আজকে আমরা শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী গ্রন্থের অন্তর্গত।
শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া
বাংলাদেশে বিমূর্তবাদী শিল্পীদের মধ্যে যে কয়জন দ্বিধাহীন স্বীকৃতি ও সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে মোহাম্মদ কিবরিয়া অবশ্যই শীর্ষস্থানীয়। পঞ্চাশ দশকের মধ্যভাগ থেকে ষাট দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে বিমূর্তবাদী শিল্পীদের নিয়ে সমালোচনার যে ঝড় ওঠে তার সামান্য ঝাপটাও কিবরিয়াকেও স্পর্শ করেনি। বলতে গেলে, শুরু থেকেই তিনি শিল্পী ও শিল্পরসিকদের কাছে নন্দিত হয়ে আসছেন । কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে, আবার কেউ বা অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে তার সম্বন্ধে উচ্চ অভিমত পোষণ করে থাকেন ।
নম্র, লাজুক, বিনয়ী স্বভাবের চরিত্র বৈশিষ্ট্য তার কাজের সাথে যুক্ত হয়ে শিল্পরসিক ও সাধারণ দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তার কাজের ধরন থেকে ধীর, স্থির, অবিচলিত সংবেদনশীল চরিত্র বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। তার কাজগুলো পর্যায়ক্রমে পর্যালোচনা করলে মোট দু’ভাগে ভাগ করা যায়:
১. বিষয়বস্তুভিত্তিক জ্যামিতিক আকার ও বাইয়োমরফিক রূপকল্প ।
২. বিষয়বস্তুহীন অর্থাৎ বিমূর্ত প্রকাশবাদ । ষাট দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তার প্রথমোক্ত কাজের ভেতর দু’রকম বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা দেখা যায় ।
প্রথমত, জীবনভিত্তিক এবং দ্বিতীয়ত, কাল্পনিক ও অলঙ্করণকৃত বা রূপক। দ্বিতীয়োক্ত বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তিনি ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট না বোঝা গেলেও স্বপ্নিল পরিবেশ অনুভব করা যায় । সম্ভবত তিনি যে প্রীতিকর জগতের কল্পনা করেন তারই কিছুটা আভাস ঐসব কাজের ভেতর প্রতিফলিত হয়েছে । যে জগতে মানুষে মানুষের মধ্যে নেই কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, কলহ- বিবাদ, রেষারেষি; আছে শুধু অনাবিল শান্তি-সম্প্রীতি, স্নেহ-ভালোবাসা, প্রেম আর মমতা। কিবরিয়া তেমন একটা জগতের কল্পনা করেন ।
তার ঐ সময়ের কাজের মধ্যে কদাচিৎ আর একটা বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা দেখা যায়। সেটা হলো, বিয়োগান্তক নাটক। যেমন— উদাহরণস্বরূপ এখানে সমাধিক্ষেত্র বা গোরস্থান-এর কথা উল্লেখ করা যায়।
গোরস্থানটি নানারকম ছোট-বড় মাঝারি গাছপালা ও আগাছায় ভরে আছে (আমাদের দেশের গোরস্থানগুলো সাধারণত যেমন হয়ে থাকে)। গোরস্থানগুলো দেখলে মৃত ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের উদাসীনতা, অনিহা ও অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায় । এমনকি পরম আপনজনকেও একবার সমাধিস্থ করলে আর আমরা কোনোদিন সেদিকে ফিরেও তাকাই না । আমাদের কাছে মৃত ব্যক্তিরা মৃতই। কিবরিয়া যেন সে কথাটাই আমাদের বলতে চেয়েছেন । এখানে মৃত ব্যক্তিদের প্রতি তার সংবেদনশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায় । তবে কিছু যে ব্যতিক্রম নেই তা বলা যায় না ।
অগ্রভূমিতে একটা মাঝারি আকারের গাছের নিচে এক জোড়া কবর । জোড়া কবরের পশ্চাদভূমিতে আরো অনেকগুলো কবর। হয়তো পরিবারের বাপ-মা, ভাই- বোন, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী অনেকেই এখানে শুয়ে আছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত এক ব্যক্তি জোড়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করছে। তার দাঁড়ানোর ও মুখভঙ্গিতে বিষণ্ণ ভাব ফুটে উঠেছে।
হয়তো সে অনেক পরে বাড়িতে এসেছে। সে তার সন্তানদের জোড়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে । সে বাপ-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের কবর জিয়ারত করতে এসেছে। সস্তানের জোড়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অতীতের স্মৃতিচারণ করছে। অতীতের স্নেহ- ভালোবাসা, হাসি মুখরিত দিনগুলোর কথা মনে করছে। মনে পড়ে যায় তার নিজের শৈশবের কথা। মনে পড়ে যায় তার বাপ-মায়ের স্নেহ-ভালোবাসার কথা । অনেকদিন আগের কথা। তখন সে ছোট ছিল। তাকে ঘিরে বাপ-মায়ের কত সাধ-আকাঙ্ক্ষা । একদিন তাদের ছেলে বড় হবে, মানুষের মতো মানুষ হবে।
সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাপ-মায়ের মন আনন্দে নেচে উঠত । কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন সইল না । একদিন বাপ-মা, ভাই-বোন চিরদিনের জন্য তাকে একাকী ফেলে একে একে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। তাই আজ অতীতের আনন্দমুখর দিনগুলোর কথা চিন্তা করে তার মন ব্যথায় ভরে উঠেছে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সন্তানদের জোড়া কবরের পাশে উদাসভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেও একদিন তার সন্তানদের নিয়ে এমনি কত স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু প্রকৃতি তাকে নিয়ে নির্মম পরিহাস করল। কিবরিয়ার গোরস্থান শীর্ষক চিত্রকর্মটা দেখলে কবি জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার কথা স্মরণ হয়:
“জোড়া মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু ছায়
গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে তায়
জোনাকী মেয়েরা কত স্নেহ ভরে জ্বালাইয়া দেয় আলো
ঝিঁঝিঁরা বাঁজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসেভালো।”
উদ্ধৃত চরণগুলোর ভেতর দিয়ে কবি যেমন অতি করুণ হৃদয়বিদারক অথচ সুন্দর দৃশ্য এঁকেছেন তেমনি কিবরিয়া গোরস্থান ছবিটার মধ্যে বিষয়বস্তুর চয়ন, উপস্থাপনা, ভাবের ব্যঞ্জনা ও রং বিন্যাসের মধ্য দিয়ে একটা মধুর বিমুগ্ধকারী অনুভূতি সৃষ্টি করেছেন । তার এ ছবিটার জন্য ‘বেদনা-বিজড়িত মধুর’ কথাটাই একমাত্র প্রযোজ্য। মৃত্যুর ভেতরও যে সৌন্দর্য নিহিত আছে শিল্পী যেন সেটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছে।
