শিল্পী হামিদুর রহমান

আজকে আমরা শিল্পী হামিদুর রহমান সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী গ্রন্থের অন্তর্গত।

 

শিল্পী হামিদুর রহমান

 

শিল্পী হামিদুর রহমান

আমিনুল ইসলামের সহপাঠী ও সমসাময়িক হামিদুর রহমানকে বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলন, বিশেষ ভাবে বিমূর্ত শিল্প-আন্দোলনের একজন অন্যতম অগ্রনায়ক হিসেবে গণ্য করা হয় । বস্তুত জয়নুল আবেদিন এদেশে শিল্প-আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যে কয়েকজন বিশ্বস্ত উত্তরাধিকারীকে নিয়ে শুভযাত্রা শুরু করেন হামিদুর রহমান তাদের মধ্যে একজন অন্যতম উল্লেখযোগ্য শিল্পী।

কিন্তু ঢাকার চারুকলা বিদ্যালয়ে মাত্র দু’বছর প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরে তিনি এ বিদ্যায়তন ত্যাগ করে সরাসরি পাশ্চাত্যের উন্নত ধারা ও পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য প্যারিসের অ্যাকোল-ডেজবজ আর্টস-এ অধ্যয়ন করেন । ঢাকার চারুকলা বিদ্যায়তন ত্যাগ করার কয়েকটি কারণ থাকতে পারে, যেমন-

১. সম্ভবত তৎকালীন ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে কর্মরত শিক্ষকদের (জয়নুল আবেদিন বাদে) মেধা, বুদ্ধিমত্তা এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতির উপর তার আস্থা ছিল না এবং নিজেকে বড় মনে করতেন ।

২. এদেশে শিল্প-আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা ।

৩. ইনস্টিটিউটের প্রচলিত প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া এবং সার্বিক পরিবেশে অস্বস্তিবোধ ।

৪. প্রচলিত ইন্দো-ইংলিশ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের চেয়ে সরাসরি ঘাঁটি পাশ্চাত্য ধারায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ শ্রেয় বিবেচনা করেন । ও পদ্ধতিতে

৫. স্বাধীন, উন্নত ও প্রগতিশীল মনোভাবের জন্য পাশ্চাত্য ধারা প্রশিক্ষণ গ্রহণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

কিন্তু পাশ্চাত্য প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। পঞ্চাশ দশকের মধ্যভাগ অর্থাৎ ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকায় প্রথম বিমূর্ত চিত্রকলার একটি একক প্রদর্শনী করেন । তার প্রদর্শিত চিত্রকলার ভেতর অর্ধ-পরিচিত আকার ব্যবহার করেন এবং বিষয়বস্তুর উপস্থাপন করেন। যার মধ্যে এদেশের সামাজিক ও পরিবেশের প্রতিফলন থাকে । অবশ্য তার সমস্ত কাজের মধ্যে সমাজ ও পরিবেশের চেয়ে শিল্পের দার্শনিক দিকটাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তবুও সমাজের সর্বস্তর থেকে সমালোচনার প্রবল ঝড় ওঠে ।

এই প্রদর্শনী সম্বন্ধে সাঈদ আহম্মেদ লিখেছেন: “সেই প্রদর্শনী রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল” (Contemporary Art series of Bangladesh – 31. পূ. ৩য়, অনু ৪র্থ)। কিন্তু কবি শামসুর রাহমান ভিন্ন মত পোষণ করেন; “As far back in 1956 his solo art exhibition in Dhaka could not attract the imagination of art connoisseur’s much, although some found in him promises of a confident artist.” (Contemporary Art series of Bangladesh-31, পৃ. ৪র্থ, অনু: – ৪র্থ)।

উপরে উদ্ধৃত উক্তি থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, শিল্পী জীবনের আরম্ভ থেকে রহমান পুষ্পমাল্যে ভূষিত হয়ে রাতারাতি সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেননি । তিনি যা অর্জন করেছেন সেজন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে । সম্ভবত তিনি তীব্র সমালোচনা সহ্য না করতে পেরে আত্ম-নির্বাসিত হয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজধানী করাচি মহানগরে বাস করা শ্রেয় মনে করেন । বস্তুত তিনি আত্ম- নির্বাসিত হয়ে সারা জীবন বিদেশে বসবাস করেছেন।

একটা উড্ডীয়মান ঘুড়ি যেমন মহাশূন্যে অবস্থান করলেও মাটির সাথে তার সম্পর্ক থাকে তেমন রহমানও সারা জীবন বিদেশে বাস করলেও স্বদেশের মানুষ ও মাটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেন নি । একথা সত্য যে, সারা জীবন বিদেশে বসবাস করার জন্য এদেশের শিল্প-আন্দোলনে তার ভূমিকা যৎকিঞ্চিৎ। এতদ্বসত্ত্বেও তিনি যে সামান্য অবদান রেখে গেছেন তা এদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ।

তার কাজগুলো পরীক্ষা করলে বোঝা যায়, তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও নিরীক্ষক প্রকৃতির ছিলেন । এদেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, নানাবিধ সমস্যা প্রভৃতি তার মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। ফলে এদেশের সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সামাজিক সমস্যা, সাংস্কৃতিক সমস্যা, জাতীয় সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, এসব কিছু তার শিল্পকর্মের প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে অগ্রাধিকার পেয়েছে, যার ভেতর দিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনবোধ প্রকাশ পেয়েছে।

শিল্পের জন্য শিল্প এই মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে ব্যক্তিস্বার্থের ক্ষুদ্র গহ্বরে বাস না করে সাধারণ মানুষের সাথে মিলেমিশে একাত্মতা উপলব্ধি করেছেন। জাতীয় সমস্যাকে ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ।

তার সুন্দর বাকপটুতা, মধুর ব্যক্তিত্ব, সূক্ষ্ম ব্যঙ্গবোধ, বিশ্লেষণক্ষমতা প্রভৃতি তার চরিত্রের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল। শিল্পের দার্শনিক মতবাদ ও আবেদনের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, হামিদুর রহমান ও জয়নুল আবেদিন একই সুরে বাঁধা। তার কাজগুলো শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বিমূর্ত এবং বাস্তববাদের সংমিশ্রণ বলা যায় । তার কাজ থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বুদ্ধিমত্তার মারপ্যাচ দেখানোর ভান না করে সহজ-সরল আকার সৃষ্টি করেন। রঙের ব্যবহারে সামস্য রক্ষা করেন। তার কাজের মধ্যে আবেগ প্রবণতার চেয়ে যুক্তি বেশি।

 

শিল্পী হামিদুর রহমান

 

কবি শামসুর রাহমান বলেছেন “One characteristic of Hamidur Rahman is that he has never allowed himself to be swept away by emotionalism alone in painting. His art form in total, enriched by emotion and intellect, devotion and faithfulness to art All the same, mere efforts and devotion cannot make one a creative artist. It is sensibility and perceptibility that enthuse one to go for bright creation through colours” (Contemporary Art series of Bangladesh-31. ভূমিকা, অনু: ৪র্থ।

তার কাজগুলো মোটামুটি ছয় ভাগে ভাগ করা যায় ১. বাস্তবধর্মী ২. প্রকাশবাদ ৩. পরীক্ষামূলক ৪. বিমূর্ত প্রকাশবাদ ৫ দ্বি ও ত্রি আয়তন সংমিশ্রণ এবং ৬. শিশু চিত্রকলা।

তবে নিশ্চিতভাবে তাকে কোনো গোষ্ঠীভুক্ত করা কঠিন । অবশ্য গোষ্ঠীভুক্ত করা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। এটা নির্ভর করে বিশ্লেষক তার কোন ধরনের কাজের উপর আলোকপাত করছেন । তবে কোনো তর্ক- বিতর্কের ভেতর না গিয়ে তাকে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রিক আখ্যায়িত করাই শ্রেয়। একজন শিল্পরসিকের প্রশ্ন হলো “Is Rahman an abstractionist ? An abstract expressionist? Rahman does not want to commit anything. He does not bother much about terms and cliches of art. ” (মর্নিং নিউজ, ঢাকা, ১৯৬৪)।

১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজধানী করাচি থেকে প্রকাশিত দৈনিক ডন পত্রিকায় লিখেছে “By this young artist who has keenly described as a brave experimenter and whose work is marked by uncompromising uninhibited ecstatic and individualism. ” শিল্পরসিকদের মধ্যে এমন কৌতূহল এবং প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক। তবে তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে তাকে সঠিক মূল্যায়ন করা সহজ, সেজন্য তার কাজগুলো মোটামুটিভাবে ছয় ভাগে ভাগ করা যায় ।

রহমানের ঠিক কোন কাজগুলোকে বাস্তবাদ আখ্যায়িত করা যায়, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন । শিল্প সমালোচকদের জন্য এটা একটা কঠিন সমস্যা ও বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । কারণ বাস্তববাদের স্বতঃসিদ্ধ কোনো সংজ্ঞা নেই বা সঠিক ব্যাখ্যা করাও মুশকিল । তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, বিষয়বস্তুর চয়ন ও উপস্থাপনায় যদি জীবন ও সমাজের বিশেষ কোন দিক প্রতিফলিত হয়ে থাকে তাহলে ভাবের দিক থেকে বিচার করে তাকে বাস্তববাদ বা বাস্তবধর্মী বলা যায়। আর যদি কেবল অঙ্কন পদ্ধতিই বাস্তববাদ হয় তাহলে রহমানকে বাস্তববাদী বলা যায় কিনা তা বিতর্কিত বিষয়।

এক কথায় বলা যায়, দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তিনি ছিলেন বস্তুনিষ্ঠ, কঠিন বাস্তববাদী। কিন্তু কলাকৌশলগতভাবে তিনি প্রচলিত বিশেষ কোনো পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে। যখন যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে এঁকেছেন। অর্থাৎ ভাব প্রকাশই ছিল তার কাজের মূল লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য । এদিক থেকে বিচার করলে তাকে একজন বাস্তববাদী হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না।

১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকায় লিখেছে “Moreover like all true painters, he is a sensitive witness and interpreters of human existence in the purely visual sense.

রহমানের কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, যে কোনো জাতীয় সমস্যা ও বিপর্যয়ের সাথে একাত্মতাবোধ তার কাজের বিরাট অংশ জুড়ে আছে । এছাড়াও তিনি জীবন ও সাজের বিভিন্ন দিক ও পরিবেশের উপর আলোকপাত করেছেন, যা তাকে অতি সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যায়। বলাবাহুল্য, রহমানের কাজ বুঝতে গভীর জ্ঞান বা পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না, সরাসরি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে ।

১৯৫২ সাল মোতাবেক বাংলা সন ১৩৫৮ ইংরেজি ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ৮ ফাল্গুন তারিখে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ, ১৯৬৫ ও ১৯৭০ সাল মোতাবেক বাংলা সন ১৩৭১ ও ১৩৭৬ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, ১৯৭১ সাল মোতাবেক বাংলা সন ১৩৭৭-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৬৬ ও ১৯৮৪ সাল মোতাবেক বাংলা সন ১৩৭০-১৩৯০-এর বন্যা প্রকৃতি যথাক্রমে স্থাপত্য (ভাস্কর্য হিসেবে অধিক পরিচিত) এবং তেলচিত্রের মধ্যে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ।

ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনার স্তম্ভ হিসেবে গগনচুম্বি নয়, কাঠামো হিসেবে বিশাল নয়, স্থাপত্যের দিক থেকে ব্যয়বহুল নয়— অতি সাধারণ সরল সহজ একটা কাঠামো । কিন্তু একটা জাতির চিরপ্রত্যয়, চির-অহঙ্কার ও চির-বিজয়ের গৌরব হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যার ভেতর দিয়ে একটা জাতির বিশ্বাস ও আশা প্রতিফলিত হয়েছে, যা ভবিষৎ বংশধরদের আপন সংস্কৃতি চেতনা ও স্বদেশপ্রেমের উৎস ও অনুপ্রেরণা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, পরবর্তী দশকে বিশেষ করে তরুণ শিল্পীদের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু হিসেবে গুরুত্ব লাভ করেছে ।

