আজকের আলোচনার বিষয় : চিত্রিত পদ্মাপুরাণের পুথি। যা বাংলার চিত্রকলা ( মধ্যযুগ থেকে কালীঘাট) এর অন্তর্গত।
চিত্রিত পদ্মাপুরাণের পুথি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিশালায় আশ্চর্য এক ‘পদ্মাপুরাণ‘-এর পুথি সংরক্ষিত আছে, পুথিটির ৩৯টি পাতা চিত্রিত। অল্পস্বল্প চিত্রিত কিছু বাংলা পুথি আছে কিন্তু এতগুলো রঙিন চিত্রের সংবাদ বাংলা পুথির ক্ষেত্রে খুব বেশি পাওয়া যায় না। পুথিটি প্রাক্-ঔপনিবেশিক বাংলার চিত্রকলার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক আর পুথিশালার প্রধান সাহিন সুলতানার সৌজন্যে পুথিচিত্রগুলোর আলোকচিত্র সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।

টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার ভররা গ্রাম থেকে সংগৃহীত পুথিটি ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে (অনুলিপি) নারায়ণ দেবের ‘পদ্মাপুরাণ’ বা ‘মনসা মঙ্গল’। পনেরো শতকের শেষার্ধ্বে বা ষোলো শতকের কবি নারায়ণ দেব ময়মনসিংহের বার গ্রামে জন্মেছিলেন বলে সাহিত্য-ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন। পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল অঞ্চলে নারায়ণ দেবের ‘পদ্মপুরাণ’ জনপ্রিয় ছিল। তমোনাশচন্দ্র দাশগুপ্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪২-এ, আর ঢাকার শাজাহান মিয়া ঢাকা থেকে ১৯৯৩-এ ‘পদ্মাপুরাণ’-এর দুটি সুসম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশ করেন, এছাড়া আরও সংস্করণ হয়তো থাকবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ তমোনাশ দাশগুপ্ত টাঙ্গাইলের গোপালপুর থেকে পদ্মপুরাণের পুথি সংগ্রহ করেছিলেন।
বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-নৃত্যে মনসার কাহিনির এক বিশিষ্ট স্থান আছে। আজও বঙ্গভাষী বিভিন্ন অঞ্চলে মনসার গান হয়, বরাক উপত্যকায় হয় নৌকাপূজা, এর সঙ্গে গুরমার নৃত্য ও ওঝা নৃত্যও মনসা ও সর্প সম্পর্কিত। রাঢ়েও কাঠের নৌকা তৈরি করে নৌকা পূজার কথা জানা যায়, ঝাপান হয়। বীরভূমের সাপনাচানির গানও মনসা সম্পর্কিত।

শুধু বাংলা নয় হিন্দি ও অসমিয়াতেও মনসা কাব্য রচিত হয়েছে, রচিত হয়েছে রাভা ভাষায় । বাংলা ভাষায় মনসামঙ্গল তিন ধারার ১ রাঢ় ও দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গ ২. পূর্ববঙ্গ ৩. উত্তরবঙ্গ। বাংলায় পনেরো শতকের আগে লিখিত কোনো মনসামঙ্গলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এক কানা হরি দত্তের কথা বিজয়গুপ্ত উল্লেখ করেছেন যিনি পনেরো শতকের পূর্ববর্তী হতে পারেন। অনেককাল ধরেই মনসার আখ্যান পূর্ব ভারতে প্রচলিত আছে। দীনেশচন্দ্র সেন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য গ্রন্থে ৬২ জন মনসামঙ্গলের কবির কথা উল্লেখ করেছেন, তমোনাশ দাশগুপ্ত প্রায় সত্তর জনের কথা বলেছেন। এর পরেও আরও মনসা আখ্যানের সন্ধান পাওয়া গেছে, সব মিলিয়ে মনসামঙ্গল রচয়িতার সংখ্যা একশোর কাছাকাছি হতে পারে।
এই সংখ্যা থেকে অনুমান করা যায় মনসামঙ্গল বঙ্গজনের মধ্যে কতটা জনপ্রিয় ছিল, আজও বিবিধ আঙ্গিকে মনসা পূজার প্রচলন আছে, তার সঙ্গে গানের। পটুয়ারা এখনও মনসাপট আঁকেন, বিভিন্ন সংগ্রহশালায় অসংখ্য মনসাপট সংগৃহীত হয়েছে। আর একটি উল্লেখ্য বিষয় হলো মনসা নিম্নবর্গের মধ্যেই সর্বাধিক চর্চিত, যদিও উচ্চবর্ণের মধ্যেও মনসাপূজার প্রচলন আছে।