বর্ণিত ছবির অন্তর্নিহিত ভাব মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট (বাংলা সন মোতাবেক সম্ভবত ২ ভাদ্র, ১৩৫২) কোলকাতায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল তাতে কিবরিয়ার জীবনে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তা তার কচি হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কৈশোরেই তিনি বাপ-মা, ভাই-বোন এবং আত্মীয়-স্বজন সকলকে হারিয়েছিলেন। এ দাঙ্গা তার মনে যে ক্ষত সৃষ্টি করে সে যন্ত্রণা তাকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত দাহন করে । এই তিক্ত বিষাদময় অভিজ্ঞতা তার মনে প্রতিহিংসা, বা জিঘাংসা সৃষ্টি করার পরিবর্তে ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । তারই ফলস্বরূপ তিনি হিংসা, বিদ্বেষ ও কলহমুক্ত এমন একটা মানবসমাজ কল্পনা করেছেন যেখানে স্নেহ, মমতা, প্রেম-ভালোবাসা আর সম্প্রীতি ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
এই শান্তি-সৌহার্দপূর্ণ সমাজ পরিবেশের কল্পনা করে সম্ভবত তিনি তার হৃদয়-যন্ত্রণার উপশম প্রয়াস পেয়েছেন । সদ্য অঙ্কুরিত বৃক্ষ চারা যেমন দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোনো বস্তুর নিচে চাপা পড়লে আলো-বাতাসের অভাবে সজীবতা হারিয়ে পাংসু বিবর্ণ হয়ে যায় তেমনি কিবরিয়া কৈশোর বয়সের শুরুতেই আপনজনদের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে সম্ভবত তিনি নির্লিপ্ত, নিষ্ক্রিয় ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছেন ।
শিল্পরসিকরা যারা কিবরিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখজনক অভিজ্ঞতার কাহিনী সম্বন্ধে অবগত তারা প্রায়ই কিবরিয়ার কাজের ভেতর হতাশা ও সুপ্ত বেদনার প্রতিফলন আছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাদের এ ব্যাখ্যা সঠিক নয়। কারণ কিবরিয়ার কাজের মধ্যে লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, কেবল গোরস্থান শীর্ষক ছবিটা ছাড়া আর অন্য কোনো চিত্রকর্মের মধ্যে বিষণ্ন ও নৈরাশ্যর আভাস পাওয়া যায় না।
বর্ণিত ছবিটা মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে মনে হয় যে, জীবনে শত দুঃখ-বেদনা সহজে গ্রহণ করে প্রতিমুহূর্তে আনন্দের সাথে বাঁচতে হবে। বাঁচার মতো বাঁচতে হবে। সেই সঙ্গে মৃত আপনজনদের স্মরণ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে, পরলোকে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করতে হবে। শিল্পী যেন পরোক্ষভাবে আমাদের এ কথাটা বলতে চেয়েছেন ।
তার গঠনকালীন সময়ের কাজগুলো সম্বন্ধে কলাকৌশলগত দিক থেকে বলা যায়, তিনি ঘনকবাদের অনুসরণে জ্যামিতিক আকারে ব্যক্তিগত আঙ্গিক উদ্ভাবনে সচেষ্ট থাকেন । ঐসব কাজের মধ্যে তিনি কখনো লম্বরেখা, কখনো সমান্তরাল সরলরেখা কখনো আবার বক্ররেখা এবং পরিচিত আকাশ ও বাইয়োমরফিক রূপকল্পের সমন্বয় ঘটান ।
তার ঐ কাজের মধ্যে সবুজ রঙের প্রাধান্য দেখা যায়। সর্বময় সবুজ আভা (Greenish hue) সৃষ্টি হওয়ার ফলে অত্যন্ত শান্ত ও স্বপ্নিল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তার শিল্পকর্মগুলো দেখলে মনে হয়, কোলাহলময় পৃথিবী থেকে বহু দূরে কোনো স্বপ্নলোকে বাস করছি । যেখানে আছে শুধু শাস্তি আর সম্প্রীতি।
তার গঠনকালীন কাজের মধ্যে নারী একমাত্র বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে । নরমূর্তি প্রায় চোখেই পড়ে না। কখনো একটা নারীমূর্তি, কখনো দু’টো আবার কখনো মা ও সন্তান পুনঃ পুনঃ তার কাজের মধ্যে ঘুরে ফিরে এসেছে। এমন মনে হয় যে, নারী যেন তার সমস্ত চিন্তা-চেতনা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এর বাইরে যেন আর কোনো জগতই নেই ।
এখানে আমরা কিবরিয়ার মধ্যে একদিকে হামিদুর রহমান এবং অপরদিকে কামরুল হাসান ও রেনোয়ার সাথে ঐক্যতান খুঁজে পাই। হামিদুর রহমান যেমন একটা বা দুটি মানবদেহের ভেতর দিয়ে একটা সমাজ, কখনো একটা জাতি আবার কখনো সমগ্র মানবজাতিকে বুঝিয়েছেন কিবরিয়াও তেমন একটা বা দুটি বা মা ও সন্তানের মধ্য দিয়ে সমস্ত নারী এবং মা ও সন্তানকে বুঝিয়েছেন ।
কিবরিয়ার মা ও সন্তানের চিত্রকর্ম দেখলে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান শিল্পীদের আঁকা মেরি ও যিশুর কথা মনে পড়ে যায় । কিন্তু পার্থক্য হলো, খ্রিস্টান শিল্পীরা কেবল মেরি ও যীশুর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু কিবরিয়ার মা ও সন্তান সমস্ত জাতি, ধর্ম ও সামাজিক শ্ৰেণী সীমা অতিক্রম করে মা ও সন্তানের পবিত্র স্নেহ-ভালোবাসার প্রতিনিধিত্ব করছে।
অপরদিকে কামরুল হাসান ও প্রতিচ্ছায়াবাদী রেনোয়া এবং কিবরিয়ার সাথে সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। অবশ্য কামরুল ও রেনোয়ার কাজের মধ্যে নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যই মুখ্য বিষয় হিসেবে ধরা পড়েছে। যেজন্য তাদের নারীদেহের সৌন্দর্যের মধ্যে কখনো পরোক্ষ বা অস্পষ্টভাবে ইন্দ্রিয় কাতরতা ধরা পড়েছে। কিন্তু কিবরিয়ার নারী দৈহিক সৌন্দর্যের গুরুত্ব একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে।
তৎপরিবর্তে নারীর মাতৃত্ব, স্নেহ, মমতা মুখ্য হয়ে উঠেছে। তার নারী দেহ শরীরি অস্তিত্ব হারিয়ে কাল্পনিক বা রূপক মনে হয় । তার নারীর মুখমণ্ডল চন্দ্রাকৃতি এবং দেহের বাঁকগুলো ছন্দায়িত অর্থাৎ সমুদ্র তরঙ্গের মতো তরাঙ্গায়িত। তার কাজের মধ্যে বারে বারে নারীর উপস্থাপনা থাকলেও যৌবিক আবেদন মুক্ত।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলা যায়, অল্পবয়সে মা ও বোন হারানোর কারণে স্নেহ-ভালোবাসার অভাবে কিবরিয়ার মধ্যে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল এসব নারীমূর্তি আঁকার মধ্য দিয়ে তিনি সে অভাব আংশিকভাবে পূরণের চেষ্টা করেছেন । তাই তার প্রথমদিকের কাজের মধ্যে নারী একমাত্র বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য পায়।
শৈল্পিকভাবে তার কাজগুলো পরীক্ষা করলে যে বিষয়টা দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটা হলো যে, তিনি যখন কোনো একটা বিষয় নিয়ে এবং বিশেষ কোনো আঙ্গিকে কাজ করেন তখন কেবল একটা বিষয় এবং সেই একই বিষয়ের উপর একই আঙ্গিকে ক্রমাগতভাবে দীর্ঘদিন কাজ করতে থাকেন। ফলে আপাততঃভাবে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয়। সেজন্য শিল্পরসিকরা তার কাজকে একঘেয়েমি’ আখ্যায়িত করে থাকেন। কিন্তু পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তিনি একই বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন অর্থাৎ কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন।
