আজকে আমরা শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী গ্রন্থের অন্তর্গত।
শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মতো ব্যস্ততম জনবহুল মহানগরে বাস করলেও সফিউদ্দিন আহমেদ সারা জীবন নিজেকে পর্দার অন্তরালে রেখেছেন । তিনি অন্যদের মতো বুদ্ধিজীবীদের ভিড়ের মধ্যে যেমন ঠেলাঠেলি হুড়াহুড়ি করতে পছন্দ করেন না- তেমনি দেশপ্রেমের ভাড়ামিও করেন না। সুখ্যাতির আলেয়ার পিছনেও ছুটেন না। আবার শিল্পের আন্তর্জাতিকতাবাদের গোলক ধাঁধায়ও ঘুরপাক খান না ।
রাজনীতিতে কখনো তার কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। রাতারাতি সুখ্যাতি অর্জন করার জন্য কোনো রাজনৈতিক আদর্শ বা মতবাদের বুলি আওড়াতেও শোনা যায় না । সে জন্য অনেকে হয়তো তাঁকে আত্মপলায়নতার বা স্বেচ্ছা নির্বাসনকারী মনে করে থাকেন । কিন্তু তিনি একান্তভাবে নিবেদিত, শিল্প যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, যার অনুসন্ধিৎসার শেষ নেই, তৃষ্ণা কোনোদিন মিটল না, কর্মে কোনো ক্লান্তিবোধ করেন না, অতৃপ্তি যার শৈল্পিক চেতনাকে দাহন করে, তার কাছ থেকে শিল্পচর্চা ছাড়া আর কি আশা করা যায়? আর এই অতৃপ্ত বাসনার ফলে তিনি সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন।
সম্ভবত তিনিই একমাত্র শিল্পী এদেশে, যিনি কখনো আত্মপ্রচারণায় বিশ্বাসী নন এবং জনসম্মুখে নিজেকে প্রকাশ করতে ভয় করেন । গোষ্ঠী শিল্প প্রদর্শনীতে মাঝে মধ্যে তার কিছু শিল্পকর্ম সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সম্ভবত এ পর্যন্ত তিনি কোনো একক প্রদর্শনী করেননি (যতদূর আমার স্মরণ হয়)।
তার এই নীরবতার ফলে শিল্পরসিক ও শিল্পানুরাগীদের মনে দারুণ কৌতূহল ও প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক । এর দু’টি সম্ভাবনা আছে, প্রথমত, হয় তিনি মৃত্যুর পরে এদেশবাসীর জন্য প্রচুর মূল্যবান শিল্পকর্ম রেখে যাবেন, আর নয়তো, এদেশবাসীর প্রত্যাশা চির হতাশায় পরিণত হবে । তবে প্রথমোক্ত সম্ভাবনাই বেশি। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম।
তার সমস্ত কাজ দেখতে পাওয়াটা দুর্লভ সুযোগ। এমন কি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা দেখাটাও দুর্লভ । তবে তার কিছু উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম এবং মাঝে মধ্যে কিছু অনুলিপি (Reproduction) দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এত অল্প সংখ্যক কাজের উপর ভিত্তি করে সামগ্রিকভাবে তার সঠিক মূল্যায়ন করা হয়তো তাড়াহুড়া হবে। তবে এটা তার সম্বন্ধে সঠিক মূল্যায়নের জন্য দিক-নির্দেশক রূপরেখা (Guideline) হিসেবে বিবেচিত হতে পারে । এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, তার যেসব কাজ উল্লেখযোগ্য কেবলমাত্র সেগুলোর বিশ্লেষণ করে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা হলো ।
যেহেতু তিনি জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসানের সমসাময়িক এবং বিশেষ করে এদেশের শিল্প-আন্দোলনে একজন গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগামী শিল্পী সেহেতু তাকে উপেক্ষা করলে এদেশের শিল্প-আন্দোলনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যা হোক, তার যে কয়টি কাজের সাথে আমরা পরিচিত সেগুলোকে বিবেচনায় রেখে তাকে সঠিক জায়গায় স্থাপন করতে হবে ।
শুরু থেকেই তিনি একজন বাস্তববাদী শিল্পী, ছাপচিত্রকর । কিন্তু পরবর্তীতে অর্থাৎ পঞ্চাশ দশকের প্রায় মধ্যভাগের পর থেকে তার কাজ ক্রমশ বিমূর্তে রূপান্তরিত হতে থাকে। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, তাহলে তার কাজগুলো বুঝতে সহজ হবে । বিমূর্ত শিল্প মোট তিনটি উপ-শাখা বা ধারায় বিভক্ত; একটি হলো, বিষয়বস্তু ভিত্তিক অলঙ্করণ ও শোভাপ্রদকরণ অর্থাৎ বাইয়োমরফিক শিল্পকর্ম, অন্যটি হলো, বিষয়বস্তুকে জ্যামিতিক আকারে বিভাজনকরণ অর্থাৎ মেকানোমরফিক শিল্পকর্ম এবং তৃতীয়টি হলো, বিমূর্ত প্রকাশবাদ ।
শুরু থেকে অদ্যাবধি সফিউদ্দিনের বিমূর্ত কাজগুলো পরীক্ষা করলে তার কাজগুলোর মধ্যে বাইয়োমরফিক রূপকল্প (Image) ও জ্যামিতিক বিমূর্ত শিল্পের সংযোজনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি সচেতন বা অসচেতনভাবে এই দু’মতবাদের মধ্যে সংযোজনের চেষ্টা করেন কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অবশ্য তিনি সচেতন কি অসচেতন সেটা এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না অর্থাৎ এক কথায় বলা যায়, তিনি বাইয়োমরফিক রূপকল্প এবং পরিচিত আকৃতি ও জ্যামিতিক আকার ব্যবহার করেন ।
তার কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, প্রথমদিকের বিমূর্ত এবং বাস্তবধর্ম কাজের মধ্যে ইংলিশ স্কুল অব আর্ট-এর প্রভাব বিদ্যমান। যেহেতু তিনি কোলকাতা আর্ট স্কুলে ইংলিশ স্কুল অঙ্কন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেহেতু তার উপর এই স্কুলের প্রভাব থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে নিছক অনুকরণপ্রবণতা কোনোদিন তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি । বিষয়বস্তুর চয়ন ও উপস্থাপনার মধ্যে তার আপন সমাজ ও পরিবেশ সচেতনতা প্রকাশ পায় এবং নিজস্ব স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। যার ভেতর দিয়ে একদিকে তার জীবনবোধ এবং অপরদিকে দক্ষতা ও কৌশলজ্ঞানের প্রমাণ পাওয়া যায়।