বাংলা সাহিত্যের মনসার আগমণের আগেই বাংলার শিল্পে মনসার আবির্ভাব হয়েছে। আশুতোষ মিউজিয়ামে আনুমানিক ১০ম শতাব্দীর একটি মনসার ভাস্কর্য আছে, কোটালিপাড়া থেকে প্রাপ্ত। এছাড়া আশুতোষ মিউজিয়ামে আরও একটি সমকালীন মনসামূর্তি আছে। একাদশ শতাব্দীর একটি প্রস্তর মূর্তি আসামের নগঁও জেলায় প্রাপ্ত অসমের রাজ্য সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত। এছাড়া বহু সংখ্যক মূর্তি পাওয়া গেছে। পোড়ামাটির বহুরকমের ভাস্কর্য মনসাকে কেন্দ্র করে হয়েছে, যেমন মনসাঘট ও মনসা চাল।
বাংলার সংস্কৃতিতে মনসা বা পদ্মার এই জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে বলা যায় মনসা মূলত নিম্নবর্গের দেবী যদিও উচ্চবর্ণেও তিনি পূজিতা। উচ্চবর্ণে আসার জন্য মনসাকে চণ্ডীর সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তবেই তিনি উচ্চবর্ণে আসন পেয়েছেন। মনসার যে বিভিন্ন থান তাতে উপাসনায় যোগ দেন মূলত নিম্নবর্গ এবং আদিবাসীর। এ পর্যন্ত যত দীঘল পট বা লাটাই পট পাওয়া গেছে তার এক পশ্চমাংশ হবে মনসার পট, যারা এই পট আঁকছে তারাও নিম্নবর্গের। নৌকাপূজার যে বিশাল আয়োজন তাতেও নিম্নবর্গের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।
বিভিন্ন কবির লেখা মনসামঙ্গলের মোট সংখ্যা অন্য সব মঙ্গলকাব্যকে ছাড়িয়ে গেছে এবং বিভিন্ন বর্ণের কবিরা লিখেছেন। বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে মনসার প্রকাশ এই জনপ্রিয়তার জন্য। উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে বাঙালি শিল্পীদের পুথিচিত্র, পাটা, পট, সরা, ঘট সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়। অবনীন্দ্রনাথের ‘বাংলার ব্রত’তে সে পরিচয় পাওয়া যায়, অবনীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ চিত্রায়ণে লোকায়ত পুথিপট চিত্রের অবলম্বন দেখা যায়। নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী, যামিনী রায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘গ্রামীণ ও লোকশিল্পকে অবলম্বন করে বহু শতাব্দী ধরে বাংলার সমাজ যে অপূর্ব লোকের সৃষ্টি করেছিল সে শিল্পলোক ছিল ভাবসম্পদে সমৃদ্ধ এবং দ্যোতনায় তুলনাহীন।’

আমাদের আলোচ্য পুথির চিত্রগুলো বাংলার লৌকিক ধারার। চিত্রগুলো পদ্মপুরাণের বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রগুলোর চিত্রায়ণ, মনসার ছবি, দুর্গা, কালী, শিবের ছবি, বিষ্ণুর অবতারদের ছবি (দশাবতারের বদলে ছবিতে ৭ জন অবতারকে পাওয়া যাচ্ছে)। বেহুলা লখিন্দরের ছবি, কার্তিক (কার্তিক আবার যুদ্ধ করছেন ময়ূরে চড়ে), সাপের একাধিক ছবি, চিৎকাররত জন্তুদের ছবি। মনে হয় লিপিকার নিজেই চিত্রকর, একটি পৃষ্ঠার মধ্যে লেখা ও ছবি দু’রকমই রয়েছে কোথাও ছবি লেখার মধ্যে ঢুকে পড়ছে।
লিপিকার কাটাকুটি করে তার ওপর ছবি এঁকেছেন সাপের, জন্তুর, ছবির নিচের লেখাটি দেখা যাচ্ছে, এ এক ধরনের ডুডলিং। হয়তো বাংলা পুথিতে ডুডলিং-এর প্রথম নিদর্শন। প্রচলিত অঙ্কন শৈলীর সঙ্গে কোনো মিল নেই। ছবিগুলো দেখে নকশিকাঁথার অবয়ব ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের সরার আঁকা ছবি এমনকি টাঙ্গাইল শাড়ির নকশার কথা মনে করিয়ে দেয়। কোথাও যেন মধুবনির সঙ্গে একটা সাদৃশ্য রয়েছে। ছবিগুলো দেখিয়ে আলোচনা করছিলাম শিল্প ঐতিহাসিক ড. টি. কে. বিশ্বাস, চিত্রকর অমিতাভ ভট্টাচার্য ও ভাস্কর অনীতা ভট্টাচার্যের সঙ্গে।
