্বার্থপর । স্বার্থপরতার কারণে মানুষ নিজের মুখাবয়ব ও সর্বাঙ্গ দেখার জন্য আয়না আবিষ্কার করেছে। আমাকে কেমন দেখায়, আমি কত সুন্দর নাকি কুৎসিত, নিজেকে দেখা ও জানার এই বাসনাই মানুষকে আয়না আবিষ্কার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে । আদি মানুষের মধ্যেও দেখা যায়, তারা কোনো একটা পাত্রে পানি রেখে তার মধ্যে তার নিজের মুখচ্ছবি দেখে আনন্দ উপভোগ করত। এই বাসনা থেকেই মানুষ কালক্রমে আয়না আবিষ্কার করেছে ।
আমিনুলের ব্যাখ্যা যুক্তিসঙ্গত । কিন্তু দর্পণ কোলাজের ভাবের গভীরতা এত ব্যাপক ও সূক্ষ্ম যে বিশ্লেষকগণ চিন্তায় ধ্যানমগ্ন হয়ে নিজের মধ্যে নিজেই হারিয়ে যান । বস্তুতঃ দর্পণ জীবন-জগতের যে উপলব্ধি তারই প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে, আয়না কখনও মানুষের বিবেক, সামাজিক অবস্থা ও পরিবেশ, কখনো সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, আবার কখনো প্রেম ও আত্ম-উপলব্ধির প্রতীকী প্রকাশ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন— ইংরেজ শাসনামলে, ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত, এদেশের দরিদ্র নীল চাষীদের উপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালায় তাই দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ শীর্ষক নাটকের মধ্যে প্রতিফলিত হয়।
আবার ব্রিটিশ শাসনামলে দরিদ্র মুসলমান কৃষকদের উপর হিন্দু জমিদারগণ যে অমানুষিক নিপীড়ন ও অত্যাচার চালায় তারই বাস্তব প্রতিচ্ছবি মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকের মধ্যে চিত্রায়িত হয়ে উঠে ।
বস্তুত মানুষের মধ্যে যে মেধাশক্তি রয়েছে তারই প্রতীকী প্রকাশ হলো আয়না বা দর্পণ। মানুষ জ্ঞানবুদ্ধির দ্বারা ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে থাকে। জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের মধ্যে বিবেকের জন্ম হয়ে থাকে। তারই সাহায্যে মানুষ ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের ভেতর পার্থক্য নির্ণয় ও বিচার করতে পারে ।
আবার আয়না কখনো প্রেমের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে । উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত কবি মির্জা গালিব তার অনেক কবিতার মধ্যে আয়নাকে প্রেমের ও বিবেকের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন । এখানে তার দু’টি চরণ উদ্ধৃত করা যাক । কবি প্রেমিকের হৃদয়ের অনুভূতিকে এভাবে প্রকাশ করেছেন
“আব ম্যায় হুঁ আওর মাতুমে এ্যক শাহরে আরজু
তোড়া জো তুনে আয়না তো মিসালে দার থা”।
বাংলায় এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, যদি একটা আয়না ভেঙে টুকরো টুকরোও হয়ে যায়, তাহলেও প্রতিটি টুকরোর মধ্যে বস্তুর পূর্ণ প্রতিচ্ছবি বা প্রতিফলন দেখা যায় । তেমনিভাবে যদি প্রেমিক প্রেমিকা প্রেম বিচ্ছেদের বিরহে কাতর হয়ে পড়ে তখন সে তার চারিদিকের সবকিছুর মধ্যে তার প্রেমিকার প্রতিফলন দেখতে পায় বা অনুভব করে । তখন প্রেম আর ব্যক্তি-কেন্দ্রিক থাকে না, সার্বজনীনতা লাভ করে এক পরম সত্য, এক পরম আত্মার সাথে একাত্মতা সৃষ্টি হয়। এখানে কবি প্রেমের সার্বজনীনতা ও সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রতীক হিসেবে ‘আয়না’ ব্যবহার করেছেন ।
তাছাড়াও মানুষ জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের সাহায্যে আত্ম-বিশ্লেষণ ও আত্ম- সমালোচনার মধ্য দিয়ে আত্ম-উপলব্ধি করতে পারে, এক মহান সত্যকে জানতে পারে, পরম সত্তার সাথে একাত্মতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এই আত্ম-বিশ্লেষণ ও আত্ম- উপলব্ধি প্রতীক হিসেবে আয়না ব্যবহার হয়েছে বা হয়ে থাকে। মানুষ একদিকে উৎপাদনশীল এবং অন্যদিকে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে যেমন নিজেকে প্রকাশ করে তেমন নিজেকে উপলব্ধি করে ।