তিনি অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকতার ভেতর দিয়ে কাজ করেন এবং তার কাজগুলো নিয়মনিষ্ঠ। সেদিক থেকে বিচার করলে তাকে একজন ব্যাকরণ বিশেষজ্ঞ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। তিনি মৌলিকভাবে একজন ছাপচিত্রকর, জল ও তেল মাধ্যমে তার দক্ষতা উল্লেখযোগ্য। তেলরঙের ব্যবহারে পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী রঙের বিশ্লেষণ, রং সমন্বয় ও রঙের বিন্যাস তার দক্ষতা ও কৌশলজ্ঞানের সাক্ষ্য দেয়।
উডকাঠ, উড এনগ্রেভিং, আকোয়াটিন্ট, লিথোগ্রাফ, ড্রাই পয়েন্ট প্রভৃতি মাধ্যমগুলোতে তার দক্ষতা প্রমাণিত হলেও এচিং তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় মাধ্যম, যা তিনি অধিক ভাব প্রকাশক বলে বিবেচনা করেন। তার ছাপচিত্রগুলোকে বিশেষ করে বাংলাদেশের ছাপচিত্রের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার ব্যাকরণ হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না, যা ভবিষ্যতে ছাপচিত্রের বিভিন্ন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত, প্রশস্ত করে এবং উত্তরসূরিদের অনুপ্রেরণা যোগায়। পরবর্তী দশকে মোহাম্মদ কিবরিয়া ও আব্দুস সাত্তার অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে তাকে অনুসরণ করেন
চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে তার আঁকা কিছু ছাপচিত্র উদাহরণস্বরূপ এখানে উল্লেখ করা হলো । যেমন— বনানী পথ (Way through Jungle), সাঁওতাল কুমারীগণ (Santhal Maidens) প্রভৃতি । তার প্রথমদিকের এসব বাস্তবধর্মী কাজ কারিগরি দক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবে, যা তার পরবর্তী সময়ের কাজগুলোর মধ্যে শৈল্পিক উৎকর্ষ ও সৃজনশীলতার পূর্বাভাস দেয় ।
জংগলের মধ্য দিয়ে সাঁওতাল ছাপচিত্রের ভেতর আদি অরণ্যবাসীদের জীবন যাত্রা। বা সমাজজীবনের বিবরণ পাওয়া যায় । আদি মানুষেরা সাধারণত সবসময় সংঘবদ্ধভাবে চলাফেরা করে । কোথাও যেতে হলে গ্রামের প্রায় সকলেই সপরিবারে যায়। এমন কি তাদের গৃহপালিত পশুপাখিও সাথে নিতে ভুলে না ।
উপরিউল্লিখিত শিল্পকর্মটি তেমন একটি দৃশ্য । শিশুসহ একদল সাঁওতাল নারী ও পুরুষ তাদের গৃহপালিত পশু বিড়াল, কুকুর, গাধা প্রভৃতি নিয়ে সপরিবারে দূরে হাটবাজারে অথবা কাজের সন্ধানে সভ্য মানুষের লোকালয়ে গিয়েছিল। দিন শেষে নিজ গ্রামে ফিরে চলেছে । তবে এমন হতে পারে যে, তারা এই প্রথম গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলেছে নতুন বসতি গড়ে তোলার জন্য । তাই তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছুই সাথে নিয়ে চলেছে ।
চারদিকে গভীর ঘন অরণ্যের মধ্যে একটা খোলা জায়গা। প্রখর গ্রীষ্মের পড়ন্ত বেলা, আনুমানিক পাঁচটা হবে। চারদিকের ঘন জংগলের মধ্যে খোলা জায়গা পড়ন্ত বেলার উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে। সূর্যের রশ্মি গাছের ফাঁক দিয়ে জংগলের মধ্যে কিছু দূর পর্যন্ত প্রবেশ করেছে। অগ্রভূমিতে এবং খোলা মাঠের মধ্যে মানুষ, পশু ও পশ্চাদভূমিতে গাছের ছায়া এসে পড়েছে। মানব প্রতিমূর্তি ও বস্তুর উপর তীব্র আলোকপাতের ফলে প্রতিমূর্তি ও বস্তুগুলো অন্ধকার জংগলের বিপরীতে সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে এবং পরস্পর থেকে পৃথক হয়েছে।
বৈষম্যমূলক আলো-ছায়ার ব্যবহার এবং মানুষ ও পশুর চলার ভঙ্গির ভেতর দিয়ে একদিকে যেমন গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপ ফুটে উঠেছে অন্যদিকে তেমনি ক্লান্তি ও অবসাদ ফুটে উঠেছে। সারাদিন পরিশ্রম করে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ক্লান্ত-অবসন্ন দেহে তারা গৃহে প্রত্যাবর্তন করছে। তাদের চলার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, তাদের গ্রাম এখনো কয়েক কোশ পথ দূরে । সন্ধ্যার আগেই নিরাপদ স্থানে, বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। গভীর জঙ্গলে হিংস্রে জীবজন্তুর ভয়। দিনের আলো থাকতে থাকতে জঙ্গলটা পার হয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাতে হবে ৷ ক্লান্তি ও শ্রান্তিতে অবসন্ন দেহটা যেন আর টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না। তবুও তারা দ্রুত পা চালিয়ে চলেছে ।
কয়েকজন মহিলা কাপড়ে বাধা খাবার পোটলা মাথায় নিয়ে চলেছে। পুরুষরা বাড়ির দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস নিয়ে চলেছে। একজন বৃদ্ধ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই তার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে একটা গাধার পিঠে চড়ে চলেছে। সে নিজেকে রোদ থেকে রক্ষা করার জন্য মাথার উপর একটা ছাতা ধরে রেখেছে। তার পোষা কুকুরটা তার পেছনে পেছনে তাকে অনুসরণ করে চলেছে। একেবারে সামনে একজন মহিলা তার কোলের শিশুকে রোদ থেকে বাঁচাবার জন্য মাথার উপর একটা ছাতা ধরে রেখেছে।
অগ্রভূমিতে কুকুরটা মাথা উঁচু করে গাধার পিঠে উপবিষ্ট তার প্রভুর দিকে চেয়ে পথ চলছে । তার চাহুনির ভেতর দিয়ে বিশ্বস্ততা ও প্রভুভক্তি ফুটে উঠেছে। মনে হয়, কোনো অজানা আগন্তুক জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে এই দৃশ্য দেখছে ।