ফলে প্রত্যেকটা কাজ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বস্তুত একই ধারা, ধরন ও আঙ্গিকে দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে দক্ষতা ও পরিপক্কতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন, যা তার কাজের বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছে। যেমন প্রায় পঞ্চাশ দশকের মধ্যভাগ থেকে ষাট দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এবং সত্তর দশকের শুরু থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত সমস্ত কাজগুলো একই রকম মনে হয় ।
ষাট দশকের মধ্যভাগ থেকে অর্থাৎ প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দেশ ঘুরে আসার পর থেকে তার কাজের মধ্যে আকস্মিক পরিবর্তন দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্বের বিষয়বস্তুভিত্তিক জ্যামিতিক আকার হঠাৎ বিষয়হীন নিরাকার অর্থাৎ বিমূর্ত প্রকাশবাদে রূপ নিল । এ পরিবর্তন ক্রমবিবর্তনের প্রক্রিয়া এড়িয়ে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটল। সেজন্য তার কাজের ভেতর ঊর্ধ্বলক্ষের প্রবণতা ধরা পড়ে। ফলে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কাজের মধ্যে সম্পর্কহীনতা ও অসঙ্গতি দেখা যায়।
তার পরবর্তী কাজের মধ্যে আকার ও আকৃতি সম্পূর্ণভাবে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে । তৎপরবর্তীতে রেখা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও ভাবপ্রকাশক হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পায় । পূর্বের সর্বময় সবুজ আভা সহসা মিলিয়ে গিয়ে নিরপেক্ষ রঙে ( Acromatic Neutral Colour) রূপান্তরিত হয়ে যায়। তেল মাধ্যমের পাশাপাশি ছাপচিত্র, বিশেষ করে এচিং বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। অর্থাৎ তিনি একই সময় তেল মাধ্যম ও ছাপচিত্রে কাজ করতে থাকেন । এ সময় থেকে বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ লোপ পায়। কেবল মূর্তকরণ এবং বুনোট নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে।
সন্দেহের অবকাশ নেই যে, তার এই নতুন ধরনের শিল্পকর্ম দেখে শিল্পরসিক ও অনুরাগীরা হতবুদ্ধি ও বিব্রতবোধ করলেন। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, সত্য গোপন রেখে সকলে তার এই নতুন কাজকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন। অদ্যাবধি এদেশের শিল্পরসিকগণ তার সম্বন্ধে যেসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন সেসবের সারাংশ করলে কেবল একটা উক্তিই পাওয়া যায়; ‘কিবরিয়া টেক্সচার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, পৃথিবীতে এতকিছু থাকতে সবকিছু উপেক্ষা করে কিবরিয়া কেন শুধু বুনোট নিয়ে পরীক্ষা করছেন? কী এত পরীক্ষা করছেন? তিনি কী আঁকার মতো আর কিছু খুঁজে পান না? প্রকৃতির এত অফুরন্ত রূপ রস থাকা সত্ত্বেও কী তার চিত্ত আকর্ষণ করতে পারছে না? জীবনের কোনো সমস্যাই কি তার হৃদয় স্পর্শ করতে পারে না, তার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে? শিল্পানুরাগী ও সাধারণ দর্শকদের মধ্যে এমন সব প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক কিছু না। আর এ কারণেই শিল্পী ও শিল্পরসিকরা তার কাজকে একঘেয়েমি বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
তবে একটা কথা বুঝলে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া এবং কিবরিয়াকে বোঝা সহজ হবে । সেটা হলো, কিবরিয়া অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক, স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল। আর আত্মকেন্দ্রিকতার জন্যই তিনি নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকেন- নিজের ভেতর নিজেকে খুঁজেন । তাহলেও বলা যায়, শুধু কিবরিয়া নয়, সব শিল্পীই স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল হয়ে থাকেন । বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে অন্যসব শিল্পীরা যদি তাদের অভিব্যক্তি, অনুভূতি ও জীবনবোধ প্রকাশ করতে সক্ষম হয় তাহলে সবকিছু উপেক্ষা করে কিবরিয়া কেন কেবল বুনোট নিয়ে কাজ করছেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, ‘অনুভূতি’ শব্দটা একটা সম্পর্কিত শব্দ, ইংরেজিতে যাকে ‘টার্ম’ বলে । অনুভূতির যেমন কোনো সন্দেহ নেই, বাঁধা ধরা নিয়ম নেই, শিল্পের ক্ষেত্রেও তেমন কোন স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম নেই। একজন শিল্পীর যখন যা মন চায় । অর্থাৎ যখন যেমন অনুভূতি জাগে তখন তাই তেমন ভাবে আঁকে । অর্থাৎ যখন যেমন ভাবে মনের ভাব সহজে প্রকাশ করতে পারে তখন তেমন ভাবে আঁকে ।
সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কিবরিয়া বুনোটের ভেতর দিয়ে তার অনুভূতি বা স্নায়ুবিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। অতএব, দেখা যায় যে, আপাতঃ ভাবে তার কাজগুলো এক ঘেয়েমী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয় । বরঞ্চ বৈচিত্র্যময় ।
এখন কথা হলো যে, তিনি বুনোটের উপর কী পরীক্ষা করছেন এবং কেমনভাবে মনের ভাব অর্থাৎ অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে? কথাটা সহজ করে বললে দাঁড়ায়যে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্নায়ুবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা ইন্দ্রানুভূতির বহিঃপ্রকাশের জন্য তিনি বুনোটকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে । তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বুনোট সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে স্নায়ুবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ইন্দ্রানুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করেন ।