দর্শনশাস্ত্রের সক্রেটিসের ‘know theyself’ অর্থাৎ নিজেকে জানো বলে একটা কথা আছে । জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে মানুষের আত্ম-প্রকাশের যে প্রচেষ্টা এবং জ্ঞানবুদ্ধি দ্বারা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে যে আত্ম-উপলব্ধি জাগে তা মানুষকে সসীম থেকে অসীমের দিকে নিয়ে যায়। জীবন-জগত সম্বন্ধে সম্যক ধারণা, যে ধারণা এক মহাসত্যের সাথে একাত্মতা সৃষ্টি করে, পরম আত্মার সাথে একাত্মতা উপলব্ধি করতে সহায়তা করে তাই হল নিজেকে জানা।
রবীন্দ্রনাথের ‘বসুন্ধরা’ কবিতার মধ্যে আমিত্বের যে উপলব্ধি এবং কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্যে “আমিত্বের’ যে বিভিন্ন প্রকাশ দেখা যায়, এই উভয় ভাবের যে ব্যঞ্জনা রয়েছে, আমিনুলের দর্পণ কলাজের মধ্যে সেই উভয় ভাবের যৌথ ব্যঞ্জনা অনুরণিত হয়েছে ।
দর্পণ কোলাজে তিনি মিশ্র মাধ্যম ব্যবহার করেছেন। প্রথমে তিনি তেলরঙ দিয়ে কিছুটা অংশ এঁকেছেন তারপরে রঙ মোটা পুরু করে লাগিয়ে তার মধ্যে অনেকগুলো ছোট ছোট আয়না বসিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তেলরঙ ব্যবহারের কলা-কৌশলগত অদক্ষতা হতাশাব্যঞ্জক।
কলা-কৌশলগত কারণে রঙ স্বচ্ছতা ও ঔজ্জল্য হারিয়ে একেবারে ময়লা কাদাকাদা হয়ে গেছে। ফলে এগুলো ভাবের দিক থেকে যতই গভীর ও সূক্ষ্ম হোক, শিল্পের বিচারে যতটা আবেদন সৃষ্টি করতে পারত ততটা আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি।
দর্পণ কোলাজ খুব স্বল্পমেয়াদি হয় । এই পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় সন্তোষজনক অগ্রগতি ও উৎকর্ষ অর্জন করার আগেই তিনি পাশ কাটিয়ে কাগজ কোলাজ আরম্ভ করেন। কাগজ কোলাজেও তিনি সাদা-কালো ও রঙিন আলোকচিত্রের পাশাপাশি তেলরঙ ব্যবহার করেন । তবে কাগজ কোলাজে তেলরঙ ব্যবহার দর্পণ কোলাজের তুলনায় অনেকটা আশাব্যঞ্জক ৷
বৈদেশিক নানা পত্রপত্রিকা থেকে নানা রকম আলোকচিত্র সংগ্রহ করে সেগুলো আঠা দ্বারা ক্যানভাসের উপর এমনভাবে সংস্থাপন করেন যে তা থেকে একটা তথ্য বা বাণী পাওয়া যায় । কাগজ কোলাজের সাথে কিছু কিছু জায়গায় তেলরঙ ব্যবহার করেন।
প্রত্যেকটা ছবির জন্য অত্যন্ত সতর্কভাবে বিশেষ ধরনের আলোকচিত্র এমনভাবে মনোনয়ন করে সাজানো হয়েছে যে, তা থেকে কোনো ঘটনা বা কাহিনী সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের আলোকচিত্রগুলো এমন সুচিন্তিত ও পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে পরস্পরের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত হয়ে যৌথভাবে একটা তৃতীয় কাহিনী বা ঘটনা সৃষ্টি হয়েছে ।
প্রত্যেকটা আলোকচিত্র আপন আপন বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ও সত্তা হারিয়ে ফেলে তৃতীয় একটা ভিন্ন কাহিনী সৃষ্টি হয়েছে। এখানে আমিনুলের চিন্তার স্বচ্ছতা ও শৈল্পিক দক্ষতা প্রশংসার দাবি রাখে। উদাহরণস্বরূপ সময়ের অতিক্রম (টাইম বিয়োন্ড) এবং “” (শিরোনাম না জানা থাকায় দুঃখিত) একটা যুদ্ধরত জাতির সামাজিক অবক্ষয়ের ছবি এখানে উল্লেখ করা হল ।
সময়ের অতীত শীর্ষক কোলাজে একটা বড় আকারের দেয়াল ঘড়ির কাঠামোর মধ্যে কয়েকজন বলিষ্ঠ ক্রীড়াবিদদের আলোকচিত্র সংস্থাপন করা হয়েছে। তাদের ঠিক নিচের ঘড়ির পেন্ড্রালাম দেখা যাচ্ছে। ঘড়ির বিপরীতে সমস্ত অগ্রভূমিতে রেখা দ্বারা দাবার ছকের মতো ভাগ করা হয়েছে। সমস্ত ছকগুলো চারদিকে ক্রমশ এক বিন্দুতে মিলিত হবার প্রবণতা । ক্রীড়াবিদদের রঙিন আলোকচিত্রটা ছাড়া অবশিষ্টাংশ তেলরঙে আঁকা হয়েছে।