বৃদ্ধের হাত তীর্যকভাবে এবং ছাতার হাতাটা আড়াআড়িভাবে দেখানো হয়েছে। গাধার মাথাটা অগ্রভূমিতে মহিলার ছাতার আড়ালে আংশিকভাবে না ঢেকে দেখানো হয়েছে। অগ্রভূমিতে নিকটবর্তী গাছের কাণ্ডের ছায়া অংশের প্রান্তে কোনো প্রতিফলিত আলোর আভাস না থাকায় সম্পূর্ণ অন্ধকার দেখানো হয়েছে। ফলে ছায়াচ্ছন্ন অংশ কাণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ না হয়ে শূন্যস্থান বলে মনে হয় এবং কাণ্ডের দৃঢ়তা, ঘনত্ব ও পরিধি হারিয়ে ফেলেছে । অবশ্য এটা তার আরম্ভ অর্থাৎ গঠনকালীন সময়ের কাজ । অতএব, সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা অস্বাভাবিক কিছু না, যা উপেক্ষা করা যায় ।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের নবীন-প্রবীণ প্রায় সব (কতিপয় ব্যতীত) শিল্পীর মধ্যে পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহারে দ্বিধা দ্বন্দ্ব অথবা জ্ঞানের অভাব লক্ষণীয়। এক কথায় বলা যায়, চিত্রকলায় বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো বা বিজ্ঞানসম্পর্কী বিষয়গুলো অনেকটা উপেক্ষিত হয় এবং ভাবের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু সফিউদ্দিনের মধ্যে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়।
তার প্রথমদিকের কিছু কাজের মধ্যে যদিও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায় তবুও বিজ্ঞানসম্পর্কিত বিষয়গুলো মুখ্য এবং বিষয়বস্তুর তাৎপর্য বা ভাবের নিকটা অনেকটা গৌণ হয়ে পড়ে। সেজন্য এ কাজগুলো তার কারিগরি দক্ষতা, নিপুণতা ও মাধ্যমের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং গভীর জ্ঞানের পরিচয় বহন করে।
সাঁওতাল কুমারীগণ তার ঐ সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাঠ খোদাই ছাপচিত্র। যার মধ্যে সাঁওতালদের দৈনন্দিন জীবনের একটা দিক তুলে ধরা হয়েছে। নিত্য পানীয়জলের প্রয়োজন মিটানোর জন্য দু’জন সাঁওতাল কুমারী নির্জন জঙ্গলের মধ্যে একটা ডোবা থেকে কলসে পানি ভরছে। শুষ্ক মৌসুমে ডোবার পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে। পায়ের গিরা পর্যন্ত পানিতে কলস ভালো করে ডোবে না। জঙ্গলের মধ্যে খাবার পানির যথেষ্ট অভাব । বহুদূর থেকে মেয়েরা কলস নিয়ে এসে এখান থেকে পানি নিয়ে যায় ।
বস্তুত দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের এই দিকটা শুধু সাঁওতাল নয়, বিশেষভাবে বাংলাদেশ এবং সার্বিকভাবে উপমহাদেশের সর্বত্র, গ্রামাঞ্চলে এই দৃশ্য আমাদের কাছে চির পরিচিত, যা আমাদের দেশের শিল্পী ও কবিদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের উৎস ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে ।
অগ্রভূমিতে নিকটবর্তী মেয়েটা কলসে পানি ভরে মাথায় নিয়ে কেবল সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার সঙ্গীর অপেক্ষায় । তার হতচকিত ভাব থেকে মনে হয় যে, অসময়ে এই নির্জন জঙ্গলের ভেতর কোন এক অপরিচিত লোকের হঠাৎ আবির্ভাবে কিছুটা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে । অপরিচিত ব্যক্তি যেন তাদের পানি ভরার দৃশ্যটা তাদের অগোচরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবলোকন করছিল।
আগন্তুকের সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটা যেন লজ্জায় বিব্রত হয়ে পড়ে। কিন্তু তার সাথী অপরিচিত আগন্তুকের উপস্থিতি বুঝতে পারে না। সে শান্তভাবে আপন মনে কলসে পানি ভরার চেষ্টা করছে।
পশ্চাদভূমিতে আরেকটা সাঁওতাল দম্পতি জঙ্গলের ভেতর আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে ধীর পদক্ষেপে বাড়ি ফিরছে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে উজ্জ্বল আকাশের বিপরীতে জঙ্গলের ভেতর ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। অগ্রভূমিতে ডোবার পানিতে উজ্জ্বল আকাশের প্রতিফলন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউয়ের উপর ঝিকমিক করছে, দৃষ্টি ধাঁধিয়ে দেয়ার উপক্রম ।
লম্ব ও বক্ররেখার সমন্বয়ে আড়াআড়ি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঁচড় গাছের কাণ্ডের উপর উজ্জ্বল আলো এবং পানির ভেতর সুন্দর প্রতিফলন, এসব মিলিতভাবে আলো-ছায়ার সুন্দর সঙ্গীত সৃষ্টি করেছে । অস্থির পানিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউয়ের উপর আলোর ঝিকিমিকি ও নারী প্রতিমূর্তিগুলোর গাঢ় প্রতিফলন মিলিতভাবে পানির স্বচ্ছ টলটলে ভাব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
কিন্তু সামনের মেয়েটির দাঁড়ানোর ভঙ্গির ভেতর কিছুটা কৃত্রিমতা বা অস্বাভাবিক ভাব রয়েছে। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া মেয়েটির প্রসারিত হাত স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্য না হয়ে। জড়বস্তু বলে মনে হয়। ঝুঁকে পড়া মেয়েটি পায়ের গিরা পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে । কিন্তু কলসটা বাম দিকে ডোবার একেবারে কিনারায় অল্প পানিতে ডোবাচ্ছে মনে হয়। অর্থাৎ মেয়েটির পা ও কলস এক সরলরেখায় না হয়ে প্রায় কয়েক ফুট দূরে ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। সামনের দণ্ডায়মান মেয়েটির উরুর উপরে উজ্জ্বল আলোকপাতের ফলে পানি ঝিকিমিকিতে আলো-আঁধারের যে মধুর সঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকাংশে ব্যাহত হয়েছে ।
সাঁওতাল মেয়েদের গলায় পুতি ও ধাতব বস্তুর তৈরি মালা, বাজুবন্ধ, চুড়ি এবং খোঁপায় ফুল ব্যবহারের ভেতর দিয়ে তাদের সৌন্দর্যপ্রীতি ও শৌখিনতা প্রকাশ পেয়েছে । তাদের এই শৌখিনতা ও আদিমতার প্রতি সফিউদ্দিনের দারুণ আগ্রহ দেখা যায়। মনে হয়, যেম তিনি তার কল্পনার প্রেয়সীকে মনের মাধুরী মিলিয়ে সযত্নে সাজানোর চেষ্টা করেছেন । এখানে আমরা তার মধ্যে কিছুটা কাব্যিক ও রোমান্টিক ভাব বা প্রবণতা লক্ষ্য করতে পারি। এই মর্মে পাকিস্তানের জালাল উদ্দিন আহম্মেদ লিখেছেন: ” the indigenous folk tradition inspires the work of another artist- colleague of his, Shafiuddin Ahmed, whose career has closely followed the pattern of Abedin’s but whose works differ very significantly from his.”