শহীদ মিনারের পরিকল্পনা রহমানের জন্য শুধু একটা স্মৃতিস্তম্ভ ছিল না । এই স্মৃতিস্তম্ভের ভেতর দিয়ে অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, অপরদিকে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আশাবাদ প্রকাশ পেয়েছে । বলাবাহুল্য, তার প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভেতর অকৃত্রিম দেশাত্মবোধ ও আশাবাদ উচ্চারিত হয়েছে। শহীদ মিনারের মূল নকশাটি এরূপ পরিকল্পনা করা হয়:

প্রশস্ত চত্বরের চারদিক থেকে শ্বেত পাথরের রেখা মূল কাঠামোর নিচে এক বিন্দুতে গিয়ে মিশেছে । শ্বেত পাথরের মধ্যে খোদাই করা লাল পদচিহ্ন । অর্থাৎ জীবনের বা একটা জাতির মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে ঐক্যবদ্ধভাবে ধীর পদক্ষেপে ক্রমশ গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতে হয়। জাতীয় জীবনে বৃহৎ কিছু অর্জন করতে হলে অনেক কিছু বিসর্জন, অনেক আত্মাহুতি দিতে হয় ।

২. মূল পাঁচটা স্তম্ভ রঙিন কাচ দ্বারা এমনভাবে শোভাপ্রদকরণ, যেন সূর্যরশ্মি কাচ ভেদ করে সম্মুখের চত্বরে এসে পড়ে, যা স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিজয়ের প্রতীকী প্রকাশ। অর্থাৎ স্বৈরাচারীর শাসকগোষ্ঠীর কঠিন ব্যুহভেন করে গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান।

৩. মূল বৃহৎ কাঠামোর পেছনে টকটকে লাল বৃত্ত উদীয়মান সূর্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, যার মধ্যে একটা জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনার পূর্বাভাস পাওয়া যায় ।

তখন রহমানও একজন উদীয়মান নবীন শিল্পী ছিলেন। সম্ভবত শহীদ মিনারের পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে ব্যক্তিগত সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জীবনের ইঙ্গিত দিয়েছেন (অবচেতনভাবে) । তার চরিত্র বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, প্রত্যয় ও আশাবাদ স্পষ্ট উচ্চারিত হয়েছে ।

তার সমকালীন সময়ের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে লক্ষ্য রেখে তিনি শহীদ মিনারে কোনো মনুষ্য প্রতিমূর্তি ব্যবহার না করে কেবল কনক্রিটের কাঠামো নির্মাণ করেন। প্রশস্ত চত্বরের একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে বৃহৎ মূল কাঠামোকে শহীদ ছাত্রদের মা এবং মূল কাঠামোর উভয়পাশের দু’টি করে ছোট কাঠামোগুলোকে ছাত্রদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যা তার আপন ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তার মানসিক ভারসাম্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।

 

শিল্পী হামিদুর রহমান

 

এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, তিনি সারা জীবন পাশ্চাত্য দেশে বসবাস করলেও আপন সমাজ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অক্ষুণ্ণ রেখেছেন । অথচ তার সমসাময়িকরা সারা জীবন দেশের মাটিতে বাস করেও পাশ্চাত্য প্রেমে মগ্ন হয়ে আছেন । এটা কি তাদের জন্য বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক প্রহসন নয়? আর এখানেই অন্যদের সাথে তার পার্থক্য দেখা যায়।

শহীদ মিনারের ঠিক নিচের কক্ষ অভ্যন্তরে তিনি একটি দেয়াল চিত্র অঙ্কনের সম্মান লাভ করেন । এই দেয়াল চিত্রের মধ্যে তিনি বিমূর্ত মনুষ্য প্রতিমূর্তি আঁকার সুযোগ পান । এই চিত্রের মধ্যে তিনি বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সাল মোতাবেক বাংলা ০৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮ সনের ভাষা আন্দোলনের নিহত ছাত্রদের মর্মান্তিক কাহিনী চিত্রায়নের প্রয়াস পান । কিন্তু এখানেও তিনি বাস্তবধর্মী । মানব প্রতিমূর্তির পরিবর্তে বিমূর্ত আঙ্গিকে জ্যামিতিক আকারে কেবল কয়েকটা হাত ও পা নিহত ছাত্র তথা শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন ।

এই দেয়ালচিত্রের মধ্যে তিনি অর্ধ-পরিচিত আকার এবং বায়োমরফিক রূপকল্প ব্যবহার করেন । সাদা, কালো ও ধূসর রঙের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী শাসনের বিভীষিকা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । মাটির উপর পড়ে থাকা একটা অর্ধ-পরিচিত আকৃতি শহীদ ছাত্রদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে । অপরদিকে একটা কালো হাতের থাবা সর্বগ্রাসী স্বৈরাচারী শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছে । এখানে-ওখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছড়ানো

কতকগুলো মানুষের হাত ও পায়ের মধ্য দিয়ে নিষ্পেষিত, জর্জরিত জনগণের মুক্তি পথের সন্ধানের আকুলতা ধ্বনিত হয়েছে। বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা, আকার, আকৃতি, রঙের ব্যবহার প্রভৃতি সবকিছু মিলিতভাবে স্বৈরাচারী শাসকের শোষণ ও নিষ্পেষণের প্রচণ্ডতা দারুণভাবে উচ্চারিত হয়েছে, যা ভীতি সঞ্চার করে। বিশেষভাবে কালো রঙের ব্যবহার বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত ভাব প্রকাশ দারুণ সহায়তা করেছে। এখানে কালো, রঙ হিসেবে ব্যবহার না হয়ে ভাব প্রকাশক রঙ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে।

জ্যামিতিক পদ্ধতিতে আঁকা অর্ধ-পরিচিত আকার আকৃতি এবং ভীতি এসবের ভেতর পিকাসোর ‘পয়ের্নিকা’ ও অন্যান্য জ্যামিতিক আকারের মানুষের প্রভাব ও অনুকরণ প্রবণতা ধরা পড়ে। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পরে পঞ্চাশ দশকে পিকাসোর ‘গয়ের্নিকা’ যখন সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তখন তরুণ হামিদুর রহমান ইউরোপ থেকে সদ্য স্বদেশে ফিরে প্রায় দু’বছর পরে ১৯৫৬ সালে ভাষা আন্দোলনভিত্তিক এই দেয়াল চিত্রটা আঁকেন। অতএব, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পিকাসোর প্রভাব বা অনুকরণ প্রবণতা অস্বাভাবিক কিছু নয় ।

তবে শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটার গুরুত্ব যাই হোক না কেন, এদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে এটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। দুঃখের বিষয়, ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এই দেয়ালচিত্রটা স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী কর্তৃক আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয় (হামিদুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ করে আমাকে এ কথা বলেছিলেন) ।

এ প্রসঙ্গে নভেরা আহম্মেদের নাম উল্লেখ না করা হলে অত্যন্ত অন্যায় হবে। প্রকৃতপক্ষে, শহীদ মিনারের মূল নকশা সজ্জা-পরিকল্পনা এবং নির্মাণ কাজ রহমান ও নুভেরার যৌথ প্রচেষ্টায় সম্পন্ন হয়। শহীদ মিনার নির্মাণের মধ্যে দিয়ে নভেরা যে অবদান রেখে গেছেন তা এদেশের ইতিহাস তার নাম অবিস্মরণীয় করে রাখবে । পূর্বে বলা হয়েছে যে, নভেরা ছিলেন চট্টগ্রামের এক ধনী পরিবারের কন্যা ।

রহমানের মতো তিনিও লন্ডনে ভাস্কর্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পরে স্বদেশে ফিরে আসেন। স্বদেশে ফেরার অল্পদিন পরে তিনি বর্মার ঐতিহ্যবাহী কাঠ খোদাই করা ভাস্কর্যের উপর গবেষণামূলক কাজের জন্য রেঙ্গুন গমন করেন। প্রায় দু’বছর পরে বর্মা থেকে ফিরে এসে অল্পদিন পরেই রহমানের সাথে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এদেশের সমস্ত শিল্পীদের মধ্যে রহমান সর্বপ্রথম যিনি এদেশের প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রেক্ষিতে নানারকম মাধ্যম ব্যবহারের সম্ভাবনা ও উপযোগিতার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। যেমন- পরিত্যক্ত কাঠ, তক্তা, পাট, চট, বালু, সিমেন্ট প্রভৃতি। এসবের মধ্যে সিমেন্ট মাধ্যমে তাঁর আঁকা দেয়ালচিত্র উল্লেখযোগ্য ।

১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯ সালে হংকং থেকে প্রকাশিত দ্য এশিয়ান স্টুডেন্ট পত্রিকায় পাকিস্তানের গোলাম মালিক লিখেছেন: “After five years, he returns to East Pakistan with imaginative ideas bursting out of his head. Strongly felt the desire to infuse new life and expression into the drabness of Dhaka’s monotonous life Rahman grasped with the weather effects of the hot, humid rainy season. He used cement mixing it with colours as a medium that the cement gives strength to the walls and with stands the unfavourable climate ”

এসব মাধ্যম ব্যবহারে রহমানের নিজের কথায় বলা যায়: “I use my hands, they are move in direct contact with the medium. ” খুব কম শিল্পী আছেন, যারা ছবি আঁকার সময় নিজের হাতের আঙ্গুল ব্যবহার করেন । এমন দৃষ্টান্ত বিরল।

সে সময় ঢাকায় বেশ কিছু নতুন নতুন ভবন নির্মাণ হচ্ছিল। এসব ভবনে দেয়ালচিত্র আঁকার জন্য রহমান উৎসাহ অনুভব করতে লাগলেন। তিনি সরকারি ঊর্ধ্বতন আমলাদের কাছে ধরনা দিতে লাগলেন। ‘Can firures be put on display?” একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রশ্ন করলেন। সে সময় দেয়ালচিত্রকে প্রতিমা পূজা বা পৌত্তলিকতার সমান মনে করতেন । কিন্তু রহমান সহজে নিরুৎসাহ হলেন না ।

তিনি মোগল, তুর্কি, মিশরীয়, পারস্য প্রভৃতি চিত্রকলার দৃষ্টান্ত দিয়ে তার স্বপক্ষে অকাট্য যুক্তি তুলে ধরলেন । তার সুন্দর বাকপটুতা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি সকলকে বোঝাতে সক্ষম হলেন । তার দেয়ালচিত্রগুলোর মধ্যে করাচিতে অবস্থিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক এবং ঢাকার তৎকালীন সাধারণ পাঠাগার, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পাঠাগারের দেয়ালচিত্র দেখে অনেকেই পুলকিত হলেন ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালচিত্রের জন্য তিনি কোনো বিস্ময়কর, হতবুদ্ধিকারী বিষয়বস্তুর অবতারণা করেননি। তিনি অতি সহজ সরলভাবে রং ও রেখার ভাষা দিয়ে এদেশের কৃষিভিত্তিক জেলেদের দৈনন্দিন জীবনের উপস্থাপনা করেন। কিন্তু তার সমসাময়িক অন্যদের মতো পাশ্চাত্যের কোনো মহান শিল্পীর অনুকরণে আধ্যাত্মিকতা দেখাননি অথবা কলাকৌশলগতভাবে বৃদ্ধির মারপ্যাচ দেখিয়ে জনগণকে বিহ্বল করার চেষ্টা করেননি ।

জেলেদের জীবনভিত্তিক বিষয়বস্তুর অবতারণার মধ্য দিয়ে এদেশের কৃষিজীবী গ্রাম্য মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের উপর আলোকপাত করেন । সহজ-সরল ভাষার জন্য তার ও অতি সাধারণ দর্শকের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে । তার কাজ বোঝার জন্য কোনো বিশ্লেষক, সমালোচক বা ব্যক্তিগত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না ।

এই দেয়ালচিত্রটা কয়েক ভাগে ভাগ করা যায় । প্রতিটি অংশে জেলেদের দৈনন্দিন কর্মজীবনের একেকটা দিক দেখানো হয়েছে । এক অংশে দু’জন জেলেনী ঝুড়ি ভর্তি মাছ মাথায় নিয়ে যাচ্ছে ফেরি করতে। একজন জেলে মাছ বিক্রি করছে। সে একটা মাছ হাতে তুলে নিয়ে ক্রেতাকে টাটকা মাছ দেখিয়ে দর কষাকষি করছে।