এই বিরল চিত্রগুলোর বিশেষত্ব সম্পর্কে এঁরা অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। শাড়িতে যেমন বুনে নকশা করার ব্যাপার থাকে এখানেও সেইভাবে এঁকে নকশা করা হয়েছে। নর-নারী দেবদেবীর বেশভূষায় আর রয়েছে কাঁথার মতো মোটিফ। মাঝে মাঝে ছবির মধ্যে একটি পদ্ম আঁকা হয়েছে কালোয়। রেখাগুলো ভাঙা ভাঙা এবং অপরিশীলিত। চিত্রগুলো কোথাও কোথাও এরোটিক মনে হতে পারে। লিপিকার-চিত্রকর হয়তো স্থানীয় লোকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা পাশাপাশি সরা-কাঁথা- ঘট-পুতুল-শাড়ির শিল্পীদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে থাকবেন।
এখানে যেমন বিষ্ণুপুরি শৈলীর ছাপ নেই তেমন পারস্য বা মোগল শৈলী অনুসরণের কোনো লক্ষণ নেই, ইংল্যান্ডের শিল্পীরা এ পুথি চিত্রিত লিখিত হওয়ার আগেই এসেছেন, সেই শৈলীর কোনো ছায়াপাত নেই। প্রচুর বিন্দু আঁকা হয়েছে, ছোপ দেওয়া হয়েছে, ছোটো ছোটো রেখা ভেঙে স্থানপূরণ হয়েছে। এ ধরনের বিন্দু ও ভাঙা রেখার ব্যবহার শাড়ি ও কাঁথায় প্রচুর দেখা যায়। পূর্ববঙ্গে প্রচলিত মনসার ঘটের অপেক্ষাকৃত গাঢ় ছোটো ছোটো রেখার কথা মনে পড়ে।
পদ্মার সর্পভূষণ, হাতে ধরা সাপ তাঁকে চিহ্নিত করছে। পাতায় পাতায় ছবির ভেতরে আঁকা পদ্মফুলের অলংকরণ। পুথির লিখিত অংশের মতো চিত্রিত অংশের জমিতে রং নেই, কোনো আস্তরণ বা কোটিং-এর ওপরও ছবিগুলো আঁকা হয়নি। শিবের রংটি কাগজের মিশ্র সাদা রং থেকে আলাদা করার জন্য উজ্জ্বল সাদা রং ব্যবহার করা হয়েছে, সম্ভবত শামুকের খোলার গুঁড়ো থেকে।”
মধ্যযুগে কোনো বাংলা পুথিতে এতগুলো রঙিন চিত্র পাওয়া যায় না। এদিক থেকেও পুথিটি উল্লেখযোগ্য। যেসব বহুবর্ণ চিত্রিত পুথি বাংলায় রচিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখ ‘ভাগবতপুরাণ’ (১৬৬২, সরসীকুমার সরস্বতী সংগ্রহ)। ‘রামচরিত মানস’ (১৭৭৫, আশুতোষ মিউজিয়াম)। ‘গীতগোবিন্দ’ (উনিশ শতক, চুঁচুড়া) এগুলো কোনোটাই বাংলা ভাষার নয় তবে বাংলার শিল্পীরা অবশ্যই এই পুথিচিত্রকরদের মধ্যে ছিলেন।
‘রামচরিতমানসের পুথিটির ৩৪৩ পৃষ্ঠাই চিত্রিত। এটি উড়িষ্যা চিত্র শৈলীর সঙ্গে মেদিনীপুরের আঞ্চলিক শৈলীর মিশ্রণের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। পুথিটি বাংলা না হলেও শিল্পীরা বাঙালি বা বাংলায় বসবাসকারী ছিলেন। উৎকৃষ্ট পুথিচিত্র শৈলীর জন্য পুথিটি বিখ্যাত। এটির সঙ্গে এর ২০ বছর পরে চিত্রিত ‘পদ্মপুরাণে’র তুলনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে ‘পদ্মপুরাণ’ আরও বেশি লৌকিক প্রাকৃত।
‘রামচরিতমানস’-এর চিত্র শৈলী মেদিনীপুর অঞ্চলের পরবর্তী চিত্রকলায় দেখা গেছে ‘পদ্মপুরাণের শৈলী শাড়ি-সরা-কাঁথার নকশায়। পূর্ববঙ্গ থেকে প্রাপ্ত দীঘল পটচিত্রেও এই ধরনের অঙ্কন দেখতে পাওয়া যায় না। ঢাকায় বা বর্তমান বাংলাদেশে আরও কয়েকটি চিত্রিত পুথি আছে সেগুলো দেখার সুযোগ হয়নি তাই পদ্মপুরাণের পুথিচিত্রের সমধর্মী আর কোনো পুথিচিত্র আছে কিনা বলা যায় না। ঢাকা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত পাটাচিত্রগুলোও আমাদের আলোচিত তিনটি ধারার মধ্যে পড়ে যায়।
দুর্ভাগ্য এই যে, বাংলার মধ্যযুগের পুথিচিত্র নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সমৃদ্ধ কোনো নিবন্ধের কথা আমাদের জানা নেই। পুথির পাটা বা পুথিচিত্র নিয়ে লেখা হয়েছে খুবই অল্প, শিল্পের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে, অঙ্কন শিল্প নিয়ে আলোচনা বিরল। পালযুগের চিত্রকলা’তে যে গবেষণা, শ্রম ও বিশ্লেষণ করেছেন প্রয়াত সরসীকুমার সরস্বতী অধুনা সে প্রয়াস আর দেখা যায় না। এখনও বাংলার চিত্রকলার মধ্যযুগের ধারা সম্পর্কে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে গেল ।
আরও দেখুনঃ