বস্তুত পাকিস্তানের জালাল উদ্দিন এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ সমালোচক কোনো শিল্পীর গ্রামীণ জীবন বা দৃশ্যর বিষয়বস্তু দেখলেই সেটাকে ‘লোকশিল্প’ বলে ভুল করে থাকেন । প্রকৃতপক্ষে এসব শিল্প-সমালোচকের শিল্প সম্বন্ধে ভুল ধারণা এবং অভিজ্ঞতার অভাবের জন্য, ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প এবং পল্লী বিষয়বস্তুর বৈশিষ্ট্যর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম না হওয়ার কারণে এই ভুল করে থাকেন । আসল ব্যাপার হলো, ‘লোক ঐতিহ্য’ ও ‘লোক-আঙ্গিক’ এই শব্দদ্বয় কিছু কিছু সমালোচক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
সফিউদ্দিনের আরেকজন সমালোচক খুব সুন্দরভাবে বলেছেন: “For this highly sensitive artist the many patterns in gushing water, the abb, and the whirlpools, the low clouds and the high Aides, have a different meaning. And he has followed this verdict of this own feelings as truthfully as he can. By reason of the fact that he has been able to comprehened the intrinisic nature of this for him- new realm of discovery, his work has become enormorsly exciting, sincere and persuasive”
কামরুল হাসানের মতো সফিউদ্দিন আহমেদও কোলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এবং নগর পরিবেশে লালিত-পালিত হয়ে ওঠেন । পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় স্থানান্তরিত হন । ভারতীয় বঙ্গ প্রদেশ, বিশেষ করে কোলকাতা, অনেক উঁচু ও শুষ্ক আবহাওয়ার জায়গা । সে তুলনায় বাংলাদেশ হলো আর্দ্র আবহাওয়াবিশিষ্ট বৃষ্টিবহুল নিম্ন সমতল ভূমি ।
অতএব, কোলকাতা নগরবাসীদের জন্য হুগলি নদী ও নগর থেকে দূরবর্তী গঙ্গা নদী ব্যতীত নদী দেখতে পাওয়া একটা দুর্লভ সুযোগ । কিন্তু বাংলাদেশ, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চল হলো একটি নদীমাতৃক দেশ; বহু নদ-নদী, খাল-বিল-জলাভূমির দেশ। নদ-নদী ও খালগুলো সমগ্র দেশকে খণ্ড বিখণ্ড করেছে।
কোলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আসার পরে তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন । তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন, অপরিচিত পরিবেশের মধ্যে নিজেকে দেখতে পান, সেজন্য গৃহ-আকর্ষণ (Nostalgia) বোধ করাটা অস্বাভাবিক নয় । ফলে তার মধ্যে সব সময় এক ধরনের স্থানচ্যুতি ও নিঃসঙ্গতা বোধ সৃষ্টি হয়। বর্ষা ঋতুতে মুষলধারে বর্ষণ শুরু হয়, ঘন ঘন বৃষ্টিপাত হওয়ার ফলে চারদিকের নিম্নভূমি পানিতে ভরে যায়, পানি ধারণের আর কোনো জায়গা থাকে না, অতিরিক্ত পানি প্লাবন ঘটায়, সমগ্র দেশ জলমগ্ন হয়ে যায় ।
ঢাকা নগরের অন্তঃস্থলের লোকালয় পর্যন্ত প্লাবিত হয়ে যায়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে জলমগ্ন থাকে। সমগ্র দেশের সাথে রাজধানীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নগরজীবন বিঘ্নিত হয়, অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। বন্যাপীড়িতদের দুরবস্থা, হাহাকার সফিউদ্দিনকে বিচলতি করে, উদ্বিগ্ন করে। প্রতি বছর ভয়াবহ বন্যা শফিউদ্দিনের মনে ভীতি সঞ্চার করে। তিনি শুদ্ধ-উঁচু জায়গার লোক; অবন্ধুসুলভ প্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে কষ্টবোধ করেন।
বৈরী প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা তার হৃদয়ে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে, যা তার সমস্ত চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ফলে তার কাজের মধ্যে সব সময় একধরনের নিঃসঙ্গতা ও ভীতি অনুভূত হয় । বন্যা একদিকে যেমন তার মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করলো, অপরদিকে তেমনি কল্পনার জগতের নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। একইভাবে বন্যা তার জন্য অনুপ্রেরণার স্থায়ী উৎস হিসেবে কাজ করলো । ফলশ্রুতিতে বন্যার বিভিন্ন অবস্থা বা রূপ, নদীমাতৃক জীবন অর্থাৎ নৌকা, জেলে এবং বেদেরা তার কাজের মুখ্য বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পেল। তার ছাপচিত্র এবং ক্যানভাসগুলো শুধু বন্যা, বন্যা আর বন্যা এবং নৌকা ও মাঝে মাঝে জালে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
বাংলাদেশের বেদেরা, তার হৃদয়ে, ভারতের সাঁওতালদের জায়গা দখল করে নিলো। এখানে এ কথা বলা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, কামরুল হাসান এবং সফিউদ্দিন উভয়েই ভারত থেকে আগত, কিন্তু তাদের মধ্যে পার্থক্য হলো- প্রথমজন লোক-ঐতিহ্য ও প্রকৃতির আনকোরা সৌন্দর্যের স্তুতিগান করেন, আর দ্বিতীয়জন বৈরী প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি দেখে ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়েন। এদেশের লোকের দুঃখ-কষ্টে বেদনা বোধ করেন, দেশপ্রেমের কথা না বললেও মনে-প্রাণে এদেশেরই একজন সন্তান হয়ে আছেন ।