তারপাশের দৃশ্যে দেখা যায়, একজন জেলেনী বাড়িতে মাটির ঘরের বারান্দায় বসে সস্নেহে একটা ছাগলের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করছে। আরেকটা দৃশ্যে দেখা যায়, একজন অল্প বয়সী জেলে এক ঝুড়ি মাছ নিয়ে বসে আছে। তার এক কাঁধের উপর একটা গামছা রাখা আছে । তাকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে- যদি

মাছ বিক্রি না হয় তাহলে মাছগুলো পচে যাবে। পরিবারের সকলকে অনাহারে থাকতে হবে। তার পাশে তার স্ত্রীর হাতে একটা মাছ। বাড়ির সকলের জন্য সে মাছটা রান্না করবে । সমস্ত মাছ বিক্রি করলে তো চলে না— বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের জন্যও তো দু’একটা রাখতে হয়।

রহমান এদেশের সাধারণ মানুষ, তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও বাঁচার জন্য যে সংগ্রাম তার প্রতীক হিসেবে মাছের উপস্থাপনা করেছেন। এদেশ কৃষিভিত্তিক । মাছ এদেশের মানুষের কাছে শুধু প্রিয় খাদ্য নয়, জীবিকা ও জীবনধারণের একটা উল্লেখযোগ্য পাথেয়। এদেশের একশত ভাগ লোকই মাছের উপর নির্ভরশীল, কারো কাছে খাদ্য হিসেবে কারো কাছে জীবিকা অর্জনের উৎস হিসেবে।

এ প্রসঙ্গে এস. এন. হাশিম লিখেছেন “In East Pakistan, fish in what dreams of a good catch measures the difference between empty stomach and prosperity It is a symbol of all that is good in life. the symbolism in After the Storm’ shows an uprooted family giving at a fish, a rehabilitate of peace” (ডন, করাচি, ডিস: ১৯৫৯)।

নদীমাতৃক অঞ্চলের কাদা-মাটির সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে তিনি পশ্চাদভূমিতে উজ্জ্বল হলুদ এবং ছায়াংশে হালকা খয়েরি রং ব্যবহার করেছেন । হলুদ ও খয়েরি রঙের বিপরীতে সাদা প্রতিমূর্তিগুলো সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে । ব্যক্তি ও বস্তুগুলো কালো দৃঢ় রেখা দ্বারা বেষ্টন করা হয় । আকারগুলো বিস্তারিত করার পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত করেন এবং রঙের ব্যবহারেও মিতব্যয়িতা রক্ষা করেন। সবকিছু মিলে উল্লেখযোগ্য সরলতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে । বস্তুত তার কাজের এটাই হলো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, যা তার জীবনের শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায় ।

এতদ্বসত্ত্বেও তাকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায় । সমালোচনার ঝড় ওঠে । অনেকে শব্দ দ্বারা তাকে ভীষণভাবে আক্রমণ করেন । কিন্তু তিনি সমস্ত সমালোচনা ও প্রতিকূলতা হাসিমুখে বরণ করে নেন । মিষ্ট ভাষা ও সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার দিয়ে তিনি ক্রমে ক্রমে এদেশের মানুষের মন জয় করতে থাকেন; অবশ্য বাহ্যিকভাবে তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও মানসিকভাবে যে তিনি জর্জরিত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তা তার আত্মনির্বাসিত হয়ে স্বদেশ ত্যাগ করার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায় । এদিক থেকে বিচার করলে আমিনুল ইসলামের তুলনায় তার মধ্যে সাহস, দৃঢ়চিত্ত ও প্রত্যয়ের অভাব লক্ষ্য করা যায়।

স্বদেশ ত্যাগ করে প্রথমে কয়েক বছর করাচি পরে ইংল্যান্ডে বাস করেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি সুদূর কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন । তার আত্মনির্বাসিত হওয়ার পেছনে সম্ভবত চারটি প্রধান কারণ থাকতে পারে৷ প্রথমত, সময়ের হিসেবে এদেশে তিনি নিজেকে অসময়োপযোগী মনে করেন; দ্বিতীয়ত, এদেশে প্রগতিশীল শিল্প আন্দোলন গড়ে উঠার সম্ভাবনা সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা; তৃতীয়ত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিকূলতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং সবশেষে, তিনি সমালোচনা সহ্য করতে পারেননি ।

সময় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে স্বদেশ ত্যাগের জন্য রহমানকে হয়তো সম্পূর্ণভাবে দোষারোপ করা যায় না এবং তার সিদ্ধান্তকে একেবারে অযৌক্তিক বলা যায়। না । এ থেকে এ কটা কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ছিলেন, ভাব বিলাসী নন ।

১৯৬৪ সালে করাচিতে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে তার আঁকা আর একটা দেয়ালচিত্র উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এ দেয়ালচিত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে তিনি একটা ধনী পরিবারের উপস্থাপনা করেছেন। শয়ন কক্ষের ভেতর সোজাসুজি (দর্শকের) এবং আড়াআড়িভাবে দু’টি ব্যয়বহুল গদির খাট পাতা রয়েছে খাটের ডান পাশে স্ট্যান্ডের উপর একটা ফুলদানিতে রাখা ফুল ঘরের শোভা বৃদ্ধি করেছে।

এ ছবির যে বিষয়টা কৌতূহল উদ্রেক করে সেটা হলো, বিশেষ কোনো আসবাবপত্র অঙ্কন না করে কেবল কিছু জ্যামিতিক স্থূল আকার এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, মনে হয় যেন দামিদামি আসবাবপত্র দিয়ে সমস্ত ঘর সাজানো রয়েছে। যাহোক, মোট পরিবেশ দেখে মনে হয় যে, এটা একটা সমৃদ্ধশালী পরিবারের শয়ন কক্ষ ।

গৃহস্বামী একটা খাটের উপর বসে তার সুন্দরী সহধর্মিনীর সাথে আলাপ করে অবসর কাটাচ্ছে । তার স্ত্রী মুগ্ধ দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মধুর ভাষণ যেন গোগ্রাসে গিলছে। আর দু’হাত দিয়ে কিছুটা অন্যমনস্কভাবে চুল বাঁধছে ।

তাদের বিপরীত দিকে খাটের উপর তার শ্যালিকা বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে । সে দু’হাতের কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে হাতের তালুর উপর মুখ রেখে মনোযোগ সহকারে তাদের গল্প উপভোগ করছে।

গৃহস্বামী খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বসে আছে । তার পাশে একটা ঝুড়ির মধ্যে কিছু কাপড় অগোছালোভাবে পড়ে আছে। তার বাম হাতটা আলগাভাবে ঝুড়ির উপর রাখা । তার স্ত্রী ও শ্যালিকা কোনো ব্লাউজ ছাড়াই শাড়ি পরেছে, যেমন আমাদের গ্রামের মেয়েরা সাধারণত পরে থাকে, শাড়ির আঁচল দিয়ে শরীরের অর্ধাংশ পেচিয়ে রেখেছে। পিঠের প্রায় অর্ধেকটা অনাবৃত। তার পরিহিত লুঙ্গি এবং বিশেষভাবে মহিলা দু’জনের শাড়ি পরার ধরন দেখে মনে হয় যে, তারা বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার।

শয়নকক্ষের সার্বিক পরিবেশে তাদের কিছুটা বেমানান লাগে। কারণ শয়ন কক্ষের সার্বিক পরিবেশ দেখে মনে হয় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধশালী পরিবারের শয়ন কক্ষ। অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সম্ভবত রহমান তৎকালীন পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে পরোক্ষভাবে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ বা সামঞ্জস্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন।

পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পার্থক্য ও বৈষম্য বিদ্যমান ছিল ষাট দশকের শুরুতেই তা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়নি । সুতরাং একজন সচেতন দেশপ্রেমিক হিসেবে রহমান যদি

উভয় অঞ্চলের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ ঘটানোর চেষ্টা করে থাকেন তাহলে সেটা নিন্দা ও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায় না । শৈল্পিকভাবে বলা যায়, বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা, আকার গঠন, রঙের বিন্যাস, ট্রিটমেন্ট প্রভৃতি মিলিতভাবে দ্বি ও ত্রি আয়তন ধারণার মধ্যে সংযোজন বা দ্বন্দ্ব সমন্বয় দেখা যায়, যা তার পরবর্তী প্রায় সমস্ত কাজের ভেতর দেখা যায়।

বস্তুত এটাই তার স্বতন্ত্র ও মৌলিকতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সাদাটে হালকা হলুদ পশ্চাদভূমির বিপরীতে নর-নারীর প্রতিমূর্তি, ফুলদানি, আসবাবপত্র সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে। গাঢ় তামাটে অগ্রভূমি ডানদিকে (দর্শকের বাম) গাঢ় লালচে পশ্চাদভূমির সাথে মিশে গেছে । ফলে পশ্চাদভূমি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তবে উভয়পাশে হালকা ধূসর বর্ণ কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন মনে হয়, যা দৃষ্টিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে ।

১৯৫৮ সালে তার গঠনকালীন সময়ের কাজের মধ্যে তেলরঙে আঁকা নিসর্গের মাঝে মুখ এখানে আলোচনা করা হলো । একজন মানুষের মুখ হাতের তালুর উপর ভর দিয়ে রাখা। এ ছবিটি বিজ্ঞানমতে প্রতিফলন ও প্রতিসরণ, ইংরেজিতে যাকে *Reflection & Reflection’ বলে, পদ্ধতিতে আঁকা ।

একজন মানুষের প্রতিকৃতির ভেতর দিয়ে গ্রামবাংলার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে । গ্রামের মানুষ ও প্রকৃতি যেন এক অবিচ্ছিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা— এ কথাই যেন শিল্পী বলতে চেয়েছেন । অন্তর্নিহিতভাব যাই হোক, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার কাজের ভেতর একটা কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, স্বদেশের মানুষ ও মাটি তার সমস্ত চিন্তা ও চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল ।

দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার কাজগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি জীবনকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। ‘জীবন’ শব্দটা ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হয়। জীবনের ব্যাপকতা অপরিসীম। অবশ্য ‘জীবন’ একটা আপেক্ষিক শব্দ, সঠিক কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন । অতএব, জীবন বলতে আমরা যে যা বুঝি তাই অন্যকে বোঝাতে চেষ্টা করি। দুঃখ-দুর্দশা, আনন্দ-বেদনার যেমন বিভিন্ন কারণ, ধরন এবং তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে, ভালোবাসারও তেমন বিভিন্ন ধরন ও ব্যাখ্যা আছে ।

দার্শনিকভাবে ‘ধরণে’র দিক থেকে প্রেম-ভালোবাসার দু’টি স্তর আছে; একটা হলো বাস্তব বা পার্থিব; অন্যটা হলো, আধ্যাত্ম বা ঐশ্বরিক। আবার ভালোবাসার দু’টি দিক আছে; একটা হলো— মিলনাত্মক, অন্যটা হল- বিয়োগান্তক। তবে প্রেম পার্থিব হোক আর আধ্যাত্ম হোক, মিলনাত্মক হোক, আর বিয়োগান্তক হোক, প্রেমের ভালোবাসার সঞ্জীবনী হলো রোমান্টিকবাদ, যা নারী-পুরুষ সকলেই যৌবন বয়সে একান্তভাবে কামনা করে ।

তাই যৌবনের শুরুতেই প্রত্যেক তরুণ-তরুণী আবেগ প্রবণ হয়ে অন্যকে ঘিরে আপন কল্পনার জগৎ রচনা করে। আর এ দু’টি দিক ১৯৫৬ ও ১৯৬০ সালে রহমানের আঁকা যথাক্রমে বংশীবাদক এবং রোডা শীর্ষক ছবির ভেতর প্রতিফলিত হয়েছে। এছাড়াও ভালোবাসার অন্যান্য দিক ও ব্যাখ্যা আছে, যা পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের কাজের ভেতর প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৭০ সালে করাচি থেকে প্রকাশিত দ্য মর্নিং নিউজ

পত্রিকায় লিখেছে: “The theme is love and who could depict it letter than Hamidur when it comes to colours there are landscapes of love. faces of passion, dreams of love, and the ‘Prisoner’ to complete the triangle. And finally, there is maternal love the ‘Mother and child’ ”