এটার মধ্যে দেখা যায়, কয়েকজন ক্রীড়াবিদ দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত রয়েছে । এখনই দৌড় শুরু হবে। শিল্পী এখানে বলতে চেয়েছেন যে, মানুষ প্রতি মুহূর্তে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছে । মানুষ এক দিকে যেমন সময়ের সাথে পাল্লা দিচ্ছে তেমন পরস্পর পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতামূলকভাবে পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছে- কে কার আগে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছাতে পারে। মানুষ যেন সময়কে জয় করতে চায়। সময়কে জয় করার প্রবণতার মধ্যে দিয়ে পাশ্চাত্যের বিংশ শতাব্দীর মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে । কিন্তু সময় অনন্ত, সময়ের শুরু নেই শেষও নেই। কিন্তু জীবন সসীম, তার শুরু আছে শেষও আছে। তাই মানুষ জীবনের এই স্বল্প সময়ের মধ্যে জীবনের ঈস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায় ।
জীবন-আনন্দ-বেদনা, ঘাত-প্রতিঘাত যতই থাকুক না কেন, জীবন এক মুহূর্তের জন্য থেমে থাকে না । মানুষের জন্মের পর থেকেই এ দৌড় শুরু হয় আর মৃত্যুতে শেষ হয় । একজনের দৌড় শেষ হয় আরেকজনের শুরু হয়। এ দৌড়ের শেষ নেই । এই কোলাজটির মধ্যে গতিবাদ ব্যক্ত হয়েছে ।
তার জন্য একটি কোলাজের মধ্যে যুদ্ধরত একটা জাতির সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিফলন দেখতে পাই। এটার মধ্যে একদিকে সামরিক তৎপরতা এবং অপরদিকে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র আমাদের সামনে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। যুদ্ধ সমাজকে অবনতির শেষ সীমায় নামিয়ে দেয় । মনুষত্বের লোপ পেয়ে অবক্ষয় ঘটে,
মনুষত্ব ও কল্যাণের পরিবর্তে পশুপ্রবৃত্তি সমাজকে গ্রাস করে, সেটাই এখানে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে। আলোচিত কোলাজের মধ্যে দেখা যায়, কয়েকটি উদ্বাস্তু পরিবার অসহায়ভাবে বসে আছে । অন্য একটা আলোকচিত্রে দেখা যায়, সামরিক বাহিনীর কয়েকজন লোক রাখাইন থেকে ফিরে সুরা-নারী নিয়ে মত্ত হয়ে আছে। বামদিকে বড় একটা অণুবীক্ষণ যজ্ঞ। ঠিক তার নিচের দু’জন নর-নারীকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা যাচ্ছে ।
বিশেষ করে এই আলোকচিত্রের মধ্যে যদিও কিছুটা অশ্লীলতা দেখা যায় তবুও সমস্ত আলোকচিত্রগুলো মিলিতভাবে যে কাহিনী সৃষ্টি হয়েছে তাতে অশ্লীলতা চাপা পড়েছে । যুদ্ধের কারণে মানুষের যে দুঃখ-দুর্দশা সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে তাই আমিনুলের মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তারই ফলস্বরূপ যুদ্ধের প্রতি তার দারুণ ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে।
কিন্তু ভাব যতই গভীর হোক আর উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক, শিল্পের বিচারে এগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতটা আছে সেটা বিচার করতে হবে। আগেই বলা হয়েছে যে, তার বিশেষ করে দর্পণ এবং সার্বিকভাবে কাজগুলোকে দার্শনিক ভাবের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তেলরঙ ব্যবহারে কলা-কৌশলগত দুর্বলতার জন্য যতটা আবেদন সৃষ্টি করতে পারবে বলে আশা করা হয়েছিল ততটা আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া, এগুলো তার আপন কল্পনায়।
অর্থাৎ কোলাজ তার আপন কল্পনা প্রসূত বা উদ্ভাবিত না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোলাজের পুনরাবৃত্তিমাত্র । অবশ্য উৎসর কথা না হয় বাদই দেয়া গেল । তবে কলা-কৌশলগত দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, তার কাগজ কোলাজের ভেতর তেলরঙের ব্যবহার অনেকটা সফল হয়েছে ।
কাগজ কোলাজের ভেতর যেসব আলোকচিত্র ব্যবহার হয়েছে তার মধ্যে আমাদের সমাজ, পরিবেশ ও সংস্কৃতির যেমন কোনো প্রতিফলন নেই তেমন আমাদের জীবনবোধও যৌথ-অসচেতনতারও কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। উপরন্তু, পাশ্চাত্যের সমাজ ও সংস্কৃতি প্রাধান্য পেয়েছে। অবশ্য এটার কারণ এই হতে পারে যে, তিনি কাগজ কোলাজের ভেতর দিয়ে যেসব আলোকচিত্র ব্যবহার করেছেন সেগুলো সব পাশ্চাত্যের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ।
অতএব, এদিক থেকে বিচার করলে সহানুভূতি উদ্রেক করে। তবে একথা বলা যায়, ষাট দশকের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে অত্যাধুনিক অগ্রগতি দেখা যায় এগুলো তারই পুনরাবৃত্তি। অতএব, আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারা ও প্রবাহে এগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিতর্কিত হতে পারে। কিন্তু বিবেচনার বিষয়।
এই কোলাজটির সাথে তার আগের কিছু পরাবাস্তববাদী কাজের মধ্যে বিষয়বস্তুর দিক থেকে কিছু সামঞ্জস্য পাওয়া যায় । পরাবাস্তব আঙ্গিকে আঁকা কিছু কাজের ভেতর মানুষের মাথার খুলি, অর্ধ-কঙ্কাল, হাত ও পায়ের হাড় ইত্যাদি পড়ে আছে । কিন্তু কেবল মানুষের কিছু মাথার খুলি, কঙ্কাল ও হাড়-গোঁড় থাকলেই সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা অন্য কোনো যুদ্ধের উপস্থাপনা হবে সে নিশ্চয় করে বলা যায় না। এটা দুঃস্বপ্নও হতে পারে।
যেহেতু এগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকালে আঁকা হয়েছে সেহেতু এগুলোকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে ভুল করা অস্বাভাবিক নয় । এই পরাবাস্তব রচনা কৌশলের দিক থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলা যায় । বিষয়বস্তু একত্রে কেন্দ্রীভূত না হয়ে ক্যানভাসের চারদিকে ছড়িয়ে আছে। এটাকে কেন্দ্রবিহীন রচনা বললে হয়তো ভুল হবে না। কিন্তু বিষয়বস্তু চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে ক্যানভাসের মধ্যস্থলে কিছুটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। রচনাশৈলীর দিক থেকে ডিগাসের অনেক কাজের সাথে সামগ্রস্য পাওয়া যায়।
তার নিজস্ব ভাষ্যনুযায়ী তিনি কোন এক আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনীতে কোনো এক শিল্পীর আঁকা একটা শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হন । যার ভেতর দু’জন দাবাড়ু ধ্যানমগ্ধ হয়ে দাবার চাল ভাবছে । কিন্তু উভয়ে চাল দিতে দিতে দাবার গুটিগুলো এমন এক জায়গায় উপনীত হয়েছে যে, গুটিগুলো ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে- কোনটি সাদা আর কোনটি কালো তা পৃথক করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় উভয় খেলোয়াড় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে । ছবিটা না দেখলে তার অন্তর্নিহিত ভাব বুঝতে অসুবিধা হয় ।
তারপর থেকে আমিনুলের ক্যানভাসগুলো ধূসর হয়ে উঠল। তবে উপর্যুক্ত শিল্পকর্মটার অন্তর্নিহিত ভাব এবং আমিনুলের কাজ ও ভাবের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। বলে মনে হয়। (বিদেশের শিল্পকর্মটা আমার দেখা নেই বলে উভয়ের মধ্যে সঠিক পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব হল না)।
তবে পার্থক্যের কারণ হিসেবে দু’টি সম্ভাবনা ধরা যায়; প্রথমত, উল্লিখিত কাজের অন্তর্নিহিত ভাবের সূক্ষ্মতা না বুঝে কিছুটা ভাসা ভাসা ভাবে দেখেছেন ফলে তার ভেতর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে অথবা ঐ কাজের অন্তর্নিহিত ভাবরস গ্রহণ করে তাই নিজের মতো করে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন; দ্বিতীয়ত, তিনি নিজস্ব স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে মূল ভাবকে বিশ্লেষণাত্মকভাবে সম্প্রসারিত ও ব্যাপকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। সে যাই হোক, তার ধূসর বর্ণের কাজগুলো সফল হয়েছে বলা যায় না।
ভাবের দিক থেকেও বক্তব্য অস্পষ্ট। যেমন— একটা ছবির মধ্যে দেখা যায়, একজন লোক নগ্নাবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এবং রচনার নিচের ডানদিকে নিচের কোণায় ধূসর রঙে আঁকা পাবলো পিকাসোর একটা বাস্তব প্রতিকৃতি ।