সত্য হোক আর নাই হোক, অনেকে দুঃখ করে বলেন থাকেন, বাংলাদেশ প্রকৃতির একটা অভিশপ্ত দেশ । প্রতি বছর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এদেশের শত সহস্রাধিক লোকের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে থাকে। বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু হয় প্রবল ঝড়- ঝঞ্ঝা, শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাত দিয়ে, তাকে অনুসরণ করে আসে বন্যা । সমগ্র দেশ প্লাবিত হয়ে যায়, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভূ-ভাগ জলমগ্ন থাকে, বন্যার স্রোতে ভেসে যায় শত সহস্রাধিক পরিবার। বন্যা বছরের প্রায় মাঝামাঝিতে তুফান ও সমুদ্র জলোচ্ছ্বাসের পথ সুগম করে দেয় ।
এক বিরাট এলাকাজুড়ে সমুদ্রের নোনা পানির নিচে নিমজ্জিত হয়, সমুদ্রের পানি বিস্তীর্ণ এলাকা একেবারে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নিয়ে ফিরে যায় সমুদ্রগর্তে। পিছনে ফেলে যায় সহস্র মানুষ ও গবাদিপশুর শবদেহ আর গৃহহারা, আশ্রয়হারা বুভুক্ষু মানুষের দল- কেউ মরে রোগে, কেউ মরে শোকে আর কেউ মরে। অনাহারে।
তার এই দুঃখজনক অভিজ্ঞতা, ছাপচিত্রের বিভিন্ন মাধ্যমে বাঙময় হয়ে ওঠে । যেমন- আসন্ন বন্যা (Approaching Flood), বন্যা-১, বন্যা-২, বন্যা হ্রাস (Reccding Flood), সেতু পারাপার (The Bridge Across ), যথাক্রমে আকোয়াটিস্ট, এচিং ও আকোয়াটিন্ট, এগুলো উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এসব ছাপচিত্রের মধ্যে বন্যার বাস্তবধর্মী উপস্থাপনা না করে বন্যার ভয়াবহতার প্রতীকী বা বিমূর্ত উপস্থাপনা করা হয়েছে। যার মধ্যে বন্যাকবলিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ব্যক্ত হয়েছে। এতদ্বসত্ত্বেও তার কাজের মধ্যে হতাশা ও নৈরাশ্যের কোনো ছায়া দেখতে পাওয়া যায় না। উপরন্তু আশাবাদ উচ্চারিত হয়েছে।
বন্যা-১ ও ২-এর মধ্যে কোথাও কোনো প্রাণী চোখে পড়ে না, মাইলের পর মাইল জলে নিমজ্জিত- যতদূর দৃষ্টি যায় চারদিকে জল থৈ থৈ করছে, শুধু পানি আর পানি আর মাঝে মাঝে ঘূর্ণাবর্ত কোথাও কোনো জন-প্রাণীর সাড়া মেলে না, সমস্ত প্রকৃতি নীরব নিস্তব্ধ- চারদিকে ভয়াবহ নীরবতা ও নিঃসঙ্গতা বিরাজ করছে, সমগ্র দেশ বিষণ্ণ । যখন প্লাবন আসতে শুরু করে গ্রামবাসীরা নিরাপদ জায়গার সন্ধানে বের হয়ে পড়ে, পিছনে গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে।
সাদা-কালো ও ধূসর বর্ণের সাথে সবুজ ও নীল রঙের ব্যবহারে ভয়াবহ বিষণ্ণ পরিবেশ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সতর্কভাবে হিসাব করে কয়েকটি আঁচড়ের মধ্য দিয়ে পানির ছোট ছোট ঢেউ এবং স্রোতে ভাসমান শেওলার ধারণা পাওয়া যায়।
বন্যা হ্রাস (Receding Flood) ছবিটির মধ্যে দেখা যায়, এক বিস্তীর্ণ জলমগ্ন এলাকার মধ্যে একটা বড় গাছ, রাজকীয় ভঙ্গিতে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছবিটির ভেতর বন্যার ভয়াবহতা ও নিঃসঙ্গতা আমাদের দারুণভাবে আতঙ্কিত করে। কিন্তু তিনটি ডিঙ্গি নৌকার উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে মিলনাত্মক নাটক (Melodrama) সৃষ্টি করেছে। ডিঙ্গিগুলো নৌকা হিসেবে উপস্থাপিত না হয়ে (বিপদ) উদ্ধার ও বেঁচে থাকার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অবশেষে, বন্যা হ্রাস পেতে শুরু করে, জীবন ক্রমশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, মানুষ আবার নিজ গ্রামে স্বগৃহে ফিরে যায় আবার হাসে।
গাছের কাণ্ড এবং শাখা-প্রশাখাগুলোতে দৃঢ় স্থূল গতিশীল কালো রেখা, হালকা তামাটে বর্ণের পাতা এবং গাঢ় সবুজ পানি; এসব কিছু মিলিতভাবে যেমন ভয়াবহ তেমন নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ ভাব সৃষ্টি করেছে। গাছের কাণ্ডে ও শাখা-প্রশাখায় কালো রঙের ব্যবহার ভয়াবহতা আরো বৃদ্ধি করেছে । কিন্তু পানির উপরে সদ্য জেগে ওঠা কয়েকটা খুঁটার মাথা এবং পল্লবের মাঝ দিয়ে দৃশ্যমান উজ্জ্বল আকাশ থেকে বোঝা যায়, বন্যার পানি হ্রাস পেতে শুরু করেছে এবং আকাশ মেঘমুক্ত; যার ভেতর দিয়ে আশাবাদ প্রকাশ পেয়েছে ।
উপরে আলোচিত কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তিনি বস্তুগুলোকে প্রকৃতির মধ্যে নিজস্ব আকার হিসেবে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে, তাদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং মাঝে মাঝে সরলরেখার ব্যবহারে বক্ররেখাকে আরো ক্ষীপ্ৰ গতিশীল করেছে । বন্যা হ্রাস-এর মধ্যে দৃষ্টি আকার থেকে আকারে ঘুরে ঘুরে পল্লবের ফাঁক দিয়ে দূর আকাশে নিক্ষিপ্ত হয়। আবার বন্যা-২ এর মধ্যে দৃষ্টি ছবির ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে।