তখন রহমান ছিলেন একজন পূর্ণ যুবক । তাই তিনিও যে জীবনের শুরুতে প্রেমের নৌকায় কল্পনার পাল তুলে আবেগ প্রবণতার স্রোতে ভেসেছেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই । তার বংশীবাদক ছবিটি দেখে মনে হয়, রহমানের প্রথম প্রেম বিয়োগান্তক নাটকে শেষ হয়। তার জীবনে এই প্রথম বিষাদ ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা বংশীবাদক-এর ভেতর প্রতিফলিত হয়েছে।

এ ছবিতে একই ক্যানভাসকে দু’ভাগে ভাগ করে এক জোড়া যুবক-যুবতীর বেদনাদায়ক স্মৃতি রোমন্থন করার দৃশ্য উপস্থাপন করা হয়েছে । উভয়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছেদ হয়ে প্রেম বিরহে কাতর যুবক বাঁশির সুরের মধ্যে তার বেদনার উপশম খুঁজছে। প্রেমিকাকে হারিয়ে সে বৈরাগ্য জীবন বেছে নিয়ে ভবঘুরে জীবন কাটাচ্ছে । জীবনের প্রতি তার আর কোনো আসক্তি নেই। কি হবে এ পার্থিব সুখ- ভোগে? কে তার আনন্দে, সমৃদ্ধি দেখে পুলকিত হবে? যাকে নিয়ে এত কামনা-বাসনা, যাকে ঘিরে সে একদিন কল্পনার জগৎ রচনা করেছিল, সে সবই তো একদিন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল । এখন রিক্ত, চিরমুক্ত, বন্ধনহীন ।

তাই আজ সে সঙ্গীতকে জীবনের একমাত্র সাথী হিসেবে বেছে নিয়েছে। তার হৃদয়ের এ হা-হুতাশ যেন বাঁশির সুরের ভেতর বারে বারে রণিত হয়ে উঠছে।

বংশীবাদকের বিপরীত দিকে একজন বয়স্কা মহিলার প্রতিকৃতি । তার মাথার উপর দিয়ে আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তার যৌবনের রূপ-লাবণ্য এখন আর নেই। যৌবনের সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। মুখে বিষাদের ছাপ। চাঁদনী রাতে অতীতের স্মৃতিচারণ করছে ।

অনেক বছর আগের কথা; এমনি এক চাঁদনী রাতে সে তার প্রেমিকের বাহু-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কত সুখের স্বপ্ন দেখেছিল । কিন্তু একদিন সে স্বপ্ন ভেঙে গেল । তার জীবনে এখন কোনো সাধ-আহ্লাদ নেই । এ নশ্বর দেহটা আজ তার কাছে বোঝাস্বরূপ । উভয়ের হৃদয়ের গভীরে প্রেমের যে আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে, সে আগুনের আভা বংশীবাদক-এর মধ্যে অনুভব করা যায়।

প্রকৃতির প্রভাবের জন্যই হোক আর যে কোনো কারণেই হোক, বাঙালি জাতি, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা একটু বেশি আবেগপ্রবণ, রোমান্টিক এবং কাব্যিক ভাবের হয়ে থাকে। তাই প্রেমিকাকে কেন্দ্র করে অনেক কল্পনার জাল বুনে তার রূপ-লাবণ্যকে কখনো আকাশের চাঁদ আকারে কখনো ফুলের সাথে তুলনা করে। ১৯৬০ সালের তেল রঙে রহমানের আঁকা রোডা তেমন একটা ছবি ।

রোডা পূর্ণিমা রাতে ফুল বাগানের দাঁড়িয়ে আছে। তার নাতিদীর্ঘ চুলের বেনীটা ঘুরিয়ে বক্ষের উপর ঝুলছে । বেনীতে একটা ফুল গোছা আছে ৷ জ্যোৎস্না রাতে চারদিকে ঝলমল করছে । জ্যোৎস্নার আলোয় সাদা শাড়ি পরিহিতা রোডাকে অনেক বেশি রমণীয়

লাগছে। তার পশ্চাদভূমিতে ফুল বাগানে ফুল ফোটে আছে। পূর্ব চাঁদের নিচের দিকে আংশিক ফুলের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এ ছবির মধ্যে কাব্যিক ভাব প্রকাশ পেয়েছে। এ ছবিটা কাজী নজরুল ইসলামের গানের কয়েকটি চরণ স্মরণ করিয়ে দেয়।

‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী

দেব খোঁপায় তারার ফুল,

রামধনু হতে লাল রঙ টেনে আলতা পরাব পায়”

রহমানও যেন ঠিক তেমনভাবে প্রকৃতির উপাদান দিয়ে তার প্রেয়সীকে সাজাবার বাসনা করেছেন ।

রোডা মধ্যবিত্ত পরিবারের রুচিশীল সহজ-সরল অনাড়ম্বর স্বভাবের মেয়ে, তার সবকিছুর মধ্যে সরল ভাব রয়েছে। ‘সরলতাই সৌন্দর্য’ শিল্পী যেন এ কথাটাই সকলকে বোঝাতে চেয়েছেন । যে সরলতা রহমানের মনে গভীর রেখাপাত করেছে। তাই তিনি প্রেমিকার সরলতায় মুগ্ধ হয়ে চাঁদ ও ফুলের সাথে তুলনা করেছেন। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন যে, বিশেষভাবে বাংলা সাহিত্যে বা সমাজে সৌন্দর্য ও পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে যথাক্রমে চাঁদ ও ফুল ব্যবহার বা তুলনা করা হয়ে থাকে। তাই রহমানও তার প্রেয়সীর রূপ-লাবণ্য, পবিত্রতা এবং যৌবনের প্রতীক হিসেবে যথাক্রমে পূর্ণিমার চাঁদ ও ফুলের অবতারণা করেছেন । এদিক থেকে বিচার করলে তাকে রোমান্টিক শিল্পী বললে ভুল হবে না।

উপর্যুক্ত ছবিটি বিশ্লেষণ করলে এটাকে প্রকাশবাদ বলা যেতে পারে। তবে সঠিকভাবে প্রকাশবাদও বলা যায় কিনা সেটা বিতর্কিত। কারণ এর মধ্যে প্রকাশবাদ এবং বাস্তববাদের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায় । অবশ্য আগেই বলা হয়েছে, এটা নির্ভর করে সমালোচক বা বিশ্লেষক তার কোন কাজের উপর এবং কোন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার কোন কাজের উপর আলোকপাত করছেন । এ কাজটি তার পূর্ব ও পরবর্তী প্রেম প্রসঙ্গ নিয়ে আঁকা কাজগুলোর মধ্যে সেতু হিসেবে গণ্য করা যায় ।

 

শিল্পী হামিদুর রহমান

 

তার সব কাজ পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তিনি বর্তমান ও অতীতের মধ্যে বারে বারে আনাগোনা করেছেন অর্থাৎ বর্তমান কাজে তৃপ্ত না হতে পেরে আবার পূর্ববর্তী ধারা ও আঙ্গিকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। যখন তিনি বিশেষ কোনো এক ধারা বা আঙ্গিক অনুসরণ বা অনুভব করেছেন যে তিনি যেন ঠিক দানা বাঁধতে পারছেন না তখনই পূর্ববর্তী ধারা বা আঙ্গিকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন । কথাটা সহজে এই দাঁড়ায় যে, তিনি পুনঃ পুনঃ বিমূর্তের দিকে ঝুঁকে পড়ে আবার বাস্তববাদে ফিরে গেছেন। ফলে বিমূর্ত ও বাস্তববাদের টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছেন।

কথাটা এভাবেও বলা যায়, তিনি মৌলিকভাবে বাস্তববাদী ছিলেন, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বিমূর্তবাস বা মেকানোমরফিক চিত্রকলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেননি আবার গ্রহণ করতেও পারেননি । যার ফলে মাঝে মাঝে পা পিছলে বিমূর্তের দিকে ঝুঁকে পড়ে টাল সামলে নিয়ে আবার বাস্তববাদে ফিরে গেছেন। এখানে আমরা তার ও জয়নুল আবেদিনের মধ্যে একই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত লক্ষ্য করি ।

একটা প্রবাদ আছে ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু আমাদের সকলের এ সত্য জানা আছে যে, অতীতকে কোনো দিন ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ যে দিন গত হয়ে যায় সেদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। তাই তিনিও পারেন নি। যখনই তিনি অতীতকে ফিরাবার চেষ্টা করেছেন তখন অতীত তার কাছে নতুন ভঙ্গিতে নতুন আঙ্গিকে ফিরে এসেছে। এতে একটা সুফল ফলেছে যে, বাস্তব তার কাছে সবসময় নতুনভাবে নতুন রূপে ধরা দিয়েছে।

স্থির নৌকা শীর্ষক ছবিটি একটা ব্যতিক্রম শিল্পকর্ম বলা যায়। এর মধ্যে বাস্তব ও বিমূর্তবাদের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যয়। একটা চতুষ্কোণ ক্যানভাসের উপর রঙ দ্বারা আয়তক্ষেত্রাকার গঠন করা হয়েছে। প্রথমে তিনি ক্যানভাসের উপর মসৃণভাবে রং পাতলা করে লাগিয়েছেন, যা ছবির ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে।

তার উপর কালো রঙ মোটা করে লগিয়ে তুলির উল্টো পাশ দিয়ে ক্যানভাসের বামদিকে মোটা পুরু করে লাগানো রঙের মধ্যে আঁচড় কেটে কেটে অর্ধ-বৃত্তাকার রেখা এবং কিছু লম্বা রেখা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা ঢাকা অঞ্চলের নৌকার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, তথা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। তিনি রেখাকে আকারের অবিচ্ছেদ্য ও অভিন্ন অংশ হিসেবে গণ্য না করে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও ভাব প্রকাশক হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছেন । রেখার ব্যবহারে আমরা রহমান ও কিবরিয়ার মধ্যে মতৈক্য দেখতে পাই।

আমাদের সকলের জানা আছে যে, আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। বিশেষভাবে পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের অসংখ্য নদী-নালা বিস্তীর্ণ শ্যামলভূমিকে খণ্ড বিখণ্ড করে মসৃণভাবে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে। তাই এই বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চলে বন্যার প্রাদুর্ভাব এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক বেশি । সমস্ত অঞ্চল কখনো প্লাবিত হয়ে জলমগ্ন থাকে আবার কখনো দারুণ খরায় খাল-বিল শুকিয়ে মাঠ-ঘাট চৌচির হয়ে যায় ।

নদীর এক কূল ভাঙে এক কূল গড়ে । নদীর ভাঙনে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যায় । কত লোক আশ্রয়হীন হয়ে যায়। সর্বহারা মানুষগুলো সপরিবারে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনাহারে অনিদ্রায় পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। আবার নতুন চর জাগে । কত লোক নতুন চরে ঘর বাঁধে, চাষাবাদ করে । নতুনভাবে জীবন শুরু করে, নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নতুনভাবে সংগ্রাম করে বাঁচবার জন্য। বাঁচবার জন্য অবিরামভাবে প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে । এটাই রহমানের শিল্পকর্মের মূল ও মুখ্য বক্তব্য । যেমন— কুতুবদিয়া (১৯৬৪), অস্তিত্ব (১৯৬৬), ঘূর্ণিঝড় (১৯৭৩) এবং ১৯৮৪ সালে আঁকা ধারাবাহিক বর্ষা উদাহরণস্বরূপ এখানে উল্লেখ করা যায়।

পুরনো ঢাকার এক জনাকীর্ণ পরিবেশে এক সম্রাপ্ত মুসলমান পরিবারে ১৯২৮ সালে হামিদুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন । জন্ম থেকেই তিনি বৈরী প্রকৃতির সাথে পরিচিত । আশৈশব থেকে প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি তার মনে যে রেখাপাত করেছে তাই তার বুদ্ধিমত্তা কর্মকাণ্ডের মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে। তাই বৈরীভাবাপন্ন প্রকৃতির রুদ্রমূর্তির মুখোমুখি

দাঁড়িয়ে স্বাভাবিকভাবেই বাস্তববাদী হতে বাধ্য ।

তিনি অলীক কল্পনা বিলাসী হতে পারেননি,

১৯৬৪ সালে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের ফলে যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়, কুতুবদিয়ার মধ্যে তার প্রতিফলন দেখা যায়। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সমস্ত কুতুবদিয়া দ্বীপ গ্রাস করে ফেলেছে। সমুদ্রের পানি যেন সমস্ত দ্বীপটাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে। কোথাও কোনো জন-প্রাণী দেখা যায় না। শুধু পানি, আর পানি । এটা বিমূর্ত প্রকাশবাদী আঙ্গিকে আঁকা হয়েছে।