কারণ একই বস্তু একই অবস্থায় একই সময় বিভিন্ন ব্যক্তির মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । আবার একই বস্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অবস্থায় একই ব্যক্তির বা বিভিন্ন ব্যক্তির মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ।
এখানে বুনোট সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন। কারণ বুনোট বা বস্তুর উপরিভাগের গুণগত বৈশিষ্ট্য আন্ত-সম্পর্কযুক্ত । তাই বুনোটের কথা বলতে গেলে যেমন স্বাভাবিকভাবে ইন্দ্রানুভূতির কথা এসে যায় তেমন ইন্দ্রানুভূতির কথা বলতে গেলে বুনোটের প্রসঙ্গ বাদ দেয়া যায় না। প্রথমে ইন্দ্রানুভৃতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন । তা না হলে বিষয়টা সঠিকভাবে বোঝানো বা বোঝা অনেকের জন্য সম্ভব নাও হতে পারে ।
সকলের জানা আছে যে, মানুষ যা কিছু অনুভব করে সেসবই পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বা দ্বারা অনুভূত হয়। শুধু মানুষ নয়, যে কোন প্রাণী-জীব পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করে । বিশেষ বিশেষ ইন্দ্রিয় দ্বারা বিশেষ বিশেষ অনুভূতি জাগে । প্রতিটি ইন্দ্রিয় কার্যকারিতা ভিন্ন। যে ইন্দ্রিয়ের যে ধরনের কার্যকারিতা স্নায়ুতে সেই ধরনের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে । এই পঞ্চ হলো ১. দর্শনেন্দ্রিয়, ২. শ্রবণেন্দ্রিয়, ৩. স্পর্শেন্দ্রিয়, ৪. মাণেন্দ্রিয় এবং ৫ আস্বাদনেন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয় স্নায়ুতে যে ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় মনে সেই ধরনের অনুভূতি জাগে।
এখন বুনোট বা বস্তুর উপরিভাগের গুণাগুণ সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক। বিভিন্ন বস্তুর বুনোট বিভিন্ন হয়ে থাকে । অতএব, বিভিন্ন বস্তুর বুনোটের গুণগত মানের পার্থক্য ও ভিন্নতার কারণে মনে বিভিন্ন ভাব বা অনুভূতি জাগে । সেজন্য চিত্রকলায় বস্তুর গুণাগুণকে শৈল্পিকভাবে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে; যেমন, ১ দর্শনীয় বা দৃশ্যমান (Visual Texture) বুনোট, ২. স্পর্শীয় বুনোট (Tactile Texture)।
প্রতিটি আবার দু’টি উপ-শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে, যেমন- মলিন, অস্বচ্ছ, ঘোলাটে ময়লা, অনুজ্জ্বল, চকচকে, স্বচ্ছ, উজ্জ্বল, পরিষ্কার প্রভৃতি দৃশ্যমান বুনোটের অন্তর্ভুক্ত। একইভাবে স্পর্শীয় বুনোট দু’রকম হয়; যেমন, অমসৃণ বা খসখসে, এবং মসৃণ বা মোলায়েম । এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে স্পর্শীয় বুনোট আবার দৃশ্যমান বুনোটের মধ্যেও পড়ে। কারণ কোনো বস্তুর উপরিভাগ স্পর্শ করে যেমন অমসৃণতা অনুভব করা যায় তেমন দৃষ্টিতেও অমসৃণতা অনুভব করা যায়।
অমসৃণ বুনোট আবার কয়েক রকম হয়ে থাকে, যেমন, এ্যাবড়ো-থেবড়ো, খসখসে, ভঙ্গুর। মসৃণ বুনোটও কয়েক রকম হয়ে থাকে; যেমন, অতিমসৃণ, মসৃণ, মোলায়েম, কোমল, কঠিন প্রভৃতি । কয়েকটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যেমন, এ্যাবড়ো- থেবড়ো পাথর, অমসৃণ তক্তা, বালু, চট প্রভৃতি বস্তুর উপরিভাগ স্পর্শ করলে সবক্ষেত্রে সাধারণ অনুভূতি হল ‘অমসৃণ’। কিন্তু বস্তুর ভিন্নতার কারণে মসৃণতার অনুভূতি ভিন্ন হয়ে থাকে ।
একইভাবে কাঁচের পাত্র, নতুন পিতল, কাঁসা, সোনা, রূপা প্রভৃতি বস্তুর দিকে তাকালে সাধারণ অনুভূতি হল উজ্জ্বল, চকচকে, স্বচ্ছ এবং মাটি, সিমেন্টের দেয়াল, পুরাতন বস্ত্র, ময়লা বস্ত্র প্রভৃতি বস্তুর দিকে তাকালে সাধারণ অনুভূতি হল, অস্বচ্ছ, ঘোলাটে মলিন । হালকা রঙ উজ্জ্বল দেখা যায় এবং গাঢ় রঙ অনুজ্জ্বল মনে হয় ।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, সূর্যরশ্মি ভূ-পৃষ্ঠের উপর সমানভাবে পড়েছে। কিন্তু বস্তুর বুনোটের গুণগত মান এবং রঙের পার্থক্যের ও তারতম্যের কারণে আলো কম বা বেশি প্রতিফলিত হয় । বস্তুর উপরিভাগ যত বেশি মসৃণ ও হালকা রঙের হয় আলো তত বেশি প্রতিফলিত হয়; যেমন, সাদা, হলুদ এবং যে কোন হালকা রঙের উপর আলো বেশি প্রতিফলিত হয় ।
তেমন বস্তুর অমসৃণ উপরিভাগ বা বুনোট এবং গাঢ় রঙের উপর আলোর প্রতিফলন কম হয়, যেমন- কালো, লাল, নীল, সবুজ বা যেকোন গাঢ় রঙ আলো কম প্রতিফলিত করে । বস্তুর বুনোটের গুণাগুণ ও রঙের তারতম্য এবং পার্থক্যের ফলে স্নায়ুতে যে রকম ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় মনে সেই রকম অনুভূতি জাগে।
তাছাড়াও, পৃথিবী অহরহ আপন মেরু এবং নিজ কক্ষপথে পরিক্রমার কারণে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে ভূ-পৃষ্ঠের উপর পতিত আলো এবং প্রতিফলিত আলোর দিক বা কোণ পরিবর্তনের সাথে সাথে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের (ওয়েড লেন্স) পার্থক্য হয়ে থাকে। আলোর কোণ এবং তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের পার্থক্যের কারণে একই বস্তুর উপরিভাগ এবং বিভিন্ন বস্তুর উপরিভাগ মুহূর্তে মুহূর্তে ভিন্নতর মনে হয় বা দেখা যায় । এ পার্থক্য খুবই সূক্ষ্ম।
মনোবিজ্ঞান ও দার্শনিক কোণ থেকে বলা যায় যে, মানুষের মন সর্বদা চঞ্চল মনের চাঞ্চল্যের কারণে মানুষের মধ্যে অহরহ নানা রকম স্নায়ুবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে থাকে । বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, সূর্যের স্থান পরিবর্তনের ফলে সূর্যের আলো ভূ-পৃষ্ঠের উপর একই বস্তুর উপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কোণ থেকে পড়ছে। বস্তুর উপর পতিত আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে চোখের রেটিনায় আসছে।
সেজন্য আলোর কোণ পরিবর্তনের সাথে সাথে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যেরও পরিবর্তন হচ্ছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পতিত আলো এবং প্রতিফলিত আলোর কোণ এবং তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পরিবর্তনের জন্য একই সময় একই ব্যক্তির চোখে বিভিন্ন বস্তু একই অবস্থায় বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ।