কিন্তু মূল বিষয়বস্তুর সাথে পিকাসোর প্রতিকৃতির কি সম্পর্ক আছে বা এটা উপস্থাপনারও যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে কি পিকাসো সমকামী ছিলেন এ কথা বলতে চেয়েছেন আমিনুল? তা যদি হয় তাহলে এ ছবিটা হয়ত একেবারে অর্থহীন বলা যায় না। কারণ ইদানীং যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইউরোপে অনেক মনোবিজ্ঞানী পিকাসোর কাজ ও জীবন চরিত বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে ‘স্যাডিস্টিক’ প্রবণতা ছিল বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
বিশেষ করে পিকাসোর তৃতীয় স্ত্রী হেলেন পফ্রাঙ্কেয়ার ‘My life with Picasso’ শীর্ষক আত্ম-চরিত বা কাহিনী বিশ্লেষণ করলে পিকাসোর মধ্যে ‘স্যাডিস্টিক’ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আর স্যাডিস্টিক প্রবণতা থেকে সমকামীতার জন্ম হয় । এদিক থেকে আমিনুলের এ কাজের কিছুটা সমর্থন পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে পিকাসোর মৃত্যু হয়। অতএব, ধরে নেয়া যায় যে, তার প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার প্রতিকৃতি উপস্থাপন করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠ ও প্রবীণ শিল্পীদের প্রতি অনেকেই শ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকেন। কিন্তু জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এ নিয়ে যদি বাড়াবাড়ি করা হয় তাহলে তাকে ভাড়ামি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
অন্য আরেকটা ছবির মধ্যে একইভাবে একজন পুরুষকে নগ্নাবস্থায় উপস্থাপন করা: হয়েছে। তামাটে রঙের নরমূর্তির এখানে ওখানে ধূসর বর্ণের চতুর্বর্গে আড়ালে ঢাকা পড়েছে । তার একটা হাত অর্ধ-ভাঁজ করা অবস্থায় একটা চতুর্বর্গের উপর রাখা আছে এবং তলপেটের নিচের অংশ আর একটা চতুর্বর্গের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। এতে বোঝা যায়, শালীনতা ও সামাজিক মূল্যবোধের কারণে তিনি নরমূর্তির নিম্নাংশ আবৃত করার চেষ্টা করেছেন । কিন্তু এতে নগ্নতা বেশি প্রকাশ পেয়েছে, যা অশ্লীল বলে মনে হয় ।
আমিনুলের বিবস্ত্র উপস্থাপন বিশ্লেষকদের কৌতূহল উদ্রেক করে। কারণ সাধারণভাবে দেখা যায়, শিল্পীরা অকলুষতা, নিষ্পাপ, পবিত্রতা, কামনা-বাসনা, প্রলোভন-মোহ-মায়া, সৃষ্টি-ধ্বংস, স্নেহ-মমতা, প্রেম-ভালবাসা, উৎস-অনুপ্রেরণা প্রভৃতির প্রতীক হিসেবে বিবস্ত্র নারীমূর্তি উপস্থাপন করে থাকেন।
অর্থাৎ এক কথায় জীবন জগত সম্পর্কে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি আবার কোনো কোনো সময় অতিন্দ্রিয়ানুভূতির প্রতীক হিসেবে নারীমূর্তি উপস্থাপন করে থাকে । কিন্তু আমিনুল ব্যতিক্রম দেখা যায় । কেবল মাইকেল অ্যাঞ্জেলা এবং রাশিয়ান শিল্পী আলেকজান্ডার নভোকভ-এর কাজের মধ্যে নরমূর্তি প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ মাইকেল অ্যাঞ্জেলা শৌর্য- বীর্য, শক্তি-পরাক্রম, অদুর্জেয়তা, অদুর্দমনিয়তা প্রভৃতির প্রতীক হিসেবে বিবস্ত্র নরমূর্তির উপস্থাপনা করছেন।
তাছাড়া, তিনি বাইবেলের কাহিনী চিত্রায়ণ করেছেন এবং আলেকজান্ডারও মাইকেল অ্যাঞ্জেলার মতো বাইবেলের অর্থাৎ ধর্মীয় বিষয়বস্তুর উপস্থাপন করছেন । সুতরাং আল্লাহ মানুষকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তিনি সেইভাবেই রূপ দিয়েছেন ।
মাইকেল অ্যাঞ্জেলার মতে ‘The beauty of a woman is to love not to paint’ কিন্তু আমিনুলের পুরুষরা শাস্ত, ভাবলেশহীন স্বাভাবিক সুস্থ দেহের । অতএব, তার বিবস্ত্র নরমূর্তি উপস্থাপন স্বাভাবিকভাবেই বিশ্লেষকদের কৌতূহলোদ্দীপক। অবশ্য কোনো কোনো বিশ্লেষক ও মনোবিজ্ঞানী মাইকেল অ্যাঞ্জেলার সমকামিতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ।
তাহলে কি আমিনুল সমকামী? কারণ তার নরমূর্তি শৌর্য-বীর্য, শক্তি- পরাক্রম প্রভৃতির প্রতীক নয় । কারো কারো মনে এমন প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয় ৷ কিন্তু কেবল কয়েকটি কাজের মধ্যে বিবস্ত্র নরমূর্তির উপস্থাপনার উপর নির্ভর করে নিশ্চিতভাবে এ কথা বলা ঠিক হবে না । বিশেষ করে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে যতদূর
জানা যায় তাতে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তার বিবস্ত্র নরমূর্তি উপস্থাপনার কারণ মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি সম্ভাবনা দেখা যায়: প্রথমত, তার ভেতর সমকামিতার প্রবণতা জন্মাতে পারে;
দ্বিতীয়ত, তার জীবনে যেসব ঘাত-প্রতিঘাত ও সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নির্যাতন প্রবণতা (স্যাডিস্টিক) সৃষ্টি হয়েছে;
তৃতীয়ত, বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং সার্বিকভাবে সারা বিশ্বে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে যে অন্যায়, অবিচার ও ধ্বংস চলছে এবং জীবন-জগত সম্বন্ধে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাল্টা আক্রমণাত্মক প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে । আবার এমনও হতে পারে যে, উল্লিখিত তিনটি কারণ যৌথভাবে অবচেতন মনে নির্যাতন প্রবণতা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক নয় ।
তার বিবস্ত্র নর-নারী উপস্থাপনার মধ্যে আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় যে, তিনি যদিও কিছুটা জোর করে নিজেকে মধ্যবিত্ত সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কারের ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টা করেছেন তবুও মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ও সংস্কার মুক্ত হতে পারেননি। উপরন্তু, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ও সংস্কারের প্রতি শ্রদ্ধাই বেশি প্রকাশ পেয়েছে। কারণ তার বিবস্ত্র নর-নারীর বিশেষ বিশেষ অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো তিনি সবসময় দর্শকদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছেন । এতে এ কথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, সংস্কারমুক্ত হতে চাইলেই সংস্কারমুক্ত হওয়া যায় না । এখানে উর্দু কবি গালিবের দু’টি চরণ স্মরণ করা যায়:
হার চাঁদ সুবুকদস্ত বুদশীকনি ঘেঁ
হাম হ্যাঁ তো রাহোঁ মে সংগেগেরাঁ আওর।’
এটার বাংলা অর্থ হল, আমি সনাতন রীতিনীতি, প্রচলিত সংস্কার ও মূল্যবোধ প্রভৃতির সব পাষাণ মূর্তি ভেঙে চুরমার করে ফেলেছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে বাঁধা পাহাড়ের মতো আমার পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে, তা হলো আমার বিবেক । আবার ইংরেজ লেখিকা ভার্জিনিয়া উল্ফের উক্তির মধ্যেও একই সংস্কারবোধের কথা ধ্বনিত হয়েছে: “While I was writing this review, I discovered that if I was going to review books I should need to do betray with certain phantoms and the phantom was a woman I called her the angel in the house. It was she who used to come between me and my paper when I was writing reviews, bothered me and wasted my times and so tormented me ”
তেল মাধ্যমে আঁকা অস্ত্রোপচারের আগে বা পরে একটি বাস্তবধর্মী শিল্পকর্ম । একজন রমণী সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে দর্শকদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে আছে । ক্যানভাসের একেবারে নিচের কোণায় (ডানদিকে) একটা টুলের উপর এক জোড়া সার্জিক্যাল দস্তনা ও একটা স্থেটিসকোপ রাখা হয়েছে। নারীমূর্তিটা প্রায় সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে নিয়েছে । টুলটা ক্যানভাসের নিচের কিনারায় কেটে গেছে ।
গাঢ় অন্ধকার পশ্চাদভূমির বিপরীতে আলোক উদ্ভাসিত নারীমূর্তিটা বেরিয়ে এসেছে। মাথার চুল অন্ধকার পশ্চাদভূমির সাথে প্রায় মিশে গেছে। আলো-অন্ধকার বিষয়বস্তুকে নাটকীয় করে তুলেছে। ট্রিটমেন্টের দিক থেকে অনেকটা চেয়ারেঞ্চুরো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে।
স্বচ্ছ উজ্জ্বল রঙের সুন্দর বিন্যাস, দক্ষ ও নিপুণ ট্রিটমেন্টের জন্য রমণীর দেহের সুন্দর ত্বকের মসৃণতা, কোমলতা ও নমনীয়তা সুন্দরভাবে অনুভব করা যায়। রঙের ব্যঞ্জনা এবং আলো-আঁধারের নাটক সৃষ্টির ফলে রমণীর সর্বাঙ্গে যেন আলোর ঝর্ণা বইছে । রমণীর দেহের পেশীর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের পরিবর্তে স্থল আকার গঠন করা হয়েছে। অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মাস ড্রইং’। আলোছায়ার বৈপরীত্য সৃষ্টি না করে।
এমনভাবে টোন বিন্যাস করা হয়েছে যে, সর্বাপেক্ষা আলোকিত স্থান ক্রমশ অন্ধকারের সাথে মিশে সুরের দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে, যা তার শৈল্পিক দক্ষতা ও নৈপুণ্য প্রমাণ করে । এখানে এ কথা বলা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, তিনি প্রায় দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে। বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন, তৎসত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত বাস্তবধর্মী ছবি আঁকতে তার দক্ষতা অক্ষুণ্ণ রয়েছে । যাহোক, সবদিক থেকে বিচার করলে এটা তার একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ শিল্পকর্ম হিসেবে উল্লেখের দাবি রাখে ।
কিন্তু দস্তানার ট্রিটমেন্টে কিছুটা আড়ষ্টতা অনুভব করা যায়। দস্তানা কোনো শক্ত পদার্থ বা মোটা কাপড় দ্বারা তৈরি বলে মনে হয় । ফলে এটা কোনো সার্জিক্যাল দস্তানার পরিবর্তে খেলোয়াড় বা লোহার মিস্ত্রি অথবা বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির দস্তানা বলে মনে হয় । এক কথায় দস্তানার ট্রিটমেন্টে প্লাস্টিক কোয়ালিটির অভাব রয়েছে ।
দস্তানা ও স্থেটিসকোপ অবতারণার জন্য ছবিটির ভেতর দ্ব্যর্থক ভাব সৃষ্টি হয়েছে । আসন্ন অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় রোগিনী বসে আছে নাকি অস্ত্রোপচারের পরে বসে আছে ঠিক বোঝা যায় না । তবে ধরে নেয়া যায় যে, অস্ত্রোপচারের পূর্ব মুহূর্তে রোগিনী বসে অপেক্ষা করছে। দস্তানা ও স্থেটিসকোপ অবতারণা করে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা দেখা যায়। বিষয়বস্তুর দিক থেকে এ ছবিটা টমাস একিন্স-এর দ্য ক্লিনিক এবং উপস্থাপনার দিক থেকে টিসিয়ানের দ্য বাথারস-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
অবশ্য দস্তানা ও স্থেটিসকোপের উপস্থাপনা থেকে বোঝা যায়, আমাদের মতো ধর্ম গোড়া রক্ষণশীল সমাজে বিবসনা নারীমূর্তি সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে বিবেচনা করে তিনি এটাকে বিশেষ অর্থবোধক করার জন্য পরবর্তীতে দস্তানা ও স্থেটিসকোপ সংযুক্ত করেছেন। তাছাড়াও, দর্শকদের মনে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য এগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো পরবর্তীতে যোগ করার ফলে পরিপ্রেক্ষিত বহির্ভূত মনে হয় । কিন্তু এগুলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না ।
আজ আমিনুল প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠ পেরিয়ে বার্ধক্যে পদচারণা করছেন । বয়স ষাটের কিছু ঊর্ধ্বে হবে । কিন্তু দৈহিক বার্ধক্য এলেও তার মধ্যে এখনও যে কর্মোদ্দম, উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আগ্রহ এবং কঠোর পরিশ্রম ক্ষমতা রয়েছে এবং চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে যে সজীবতা রয়েছে সেদিক থেকে তাকে তারুণ্যের চেয়েও তরুণ মনে হয় । তার কাছে অনেক তরুণ নবীন শিল্পীও লজ্জা পায়। নব নব আবিষ্কার, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা এবং
অনুসন্ধিৎসা শুরু থেকে তার জীবনে যে গতি সঞ্চার করেছে তা এখনও শিথিল হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না । আর এই অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষাই তার জীবন এবং কর্মের ভেতর বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে । এদিক থেকে বিচার করে তাকে একজন দৃষ্টান্তমূলক শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় । তবুও বলতে হয় যে, তিনি বৈচিত্র্যময় কল্পনার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিস্ময়কর হতে পারেননি বা ছাঁচে ঢালা প্রশংসা অর্জন করে জনপ্রিয় হতে পারেননি ।
আমরা যারা আমিনুলকে কাছ বা দূর থেকে কমবেশি দেখেছি তাদের কাছে তিনি একজন বিংশ শতাব্দীর বিমূর্তবাদী শিল্পী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই অত্যাধুনিক মানুষটার মধ্যে যে একজন দার্শনিক চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে তা তার বিশেষ করে দর্পণ ও কাগজ কোলাজ এবং আলোচিত কিছু কাজের ভেতর সাক্ষ্য পাওয়া যায় ।
তিনি সারা জীবন এখান থেকে সেখান থেকে স্থান-কাল-পাত্র, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে যার মধ্যে যা কিছু ভালো পেয়েছেন মৌমাছির মতো একটু একটু করে সঞ্চয় করেছেন, তারই লব্ধ ফসল হলো তার আলোচিত শিল্পকর্মগুলো। যার ভেতর তার সংবেদনশীল মন এবং জীবন-জগতের নানাবিধ সমস্যাবলীর অধিভাসিক উপলব্ধি প্রকাশের প্রচেষ্টা দেখা যায়।
যাহোক, আমিনুলের চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং বুদ্ধিমত্তা কর্মকাণ্ড মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দু’টি বিষয় লক্ষ্য করা যায়; প্রথমত, কিছুটা জোর করে নিজেকে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ প্রভৃতি সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা এবং দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত আত্ম-বিশ্বাস এবং প্রগতিশীলতার নামে প্রতীচ্য প্রীতি । ফলে কিছুটা বিপথগামী হয়ে পড়েন বলা যায় ।
যেজন্য ষাট দশকের পর থেকে কাজের মধ্যে এদেশের মাটি ও মানুষের অনুপস্থিতি স্পষ্ট অনুভব করা যায়। অবশ্য অনেক শিল্পরসিক ও সমালোচক শিল্পের প্রগতিশীল ও আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রশ্ন তুলে সাধারণ দর্শক ও অনুরাগীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারেন । অথবা এটা বিতর্কিত বিষয় হতে পারে। কিন্তু একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, আপন সমাজ ও সংস্কৃতি উপেক্ষা করে কেউ কোনো দিন প্রগতিশীল হতে পারে না।
উপরন্তু, যে বুদ্ধিমত্তা কর্মকাণ্ডের মধ্যে আপন সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিফলন থাকে তাই স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সকলের কাছে নন্দিত ও স্বীকৃত হয়ে থাকে । তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:
“ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া দেখি নাই শুধু চক্ষু মেলিয়া
ধানের শীষেতে একটি শিশির বিন্দু”।
আবার ‘কেলিনু শৈবালে তুলি কমল কানন’ উক্তির মধ্য দিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত একই আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন ।
আমিনুলের মতো একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিল্পী যে নিজের জাতের জন্য কিছু মূল্যবান অবদান রাখবেন এমন প্রত্যাশা করা অতিরিক্ত কিছু না। এটাই আমাদের একমাত্র কাম্য।
আরও দেখুনঃ