সাধারণ মূর্তকরণ এবং রঙের বিন্যাসই প্রধান বিষয় । ১৯৬৬ সালে আঁকা অস্তিত্ব এর মধ্যে একদিকে বন্যার ভয়াবহতা অপরদিকে মানুষের নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচার জন্য যে আশা ও চেষ্টা এবং সংগ্রাম তাই উচ্চারিত হতে দেখা যায়। সমস্ত দেশ প্লাবিত । যতদূর দৃষ্টি যায় পানি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। আশ্রয় পাওয়ার মতো কোথাও তিলমাত্র ঠাঁই নেই ।

জলমগ্ন একটা পরিবারের তিন সদস্যের উপস্থাপনার ভেতর দিয়ে বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিবারের একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আছে । তবুও তারা বাঁচার আশা ছাড়েনি। এ দুর্যোগের মধ্যেও তাদের যা কিছু সম্বল তারা মরিয়া হয়ে সেগুলো রক্ষার চেষ্টা করছে। গৃহিণী একটা বটি উঁচু করে ধরে আছে । তার বামপাশে আর একজন মহিলা একটা কুঁড়ে ঘর এবং ডানপাশে একজন পুরুষ একটা ছৈওয়ালা নৌকা মাথার উপর উঁচু করে ধরে আছে।

তাদের অভাবের ছোট সংসার এবং জীবিকার একমাত্র পাথেয় এর প্রতীক হিসেবে যথাক্রমে বটি, কুঁড়ে ঘর ও নৌকা উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ জীবন-জগতের প্রতীকী উপস্থাপনা । ভাব প্রকাশের জন্য শিশু-চিত্রকলার ঢংয়ে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা করা হয়েছে ।

পার্থিব এ জীবন সমস্ত মানুষের কাছে অতি প্রিয়। বিষয় সম্পত্তি যার যা কিছু আছে এসব তার কাছে অতি আপন, অতিপ্রিয় । তাই সকল মানুষ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিবারের সকলকে নিয়ে বিষয়-সম্পত্তি আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। মানুষ এই জীবন- জগতের মায়া কাটাতে পারে না। চায় না এ পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নিতে । এই অন্তর্নিহিত ভাবই এই ছবির মূল বক্তব্য । “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই” রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার মধ্যে ভাবের যে ব্যঞ্জনা রহমানের অস্তিত্ব’র মধ্যে তাই ধ্বনিত হয়েছে ।

অবশ্য তিনি যে শুধু প্রকৃতির রুদ্রমূর্তিই দেখেছেন, তা নয়, স্নিগ্ধ প্রকৃতির বদান্যতাও তার মনে কোমল স্পর্শ দিয়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে আঁকা নদীমাতৃক বাংলাদেশ এবং ১৯৭৭ সালে মনট্রিলের ডয়সন কলেজের দেয়ালচিত্র উদাহরণস্বরূপ এখানে উল্লেখ করা যায় । নদীমাতৃক বাংলাদেশ একটি মনোরম নদীর দৃশ্য।

এ ছবিটা দেখে মনে হয় যে,

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার মনে যে উৎকণ্ঠা, বিষাদ ও ক্ষোভ জমা হয়েছিল স্বাধীনতার পরে তা স্তিমিত হয়ে শান্তি ও আনন্দে পরিণত হয়েছিল। নদীর তীরে ছোট ছোট পল্লী, মাঝ নদীতে জেলেদের নৌকা, মাল বোঝাই বজরা, পাল তোলা ডিঙি নৌকা, কুগুলী কুণ্ডলী পাকানো সাদা মেঘ প্রভৃতি মিলিতভাবে বাংলাদেশের নদীমাতৃক অঞ্চলের একটা মনোরম দৃশ্য। সুবিস্তৃত নদী দূরে দিগন্তরেখায় মিশে গেছে। দৃশ্যটা দেখলে পদ্মা, যমুনার কথা মনে পড়ে

তবে প্রাকৃতিক দৃশ্য হিসেবে উপযুক্ত শিল্পকর্মটি যতই মনোরম হোক কলাকৌশলের দিক থেকে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা যায়। যেমন- রচনার অগ্রভূমির ডান ও বামপাশে ছোট ছোট পল্লীর ঘর এবং সার্বিক পরিবেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পরিবর্তে পাশ্চাত্যের ছায়া রয়েছে এবং কোনো ধনী পরিবারের গৃহ অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ও নৃত্যের ভঙ্গিতে মহিলাটি মূল বিষয়বস্তুর সাথে অসঙ্গত লাগে ।

নদীর মধ্যে একেবারে বামদিকে একটা ড্যাম ও পাহাড়ের সামান্য অংশ মূল দৃশ্যের সাথে বেমানান ও অর্থহীন। এমন হতে পারে যে, তিনি এদেশের ভূ-প্রকৃতি, আর্থ- সামাজিক অবস্থা, সংস্কৃতি, অগ্রগতি প্রভৃতি একই সাথে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন । এদিক থেকে বিচার করে বলা যায়, পাশ্চাত্যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরাই যদি মুখ্য উদ্দেশ্য হয় তাহলে সমস্ত বিষয়টা ভিন্নভাবে পরিকল্পনা ও উপস্থাপন করা অধিক যুক্তিযুক্ত হত ।

বিশেষ করে অগ্রভূমিতে নদীর মধ্যে হঠাৎ তিনটে শাপলা ফুল অসঙ্গত ও পরিপ্রেক্ষিত বহির্ভূত। তবে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচয় হিসেবে শাপলা ফুলের প্রতীক উপস্থাপন করেছেন । তাছাড়াও, মূল দৃশ্যই যখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে তখন অন্যান্য প্রতীক, রূপবন্ধ বা রূপকল্প ব্যবহার নিষ্প্রয়োজন।

এমন মনে হয় যে, মূল দৃশ্য দেখে অনেক বিদেশী হয়তো বাংলাদেশকে শনাক্ত করতে পারবেন না তাই পরবর্তীতে তিনি উপর্যুক্ত প্রতীকগুলো যোগ করেছেন । যাহোক, এসব প্রতীক ব্যবহারের ফলে মূল দৃশ্যের গুরুত্ব অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।

তাছাড়া শৈল্পিকভাবে বলা যায়, অনেকগুলো বিভিন্ন প্রতীক ও রূপবন্ধ ব্যবহারের ফলে মূল দৃষ্টিকোণ এক জায়গায় আলোকপাত না করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অগ্রভূমির একেবারে নিম্নাংশে উভয় পাশের দৃশ্যগুলো এবং পাহাড়ের অংশ অনেক দূরবর্তী মনে হয় । কিন্তু মূল দৃশ্য ও শাপলা অনেক কাছে দেখানো হয়েছে ৷ ফলে দৃষ্টি সামনে পেছনে হতে থাকে, যা কলাকৌশল নিয়মের, বিশেষ করে বাস্তবধর্মী কাজের, পরিপন্থী।

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহারে রহমানের মধ্যে স্পষ্ট ধারণার অভাব ছিল অথবা অসচেতনভাবে উপেক্ষা করেছেন। ফলে দ্বি ও ত্রি আয়তন ধারণার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য এটা তার কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা যায় । কারণ তার পরবর্তী সব কাজের দ্বি ও ত্রি আয়তন-এর মধ্যে সচেতন। সংমিশ্রণের প্রচেষ্টা লক্ষণীয় এবং পরিপত্রতা লাভ করেছে। কিন্তু তাই বলে আলোচিত ছবিটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কানাডার রাজধানী মন্ট্রিওলে ডয়সন মহাবিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ক্লাবে ১৯৭৭ সালে তিনি একটি দেয়ালচিত্র আঁকেন।

যার মধ্যে মানুষ ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্য দিয়ে ভৌগোলিক অবস্থার উপস্থাপন দেখা যায়। ভূগোল সম্বন্ধে যাদের সামান্যও ধারণা আছে তাদের সকলের জানা আছে যে, কানাডা পৃথিবীর একেবারে উত্তর মেরুতে অবস্থিত । প্রচণ্ড শীত, প্রায় সারা বছর বরফাচ্ছন্ন থাকে। গ্রীষ্মকালে চোখে সূর্য দেখা গেলেও উত্তাপ নেই বললেই চলে।

তুষারমণ্ডিত পর্বত শিখর, গিরিশৃঙ্গের উপর দিয়ে ভাসমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেঘমালা, সদ্য বরফগলা পর্বত শিখর, ফেনিল সমুদ্র সৈকত, খাড়া জলপ্রপাত, তরঙ্গায়িত সাগর সবকিছুর মধ্যে যেমন শীত শীত অনুভূত হয় তেমন-ই ঐ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য সহজে অনুমান করা যায়। গাঢ় ও নীল রঙ ক্রমশ ধূসর বর্ণে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে উত্তর মেরুর শীতল জলবায়ু উপলব্ধি করা যায়।

অস্তগামী সূর্যের লালরশ্মি, তামাটে রঙের পাহাড়, সমুদ্র তীরে দুর্গ এবং লাল পোশাক পরিহিত আদিবাসী সবকিছু মিলে কিছুটা উষ্ণতা সৃষ্টি করেছে। মাঝে মধ্যে উষ্ণ রঙ ব্যবহারের ফলে উত্তর মেরুর শীতলতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এ ছবিতে প্রাণসঞ্চার করেছে । তামাটে-কমলা রঙের পাহাড়ের উপর সাদা নরপ্রতিমূর্তিগুলো যেন কোনো খেলাধুলারত বলে মনে হয় ।

 

শিল্পী হামিদুর রহমান

 

অগ্রভূমিতে অনেকটা হৃৎপিণ্ডের মতো আকার এবং নিচে ডানদিকে সাদা রঙের একটা পাতার আকৃতি থেকে ঐ দেশের অরণ্যের আভাস পাওয়া যায় । রচনার ডানদিকে বাংলাদেশের লোক আঙ্গিকের ধরনে আঁকা দু’টো পাখি এদেশে পরিচিত পাখির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাখি দু’টোর ঠিক নিচের একটা নরমূর্তি উপরের দিকে হাত তুলে অনেকটা দৌড়ের ভঙ্গিতে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। এ নরমূর্তিটা দেখে সমুদ্র সৈকতে চৈতন্যদেব ছবির কথা মনে পড়ে যায় (শিল্পীর নাম স্মরণ না থাকার জন্য দুঃখিত)।

রহমান কিছুদিন বিমূর্ত ধারা চর্চা করেন এবং নানা রকম মাধ্যম ব্যবহারের সম্ভাবনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন । যেমন— উৎস, একজন আদি মানবের প্রেমপত্র, একটি চড়ুই পাখির মৃত্যু, একটা ভগ্ন পরিত্যক্ত তক্তা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।

মিশ্র মাধ্যমে আঁকা উৎস বিমূর্ত প্রতীকধর্মী কাজ । এর মধ্যে তিনি একটা ক্যামিও’র উপস্থাপন করেছেন । ধূসর বর্ণের বিপরীতে স্থুল কালো রেখা দ্বারা বেষ্টিত পীতাভ- তামাটে ও গাঢ় তামাটে রঙের একটা ‘ক্যামিও’ সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থাৎ ডিম্বাকৃতি আকার গঠন করা হয়েছে । এটার ঠিক মাঝখান দিয়ে লম্বভাবে একটা কালো রেখা ক্যামিওটাকে দু’ভাগ করেছে।

ক্যামিও’র উপস্থাপনা থেকে মনে হয় যে, সব মানুষের কাছে তার পূর্ব-পুরুষদের স্মৃতি অতিপ্রিয় । উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যে কোনো বস্তু, তার আর্থিক মূল্য থাকুক আর নাই থাকুক, অন্যের কাছে সমাদৃত হোক আর নাই হোক, তবুও উত্তরসূরিদের কাছে এর গুরুত্ব ও মূল্য অপরিমেয় । পূর্ব পুরুষের স্মৃতিচারণ করে প্রতিবেশী ও সমাজে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়। শিল্পী যেন আমাদের কাছে এই বাণী পৌঁছে দিতে চেয়েছেন ।