আবার একই বস্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অবস্থায় একই ব্যক্তির কাছে বিভিন্ন মনে হয় । আর এ জন্যই মানুষের মধ্যে মুহূর্তে মুহূর্তে বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায় । স্নায়ুবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার শেষও নেই, সীমাও নেই।
প্রসঙ্গক্রমে একটা ঘটনার উল্লেখ করলে হয়তো বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। কথিত আছে যে, একদিন সকালে প্রতিচ্ছায়াবাদী মনে তার উপকূলবর্তী বাড়ির সামনে প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকছিলেন । তিনি সকাল ৯টায় একটা ছবি আঁকতে শুরু করেন । কিন্তু প্রায় পনেরো মিনিট পরে লক্ষ্য করেন যে, একই দৃশ্যের সর্বময় রঙের আভা (হিউ) সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে।
তিনি ঐ ছবিটা স্থগিত রেখে আর একটা ক্যানভাসে ঐ একই দৃশ্য পুনরায় আঁকতে শুরু করেন । আবারো পনেরো মিনিট পরে নিরীক্ষণ করেন। যে, রঙের আভা পুনরায় সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এমনিভাবে মোট পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময়ের মধ্যে তিনি একই জায়গায় একই দৃশ্যের তিনটি পৃথক পৃথক আভাযুক্ত ছবি আঁকেন ।
উদ্ধৃত ঘটনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, প্রতি পনেরো মিনিট পরে পরে সূর্যের স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতির মধ্যে রঙের আভা রূপান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একই বস্তু একই অবস্থায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম দেখা যায় ।
উপরে আলোচিত বিষয়ের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে যে, তাহলে কিবরিয়া কেন শুধু বুনোট এবং নিরপেক্ষ রঙ নিয়ে পরীক্ষা করেছেন? বুনোট সম্বন্ধে বলা যায় যে, বুনোটের পার্থক্যের কারণে পতিত আলো ও প্রতিফলিত আলো এবং তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের পার্থক্য হয়ে থাকে । আর সেজন্যই তিনি কেবলমাত্র বস্তুর বুনোটের গুণাগুণ নিয়ে ক্রমাগতভাবে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন ।
সুতরাং তার কাজগুলোকে শৈল্পিক সমস্যার সাথে মনো- বৈজ্ঞানিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ধারাবাহিক বিশ্লেষণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। অর্থাৎ বুনোটের মাধ্যমে ইন্দ্রীয়ানুভূতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করা তার কাজের গুরুত্বপূর্ণ ও মূখ্য বিষয় ।
তবে নিরপেক্ষ রঙ ব্যবহারের সঠিক কারণ উদ্ঘাটন করতে হলে তার কাজগুলো দীর্ঘদিন বৈজ্ঞানিক ও মনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বিশ্লেষণের দরকার । তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, নিরপেক্ষ রঙ আভাহীন ও স্থিতিশীল হওয়ার কারণে তিনি এসব রঙ নিয়ে কাজ করতে, বিশেষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন । দ্বিতীয় কারণ এই হতে পারে যে, সম্ভবত তিনি একই দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীক্ষণ করে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পার্থক্য নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন।
অথবা, এমনও হতে পারে যে, দৃষ্টির মধ্যে রেটিনাল বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার কারণে তিনি সব সময় নিরপেক্ষ রঙ দেখেন। অথবা রঙ অন্ধত্ব সৃষ্টি হওয়াও অস্বাভাবিক না। নিরপেক্ষ রঙের মধ্যে ধূসর রঙের ব্যবহার সম্বন্ধে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বলা যায়, সম্ভবত অবচেতনভাবে বিষণ্ণতা তার মন আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
তার হাল আমলের অনেক কাজের মধ্যে দেখা যায়, তিনি ক্যানভাসের উপরিভাগে রঙ জমিয়ে জমিয়ে প্রায় এক/দেড় ইঞ্চি উঁচু ঢিবি বা দেয়ালের মতো সৃষ্টি করেন । রঙ উঁচু হওয়ার ফলে ক্যানভাসের উপর আলো পড়লে স্বাভাবিকভাবেই আলো-ছায়া সৃষ্টি হয় । এমনিভাবে তিনি ক্যানভাসের অভ্যন্তরে, একদিকে যেমন কৃত্রিম উপায়ে, আলো- ছায়ার নাটক সৃষ্টি করেন অপরদিকে তেমন ঘনত্ব, দূরত্ব, পরিধি, গভীরতা সৃষ্টি করেন ।
উপরে আলোচিত ইন্দ্রানুভূতি ছাড়াও তিনি আরেকটা তৃতীয় ইন্দ্রানুভূতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন; যেমন- শ্রবণেন্দ্রিয়ানুভূতি । অবশ্য বুনোটের মধ্য দিয়ে এই ইন্দ্রিয়ানুভূতি সৃষ্টি করা সম্ভব না । তবুও তিনি প্রতীকের সাহায্যে এই অনুভূতি জাগানোর চেষ্টা করেছেন ।
সম্ভবত এ কারণে তার কাজের মধ্যে স্বতন্ত্র ও ভাবপ্রকাশক হিসেবে রেখা প্রাধান্য পেয়েছে । সম্ভবত তিনি বিভিন্ন ধরনের রেখাকে এই বিশেষ অনুভূতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন । বিভিন্ন রকম রেখার সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের শব্দ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন; যেমন— কর্কশ, খসখস, ঘসঘস, কিচকিচ ইত্যাদি শব্দের প্রতীক হিসেবে কখনো সরল কখনো বক্র, কখনো হিজিবিজি, কখনো ভঙ্গুর আবার কখনো দৃঢ় ।
তাই দেখা যায়, সরু মোটা রঙের মধ্যে কখনো আঁচড় কেটে গভীর খাত সৃষ্টি করেছেন, কখনো একটা সরলরেখা, কখনো সরল ও বক্ররেখার সমন্বয়, আবার কখনো হালকাভাবে হিজিবিজি রেখা সৃষ্টি করেছেন। এসব বিভিন্ন ধরনের রেখা দ্বারা বিভিন্ন ধরনের শব্দের প্রতীক সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন— একটা কঠিন ধাতব পদার্থের উপর আর একটা কঠিন ধাতব পদার্থ, দ্বারা জোরে ঘর্ষণ করলে কর্কশ বা কিচ শব্দ সৃষ্টি হয় ।
দু’টো কঠিন ধাতব পদার্থ হালকাভাবে ঘর্ষণ করলে কিচিকিচ শব্দ হয়। বালু, কাগজ ইত্যাদির উপর ঘর্ষণের ফলে খসখস শব্দ শোনা যায়। এসব বিভিন্ন ধরনের শব্দ স্নায়ুর উপর আঘাত করলে যে ক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা থেকে বিরক্তি অনুভূত হয় ।