প্রায় সব ছাপচিত্রের মধ্যে তিনি আলো-আঁধারের বৈষম্য সৃষ্টি না করে সামঞ্জস্য বজায় রেখেছেন । অর্থাৎ মিডল-টোন (Middle-tone) ব্যবহার করেছেন। মিডল টোনে তিনি হালকা ও গাঢ় এই দু’রকমের ধূসর বর্ণ এবং আলোকিত স্থান ও উজ্জ্বল আলোর জন্য পত্র-সাদা (Paper White) ব্যবহার করেছেন। তিনি অধিক ছায়া এবং সামান্য আলো ব্যবহার করে আলো-ছায়ার সুন্দর নাটক সৃষ্টি করেছেন। অবশ্য সব সময় যে সামঞ্জস্যপূর্ণ আলো-ছায়া ব্যবহার করেছেন তা নয়, অনেক সময় বৈষম্যও চোখে পড়ে ।
এচিং ও আকোয়াটিন্ট মাধ্যমে আঁকা সেতু পারাপার একটি চমৎকার ছাপচিত্র। এটাকে তার কাজের ধারা ও ধরনের রূপান্তর বলাই সঠিক হবে। তিনি বাস্তববাদকে বিদায় জানিয়ে প্রথম চৌকাঠ ডিঙিয়ে বিমূর্ত জগতে প্রবেশ করেন । এই কাজটাকে বিমূর্ত এবং তার ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য আঙ্গিক উদ্ভাবনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যায়। তিনি পাশ্চাত্যের আধুনিক অর্থাৎ বিমূর্ত ধারণা, বিশেষ করে ইংলিশ স্কুল অব আর্ট থেকে রস গ্রহণ করে তাই-ই ব্যক্তিগত আঙ্গিকের সাথে সংমিশ্রণ করে স্বতন্ত্র আঙ্গিকে উন্নয়নে প্রয়াসী হন, কিন্তু বিষয়বস্তু ও রূপবন্ধ চয়ন ও উপস্থাপনার দিক থেকে তার মূল শিকড় এদেশেরই মাটির গভীরে প্রোথিত ।
এই ছবিটির মধ্যে তিনি বাংলাদেশের নদীমাতৃক পূর্বাঞ্চলের বেদেদের জীবন উপস্থাপন করেন । নদী তীরে কয়েকটা বেদে নৌকা বাঁধা, তার মধ্যে কয়েকজন বেদে নারী ও শিশু বসে আছে, অন্যরা জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে গেছে । এটা একটা ছোট নদী, লোক পারাপারের জন্য বাঁশের তৈরি একটা সাঁকো উভয় তীরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করছে।
এই ছবির মধ্যে তিনি সমস্ত প্রকৃতিকে কেবল একটি আকারে নৌকা, পাল, নদীর তীর, সেতু— অর্ধ-বৃত্তাকারে রূপান্তরিত করেছেন, যার মধ্যে নদীর বাঁকের অনুভূতি জাগে । বাঁশের সাঁকোটা অগ্রভূমিকে প্রায় কোনাকুনিভাবে দু’ভাগে ভাগ করেছে, দৃষ্টি সাঁকো অনুসরণ করে মূল বিষয়বস্তুতে পৌঁছায়। এখানে আমরা দ্বি ও ত্রিমাত্রিক আয়তনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখতে পাই, যদিও সমন্বয় সৃষ্টি হয়েছে ।
অবশ্য এটা অস্বাভাবিক নয়, কারণ তিনি সবেমাত্র বাস্তববাদ থেকে বিদায় নিয়ে বিমূর্তবাদের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছেন, সুতরাং বাস্তববাদ থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি। সূক্ষ্ম গতিশীল ছন্দায়িত রেখা, অর্ধ-বৃত্ত আকার, এসব কিছু মিলে সঙ্গীত সৃষ্টি করেছে। নৌকার পালগুলো উপরের কিনারায় এবং অগ্রভূমিতে বাঁশের সাঁকো আংশিক কেটে যাওয়ার ফলে রচনা যেমন দারুণ ক্ষীপ্র গতি সৃষ্টি হয়েছে তেমন ছন্দময়ী হয়ে উঠেছে।
তিনি আলো-আঁধারের বৈষম্য সৃষ্টি না করে মিডল-টোনের বিভিন্ন স্তর বিন্যাস করেছেন, সেজন্য সুক্ষ্ম ছন্দায়িত রেখা ও অর্ধ-বৃত্ত আকারের সাথে সমন্বিত আলো-ছায়া একত্রে মিশে মধুর সঙ্গীত সৃষ্টি করেছে । সমসাময়িকদের তুলনায় সফিউদ্দিন তেল মাধ্যমেও নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন । তার প্রথমদিকের কিছু তেলচিত্রের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান ভিত্তিক রঙের বিশ্লেষণ ও ব্যবহার থেকে রং সম্বন্ধে তার স্পষ্ট ধারণার সাক্ষ্য পাওয়া যায়।
টাটকা বা খাঁটি উজ্জ্বল স্বচ্ছ রং এবং সার্বিক ব্যবহার (Treatment) থেকে আত্মবিশ্বাস ও স্বাচ্ছন্দ্য স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায় । তিনি নিশ্চিত ও দক্ষতার সাথে বস্তুর গঠনক্ষম বৈশিষ্ট্য (Plastic quality ) বা গুণাগুণ ফুটিয়ে তোলেন। যেমন- তরমুজসহ জড় জীবন এবং ধান ঝাড়া তেলচিত্র দু’টি এখানে উল্লেখ করা যায়।
জড় জীবন ছবিটির মধ্যে সদ্য কাটা রসালো এক খণ্ড তরমুজ ফালি টেবিলের উপর রাখা আছে। তরমুজ ফালির টলটলে রসালো ভাব একজন তৃষ্ণার্তকে সহজেই প্রলুব্ধ করে । খালা ও কাচের উপরে পড়ে থাকা কয়েকটি বীচি, তীক্ষ্ণ চাকুর ধারে সামান্য রস এবং কাচের উপর সামান্য রস আলোতে চিকচিক করছে, অতি ধীরে ধীরে ঢালুর দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হয় যে, এক মুহূর্ত আগে তরমুজটা কাটা হয়েছে।
তরমুজটার একপাশে পানির একটা খালি গ্লাস এবং অর্ধেক পানি ভরা একটা জগ রাখা আছে। পশ্চাদভূমিতে গাঢ় নীল রঙের পর্দা বা কাপড়ের সাথে গ্লাস ও জগটা মিশে একাকার হয়ে গেছে । জগ ও গ্লাসের উপর অতিসতর্কভাবে সাদা রঙের কয়েকটা আঁচড়ে কাচের উপরে আলো চকচক করছে মনে হয় । যা থেকে কাচের স্বচ্ছতা, ঘনত্ব, দৃঢ়তা ও আয়তন অতি সুন্দরভাবে অনুভব করা যায়।
এমন মনে হয় যে, গ্রীষ্মের কোনো এক অপরাহে কোনো গৃহবধূ বা পরিচারিকা এইমাত্র তরমুজটি কেটে পাশের ঘরে ছেলে-মেয়েদের তরমুজ যাওয়ার জন্য ডাকতে গেছে। কেবল একটি জিনিস যা সফিউদ্দিনের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে সেটা হলো, তরজুমের ফালি, থালা এবং টেবিলের উপর ইতস্তত বসে থাকা কিছু মাছির অভাব।