তবে অন্তর্নিহিত ভাব যাই হোক না কেন, কলাকৌশলের দিক থেকে এটার শৈল্পিক গুরুত্ব বেশি নেই বলা যায়। এটা রহমানের বিশেষ এক সময়ের কাজের ধারা ও ধরন হিসেবে উল্লেখ করা যায়। একটা চড়ুইয়ের মৃত্যু শীর্ষক ছবির ভেতর দিয়ে একটা অপরিচিত কাঠামোকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করেছেন, যা কেবল দর্শকদের বিব্রত করে। মূল আকৃতিটা ক্যানভাসের নিচে এবং ডানদিকে কিছুটা কেটে গেছে, তার বিপরীত দিকে বামপাশে তার নাম স্বাক্ষর রচনার ভারসাম্য রক্ষা করেছে।

পূর্বে আলোচিত অস্তিত্ব এবং এখানে আলোচিত একটি চড়ুইয়ের মৃত্যু এই দুই বৈষম্যমূলক বিষয়ের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে জীবনের দু’টি বিপরীত দিক প্রকাশ পেয়েছে; একদিকে আশাবাদ, আত্মার অমরত্ব ঘোষিত হয়েছে; অপরদিকে নৈরাশ্যবাদ, জীবনের সমাপ্তি ঘোষিত হয়েছে। একদিকে জন্ম এবং অপরদিকে মৃত্যু, এই দু’য়ের মাঝে জীবন । প্রথমোক্ত শিল্পকর্মের মধ্যে তার জীবনের প্রতি মমত্ববোধ ও বাঁচার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে এবং দ্বিতীয়োক্ত কাজের মধ্যে মৃত্যু সচেতনতা, জীবনের প্রতি নিরাসক্তি প্রকাশ পেয়েছেন ।

রহমানের ভেতর হঠাৎ মৃত্যু সচেতনতা বা চিন্তা সৃষ্টি হওয়ার সঠিক কারণ খুঁজে বের করা কঠিন। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, অনেক মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ বয়সে, মৃত্যু সচেতনতা বা চিন্তা দেখা যায়, বিশেষ করে কবি শিল্পীদের মধ্যে । যেমন— রবীন্দ্রনাথের ভেতর এক সময় মৃত্যু চিন্তা দেখা যায়, যা তার কাব্যের অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে ।

আবার কবি জসীমউদ্দীনের ভেতরও একই চিন্তা দেখা যায় এবং শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়, যা তার গোরস্থান শীর্ষক শিল্পকর্মের ভেতর প্রতিফলিত হয়েছে। ক্ষণিকের জন্য রহমানের মধ্যেও মৃত্যুচিন্তা দেখা গেলেও নৈরাশ্য বা হতাশা তাকে গ্রাস করতে পারেনি।

একটা পুরাতন কাঠ শীর্ষক কাজের মধ্যে দেখা যায়, তিনি একটা পুরাতন পরিত্যক্ত অমসৃণ কাঠ খণ্ডের উপর তেল ও টেমপারা রঙ ব্যবহার করেছেন, যার উপরের অংশ একটা বিড়ালের মুখ এবং নিম্নাংশ নারী দেহের সাথে সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়, অর্থাৎ অনেকটা দো-আঁশলা প্রাণীর মতো দেখা যায় । অমসৃণ কাঠের ঠুসঠসে অ্যাবড়ো থেবড়ো উপরিভাগ ছবির অংশ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে ।

উপর্যুক্ত আলোচিত কাজগুলো থেকে স্পষ্ট কোনো তথ্য বা ধারণা পাওয়া যায় না । এগুলো তার বিশেষ এক সময়ের পরীক্ষামূলক কাজ হিসেবে ধরা যায়। তবে শিল্পকর্ম। হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় কিনা, তা বিতর্কিত । বিভিন্ন শিল্পী ও শিল্প সমালোচকদের মধ্যে এ নিয়ে মত পার্থক্য হতে পারে । যাহোক, এগুলো তার এক সময়ের পরীক্ষামূলক কাজ হিসেবে ধরলে তাতে এমন কিছু ক্ষতি হবে না ।

অবশ্য তার কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তিনি যতই পরীক্ষামূলক কাজ করুন আর বিংশ শতাব্দীর সাথে তাল মিলিয়ে চলুন না কেন, বস্তুত তিনি কখনো আপন সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ অস্বীকার করার চেষ্টা করেননি বা বিচ্যুত হননি ।

রহমানের কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তার প্যালেট প্রধানত চারটি প্রাথমিক রঙ; যেমন— লাল, নীল, হলুদ ও সবুজ এবং তিনটি নিরপেক্ষ রঙ; যেমন- ধূসর, তামাটে এবং কদাচিৎ খয়েরি রঙের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। অর্থাৎ তিনি প্রাথমিক এবং নিরপেক্ষ রঙ বা আভাবিশিষ্ট ও আভাহীন (Cromatic & Acromatic Colour) রঙের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করেন ।

তার কাজের মধ্যে আপন সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রকাশ পেলেও কলাকৌশল পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার মধ্যে ভিন্নতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যা বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম থেকে ভিন্ন বা সম্পূর্ণ পৃথক। ডেরেক চার্লস্ অবলোকন করেছেন। “Hamidur Rahman’s mastery of oils which are quite out side Bengal tradition as a medium of expression is immediately apparent. He works within the discipline of recognized geometric forms while using his intimate knowledge of pigments and texture constantly to extend his capacity for creative expression and communication.” (ওয়ার্ল্ড ফিচারস মার্চ ৭৩তম, এপ্রিল ১ম, ১৯৭৩)।

রহমানের শিল্পকর্মের চমৎকারিত্ব নিহিত আছে দ্বি ও ত্রি আয়তন ধারার দ্বন্দ্ব সমন্বয় বা সংমিশ্রণের মধ্যে । এদিক থেকে তার কাজগুলোকে অভিনব বলা যায় । যার ভেতর হ্যান্স হফম্যান-এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তার সাম্প্রতিক কাজগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, বিমূর্ত পদ্ধতিতে দ্বি-আয়তন সমতল ভূমির উপর বা মধ্যে বিষয়বস্তুকে অর্ধ-বিমূর্ত ও অর্ধ-বাস্তবধর্মী পদ্ধতিতে উপস্থাপন ও বিন্যাস করেন, যার মধ্যে ঘনত্ব, দূরত্ব, পরিধি, গভীরতা অনুভূত হয় ।

ক্যানভাসের দ্বি-আয়তন সমতলের উপর বিষয়বস্তুকে ত্রি-আয়তন পদ্ধতিতে, পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার না করে, এমনভাবে উপস্থাপন করেন এবং রঙের বিন্যাস করেন মনে হয় যে, বিষয়বস্তু যেন ক্যানভাস ভেদ করে অনন্ত পরিসরে বিলীন হয়ে গেছে ৷ তাই বলে দৃষ্টিকটু লাগে না বা দৃষ্টিতে কোনো রকম ঝাঁকুনিবোধ হয় না । উপরন্তু, স্বাচ্ছন্দ্য ভাব রয়েছে। তার এসব কাজের মধ্যে মাত্র কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো যেমন— ঘূর্ণিঝড়, ভীতি, ঢাকার দিকে বিজয় মিছিল, বন্দী শিবিরে নারী, হাতগুলো প্রভৃতি ।

আগেই বলা হয়েছে যে, এদেশের যে কোনো জাতীয় সমস্যা, দুর্যোগ হামিদুর রহমানের মনের উপর দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। তার আচার-ব্যবহার অত্যন্ত শান্ত-শিষ্ট ও মার্জিত ছিল । কিন্তু জাতীয় যে কোনো সমস্যা বা দুর্যোগ তার মনে যে ঝড় তুলেছিল তাই তার ক্যানভাসের উপর দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৭০ সালে দক্ষিণাঞ্চলের জলোচ্ছ্বাস এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৮৪ সালে ভয়াবহ বন্যাভিত্তিক ধারাবাহিক কাজের মধ্যে তারই প্রকাশ দেখতে পাই ।

তিনি যদিও জাতীয় সমস্যা ও দুর্যোগকে কেন্দ্র করে বিষয়বস্তু চয়ন ও উপস্থাপন করেছেন তবুও এগুলোকে রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে মানব জাতির

জীবনচক্র, বাঁচার জন্য সংগ্রাম, শাসক ও শোষিতের মধ্যে চিরন্তন সংঘাত, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে যে সংঘাত, তাই উচ্চারিত হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি, অকৃত্রিম আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। সেদিক থেকে তার কাজগুলো শিল্পের সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে বলা যায়। সবদিক থেকে বিচার করলে তার বাংলাদেশের স্বাধীনতাভিত্তিক কাজগুলোকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাজ হিসেবে গণ্য করলে ভুল হবে না ।

তার সমস্ত কাজের মধ্যে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তরকালে, দু’টি বিষয় অধিক গুরুত্ব ও প্রাধান্য পেয়েছে; একটা হলো প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি এবং অপরটা হলো, যুদ্ধের বিভীষিকাময় পৈশাচিতা, মানুষের যে পৈশাচিক প্রবৃত্তি সুপ্ত আছে তাই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর বর্বোরচিত আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাভিত্তিক কাজের পরেই রহমানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম হলো জলোচ্ছ্বাস ও বন্যাকবলিত বাংলাদেশ। সাঈদ আহম্মেদ অবলোকন করেছেন: “রহমান নানারকম সামাজিক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ অবলোকন করেছেন খুব কাছে

থেকে । তাই তার চিত্রে মানব শরীর অত্যন্ত সবল ও সহিষ্ণু। কখনো কখনো আবার ভঙ্গুর দুর্বল। তার ক্যানভাসের পুরোটা জুড়েই মানুষ বিরাজ করে”,

কিন্তু যে বিষয়টা সাঈদ আহম্মেদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে সেটা হলো, রহমানের সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চেতনা ও গভীর দেশাত্মবোধ। আর এর ভেতর দিয়ে সমগ্র মানবজাতির প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি, যা একমাত্র জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র এবং ফ্রাঙ্কো গয়ার The Caprice ছাপচিত্রে’র সাথে তুলনীয় (শিল্পের দার্শনিক আবেদনের দিক থেকে বলা যায়) । দেশপ্রেম ও মানবতাবাদের দিক থেকে রহমানকে জয়নুলের পরে দ্বিতীয় স্থান দিলে হয়তো ভুল হবে না। তাই, সাঈদ আহম্মেদের ভাষায় বলতে হয় একজন শিল্পীর জন্য দেশের মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই

নেই ।’ “তার ক্যানভাসের পুরোটা জুড়েই মানুষ বিরাজ করে কখনো বাম থেকে ডান পর্যন্ত কখনো নিচ থেকে উপর পর্যন্ত” সাঈদ আহম্মেদের এই উক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ রহমানের কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, সাঈদ আহম্মেদের কথায় । “তিনি কখনো একটা শরীর দিয়ে দু’টি শরীর বুঝিয়েছেন । কখনো আবার দু’টি শরীর দিয়ে অনেক শরীর বুঝিয়েছেন।

সাঈদ আহম্মেদের উক্তি দু’টি পরীক্ষা করলে পরস্পরবিরোধী ও বৈষম্য দেখা যায়। তবে আমরা তার দ্বিতীয় উক্তিটা সঠিক হিসেবে গ্রহণ করতে পারি । কারণ রহমানের কাজগুলোর মধ্যে সংক্ষিপ্ততা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। তিনি কখনো এক আবার কখনো সর্বোচ্চ তিনটা মানব দেহের ভেতর দিয়ে কখনো পরিবার, কখনো একটা সমাজ, কখনো একটা জাত আবার কখনো সমস্ত মানব জাতিকে বুঝিয়েছেন।

আর রচনা কৌশলের দিক থেকে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, বিষয়বস্তুর কেন্দ্রবিন্দু (Focal Point) রচনার নিম্নাংশে দৃষ্টি নিবন্ধ করেছেন (রচনার নিম্নাংশ বলতে সবসময় ক্যানভাসের নিচের অংশ বোঝায় না) ।