বিভিন্ন প্রকাশ বুনোট সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি যেমন বিভিন্ন স্নায়ুবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন তেমন বিভিন্ন প্রকার বুনোট সৃষ্টির জন্য মাধ্যম হিসেবে তেল ও ছাপচিত্র, বিশেষভাবে এচিং ব্যবহার করেছেন । তার কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, অমসৃণ বুনোট এবং আভাহীন রঙের প্রাধান্য বেশি। যেমন- এবড়ো-খেবড়ো, ভঙ্গুর এবং সাদা, কালো, ধূসর, তামাটে, মাঝে মধ্যে হলুদ এবং কদাচিৎ গাঢ় নীল পূর্বের আলোচনার সূত্র ধরে নিরপেক্ষ রঙ ব্যবহারের কারণ হিসেবে বলা যায়, যেহেতু তিনি রঙের তাৎপর্যের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন সেহেতু আভাযুক্ত (ক্রোমেটিক) রঙ পরিহার করে আভাহীন (এ্যাক্রোমেটিক) ব্যবহার করছেন।
যেসব রঙ দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থাৎ শর্ত ও কারণ পরিবর্তনের সঙ্গে রঙের আভা পরিবর্তন হতে থাকে সেসব রঙের উপর নির্ভর করা যায় না। অবশ্য রঙের আভা পরিবর্তনও পদার্থ বিজ্ঞানের বিষয় । কিন্তু তিনি যে দৃষ্টিকোণ থেকে রঙের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করছেন তার পরিপন্থী । কারণ দ্রুত পরিবর্তনশীল ধারণা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সহায়ক না। তার রঙের ব্যবহার দেখে মনে হয় যে, তিনি রঙের পদার্থ বিজ্ঞানের বিষয়গুলো এড়িয়ে কেবল দৃষ্টি বিজ্ঞান (সায়েন্স অব অপটিকস)-এর বিষয় অর্থাৎ রেটিনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষা করছেন।
উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যেমন— যদি একটা লাল বস্তুর উপর সমানভাবে আলো পড়ে এবং সূর্যের স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পতিত আলো এবং প্রতিফলিত আলোর দিক বা কোণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হয় তাহলে উপরিভাগের আলোকিত স্থানে কখনো লালচে বা পিঙ্ক, কখনো হলুদ, কখনো ধূসর আবার কখনো একেবারে সাদা দেখা যায় এবং ঐ বস্তুর ছায়াংশ হালকা বেগুনি, বেগুনি দেখা যায় । অবশ্য বস্তুর উপরিভাগের রঙ এবং বুনোটের উপর কিছুটা নির্ভরশীল ।
তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে রঙের তারতম্য ঘটে। সমস্ত আভাযুক্ত (অ্যাক্রোমেটিক) রঙের ক্ষেত্রে একই কারণ বা শর্ত প্রযোজ্য। আবার পারিপার্শ্বিক কারণেও এসব রঙের মধ্যে তারতম্য ও পার্থক্য ঘটে। কারণ আলোকরশ্মির মধ্যে সাতটা রঙের সমন্বয় রয়েছে। ফলে আলোকরশ্মি ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দিক বা কোণ পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন সময় একটা রঙের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। রঙের এই রূপান্তর দ্রুত ও সূক্ষ্ম । ফলে দৃষ্টি বিভ্রান্তি ঘটে ।
কিন্তু নিরপেক্ষ রঙ, যেমন- সাদা, কালো, ধূসর, তামাটে, খয়েরি প্রভৃতি সকল অবস্থাতে এক রকম অপরিবর্তনীয় বলা যায় । বিশেষভাবে ধূসর, খয়েরি প্রভৃতি রঙগুলো সকল অবস্থাতে অপরিবর্তনীয় বা আভাহীন থাকে। রঙ আপন আপন অস্তিত্ব ও সত্তা নিয়ে বিরাজ করে ।
সৈয়দ আলী আহসানের কথায়— “Kibria like any modern artist uses colour as identity by itself as an expressince element of life and sensibility. Colour to him is not a material pigment, it has a symbolic significance in its vibrancy and intensity. In modern paintings, colour in the very substance and structure of forms.” (কনটেমপরারি আর্ট সিরিজ অব বাংলাদেশ-১৭, অনু: ৬)। আর এক জায়গায় তিনি বলেছেন : ‘In this way. he has been able to create symphony in colours in their different hues. কিন্তু আলী আহসানের এ ব্যাখ্যা সঠিক হয়েছে বলে মনে হয় না । কারণ কিবরিয়া হাল আমলের আভাযুক্ত রঙ ব্যবহার করেন না ।
কদাচিৎ নীল বা হলুদ ব্যবহার করলেও এমন সতর্কভাবে করেন যে কোনো আভা সৃষ্টি হয় না। দ্বিতীয়, নিরপেক্ষ রঙে কোনো আভা সৃষ্টি হয় না । তাছাড়াও, কিবরিয়া পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে রঙ ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছেন।
সম্ভবত, উপর্যুক্ত কারণের জন্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সুবিধার্থে তিনি নিরপেক্ষ রঙ শ্রেয় মনে করেন। অবশ্য এটাও অনুমান করা যায়, সম্ভবত তার রেটিনায় বিঘ্ন সৃষ্টির কারণে দৃষ্টি বিঘ্নিত হচ্ছে। যে কারণে তার দৃষ্টিতে রঙের আভা ধরা পড়ছে না। অথবা এমনও হতে পারে যে, পতিত আলো, প্রতিফলিত আলো, তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং তার দৃষ্টিতে এমন একটা কোণ সৃষ্টি হচ্ছে যে, তিনি অধিকাংশ বস্তু বা রঙ ধূসর দেখছেন। যেমন- অনেকেই রঙ অন্ধ (কালার ব্লাইন্ড) হয়ে থাকে।
তবে কিবরিয়ার মধ্যে রঙ-অন্ধত্ব সৃষ্টি হচ্ছে বা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে এখনই বলা যায় না।
উপরে আলোচিত বিষয়গুলোর প্রেক্ষিতে কিবরিয়ার কাজ প্রতিচ্ছায়াবাদের, বিমূর্ত ধারায়, সম্প্রসারণ বলা যেতে পারে। তার কাজগুলো বিশ্লেষণ করলে নিম্নবর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়
১. বিষয়বস্তু কাহিনীভিত্তিক বা বর্ণনামূলক না হয়ে ভাবমূলক,
২. বস্তুর বাস্তব রূপ হ্রাস পেয়ে কাল্পনিক বা রূপক,
৩. পরিচিত জ্যামিত্যিক আকার বা আকৃতি লোপ পেয়ে অপরিচিত বা কাল্পনিক বা প্রতীক আকার গঠন,
8. রেখা আকারের অবিচ্ছেদ্য ও অভিন্ন অংশ না হয়ে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও ভাব প্রকাশক,
৫. রঙ বর্ণনামূলক না হয়ে বস্তুনিষ্ঠ ভাব প্রকাশক এবং আভা বিলীন হয়ে নিরপেক্ষ রঙে রূপান্তরিত হয়েছে,
৬. দ্বি-আয়তন সমতলের উপর ত্রি-আয়তন কাঠামো গঠন, এবং
৭. ক্যানভাসের অভ্যন্তরেই ঘনত্ব, আয়তন, পরিধি ও গভীরতা সৃষ্টি হয়েছে ।
তার স্বাধীনতা উত্তরকালে কিছু কাজ এখানে আলোচনা করা হলো। যেমন- তেল মাধ্যমে আঁকা হলুদ কোলাজ এর মধ্যে তিনি সমস্ত পরিসরকে গাণিতিকভাবে হিসাব করে লম্বভাবে কতকগুলো আয়তক্ষেত্র এবং বর্গক্ষেত্রে ভাগ করেছেন। প্রত্যেকটিকে এক একটি একক ইউনিট হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। নিমসমতলে বর্গক্ষেত্রাকারগুলোকে পুনরায় অনেকগুলো ক্ষুদ্রাংশে ভাগ করা হয়েছে।
কালো রঙের একটা আয়তাকার বস্ত্র টুকরা লম্বভাবে উপরদিক থেকে এমনভাবে আঠা দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে যে তামাটে- হলুদ রঙের আয়তক্ষেত্র আংশিকভাবে ঢাকা পড়েছে। নিচের সাদা অংশ উপরের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করছে । কোলাজটা একই সময় দৃষ্টিকে উভয়দিকে টানাটানি করে । ফলে দৃষ্টি উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। যেজন্য সংকীর্ণ বা অপ্রশস্ত (Narrow or Congested) অনুভূতি জাগে ।