কাচের গ্লাস, অর্ধপূর্ণ পানির জগ, তরমুজের রসালো টলটলে ভাব একদিকে বস্তুর বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির দক্ষতা অপরদিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি ও ঘটনার বিশ্লেষণ ক্ষমতার পরিচয় বহন করে।
ধান ঝাড়ার দৃশ্য আমাদের কাছে অতি পরিচিত, যা ধান কাটার ঋতুতে আমাদের দেশের প্রতিটি গ্রামে দেখা যায়। দু’জন কৃষক তক্তার উপর আছড়ে আছড়ে ধানের আঁটি থেকে ধান ঝেড়ে আলাদা করছে। পশ্চাদভূমিতে ধানের আঁটি এদিক ওদিক পড়ে আছে ।
খামারের সার্বিক পরিবেশ দেখে মনে হয় যে, তারা গ্রামের একটা সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবার অথবা কোনো গৃহস্থ পরিবারের খামারে দিন হাজিরা হিসেবে কাজ করছে।
তাদের দৈহিক ভঙ্গি কিছুটা অতিরঞ্জিত করার জন্য মনে হয় যে, তারা ধান ঝাড়ার পরিবর্তে কুড়াল দিয়ে সজোরে কঠিন কিছু কোপাচ্ছে। তাদের কায়িক পরিশ্রমে দৈহিক ভঙ্গির ভেতর সফিউদ্দিনের ভুল পর্যবেক্ষণ ধরা পড়ে। অবশ্য শিল্পর জন্য, নাটক সৃষ্টি করার জন্য অনেক সময় ঘটনা অতিরঞ্জিত করার প্রয়োজন হয়। এটাকে ঠিক ভুল পর্যবেক্ষণ না বললেও চলে।
তার এই কাজটি প্রতিচ্ছায়াবাদী আঙ্গিকে আঁকা। যার মধ্যে তিনি মোটা বা পুরু করে রং ব্যবহার করেছেন। কিন্তু প্রতিচ্ছায়াবাদী শিল্পীদের মতো রং সরাসরি ক্যানভাসের উপর মিশ্রিত না করে প্যালেটের উপর মিশ্রিত করেছেন। ফলে রং আংশিকভাবে মলিন, প্রায় কাদা কাদা ভাব হয়ে গেছে। উজ্জ্বল আলোর জায়গায় সাদা ও ঘাঁটি হলুদ রং ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে টোনের সাথে সম্পর্কহীন মনে হয়। যার মধ্যে প্রতিচ্ছায়াবাদ সম্বন্ধে তার অস্পষ্ট ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে।
কাজের মোট ধরন থেকে এটাকে প্রতিচ্ছায়াবাদ না বলে উত্তর প্রতিচ্ছায়াবাদ বলাই ভালো। যা হোক, এটাকে তার উল্লেখযোগ্য কাজ হিসেবে গণ্য না করা গেলেও গঠনকালীন সময়ের কাজ হিসেবে সহানুভূতি সহকারে বিবেচনা করে। তার রূপান্তরের বিশেষ এক সময়ের কাজ হিসেবেই এটাকে উল্লেখ করা যায় ।
তিনি বাস্তববাদ থেকে প্রতিচ্ছায়াবাদ, উত্তর-প্রতিচ্ছায়াবাদ, এমনিভাবে ক্রমশ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বিমূর্তবাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কিন্তু এই বিবর্তনের প্রত্যেকটি স্তর ক্ষণস্থায়ী এবং কাজের সংখ্যাও খুব কম ।
বিমূর্ত কাজের আরম্ভ থেকে তিনি ছাপচিত্রের বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেন; যেমন—
লিথোগ্রাফ, অ্যাকোয়াটিন্ট, মেজোটিন্ট, ড্রাই পয়েন্ট, এচিং প্রভৃতিতে আত্মনিবেশ করেন এবং দারুণভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকেন ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে তার আঙ্গিক দানা বাঁধতে শুরু করে, এক যুগ আগে যার শুরু হয়েছিল। সত্তর দশকের শুরু থেকে তিনি বিশেষভাবে তেল মাধ্যমে পুনরায় আত্মনিয়োগ করেন। ঐ সময় থেকে তার রংগুলো টাটকা, অধিকতর স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ সবুজ ও নীল রঙের ব্যবহার তার কাজগুলোর সঞ্জীবনী শক্তি সৃষ্টি করেছে।
রঙের বিন্যাস, আকার, গঠন, আকৃতি এবং সার্বিক ব্যবহারের ভেতর তেল মাধ্যমে তার কলা-কৌশল জ্ঞান, দক্ষতা প্রমাণিত হয়। তার কাজ দেখে মনে হয় যে, তিনি অত্যন্ত পরিপাটি রুচিশীল, মার্জিত খুঁতখুঁতে স্বভাবের- সহজে তৃপ্ত হন না। ১৯৭৬ সালে তেল মাধ্যমে আঁকা জাল (Net) শিল্পকর্মটির কথাই ধরা যাক।
জাল একটি অন্যতম মনোরম বিমূর্ত শিল্পকর্ম। অত্যন্ত হিসাব করে পরিসর বিভাজন (Division of space) দীপ্তমান সবুজ ও স্বচ্ছ নীল রঙের সুন্দর বিন্যাস, ভারসাম্য রচনা এবং লাল রঙের সামান্য কয়েকটি আঁচড় নকশা সৃষ্টি করেছে। অতি যত্ন সহকারে আঁকা এই ছবিটি থেকে তার পূর্ব পরিকল্পিত চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় ।
এই চিত্রকর্মের ভেতর তিনি পরিচিত আকৃতি এবং বাইয়োমরফিক রূপকল্প ব্যবহার করেছেন । মূল বিষয় তিনি ক্যানভাসের উভয় পাশে এমনভাবে স্থাপন করেছেন যা রচনার ভারসাম্য রক্ষা করে এবং ‘ভিস্তা’ (Vista) সৃষ্টি করেছে। জাল ও মাছগুলো জেলেদের জীবনের প্রতীকী উপস্থাপনা নয় বা কোনো তথ্য প্রকাশ করে না বা বাণী বহন করে না । বিষয় একটি ভিত্তি মাত্র । এগুলো আসলে নকশার উপাদান ও উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে প্যাটার্ন সৃষ্টির অলঙ্কার হিসেবে
কিন্তু ক্যানভাসের একেবারে বামদিকে ছোট একটি বৃত্ত ব্যবহার করার জন্য রচনার ভারসাম্য এবং পরিসর বিভক্তিকরণে তার মধ্যে কিছুটা দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা প্রকাশ পেয়েছে । অবশ্য বস্তুটি যদিও অপ্রয়োজনীয় এবং অন্যান্য আকৃতির সাথে সম্পর্কহীন তবুও মূল রচনায় কোনো বিঘ্ন ঘটায় না । এই সামান্য ত্রুটি উপেক্ষা করা যায় ।
তার সব বিমূর্ত কাজ পরীক্ষা করলে দেখা যায়, প্রথমদিকের অর্থাৎ গঠনকালীন সময়ের কাজগুলোর মধ্যে অর্ধ-বৃত্তাকার ও বক্ররেখার প্রাধান্য বেশি এবং হাল আমলের কাজের মধ্যে ত্রিভুজাকৃতি ও সরলরেখা প্রাধান্য পেয়েছে। একইভাবে পূর্ববর্তী দৃঢ় রেখা ও আকৃতি হাল আমলের সূক্ষ্ম রেখা ও আকৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
তার প্রথমদিকের কাজের ভেতর আকার, আকৃতি ও টোনের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে রঙের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণই মুখ্য লক্ষ্য। প্রথমদিকের নিরপেক্ষ রং যেমন, ধূসর, কালো, সাদা, তামাটে ও মৌনী সবুজ এর পরিবর্তে হাল আমলের চিত্র-বিচিত্র স্পন্দনশীল রং যেমন- উজ্জ্বল হলুদ, লাল, স্বচ্ছ সবুজ ও নী রঙের সমন্বয় বিপরীত।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটা কথা বলা দরকার, ভাষায় যেমন স্বরের ব্যবহার অপরিহার্য তেমনি চিত্রশিল্পের রঙের ব্যবহারে টোনের গুরুত্ব অপরিহার্য। বিশেষ করে কবিতায় যেমন শব্দ চয়ন ও ধ্বনি সৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তেমন চিত্রকলার ক্ষেত্রে টোনের বিন্যাস অর্থাৎ রঙের বিন্যাস ।
চিত্রকলায় ‘টোন’কে ভাষার সাথে তুলনা করে ব্যাখ্যা করলে বুঝতে সহজ হবে । ভাষায় যেমন ব্যঞ্জন বর্ণের সাথে স্বরবর্ণ যুক্ত হয়ে ধ্বনি সৃষ্টি হয় তেমন চিত্রকলায় রং ব্যবহারে টোনের ব্যবহার হয়ে থাকে। ‘টোন’কে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, একই রঙের একেবারে গাঢ় অবস্থা থেকে একেবারে উজ্জ্বল হালকা অবস্থায় ক্রম রূপান্তর বা স্তরবিন্যাসকে টোন বলা যায়।
ভাষায় যেমন বিভিন্ন স্বর যুক্ত হয়ে বিভিন্ন ধ্বনি সৃষ্টি হয় তেমন রঙের বিভিন্ন তারতম্য ঘটিয়ে বিভিন্ন টোন সৃষ্টি হয় এবং টোনের তারতম্যের জন্য বিভিন্ন ফলাফল ও ইন্দ্রিয়ানুভূতি সৃষ্টি হয়। রঙের ব্যবহারে, টোনের কারণে, দূরত্ব, ঘনত্ব, আয়তন, গভীরতা, পরিধি, পূরক বৈশিষ্ট্য, স্বচ্ছতা, অস্বচ্ছতা প্রভৃতি সৃষ্টি হয় । যাকে চিত্রকলার ধ্বনি বলা যায় ।
তার কাজগুলো অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি আবেগতাড়িত হয়ে কোনোকিছু করেন না বা তার মধ্যে আবেগপ্রবণতার আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে না। উপরন্তু, তিনি আবেগকে সংযত করে অত্যন্ত সুনিয়ন্ত্রিতভাবে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকেন । যেজন্য তার কাজগুলো আবেগপ্রবণতার চেয়ে অধিক যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞানভিত্তিক, এক কথায় বলা যায়, নিয়মনিষ্ঠ।
তার কাজ থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে কেবল আবেগবশত তিনি কোনোকিছু শুরু করেন না। অর্থাৎ কোনো ছবি আরম্ভ করার আগেই সব বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করেন। এখানে বিষয়বস্তু কেবল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যেজন্য বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত ভাব বা তাৎপর্য গৌণ । রং ও আকৃতির বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ এবং নানারকম কারিগরি পরীক্ষা- নিরীক্ষাই হলো মুখ্য। অর্থাৎ শৈল্পিক ও নান্দনিক সমস্যা এবং সমস্যা সমাধানের পথ আবিষ্কার করা এবং কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হলো মূল উদ্দেশ্য ।
কেবল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা ও রাতারাতি সুখ্যাতির পুষ্পাঞ্জলি পাওয়ার জন্যই তিনি অনুকরণ প্রবণতাবশত বিমূর্ত ধারার দিকে ঝুঁকে পড়েন নি। কেবল মতবাদের দিক থেকে বিমূর্ত ধারা অনুসরণ করেন। কিন্তু বিষয়বস্তুর মনোনয়ন ও উপস্থাপনার মধ্যে স্বদেশিকতা অক্ষুণ্ণ থাকে ।
অবশ্য তার প্রথমদিকের কাজের ভেতর ইংলিশ স্কুল অব আর্ট-এর অস্পষ্ট ছায়া দেখা গেলেও বিশেষ কোনো ইংরেজ শিল্পীর প্রভাব বা অনুকরণ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। না। তার পরবর্তী সময়ের কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তার কাজগুলো ক্রমশ ইংলিশ স্কুল অব আর্ট-এর প্রভাবমুক্ত হয়ে পড়ে, অপরদিকে নিজস্ব স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা দানা বাঁধতে থাকে ।
এ কথা সত্য যে, তার সমসাময়িকদের মতো তিনি হয়তো জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছাতে পারেননি । কিন্তু জনপ্রিয়তা একজন শিল্পীর মাপকাঠি নয়। ‘ফল দেখে গাছ চেনা যায়’ প্রবাদটি যদি সত্য হয়, তাহলে বলা যায়, “As an artist, he is his work and not a human being ” অবশ্য এ কথা সত্য যে, আত্মগোপনতার কারণেই তার যতটা জনপ্রিয়তা হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি । কিন্তু জনপ্রিয়তা থাকুক আর নাই থাকুক, সার্বিকভাবে এদেশের শিল্প-আন্দোলনে এবং বিশেষভাবে ছাপচিত্রে তার যে অবদান বা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে ।
আরও দেখুনঃ