তেল মাধ্যমে আঁকা স্বাধীনতাভিত্তিক কাজগুলোর মধ্যে ভীতি, হাতগুলো, বন্দী শিবিরে নারী প্রভৃতি এদেশের নিরীহ মানুষের উপর পাক-বাহিনীর যে নির্যাতন এবং বর্বোরচিত পৈশাচিক অত্যাচার চালিয়েছে তারই ঐতিহাসিক স্বাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা যায় । ভীতির মধ্যে তিনজন নারী-পুরুষ অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী ও তাদের যুবতী মেয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গাবস্থায় নিরুপায়ভাবে প্রাণের ভয়ে পরস্পর জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষায় । যে কোনো মুহূর্তে পাকবাহিনীর গুলি তাদের জীবন গ্রাস করবে। স্বামী-কন্যা এবং বাপ-মায়ের সামনে হতে হবে পাক-পাঞ্জাবী সেনাদের পশু প্রবৃত্তির শিকার।

পাকসেনারা তাদের বিবস্ত্র করেছে। তবুও বাঙালি নারীর প্রচলিত সম্ভ্রমবোধ কখনো শেষ হয়ে যায় নি । মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তারা একে অন্যের আড়ালে যেয়ে কেবল নিজের হাত দিয়ে শরীরের লজ্জাস্থান ঢাকার চেষ্টা করছে। তাদের পেছনে নিরীহ মানুষের অগণিত লাশ এখানে সেখানে মাটির উপর ছড়িয়ে পড়ে আছে। ধর্মীয় বিধান মোতাবেক শেষ কাজটুকুও সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি, পড়ে আছে শিয়াল শকুনের আহারের অপেক্ষায়।

পাকসেনাদের বর্বরতার জন্য যেন শিয়াল শকুনও এদেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে গেছে। চারদিকে আছে শুধু পাক সেনাদের পৈশাচিকতার নিদর্শন আর আছে ভয়াবহতা, নীরবতা এ কাজটার ভেতর যেমন একদিকে পাকসেনাদের পৈশাচিকতা ফুটে উঠেছে অপরদিকে শালীনতা ও প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি রহমানের শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ পেয়েছে। তাই লজ্জা ও দুঃখে যেন মাথা উঁচু করে ক্যানভাসের দিকেও চোখ মেলে তাকাতে পারেনি । বন্দী শিবিরে নারী শীর্ষক শিল্পকর্মের ভেতর একই শালীনতা ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রমাণ পাওয়া যায় ।

হাতগুলো ছবিটার ভেতর নারী পুরুষের কেবল কতকগুলো হাত বিভিন্ন ভঙ্গিতে একত্রে জড়াজড়ি করে আছে। প্রত্যেকটা হাতের ভঙ্গির ভেতর দিয়ে পাকসেনাদের নির্মম নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। হাতগুলো দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, পাকসেনারা কতকগুলো নিরীহ নারী-পুরুষদের জীবিতাবস্থায় একত্রে একটা গর্তের মধ্যে

মাটিচাপা দিয়ে পুঁতে রেখেছে । নিচে চাপাপড়া মানুষগুলো নিদারুণ যন্ত্রণায় মাটির নিচে ছটফট করছে । শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। একটা হাত কোনো রকমে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। বাঁচার জন্য একে অন্যকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে, চারদিকে সাহায্যের জন্য হাতড়াচ্ছে। যদি কেউ তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসে । এ বিশ্বে কি জনমানবের সাড়া নেই? কেউ কি তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না?

উপর্যুক্ত বিষয়বস্তুর চয়ন ও উপস্থাপনা এত সহজ সরল অথচ ভাবের গভীরতা এত সূক্ষ্ম যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। বলাবাহুল্য, এত সহজ-সরলভাবে কেবল কয়েকটা হাতের ভেতর দিয়ে এত সূক্ষ্ম আবেগ এবং গভীর ভাব প্রকাশ করা কেমন করে সম্ভব, যারা রহমানের এই শিল্পকর্মটি দেখেননি তাদের পক্ষে হয়তো তা বিশ্বাস করা সম্ভব নাও হতে পারে ।

 

শিল্পী হামিদুর রহমান

 

এ দৃশ্য অত্যন্ত মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক। আমরা যারা পাকসেনাদের বর্বরতা ও পৈশাচিকতার স্বরূপ স্বচোখে দেখিনি, রহমানের এই শিল্পকর্মগুলো দেখলে তাদেরও শরীরের সমস্ত লোম শিউরে উঠবে। বস্তুত পাক-পাঞ্জাবি সেনাদের নিষ্ঠুরতা মানব ইতিহাসকে চিরকলঙ্কিত করে রাখবে, যা একমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি সেনা এবং অ্যাটিলা, হুন-এর সাথেই তুলনীয়। উপমহাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ বিজয়ের ধ্বংসযজ্ঞ পাক-পাঞ্জাবি সেনাদের বর্বরতার কাছে বামন বলে মনে হয়।

ঢাকা অভিমুখে বিজয় মিছিল আমাদের জন্য নিয়ে আসে চির মুক্তির বাণী, নিয়ে আসে চিরবিজয়ের আনন্দ, নিয়ে আসে উল্লাস। দুই শতাধিক বছর পরে এদেশের মানুষ পরাধীনতা এবং বৈদেশিক শাসন শোষণের ব্যুহভেদ করে আজ চিরমুক্তির স্বাদ পেয়েছে, স্বাধীনতার গৌরব অর্জন করেছে, বিজয়ের পুষ্পমাল্যে ভূষিত হয়েছে। তাই লক্ষ লক্ষ লোক আনন্দ-উল্লাসে নেচে নেচে বিজয়ের গান গাইতে গাইতে চলেছে রাজধানী ঢাকার দিকে ।

বস্তুত এ বিজয় কেবল বাঙালির বিজয় নয়, একটা জাতির বিজয়, সমস্ত শোষিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত মানুষের বিজয়। মানবতার বিজয়, সত্যের বিজয়। এ ছবিটা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার কয়েকটি চরণ স্মরণ করিয়ে দেয়

“তোরা সব জয়ধ্বনি কর

তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নূতনের কেতন উড়ে…..

স্বাধীনতাভিত্তিক কাজের পরে তার উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল স্বাধীনতা পূর্ব দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র জলোচ্ছ্বাস এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে বর্ষা শীর্ষক ধারাবাহিক কাজ। জলোচ্ছ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তিনি যে ধারাবাহিক শিল্পকর্ম করেছেন তার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় অন্যতম উল্লেখযোগ্য। ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে দেখা যায়, একদিকে পানি প্রবল বেগে সমস্ত চরাঞ্চল গ্রাস করে চলেছে। অপরদিকে মাথার উপরে ঘূর্ণিঝড় চক্রাকারে প্রবল বেগে বয়ে চলেছে । আর এ দু’য়ের মাঝে চরের অসহায় মানুষগুলো প্রাণ ভয়ে বাঁচার জন্য

একটু আশ্রয় খুঁজছে । কিন্তু বানের পানি সবকিছু ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেছে । যতদূর চোখ যায় জন-প্রাণীর কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। কেবল মানুষ ও পশু-পক্ষীর শবদেহ এদিক-ওদিক পড়ে আছে। চরের উপর একটা নারী শবদেহ পড়ে আছে। একটা শিশু তার মৃত মায়ের পাশে বসে অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে । এত ধ্বংসযজ্ঞের পরেও শিশুটা এত শান্তভাবে বসে আছে যেন কিছুই হয়নি, কিছুই ঘটেনি। এখানে লক্ষণীয়, রহমান কেবল একটা শবদেহের ভেতর দিয়ে চরের সমস্ত মানুষকে বুঝিয়েছেন ।

জীবিত শিশুর ভেতর দিয়ে তিনি সুন্দরভাবে রম্য নাটক সৃষ্টি করেছেন। বস্তুত জীবিত শিশুর ভেতর দিয়ে একদিকে যেমন সর্বশক্তিমান আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতা ব্যক্ত হয়েছে, অপরদিকে তেমনি দৃঢ় আশাবাদ প্রকাশ পেয়েছে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, পরম করুণাময় । তিনি ইচ্ছা করলে সবকিছুই করতে পারেন, অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন, তার কাছে কিছুই অসম্ভব না। এই জীবিত শিশুই হল তার অলৌকিক ক্ষমতার প্রতীকী প্রমাণ । এ কথাটাই যেন শিল্পী আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন ।

স্বাধীনতা উত্তরকালে তার ধারাবাহিক বর্ষা-১, ২, ৩, ৪, ৫ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । আগেই বলা হয়েছে, আমাদের দেশ নদীমাতৃক, বিশেষ করে পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল । বর্ষা মৌসুমে খাল-বিল, নদী-নালা সব কানায় কানায় ভরে ওঠে। অবিরাম ধারায় বর্ষণ শুরু হয় । অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর পানি উপচে পড়ে— অতিরিক্ত পানি প্লাবন ঘটায় । ঘরবাড়ি সব পানিতে ডুবে যায়। সমগ্র দেশের প্রায় দু-তৃতীয়াংশ পানির নিচে নিমজ্জমান থাকে। চারদিকে পানি থই থই করে ।

মানুষ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। কোথাও একটু দাঁড়ানোর ঠাঁই খুঁজে ফেরে । কেউ বা ঘরের চালের উপর আশ্রয় নেয়, কেউ বা গাছের মাথায়, আর শত সহস্র লোক অনিশ্চিতের মধ্যে বেরিয়ে পড়ে যদি কোথাও একটু ঠাঁই মেলে । মাথার উপর রোদ-বৃষ্টি আর নিচে অথৈই পানি এ দু’য়ের মাঝে মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিনের পর দিন কাটায় । চারদিকে ভয়াবহ নির্জনতা বিরাজ করে ।

অসহায় মানুষগুলো অনিশ্চিতের মধ্যে জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে অপেক্ষা করে কখন ত্রাণের হাত এগিয়ে আসবে । তবুও মানুষ প্রাণের মমতা ছাড়তে পারে না। ছাড়তে পারে না এ পৃথিবীর মায়া বন্ধন। জীবনকে আরো গভীর ভালোবাসতে আরম্ভ করে । তাই আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, যার যা কিছু আছে, আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় আপনজনকে । মানুষ বেঁচে থাকে বাঁচার আশা নিয়ে ।

কবি-সাহিত্যিক ও সংগীতজ্ঞরা বাংলাদেশের বর্ষাঋতু নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন, সংগীতজ্ঞরা সংগীত রচনা করেছেন। কালিদাস থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত কাব্য-সাহিত্যের এক বিরাট অংশ জুড়ে বর্ষার রূপ বর্ণনা দেখা যায়। কবি, সংগীতজ্ঞরা বর্ষার রূপে মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখেছেন, সংগীত রচনা করেছেন । কালিদাস বর্ষাকালে মেঘ দেখে প্রিয়া বিরহে কাতর হয়ে ভাবাবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে মেঘের কাছে প্রেমের বাণী পাঠিয়ে দেন ।

রবীন্দ্রনাথের কাছে বর্ষা এদেশের মানুষের সৌভাগ্য নিয়ে আসে। তাই তিনি লিখেছেন: ‘রাশি রাশি ভারা ভারা/ ধান কাটা হলো সারা/ ভরা নদী ক্ষুর ধারা খরপরশা/ কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরর্ষা। বর্ষাকালে বৃষ্টির অবিরাম ধারা, গাছের পাতায় ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ার শব্দ, ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক, ব্যাঙের একঘেয়েমি ঘ্যাঙর ঘ্যাং, আন্দোলিত বৃক্ষ শীর্ষ প্রভৃতি সবকিছু মিলে কবিকে মুগ্ধ করেছিল । তিনি বর্ষার রূপ এরূপ বর্ণনা করেছেন ‘ঐ বেনু বন দুলে ঘন ঘন পথ পাশ দেখ চাহিরে। আবার শ্রাবণ মাসে মেঘের গুড় গুড় শব্দ, বৃষ্টি পড়ার ঝমঝম শব্দ, দ্রুত উড়ে যাওয়া ভাসমান মেঘ সবকিছু কবির হৃদয়কে আলোড়িত করেছে ।

তাই তিনি গেয়েছেন “মন মোর মেঘের সঙ্গী/ উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে/ নিঃসীম সন্ধ্যায়/ শ্রাবণ বরষণ। সংগীতে/- মন মোর হংস বলাকার পাখায় যায় উড়ে”।