চিত্র-২ অন্যান্য কাজ থেকে একটু ভিন্ন মনে হয়, যার ভেতর তিনি টকটকে লাল (Vermilion) রঙ ব্যবহার করেছেন। লাল আকৃতিটা আংশিকভাবে ধূসর বর্ণের আকৃতির আড়ালে ঢাকা পড়েছে । যেজন্য কাছে এবং একই সময় দূরে মনে হয় ৷ কিন্তু লাল রঙের উভয় পাশে কালো আকৃতি দৃষ্টি বিঘ্নিত করে । লাল রঙ ক্রমশ লালচে-বেগুনি
রঙে রূপান্তরিত হয়েছে । তামাটে-ধূসর বর্ণের পশ্চাদভূমির বিপরীতে লালের উষ্ণতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে । এখানে লক্ষ্যনীয় যে, তিনি এ ছবিতে পদার্থবিজ্ঞান ও দৃষ্টি-বিজ্ঞান অর্থাৎ প্রতিচ্ছায়াবাদী মতবাদ অনুসারে রঙ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কোনো বিষয়বস্তু বা বস্তুর উপস্থাপন ছাড়াই কেবল রঙের মূর্তকরণ প্রাধান্য পেয়েছে ।
ছাই-৪ (Ashes-4) শীর্ষক ছবিটা তার রচনা ভঙ্গির একঘেঁয়েমি ভঙ্গ করে নতুনত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, যার মধ্যে সমস্ত পরিসরকে দিগন্তরেখার সাথে সমান্ত রালভাবে অর্থাৎ আড়াআড়িভাবে তিনটি আয়তক্ষেত্রে ভাগ করা হয়েছে। মাঝখানের সবুজাভ-সাদা আয়তক্ষেত্রটাকে কালো রঙ দিয়ে ভঙ্গ করে অর্ধ-বর্গক্ষেত্র গঠন করা হয়েছে । লম্ব রেখা আড়াআড়ি সমান্তরাল রেখার একঘেয়েমি ভঙ্গ করেছে। তামাটে- ধূসর বর্ণের খোয়া সাদৃশ্য আকৃতিগুলো সবুজাভ-সাদা আকৃতিতে খণ্ডিত করেছে । ফলে দৃষ্টি সামনে পেছনে দোলায়িত হতে থাকে । অমসৃণ বুনোট কেমন খসখসে অনুভূতি জাগায় । সেজন্য সমস্ত শরীরে শিহরণ জাগে ।
সবুজ এবং কালো (Green & Black) শীর্ষক ছবিতে সমস্ত পরিসর আড়াআড়িভাবে সমান দু’টি সমতলে ভাগ করা হয়েছে । উপরের কালো অংশকে লম্বালম্বি হালকা কালো রেখা দ্বারা ভাগ করা হয়েছে এবং নিচের সাদা অংশের অভ্যন্তরে কালো, তামাটে এবং সামান্য সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। এমন মনে হয় যে, শূন্যের মধ্যে আলো ও আঁধারের খেলা চলছে ।
নিঃসন্দেহে বলা যায়, ধাতব-ধূসর রঙের আকার (Foms in metelic gray) ছবিটা রচনা কৌশলের দিক থেকে কিছুটা অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছেন । সমস্ত পরিসরকে মোট চব্বিশটা ক্ষুদ্র বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা হয়েছে । প্রতিটা বর্গক্ষেত্রকে এক একটা একক (ইউনিট) হিসেবে ধরা হয়েছে। প্রতিটা বর্গক্ষেত্রের অভ্যন্তরে আবার অর্ধ-পরিচিত আকার গঠন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কেবল একটা ক্রস চিহ্ন ছাড়া অন্যগুলোর মধ্যে কোনটা খোয়া, কোনটা কাঠের টুকরার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ । এ ছবিটাতে কেবল সাদা, কালো এবং রূপালি-ধূসর ( Silver gray) ব্যবহার করা হয়েছে ।
এচিং-৭ম একটা ছাপচিত্র, যার ভেতর একটা গাঢ় ধূসর রঙের আয়তক্ষেত্রাকার ক্যানভাসের উপরও নিচের উভয়দিকে কেটে গেছে। ফলে অত্যুচ্ছ অনুভূতি জাগে । সাদা ও কালো রঙের অপরিচিত আকার আয়তক্ষেত্রের নিচের অংশ আংশিকভাবে ঢেকে রেখেছে । নিখুঁত বৃত্তাকার বিন্দুগুলো দেখে মনে হয় যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে অসংখ্য বুদবুদ ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠতে উঠতে একেবারে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ।
এ ছবিটা ফেনিজারের রচনা কৌশল ও কাজের ধরনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । কিন্তু আলোচিত অন্য কাজগুলোর মধ্যে পরিসর বিভাজন দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে এখানে একটা প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, যেখানে রঙ ও বুনোট দ্বারা স্পর্শেন্দ্রিয় ও দর্শনেন্দ্রিয় অর্থাৎ ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য স্নায়ুবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করাই মূল ও মুখ্য উদ্দেশ্য তখন ।
পরিসর বিভাজন এবং আকার আকৃতি গঠন বা ঘনত্ব, আয়তন ইত্যাদি সৃষ্টি করা কি প্রয়োজন? এ থেকে বোঝা যায়, তিনি যে বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন সে বিষয়টা তার কাছে অজ্ঞাত।
বর্ণিত কাজ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, কিবরিয়ার বর্তমান শিল্পকর্ম আমাদের জন্য কোনো বাণী বা তথ্য বহন করে না, কেবল মূর্তকরণ । এগুলো শুধু শৈল্পিক সমস্যা ও কলাকৌশলগত ধারাবাহিক কাজ হিসেবে গণ্য বা আখ্যায়িত করা যায়। অতএব, কোনো একটা কাজকে একক বা স্বতন্ত্রভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা দুরূহ। তবে সমষ্টিগতভাবে আলোচনা করাই শ্রেয়।
বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিল্প আন্দোলনের ইতিহাস, বুদ্ধিভিত্তিক কর্মকাণ্ড প্রভৃতি বিষয়ের প্রেক্ষাপট কিবরিয়ার বিমূর্ত কাজকে সমালোচকের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে তার মৌলিকতা ও স্বতন্ত্রতা সম্বন্ধে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক না। সুতরাং তার বিমূর্ত কাজের উৎস ও অনুপ্রেরণার ভিত্তি খুড়লে দেখা যায়, এর মূল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথিত আছে।
অতএব, এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে বিমূর্ত প্রকাশবাদী চিত্রকলা এবং তার পটভূমি সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন । তা না হলে তার কাজ সম্বন্ধে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া যেমন স্বাভাবিক তেমন গুরুত্ব নির্ণয় করাতেও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ফলে তার মৌলিকতা স্বতন্ত্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব না।
চিত্রকলার ইতিহাস (পাশ্চাত্য) পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৩৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মহামন্দা’র পর থেকে মার্কিন চিত্রকলার দ্রুত অগ্রগতি ও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় । ঐ সময় থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে বিশ্ব শিল্প-আন্দোলনের কেন্দ্র প্যারিস থেকে ক্রমশ নিউইয়র্কে স্থানান্তরিত হয়ে যায় ।
১৯৩৫ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক শিল্পী মাতৃভূমি ত্যাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে নিউইয়র্ক, মহানগর, আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এসব বহিরাগত শিল্পীদের আগমনের ফলে মার্কিন সংস্কৃতি, বিশেষভাবে চিত্রকলা, এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় ।
বহিরাগত শিল্পীদের মধ্যে আর্শিল গোর্কি, হ্যান্স হফম্যান, উইলেম ডি কুনিং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তিনজন বহিরাগত শিল্পীদের কাজকে বিমূর্ত প্রকাশবাদের সূচনা হিসেবে গণ্য করা হয় ।
একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সুদূর পশ্চিমাঞ্চল থেকে স্থানীয় মার্কিন শিল্পী জ্যাকসন পলোক, ফ্রাঞ্জ ক্লাইন, ক্লিফোর্ড স্টিল, মার্ক রথকো এবং বার্নেট নিউম্যান নিউইয়র্ক মহানগরে আগমন করেন । স্থানীয় শিল্পীরা বহিরাগত শিল্পীদের কাজ থেকে দারুণভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন ।
বহিরাগত শিল্পীদের কাজের মধ্যে আয়তন ঘনত্ব, পরিধি, গভীরতা, দ্বি ও ত্রি-আয়তন দ্বন্দ্ব সমন্বয়, বাইয়োমরফিক রূপকল্প প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য স্থানীয় শিল্পীদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে । ফলে পশ্চিম থেকে আগত উপর্যুক্ত শিল্পীগণ পশ্চিমাঞ্চলীয় উগ্র প্রকৃতির যে অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন তার সাথে বহিরাগত শিল্পীদের বৈশিষ্ট্যের সাথে সংযোজন ঘটানোর চেষ্টা করেন, যার ফলশ্রুতিতে এই শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের শুরুতেই এক নতুন ধারার প্রবর্তন ও প্রচলন হয়, যা আজ আমাদের কাছে
বিমূর্ত প্রকাশবাদ নামে পরিচিত। বিমূর্ত প্রকাশবাদকে সংকীর্ণ অর্থে নিউইয়র্ক স্কুলও বলা হয়ে থাকে । পঞ্চাশ দশকের প্রায় মধ্যভাগে বেন নিকোলসন তার অগ্রগামী হ্যান্স হফম্যানের দ্বি ও ত্রি-আয়তন দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের উপর ভিত্তি করে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলেন । তিনি ক্যানভাসের উপরে রঙ জমিয়ে জমিয়ে বরেন্দ্রভূমি অর্থাৎ দু’তিন ইঞ্চি উঁচু করে ঢিবি বা দেয়ালের মতো কাঠামো গঠন করে সত্যসত্যই ক্যানভাসের অভ্যন্তরে ত্রি-আয়তন কাঠামো সৃষ্টি করেন ।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এসব মার্কিন শিল্পীগণ বিমূর্ত প্রকাশবাদ হোক, আর যে কোনো ধারা বা মতবাদ এর উদ্ভাবক হোন বা চর্চাকারী হোন না কেন, তাদের কাজের ভেতর আপন সমাজ ও পরিবেশের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে ।
আমেরিকান শিল্প সমালোচক জন উইলমার্ডিং-এর উক্তি থেকে সে কথা স্পষ্ট বোঝা যায়
“For the United States, there was in both its landscape and in its art, a sense of panoramic scale and range, an awareness of plaintitude and over expanding frontiers. this pulsing energies of grand scale or evident equally in Jackson Polok’s ‘Autum Rhythm ‘ Fredrick Edwine Charles’ ‘Vision of Nayegra’, they suggested the environmental format.
Polok also creates a landscape of epic proportion this literal subject is to be found in the rhythmic movements of his body and the consequent gestures of paint being forcefully dripped across and around the surface.
Through carefully calculated proportions of the whole and the division of the surface as well as through the intense field of colour human creates the sense of an almost infinite landscape of inner thought and order”
বর্ণিত বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে কিবরিয়ার কাজগুলো পরীক্ষা করলে তার কাজের ভেতর এদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশের প্রতিফলন দেখা যায় না। সমালোচকের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, তিনি যদিও বাংলাদেশে বিমূর্ত প্রকাশবাদের ধারক ও বাহক, তাই বলে তাকে এই মতবাদের উদ্ভাবক বা প্রবর্তক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। কেবল একজন গুরুত্বপূর্ণ চর্চাকারী হিসেবে গণ্য করা যায় ।
উপরন্তু, মৌলিকতা ও স্বতন্ত্রতার আলোকে বিচার করলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, পঞ্চাশ দশকে আমেরিকান শিল্পীরা যা শেষ করেছেন দু’দশক পরে কিবরিয়া তাই অনুকরণ বা পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র । তার কাজগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বুনোট বা টেক্সচার সৃষ্টিতে বেন নিকোলসন এবং রঙের ব্যবহারে মার্ক রথকো এই দু’জন শিল্পীদের অনুকরণ প্রবণতা রয়েছে।
অতএব, ঝানু শিল্প-সমালোচক ও বিশ্লেষকদের মনে তার মৌলিকতা ও স্বতন্ত্রতা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন জাগে। তিনি কি সংমিশ্রণকারী? নাকি সংযোজনকারী? নাকি অনুসরণকারী? না কেবল অনুকরণকারী? এমন সব প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়। তবে তিনি আর যাই হোন না কেন, সংযোজনকারী বা সংমিশ্রণকারী হিসেবে দাবি রাখতে পারেন না। কারণ তার কাজের মধ্যে দেশজ আকারের কোনো ছোঁয়া নেই।
তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এবং বিমূর্ত প্রকাশবাদের একজন উৎকর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ চর্চাকারী। এদেশের শিল্প-আন্দোলনে, বিশেষভাবে ছাপচিত্রের অগ্রগতি ও উন্নয়নে তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সন্দেহের অবকাশ নেই যে, দক্ষতার জন্য তিনি উচ্চ সম্মানের দাবি রাখেন।
যেহেতু কিবরিয়া একজন সংবেদনশীল, সচেতন সুক্ষ্মদৃষ্টি সম্পন্ন শিল্পী সেহেতু তিনি যে দেশজ আকার, সমাজ, সংস্কৃতি ও পরিবেশের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাবেন এমন প্রত্যাশা করা হয়তো ভুল হবে না, যা ভবিষ্যতে উত্তরসূরিদের জন্য নতুন সম্ভাবনা ও প্রক্রিয়ার দ্বার উন্মোচন করবে এবং নব নব সৃষ্টির অনুপ্রেরণা যোগাবে ।
আরও দেখুনঃ