কবিরা যারা শহরে দালান বাড়িতে বাস করেন, বর্ষাকালে দোতলার জানালা দিয়ে বাইরে বৃষ্টির অবিরাম ধারা দেখেন আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর ব্যাঙের গ্যা গ্যা ডাক

শোনেন, সংগীতজ্ঞরা ঘরের মধ্যে গায়ে শাল জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে টেবিলের উপর মৃদু তাল ঠুকে ঠুকে সংগীতের তাল, লয় আর মাত্রা ঠিক করেন, তাদের কাছে বর্ষার রূপ অপরূপ মনে হয় । কিন্তু যারা মাটির স্যাঁতসেঁতে মেঝের উপর জড়োসড়ো হয়ে বসে অনিদ্রায় রাতের পর রাত কাটায়। চাল দিয়ে চুইয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানিতে ভেজে। মাথার উপর শেষ সম্বল জীর্ণ চালটাও এক সময় ঝড়ের ঝাপটায় উড়ে যায় ।

গাছ উপড়ে পড়ে ছোট কুঁড়ে ঘরটাও কাদাপানিতে মিশে যায়। আপনজন আহত নিহত হয় । রাতদিন উপোস করে থাকে, সর্দি-কাশি। আর নিউমোনিয়ায় ভোগে । বর্ষা তাদের মনে ভাবাবেগ সৃষ্টি করে না। তাদের চোখে সুন্দর মনে হয় না, কুৎসিত বীভৎস দেখায় । বর্ষা তাদের জন্য ‘রাশি রাশি ভারা ভারা আশীর্বাদ নিয়ে আসে না, তাদের জন্য নিয়ে আসে অভিশাপ, দুর্বিসহ শোক, দুঃখ-বেদনা আর অনাহার। তারা চোখ বন্ধ করে কাব্য সৃষ্টির চিন্তায় মগ্ন হয়ে যান না বা মৃদু কণ্ঠে মেঘমালাহারের সুর ভাজে না ।

তারা দেব- দেবীকে, আল্লাহ-রাসূলকে স্মরণ করে করুণা ভিক্ষা করেন, এ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে। আর এই কুঢ় বাস্তবতাই রহমান সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলি করেছেন । তাই তার বর্ষাভিত্তিক শিল্পকর্মগুলো যেন কবিদের প্রতি কটাক্ষ ইঙ্গিত । তাই স্বাভাবিকভাবে তিনি ভাব বিলাসী কবিদের অলীক কল্পনার মতো ‘হংস বলাকার পাখায়’ দিক থেকে দিগন্তে উড়ে বেড়াতে পারেন নি। তার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবমুখী, সূক্ষ্ম অনুভূতিশীল ।

বর্ষা শীর্ষক ধারাবাহিক কাজগুলোর মধ্যে দেখা যায়, কখনো একজন মহিলা গলা পানিতে দাঁড়িয়ে, কখনো স্বামী-স্ত্রী বুক পানিতে দাঁড়িয়ে, কখনো একজন যুবতীর নাক পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। সে মুখ উপরের দিকে করে কোনো রকমে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে । এসব কাজের মধ্যে বর্ষা-৪ বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একজন অল্প বয়সী মেয়ে একাকিনী অসহায়ভাবে গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরিবারের কে কোথায় তা সে কিছুই জানে না। হয়তো বন্যার প্লাবনে সবার সলিল সমাধি হয়েছে।

অলৌকিকভাবে কেবল সে-ই বেঁচে গেছে। তার গলায় একটা কবচ ঝুলছে। কবচটির উপর ‘আল্লাহু’ শব্দ খোচিত করা। হয়তো সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামের জোরেই সে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রেহাই পেয়েছে । বিপদ-আপদে সবসময় আল্লাহই একমাত্র সহায় । বিপদের সময় আল্লাহ ছাড়া আর কেউই রক্ষা করতে পারে না । এ কথাটাই যেন রহমান বারে বারে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ।

বাংলাদেশের সমস্ত শিল্পীর মধ্যে রহমানই একমাত্র মুসলমান শিল্পী, যার কাজের মধ্যে ইসলামী ভাবধারা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে। এর আগেও তার কিছু কাজের ভেতর ইসলামী ভাবধারার প্রতিফলন দেখা গেছে। পাকিস্তানের গোলাম মালিক লিখেছেন : “—এবং তার শিল্পকর্ম ইসলামের বিখ্যাত ঘোড়া—দুলদুল আর বোরাক দেখা গেল— অর্থাৎ তিনি তার শিল্পকর্মে চমৎকারভাবে ধর্মীয় ছোঁয়াও রাখলেন” (মর্নিং নিউজ, করাচি, ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯)।

আমরা যারা রহমানকে কাছ থেকে দেখেছি তাদের অনেকেই হয়তো তাকে একেবারে নাস্তিক না হলেও ধর্মে উদাসীন ও আস্থাহীন বলে মনে করে থাকি । কিন্তু এটা যে ভুল ধারণা তা তার ঐসব কাজের ভেতর প্রমাণ পাওয়া যায়। আসলে একজন শিল্পীকে বুঝতে হলে ব্যক্তিগত চরিত্র বাদ দিয়ে তার শিল্পকর্মকে বুঝতে হবে। তা না হলে একজন শিল্পীকে বোঝা সম্ভব না ।

বন্যার ভয়াবহতা বাংলাদেশের যে দু’জন শিল্পীর মনে গভীর রেখাপাত করেছে। তাদের একজন হলেন সফিউদ্দিন আহমেদ, অপরজন হলেন হামিদুর রহমান। তবে দু’জনের মধ্যে পার্থক্য হলো, বন্যার ভয়াবহতা প্রথমোক্তর মধ্যে ভীতি আর দ্বিতীয় জনের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। রহমানের কাজের আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রতীকের ব্যবহার। জীবন সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে নৌকা, অনাহার ও ক্ষুধার প্রতীক মাছ, এবং আশাবাদের প্রতীক হিসেবে কখনো উজ্জ্বল আলো আবার কখনো সূর্য ব্যবহার দেখা যায়। আর প্রেম রোমাঞ্চের ব্যাপারে সেটা মিলনাত্মক হোক আর বিয়োগান্তক হোক, উভয়ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতীক ব্যবহার হয়েছে ।

আমিনুল ইসলামের কোলাজ ব্যতীত একমাত্র রহমান ছাড়া আর কোনো শিল্পীর কাজের ভেতর প্রতীকের ব্যবহার বড় একটা দেখা যায় না। এখানেও দেখা যায়, প্রতীকের ব্যবহারেও রহমান অত্যন্ত বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। কবি শামসুর রাহমানের কথায়: “হামিদুর রহমানের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, তিনি শুধু আবেগাপ্লুত হয়ে ছবি আঁকেন না, আবেগ আর বুদ্ধিবৃত্তির সমন্বয়ে গড়ে উঠে তার চিত্র- কিন্তু শুধুমাত্র অনুশীলন ও নিষ্ঠা কাউকে স্বার্থক সৃজনশীল চিত্রকর বানাতে পারে না। অন্তর্দৃষ্টি ও একজন শিল্পীকে দিয়ে করিয়ে নেয় নতুন রূপ, নতুন ফর্ম- সুখের বিষয় হামিদুর রহমান অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী” (Contemporary Art series of Bangladesh 31, পৃ. ৩য়, অনু: ৪)।

প্রতীকের ব্যবহার ছাড়াও রহমানের কাজের আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তিনি কখনো এক ব্যক্তি আবার কখনো তিন সদস্যের এক পরিবার অর্থাৎ এক থেকে তিনটা মানব প্ৰতিমূৰ্তি ব্যবহার করেননি । সাঈদ আহম্মেদের কথায় বলা যায়: “তবে রহমান একটা শরীর দিয়েই দু’টি শরীর বুঝিয়েছেন এই চিত্রে। এখানেই শেষ হয়নি- এরপর তিনি একটা একটা মানুষ থেকেই অসংখ্য মানব শরীরের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, সেই সাথে গবাদিপশু” (Contemporary Art series of Bangladesh-31, পৃ. হয়, অনু: ৩)।

সামগ্রিকভাবে রহমানের কাজগুলো দার্শনিক আবেদনের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, জয়নুল আবেদিন ও হামিদুর রহমানের পথ ভিন্ন হলেও শিল্পের আবেদনের দিক থেকে উভয়ে একই সুরে বাঁধা। উভয়ের কাজে মানবজাতি প্রাধান্য পেয়েছে— মানুষের অসীম দুঃখ-দুর্দশা আর ভাগ্য বিড়ম্বনার মাঝেও রম্য নাটক সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আশাবাদ সমভাবে উচ্চারিত হয়েছে। রহমানের শিল্পকর্মগুলো বর্ণনামূলক নয়, খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু ভাবপ্রকাশক ।

 

শিল্পী হামিদুর রহমান

 

বুদ্ধিবৃত্তি ও কলাকৌশলের দিক থেকে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, জয়নুলের মতো রহমান বারে বারে বিমূর্তের দিকে ঝুঁকে পড়ে আবার বাস্তবমুখী হয়েছেন। আর বিমূর্ত আর বাস্তবের মধ্যে আনাগোনা করতে করতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছেন— স্বতন্ত্র আঙ্গিক দানা বেঁধেছে। তুলনামূলকভাবে বিচার করলে দেখা যায়, জয়নুল আবেদিন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে যে সংযোজন ঘটিয়েছেন হামিদুর রহমান একটু ভিন্নভাবে সেটাকে আরো প্রসারিত করেছেন।

তফাৎ শুধু মাধ্যমের, জয়নুল জলরঙ ব্যবহার করেছেন এবং রহমান তেল, যা পরবর্তীতে কামরুল হাসানের কালি কলম ও জলরঙে আঁকা কিছু কাজের মধ্যে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছে।

রহমান প্রায় সারা জীবন বিদেশে বিদেশী সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে বাস করে কেলিনু শৈবালে ভুলিনু কমল কানন’- এ সত্যটিই যেন শেষ জীবনে উপলব্ধি করেছেন । আর এই উপলব্ধির ফলে ‘যারে ফিরে অজ্ঞান তুই যারে ফিরে ঘরে এসে আপন ঐতিহ্য থেকে রস আহরণ করতে চেয়েছিলেন। কবি শামসুর রাহমান যথার্থই বলেছেন: “বিমূর্ত ধারায় বাংলাদেশের চিত্রকলার মুক্তি নেই— এমন ধারার বর্শবর্তী হয়েই বোধহয় এই সচেতন শিল্পী মানুষটি মুখ ফিরিয়েছেন আমাদের দেশজ কর্মের দিকে। সাঈদ আহম্মেদের অবলোকন মোতাবেক বলা যায় মহিলার মুখমণ্ডল ক্লাসিক্যাল কায়দায় এঁকেছেন। বাঁকানো ভ্রূ, পদ্ম ফুলের মতো বড় বড় চোখ।

প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সংমিশ্রণের ব্যাপারে উপর্যুক্ত তিনজনের মধ্যে পার্থক্য হলো, জয়নুল পাশ্চাত্য ও দেশজ লোক আঙ্গিকের মধ্যে সংমিশ্রণ করেছেন, হামিদুর রহমান পাশ্চাত্য এবং মোগল ও শিশু চিত্রকলা আর কামরুল দেশজ পট ও তার অগ্রগামী জয়নুল (আংশিকভাবে) ও গাশ্চাত্য। তাদের এই কাজগুলো থেকে মনে হয়, উত্তরসূরিরাও যদি তাদের এ পথ অনুসরণ করে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এদেশে একটা জাতীয় ধারা ও আঙ্গিক প্রতিষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব কিছু না ।

কবি শামসুর রাহমানের উক্তির মধ্যে এই আশাবাদই ব্যক্ত হয়েছে : “তবে এ কথা বলা যায়, হামিদুর রহমানের এই শিল্প প্রায়শ এখানকার শিল্পী মহলে সাড়া জাগাবে। হয়তো আমাদের চিত্রকলার ধারায় নতুন বাকও সৃষ্টি করবে।” আমরা যারা দেশজ শিল্পের অনুরাগী কবির এই আশাবাদী ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবরূপ লাভ করুক আন্তরিকভাবে এ কামনা করি ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment