শিল্পী মুর্তজা বশীর

আজকে আমরা শিল্পী মুর্তজা বশীর সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী গ্রন্থের অন্তর্গত।

 

শিল্পী মুর্তজা বশীর

 

শিল্পী মুর্তজা বশীর

আমাদের দেশে সুকুমার শিল্পের প্রসার ও উন্নতির মূলে যে কয়জন অগ্রগামী চিত্রকর আছেন মুর্তজা বশীর তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। একেবারে উগ্র মেজাজের না হলেও অতিশয় সংবেদনশীল, আবেগপ্রবণ ও অস্থির প্রকৃতির। বিস্ময়কর ও ঢাধাল্যকর কিছু সৃষ্টি করার দারুণ প্রবণতা তার মধ্যে দেখা যায়। তার কিছু কিছু চিত্রকর্মের নির্বাচন থেকে বোঝা যায়, শিল্পরসিক ও শিল্পানুরাগীদের হতবাক করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করাই একমাত্র উদ্দেশ্য। তবে এখনও পর্যন্ত তিনি বিস্ময়কর কিছু করতে পারেননি।

তার খামখেয়ালিপনা ও অস্থির চিত্ততার কারণে মাধ্যম থেকে মাধ্যম এবং ইজম’ থেকে ‘ইজম’-এ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাই দেখা যায়, তিনি লাইনোলিয়াম, লিথোগ্রাফ, এচিং, জলরঙ, দেয়ালচিত্র, অবশেষে তেলরঙ প্রভৃতি মাধ্যমে কাজ করেন । তবে তেলরঙ মাধ্যমে স্থায়িত্ব দেখা যায়। শুধু তাই নয়, মাঝে-মধ্যে সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের আঙ্গিনায়ও তাকে পদচারণা করতে দেখা গেছে।

রাজনৈতিক দিক থেকে আপন রাজ্যসীমা লঙ্ঘন করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে রাজ্য বিস্তার করলে তাকে সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে দোষারোপ ও নিন্দা করা হয়ে থাকে। কিন্তু ললিতকলার ক্ষেত্রে তার বিপরীত। যে যত আপন কল্পনার জগৎ সীমানা বর্ধিত করে নতুন নতুন ভুবন সৃষ্টি করতে পারে সে তত নন্দিত ও সমাদৃত হয়ে থাকে । তাই দেখা যায়, অনেক কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিক আপন ভাব জগতের সীমানা সম্প্রসারিত করে ললিতকলার অন্যান্য ক্ষেত্রেও নতুন নতুন ভুবন সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়ে থাকে। মুর্তজা বশীরের ভেতরও এই প্রবণতা দেখা যায়।

তিনি চিত্রকর্ম ছাড়াও গল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। এমনকি ষাট দশকের শুরুতে কারওয়া নামে একটা চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছেন। তিনি নিজেই এ ছবির কাহিনীকার, প্রযোজক ও পরিচালক ছিলেন। কিন্তু এটাই তার সর্বপ্রথম ও শেষ চলচ্চিত্র, যার মধ্যে তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ কথা বলা হয়তো অন্যায় হবে না যে, যদি তিনি চলচ্চিত্রে অধিক মনোযোগী হতেন তাহলে হয়তো তৎকালীন পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জগতে কিছু মূল্যবান অবদান রাখতে পারতেন ।

তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সার্বিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দু’টি প্রবণতা দেখা যায়: প্রথমত, হয় খামখেয়ালিপনা বহুমুখী প্রতিভার সম্ভাবনা, আর না হয়, কোন বিষয়ে আশানুরূপ সফলতা ও উৎকর্ষের অভাবের জন্য অতৃপ্ত বাসনা থেকে সৃষ্ট আবেগ প্রবণতা তাকে বিতাড়িত করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তার ঘন ঘন পট-পরিবর্তনের ফলে কোনো বিষয়েই সিদ্ধহস্ত হতে পারছেন না;

দ্বিতীয়ত, টুলুস লুত্রেকের মতো স্বাভাবিক দৈহিক উচ্চতার অভাব তার মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া এবং মানবিক জটিলতা সৃষ্টি করেছে, যা তার কাছে খুবই পীড়াদায়ক । যেজন্য তার মধ্যে অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা ও মানসিক ভারসাম্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে তার মধ্যে ‘Manic depresion’ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় এবং কিছু কিছু সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতার লক্ষণ দেখা যায় ।

 

শিল্পী মুর্তজা বশীর

 

এখানে মনস্তাত্ত্বিক এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা উল্লেখ করা প্রয়োজন । তা না হলে তার চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া বা বোঝা অনেকের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে । কারণ এই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টা তার চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও বুদ্ধিভিত্তিক কর্মকাণ্ড প্রভাবিত করে।

আলোচিত বিষয়ের আলোকে তার চিত্রকর্মগুলো পরীক্ষা করলে, বিশেষ করে কিছু কিছু কাজের ভেতর, প্রতীক ও রঙের ব্যবহারের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ ধরা পড়ে । তবে সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতা থাকলেও অল্পমাত্রায় আছে বলে মনে হয়। যেমন- অর্থহীন প্রতীকের ব্যবহার এবং প্রতীকগুলোর মধ্যে পরস্পর সম্পর্কহীনতা এবং জ্যাবড়া করে লাগানো কাঁচা রঙের ব্যবহারে নিস্তেজ ও অবসাদ ভাব ধরা পড়ে । তবে কিছু কিছু কাজের মধ্যে এই লক্ষণ দেখা গেলেও তার মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতা আছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা ঠিক হবে না। কারণ কলাকৌশল, জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবও হতে পারে।

তার কাজগুলো পরীক্ষা করলে দু’ধরনের প্যালেট ব্যবহারের ভেতর বৈপরীত্য ও বৈষম্য দেখা যায়: একদিকে নিস্তেজ ও অবসাদপূর্ণ রঙ, যেমন- ধূসর ও মলিন হলুদ এবং অন্যদিকে রুচিহীন জাঁকালো রং, যেমন— কাঁচা সবুজ, খাঁটি কমলা ও টকটকে লাল । এক রঙের মধ্যে অন্য কোনো রঙ না মিশিয়ে অর্থাৎ প্রত্যেক রঙের ইনটেনসিটি ও ভলিউম অপরিবর্তিত থাকা সত্ত্বেও রঙগুলো কেমন নিস্তেজ ও অস্বচ্ছ মনে হয় । এ থেকে মনে হয়, রঙ ব্যবহারে কলাকৌশল, জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব রয়েছে, বিশেষ করে রঙের ব্যবহারে তার মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতা এবং Manic-depression দেখা যায়।

তবে তুলনামূলকভাবে বিচার করলে দেখা যায়, তার প্রথমদিকের কাজের মধ্যে সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়, বিশেষ করে তেলরও ব্যবহারে। ১৯৬৪ সালে তার মধ্যে স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা দেখা যায়। কিন্তু সত্তর দশকের শেষদিক থেকে তার মধ্যে আমেরিকান পপ ও অপ আর্ট অনুকরণ প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে। তার প্রথম দিকের কিছু কাজ এখানে আলোচনা করলে পরিবর্তন ও পার্থক্য অনুমান করা সহজ হবে ।

তার প্রথমদিকের কাজের মধ্যে তেল মাধ্যমে আঁকা জড় জীবন এবং আমার ভাই মাত্র দু’টি এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হলো। অবশ্য এগুলো অনুশীলন কাজ, যার ভেতর ঢাকা চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রচলিত প্রভাব প্রবলভাবে বিদ্যমান। যেহেতু এর মধ্যে তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেহেতু এখানে উল্লেখ করা হলো।

তার একেবারে কিছু প্রান্ত রেখাচিত্র (কনটুর ড্রইং) যেমন— উপবিষ্ট বিবসনা নারী (সিটিং নিউড), মারিয়া জুইন এবং কাঠ খোদাই ছাপচিত্র বিড়িওয়ালা এবং লিবোগ্রাফ ছাপচিত্র মাছ বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রান্ত রেখাচিত্রগুলো তার আত্মবিশ্বাস এবং সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু বিড়িওয়ালা খুবই সাধারণ কাজ এবং মাছ শীর্ষক ছাপচিত্রের মধ্যে কৌশলজ্ঞানের অভাব লক্ষ্য করা যায়।

বিড়িওয়ালার মাথার পাগড়িও হাত দু’টো বাঙালিদের চেয়ে আফ্রিকার নিগ্রোদের সাথেই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিড়িওয়ালার পশ্চাদভূমি ও অগ্রভূমির আলোকিত অংশ আলো-অন্ধকারের নাটক সৃষ্টি না করে কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে ।

লিবোগ্রাফ মাধ্যমে আঁকা মাছ শীর্ষক ছাপচিত্রের মধ্যে পিকাসোর সাদা কবুতর (White Dove) শীর্ষক ছাপচিত্রের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। তবে লিনোগ্রাফের কৌশলগত দিক থেকে দক্ষতার অভাব আছে। যাহোক, তার প্রথম দিকের আলোচিত কাজের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা লক্ষণীয় ।

জড় জীবন এর মধ্যে দেখা যায়, একটা টেবিলের উপর একটা লাল রঙের ড্যাপারির সামনে দু’টো মদের বোতল; একটা খালি এবং অপরটা অর্ধেক খালি । একটা গবলেটে এখনও খানিকটা মদ রয়েছে । তার সামনে ছাইদানির উপর রাখা অর্ধেক পোড়া সিগারেট এখনও জ্বলছে, জ্বলন্ত সিগারেট থেকে ধোয়া চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠছে ।

পাশে ৫৫৫-এর টিন সিগারেট রাখা আছে। জড় জীবনের পশ্চাদভূমিতে দেয়ালে একটা তেলচিত্র ঝুলছে । অগ্রভূমিতে লাল মলাটের একটা বই ভাবের গভীরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছবিটার ভেতর কিছুটা রোমান্টিক ও কাব্যিক ভাব রয়েছে । ছবিটা দেখলে পারস্য কবি ওমর খৈয়ামের একটা রুবাইয়াৎ স্মরণ হয়-

এ লুফ অব ব্রেড,

এ গ্লাস অব ওয়াইন

অ্যান্ড এ বুক অব ভার্স… ”

শিল্পী এখানে খুব নাটকীয় কায়দায় একটা কাহিনী উপস্থাপন করেছেন । নাটকের নায়ক ছবির ভেতর অনুপস্থিত। কিন্তু তার উপস্থিতি সহজেই অনুভব করা যায় । এ ছবিটা প্রেম বিরহের প্রতীক উপস্থাপনা । একজন যুবক তার প্রেমিকাকে হারিয়ে প্রেম

বিরহে কাতর হয়ে পড়েছে । প্রেমিকাকে হারিয়ে তার জীবনের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাধ-আহ্লাদ নিঃশেষ হয়ে গেছে । কর্মোদ্দম, উৎসাহ, উদ্দীপনা সব হারিয়ে ফেলেছে । বেঁচে থাকার আর কোনো সার্থকতা সে খুঁজে পায় না, তবুও এই ব্যর্থ জীবনটা কোনো রকম টেনে হেঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চায় একটু সান্ত্বনা, কোন অবলম্বন । তাই হৃদয়ে ব্যথার উপশম করার জন্য সে সুরা ও কাব্যগ্রন্থ বেছে নিয়েছে ।

জীবনে যতদিন বাঁচবে ততদিন সে সুরাগ্রন্থের ভেতর তার প্রেমিকাকে খুঁজে ফিরবে, হৃদয়-বেদনা যদি কিছু লাঘব হয় । হামিদুর রহমানের বংশীবাদক শীর্ষক ছবিতে প্রেম বিরহের যে করুণ সংগীত আমরা শুনতে পাই এখানে সশরীরে জড় জীবন’র মধ্যে সেই একই করুণ সুরের ব্যঞ্জনা দেখতে পাই ।

এ ছবিতে বিষয়বস্তুর অবতারণা থেকে বোঝা যায় যে, একজন হতাশাগ্রস্থ ধনী যুবক সারারাত মদ আর ধুমপান করেছে । ধুমায়িত সিগারেট এবং অর্ধেক শূন্য গবলেট থেকে বোঝা যায় যে, যুবকটি মাতাল হয়ে দৈহিক ও মানসিক অবসাদে অবশেষে শেষরাতে ঘুমে বিছানার উপর ঢলে পড়েছে। টেবিলের উপর বোতলে, গবলেট ও সিগারেট টানে ছায়া দেখে বোঝা যায় যে, তখনো ঘরের ভেতর বৈদ্যুতিক আলোটা জ্বলছে ।

বিশেষ করে ৫৫৫ সিগারেটের টিনটা পঞ্চাশ দশকের সামাজিক অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । ঐ সময় উপরিল্লিখিত সিগারেটের টীন সামাজিক আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে। পঞ্চাশ দশকে আমাদের মতো ধর্মগোড়া রক্ষণশীল সমাজে প্রকাশ্যে সিগারেট (জ্যেষ্ঠদের সামনে) এবং মদপান শুধু নিষিদ্ধ ও নিন্দিত ছিল না, ঘৃণ্যও বটে। সে সময়ের রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশে সিগারেট ও মদ্যপানের দৃশ্য উপস্থাপনাকে প্রচলিত সামাজিক রীতি-নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলা যায়। এদিক থেকে মুর্তজা বশীরকে একজন প্রগতিশীল শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় ।

 

শিল্পী মুর্তজা বশীর

 

সিগারেটের টিন, মদের বোতল ও সুরাপানের পাত্র দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সে একজন ধনী পরিবারের সন্তান। প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করেও প্রেম বিরহে কাতর হয়ে হৃদয়-বেদনা লাঘব করার কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সুরাপান শুরু করেছে । এমন মনে হয় যে, বশীরের প্রথম জীবনের ব্যর্থ-প্রেমকাহিনী এখানে ধ্বনিত হয়েছে । বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিতভাবের দিক থেকে বলা যায়, এটা সুন্দর একটা বিয়োগান্ত ক নাটক ।

এ ছবিটার মধ্যে একদিকে স্পন্দনশীল রঙের ব্যবহার, যেমন- লেবু-হলুদ রঙের টেবিলের চাদরের ছায়াংশে তামাটে রঙ, লাল ড্র্যাপারির ছায়াংশের মতো, পশ্চাদভূমির সাদা দেয়ালের ছায়াংশ ক্রমশ নীল আভায় রূপান্তরিত হয়েছে, অপরদিকে মদের বোতল ও পবলেটের উপর উজ্জ্বল আলোর বিকিরণ এসব কিছুর ভেতর দিয়ে তার নিরীক্ষণক্ষম এবং সংবেদনশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায় । তবে বস্তুগুলো সাজানোর মধ্যে কিছুটা কৃত্রিমতা রয়েছে ।

আমার ভাইয়ের প্রতিকৃতি একটা সুন্দর দৃঢ় মুখের পার্শ্ব-প্রতিকৃতি । এ প্রতিকৃতির ভেতর প্রচলিত অঙ্কনরীতি সম্বন্ধে তার জ্ঞান প্রমাণিত। রঙ বিন্যাস ও বিশ্লেষণাত্মক অঙ্কনের ভেতর উপবেশনকারীর চরিত্র বৈশিষ্ট্য বা ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে। উপবেশনকারী ন্যাড়া মাথা, যত্ন করে ছাঁটা মোচ, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, দৃঢ় গর্দান, উপবেশনকারী একটা সূতির চাদর গায়ে জড়িয়ে একদিকে ঘাড় ফিরিয়ে ঠোঁট চেপে মাটিতে দৃষ্টি নিবন্ধ করে। বসে আছে। তার বসার ধরন ও মোট ভঙ্গিমার মধ্যে তার কূটনৈতিক চারিত্র্যিক দৃঢ়তা ও একগুয়েমি ভাব ফুটে উঠেছে ।

এই প্রতিকৃতিটা ব্রাউন রঙে আঁকা । তবে মাথার খুলি, মোচ এবং দাড়িতে খয়েরি বা আমার রঙ ব্যবহার হয়েছে। এটাকে একরঙা ছবি বলা যায়। এ ছবিটার সাথে ম্যানের আঁকা একটা প্রতিকৃতির সামজস্য পাওয়া যায়। চিত্রকর্মের ভেতর রঙের বিন্যাস ও মুখের আলোকিত অংশ প্রতিকৃতি অঙ্কন ও মাধ্যম ব্যবহারে দক্ষতার উল্লেখ করা যায়। অবশ্য আলোচিত কাজগুলো অনুশীলন মাত্র, যার মধ্যে তার ভবিষ্যত সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

পঞ্চাশ দশকের প্রায় মধ্যভাগ থেকে মুর্তজা বশীরের শিল্পীজীবনের যাত্রা শুরু হয় । এই যাত্রার শুরুতেই তার মধ্যে পাশ্চাত্যপ্রীতি ও অনুকরণ প্রবণতা দেখা যায়। অবশ্য বিষয়বস্তু চয়নের মধ্যে যে কিছু স্বদেশী প্রভাব ছিল না তা নয়। তার ঐ সময়ের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে কিছু উদাহরণ হিসেবে এখানে উল্লেখ করা হলো। যেমন— তরুণী ও পাখি (Girl with the Bird), রমণী ও টিয়া (Woman & the Parrot ), Somnambulist- Ballad, তরুণী ও আয়না (Girl & Mirror), গৃহাভিমুখে ( Towards Home ), লেবুগুলো (The Demons ), মা ও সন্তান (Mother & Child)।

শুরুতেই তিনি বিজ্ঞানের প্রতিসরণ পদ্ধতিতে জটিল আকার গঠন করতে লাগলেন । তিনি এই পদ্ধতিতে মনুষ্য প্রতিমূর্তি ও বস্তুগুলো এমনভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে ভাঙলেন, মনে হয় যেন বস্তুগুলো স্বচ্ছ, একটা বস্তুর ভেতর দিয়ে দৃষ্টি ভেদ করে অপর বস্তু দৃষ্টিগোচর হয় এবং একই বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন পাশ একই সাথে দেখা যায়।

ফলে আকারগুলো জটিলতর হয়ে ওঠে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, মনুষ্য প্রতিমূর্তি ও বস্তুগুলো প্রতিসরণ পদ্ধতিতে ভাঙচুর করে আকার গঠন করলেও মুখাবয়বের ট্রিটমেন্ট সেভাবে করা হয়নি । ফলে দ্বি ও ত্রি-আয়তন ধারণার মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রতিসরণ পদ্ধতি সম্বন্ধে অস্পষ্টতা প্রকাশ পেয়েছে ।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই শতাব্দীর প্রথম বা দ্বিতীয় দশকে পিকাসোর সমসাময়িক কয়েকজন শিল্পী বিজ্ঞানের প্রতিসরণ মতবাদের ভিত্তিতে এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। কিন্তু বশীর বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব অধ্যয়ন না করে ও না বুঝে কেবল বাহ্যিকভাবে অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন । এছাড়াও আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় হলো, মনুষ্য প্রতিমূর্তির মুখাবয়ব ছাড়াও পশুপাখির ব্যবহারে প্রতিসরণ পদ্ধতি অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন । ফলে এই পদ্ধতি অনুসরণ তার মধ্যে অস্পষ্টতা ও দ্বন্দ্ব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

তার ঐসব কাজ বিশেষ করে নারীকেন্দ্রীক । তার নারীরা সবাই পাশ্চাত্যের দীর্ঘাঙ্গি স্থূলকায় (রবাষ্ট) রমণী । তার নারীদের দেহ মাথার তুলনায় বৃহদাকার, ইংরেজি শব্দ ‘Colossal’ এখানে ব্যবহার করলে ভুল হবে না। বিশেষ করে কোমর নিম্নাংশ অতিশয় স্থূলকার এবং ছোট স্তনবিশিষ্ট। তার নারীরা কামরুল হাসান, রেনোয়াঁ ম্যানে এবং পিকাসোর বিশেষ এক সময়ের নারীদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

পিকাসোর ঐসব নারী মূর্তি পরিপ্রেক্ষিতের দিক থেকে পিপীলিকার দৃষ্টিকোণ, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Ant’s eye view’ অনুযায়ী উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বশীরের এসব নারী তার নন্দনবোধ ও ব্যক্তিগত জৈবিক কামনার প্রতীক বলা যায় । মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বলা যায়, বশীরের ব্যক্তিগত উচ্চতার অভাবের জন্য দীর্ঘাঙ্গিনী নারীদের প্রতি তার দারুণ দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। অবশ্য সেজন্য দোষণীয় বা সমালোচনার কারণ হতে পারে না। কারণ তার নারীরা অশ্লীলও নয় বা কামোদ্দীপকও নয় ।

রমণী ও টিয়া শীর্ষক ছবিতে দেখা যায়, একজন রমণী একটা মোড়ার উপর বসে তার ডান হাতের উপর মুখ রেখে গভীর চিন্তায় মগ্ন, চেহারায় বিষণ্ণভাব ফুটে উঠেছে। তার পেছনে একটা টিয়া পাখি ঝুলন্ত খাঁচার ভেতর বন্দি । মনে হয় সে তার দাম্পত্য জীবন অথবা সংসারের কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন। উপস্থিত সমস্যার সমাধান খুঁজছে । কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় বের করতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে ।

কিন্তু যত সমস্যা বাঁধালো টিয়া পাখিটা । তবে কি সে এ সংসার জীবন কারাবন্দি মনে করে? সে কি সংসার জীবনে অসুখী? সে কি সংসার জীবন থেকে মুক্তি চায়? সে কি মুক্তির পথ খুঁজছে? নাকি সে নারীসমাজকে সামাজিক বন্ধনে শৃঙ্খলাবদ্ধ মনে করে? সে কি নারীসমাজের মুক্তির পথ সন্ধানে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছে? পিঞ্জিরাবদ্ধ টিয়া পাখির প্রতীক ব্যবহারের ফলে দর্শক ও সমালোচকদের মধ্যে ভাবের দ্ব্যর্থকতার সৃষ্টি হওয়ার ফলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ।

অতএব, বলা যায়, টিয়ার প্রতীক ব্যবহার করে ভাবের দিক থেকে কিছুটা জোর করে আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা ভাবের মধ্যে দ্ব্যর্থকতা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে । কিন্তু শৈল্পিক দিক থেকে টিয়া পাখির কোন প্রয়োজন অনুভূত হয় না ।

‘Somnam builist Ballad’ শীর্ষক চিত্রকর্মে পাশ্চাত্যের কোনো একটা জনপ্রিয় গাঁথা উপস্থাপনের চেষ্টা দেখা যায়। পাশ্চাত্যের দীর্ঘাঙ্গী, স্বর্ণকেশী, স্থূলকায় রমণীকে তার সাঁতারের পোশাকে গাঁথা গায়িকা হিসেবে বা গীতিকার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে । সে নির্জনে একাকিনী বসে আছে । তার বিপরীত দিকে পশ্চাদভূমিতে সমুদ্রের মধ্যে একটা নৌকা এবং সাগর সৈকতে একটা ঘোড়া দেখা যায় । নৌকাটা কাগজের তৈরি শিশুদের খেলনা বলে মনে হয় । সর্বময় সবুজ আভা সৃষ্টির ফলে স্বপ্নিল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে ।

এমন মনে হয় যে, স্বর্ণকেশিনী চাঁদনী রাতে একাকী বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন । কিন্তু যে গাঁথা তিনি উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন সে সম্বন্ধে বশীরের স্পষ্ট কোনো ধারণা না থাকায় নিজের খেয়ালখুশি মতো নির্জন সাগরে একটা নৌকা ভাসিয়ে এবং সৈকতে একটা ঘোড়া দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

 

শিল্পী মুর্তজা বশীর

 

ফলে বিভ্রান্তি হয় যে, এই স্বর্ণকেশিনীর সাথে নৌকা এবং ঘোড়ার কি সম্পর্ক? উপরন্তু, স্বর্ণকেশিনীর দৈহিক গঠন, বিশেষ করে সাঁতারের পোশাক বা বিকিনি পোশাক, দেখে তাকে একজন শরীর চর্চাকারিণী ব্যায়ামবীর (Gymnast) মনে হয়। এমন হতে পারে যে, সে হয়তো কোনো সার্কাস দলে এই ঘোড়া নিয়ে কসরৎ প্রদর্শন করে থাকে। তা যদি হয় তাহলে শিরোনাম ও বিষয়বস্তুর সম্পর্ক কোথায় থাকলো? বরঞ্চ, এই ঘোড়াটা না থাকলেই দর্শকদের মনে ভাবের সঞ্চার হতো।

এরপরই বশীর হঠাৎ অন্যদিকে মোড় ঘুরলেন। পূর্বের প্রতিসরণ পদ্ধতিতে জটিল আকারগুলো একেবারে সহজ-সরল আকারে রূপান্তরিত হলো। এখানে আকার গঠনের চেয়ে বিষয়বস্তুর সাথে বিভিন্ন ধরনের বুনোট সৃষ্টি ও সাধারণ মূর্তকরণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রাধান্য পেল বেশি।

পাকিস্তানের জালালউদ্দীন তার কাজের প্রকৃতি এভাবে নিরীক্ষণ করেছেন : “His own work, a little sentimental in the beginning typified by canvases like ‘woman and the parrot’, under scores his early interest in modeling and drawing which led him to textural experimentation like ‘fighting rooster’ and ‘Girl with the bird’ which bear evidence of his occupation with the ‘haunting and dramatic” (আর্ট ইন পাকিস্তান, অধ্য: ৫ম, পৃ: ১৪৭, অনু: ২য়)।

বিভিন্ন ধরনের বুনোট সৃষ্টির জন্য তিনি কখনো ঘন পুরু ল্যাকারের মধ্যে তুলির উল্টো পাশ দিয়ে আঁচড় কেটে, কখনো ল্যাকারের সাথে কাঠের গুঁড়ো, বালি মিশিয়ে নানারকম বুনোট সৃষ্টি করলেন । এখানে উদাহরণস্বরূপ বিবাদরত মোরগ এবং তরুণী ও পাখি মাত্র দুটো ছবি উল্লেখ করা হলো ।

বিষয়বস্তুর চয়ন, উপস্থাপনা এবং সার্বিক ট্রিটমেন্টের দিক থেকে বিবাদরত মোরগ- এর মধ্যে কিছুটা নতুনত্ব ও স্বতন্ত্র দেখা যায় । আমাদের দেশে শহর, গ্রাম-গঞ্জে প্রায় সব বাড়িতেই হাঁস, মোরগ-মুরগি পালন করে। বাড়িতে বা পথ চলতে অনেক সময় দু’মোরগ বা মুরগির মারামারি চোখে পড়ে। আমাদের কাছে এটা একটা অতি তুচ্ছ ব্যাপার । কিন্তু পাকিস্তান ও ভারতের অনেক অঞ্চলে মোরগের লড়াই একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ।

আমরা স্পেন দেশের ‘বুল ফাইটে’র কথা জানি এবং আমাদের দেশে সাপের খেলা যেমন একটা জনপ্রিয় খেলা, তেমন পাকিস্তান ও ভারতের অনেক জায়গায় ‘মোরগের-লড়াই’ একটা জনপ্রিয় খেলা হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত হয়ে থাকে । এটা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে । ঐ দেশে এটা অনেকের জীবিকার পাথেয় এবং অনেকের কাছে আনন্দদায়ক, চিত্তাকর্ষক খেলা মাত্র। অনেক যত্ন করে মোরগ পুষে, পরিশ্রম করে নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দেয়। তারপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোরগ দিয়ে লড়াইয়ের জন্য দু’প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পর পরস্পরকে আহ্বান জানায়।

মোরগের লড়াইয়ের জন্য আগে থেকে স্থান, সময় ও তারিখ ঘোষণা করা হয়। আজকাল যেমন মুষ্টিযুদ্ধের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে মুষ্টিযোদ্ধাদের প্রচুর অর্থ দিয়ে আপন দেশে মুষ্টিযুদ্ধের আয়োজন করে দর্শকদের কাছে টিকেট বিক্রি করা হয় তেমন ঐ দেশে মোরগের লড়াইয়ের জন্য অনেক সময় দূর অঞ্চল থেকে অর্থ ব্যয় করে দু’প্রতিদ্বন্দ্বীকে আহ্বান করা হয় ।

মোরগের লড়াইয়ের জন্য চারদিকে ঘিরে দর্শকদের প্রচুর ভিড় জমে। লড়াই শুরু হলে দর্শকদের মধ্যে প্রচুর উত্তেজনা, হৈ-চৈ শুরু হয়ে যায়। অনেকে নিজেদের মধ্যে বাঁজি ধরে। এটা তাদের সমাজে একটা চাঞ্চল্যকর চিত্তবিনোদনকারী খেলা হিসেবে শতাব্দীর প্রচলিত ক্রীড়া হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত হয়ে আসছে।

এই ছবিতে উপস্থাপনা ও ট্রিটমেন্টের শিশু-চিত্রকলার ধরন অনুসরণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে অনেক বাড়িতে ঘরের দেয়ালে, পাঁচিলের গায়ে ছোট ছোট ছেলে- মেয়েরা অনেক সময় কয়লা বা কঠিন কিছু দিয়ে আঁচড় কেটে কেটে ছবি এঁকে থাকে । শিশুরা যা দেখে তা আঁকে না, যা জানে তাই আঁকে। অর্থাৎ কোনো শিল্পীশৈলীর মারপ্যাচের মধ্যে না যেয়ে সহজ-সরলভাবে মনের ভাব প্রকাশ করে। কিন্তু যখন অপরিপক্ক ও অদক্ষ শিশু-চিত্রকলার অঙ্কন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া কোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শিল্পীর হাতের ছোঁয়া পড়ে তখন তা হয়ে ওঠে শিল্পকর্ম।

একইভাবে বশীর ক্যানভাসের উপর মোটা সরু করে লাগানো রঙের মধ্যে তুলির উল্টো পাশ দিয়ে আঁচড় কেটে কেটে একটা আক্রোমন্ত্রোদত মোরগের ছবি আঁকেন। এ ছবিতে তিনি শিশু-চিত্রকলার ভাব ও ধরন খুবই সুন্দরভাবে আয়ত্ত করেছেন। কিন্তু এই একটা ছবি ছাড়া আর কোনো কাজ চোখে পড়ে না।

তরুণী ও পাখি একটা সুন্দর মনোরম শিল্পকর্ম, যা দেখে অকৃত্রিম আনন্দ অনুভূত হয়। এ ছবিতে একজন তন্বী তরুণীর মুখাবয়বের নিকটতম দৃশ্য উপস্থাপন করা হয়েছে । এটা বিশেষ কোনো রমণীর প্রতিকৃতি নয় । কাল্পনিক একটা মুখ । পূর্ণ-যৌবনা তরুণীর মুখের মধ্যে একদিকে যেমন লাবণ্যের দীপ্তি ফুটে বেরুচ্ছে অপরদিকে তেমন কামনা-বাসনার পরিবর্তে নিঃষ্পাপ নিষ্কলুষ চেহারা সহজ-সরল পদ্ধতিতে আঁকার ফলে সহজেই দর্শকের চিত্তাকর্ষণ করে। গাঢ় নীলাভ-সবুজ পশ্চাদভূমির বিপরীতে উজ্জ্বল হলুদ মুখের লাবণ্য ও সরলতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

তবে ক্যানভাসের উপরের বাম কোণায় হঠাৎ একটা পাখির ব্যবহার অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন, যা রচনার ভারসাম্য নষ্ট করে এবং দৃষ্টি বিঘ্নিত করে । পাখির অবতারণা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কেবল কাব্যিক ভাব সৃষ্টি করার জন্যই পরবর্তীতে এটা যোগ করা হয়েছে । তার ঐ সময়ের আঁকা নারী প্রতিকৃতি ও প্রতিমূর্তির সাথে প্রায়ই পশুপাখির প্রতীক ব্যবহার দেখা যায়; যেমন— নারী ও পাখি, তরুণী ও টিয়া, সোমনামবুলাট ব্যালাড প্রভৃতি মাত্র কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো।

ছবির মধ্যে পশুপাখির প্রতীকের ব্যবহার বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার দিক থেকে অর্থহীন ও সম্পর্কহীন হলেও বশীরের মানসিক ও চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দিক থেকে এগুলোর গুরুত্ব ও অর্থ কিছু কম নয়। কারণ এই প্রতীক এবং অসবাদপূর্ণ রঙের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে তার মধ্যে ম্যানিক ডিপ্রেশন থেকে সৃষ্ট বিঘ্নিত চিন্তন-রূপকল্প (Though disturbances) এর লক্ষণগুলো পরিলক্ষিত হয় ।

বশীরের প্রথমদিকের কাজের মধ্যে পাশ্চাত্যের মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র সমাজের প্রতিফলনই বেশি দেখা যায় । এ কথা স্পষ্ট বোঝা যায়, পাশ্চাত্যের সমৃদ্ধশালী সমাজের জৌলুস এবং আধুনিক নগরসভ্যতার চোখ ধাধানো চাকচিক্যের ইন্দ্রজাল বর্ণীরের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করতে পারেনি। উপরন্তু, তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নগরসভ্যতার ইন্দ্রজালের ব্যুহভেদ করে তার গভীরে লুকায়িত সত্য উদঘাটিত করেছে।

আমরা যদি বশীরের চোখ নিয়ে পাশ্চাত্যের দিকে তাকাই তাহলে দেখি যে, পাশ্চাত্যের জীবন কোনো সুখদায়ক পুষ্পশয্যা নয়। আমরা পাশ্চাত্যের সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য এবং বাইরের চাকচিক্য দেখে পশ্চাত্যকে স্বর্গভূমি মনে করি। কিন্তু ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অভ্যন্তরে যে দৈন্য, দুঃখ-দুর্দশা অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত হচ্ছে তা দেখি না। আমরা শুধু পাশ্চাত্যের, রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘জড় বিধিকে দেখি’, ‘জাগ্রত বিধাতাকে দেখি না’।

এসব চিত্রকর্মের মধ্যে একদিকে পাশ্চাত্যের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজের কঠোর জীবন সংগ্রাম, দুঃখ- দুর্দশা, অন্যদিকে একাকী জীবনের নিঃসঙ্গ, নির্জনতা, স্নেহ-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং হতাশা মূর্ত হয়ে উঠেছে। এখানে উদাহরণস্বরূপ গৃহাভিমুখে এবং লেবুগুলো উল্লেখ করা হলো ।

গৃহাভিমুখে শীর্ষক ছবিতে একজন বৃদ্ধকে তার পৌত্রী বা নাতনীকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখা যাচ্ছে। বার্ধক্যের কারণে তার অবসরপ্রাপ্ত জীবন একাকী নিঃসঙ্গভাবে কাটছে । তার পুরনো মলিন শীতবস্ত্র এবং মাথার স্কার্ফ অসচ্ছলতার সাক্ষ্য দেয়। অবসরপ্রাপ্ত জীবন, যা সামান্য ভাতা পায় তাই দিয়ে কোনো রকমে বাকি জীবন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

তার নাতনী বা পৌত্রী হয়তো অনেকদিন পরে স্কুল ছুটির দিনে তার কাছে বেড়াতে এসেছে । তাই সেসমস্ত অভাব অনটন উপেক্ষা করে নাতনীর জন্য বাজার থেকে কিছু খাদ্যদ্রব্য এবং নিজের জন্য এক বোতল সস্তা দামের মদ কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছে নাতনীর সাথে নববর্ষের উৎসব উপভোগ করতে।

সে এক হাত দিয়ে খাদ্যদ্রব্যের ঝুড়িটা নিজেই বহন করছে আর অন্য হাত দিয়ে সস্নেহে নাতনীকে জড়িয়ে ধরে, বার্ধক্যজনিত কারণে, ধীর পদক্ষেপে চলছে। অনেকদিন পরে আপনজনকে কাছে পেয়ে, স্নেহ- আহ্লাদের সুযোগ পেয়ে, শত দুঃখ-কষ্টের ভেতরও আজ সে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে ।

শিশুর উজ্জ্বল হলুদ মুখের মধ্যে নিঃষ্পাপ ও নিষ্কলুষতা এবং ভবিষ্যতের আশা- আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে। যে শিশু এখনো জীবনের রূঢ় বাস্তব সম্বন্ধে কিছুই জানে না । এখানে বশীর হতাশা ও আশা এ দুই বিপরীতমুখী ভাবের সংঘাতের মধ্য দিয়ে রম্য নাটক সৃষ্টি করার প্রয়াস পেয়েছেন।

লেবুগুলো শীর্ষক ছবিতে একজন মধ্য বয়সী লোক এক ঝুড়ি কমলা লেবু বিক্রি করার জন্য রাস্তার একপাশে চুপ করে বসে আছে। তার চেহারার মধ্যে জালাল উদ্দীনের ভাষায় : “Bewildered expresion of anxieties’ ফুটে উঠেছে। তার পোষা কুকুরটা তার পায়ের কাছে গুটিগুটি পাকিয়ে চুপ করে শুয়ে আছে। এখানে বশীর ইতালির মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজের করুণ চিত্র এবং অপরদিকে একাকী নিঃসঙ্গ জীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী ও বিপদের বন্ধু হিসেবে কুকুরকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

উপর্যুক্ত আলোচিত চিত্রকর্মগুলোর ভাবের বিষয় যাই হোক না কেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। শিল্পশৈলীর দিক থেকে বিচার করে এগুলোর যথার্থতা নির্ণয় করতে হবে। শিল্পের বিচারে বিষয়ে বলা হলো সেটা গুরুত্বপূর্ণ না, যে বিষয়ে বলা হলো তা কেমনভাবে বলা হলো, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।

রবীন্দ্রনাথের কথায় বলা যায়, “রচনার মধ্যে লেখক যথার্থভাবে বাঁচিয়া থাকে, ভাবের মধ্যে নহে, বিষয়ের মধ্যে নহে, অবশ্য রচনা বলিতে গেলে ভাবের সহিত ভাব প্রকাশের উপায় দুই সম্মিলিতভাবে বোঝায়, কিন্তু বিশেষ করিয়া উপায়টাই লেখকের।”

প্রতিকৃতিটা মেরি ক্যাসটি ও ডিগার শেষদিকের কিছু প্রতিকৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । কিন্তু বৃদ্ধা মহিলা এবং লেবু বিক্রেতার কোট ও পায়ে আলো-ছায়া দ্বারা জ্যামিতিক আকার গঠন সার্বিক ট্রিটমেন্টের সাথে অসামঞ্জস্য ও অসঙ্গত দেখা যায় কুকুর অঙ্কনে অলঙ্করণ করা হয়েছে, দোআঁশলা জীব মনে করে। কুকুরের দেহের উপর বিড়ালের মাথা বসিয়ে দেয়া হয়েছে । কমলালেবুর ট্রে এবং কাঠের বাক্সটা পরিপ্রেক্ষিতে দেখানো হয়েছে । ফলে দ্বী ও ত্রি-আয়তন ধারণার মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে ।

 

শিল্পী মুর্তজা বশীর

 

উপর্যুক্ত চিত্রকর্মগুলোতে খাঁটি কাঁচা রং ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কৌশলগত বা প্রায়োগিক দক্ষতার অভাবে রঙগুলো অস্বচ্ছ নিঃষ্প্রভ মনে হয় । যে জন্য মোট ফলাফল খুবই বিষণ্ণ ভাব সৃষ্টি করেছে। তার তরুণী ও আয়না শীর্ষক চিত্রকর্মের ভেতর একই অসঙ্গতি দেখা যায়। এখানেও তিনি জ্যামিতিক আকার ও উত্তর-প্রতিচ্ছায়াবাদী আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন । যার ফলে এ দু’য়ের ভেতর দ্বন্দ্ব দেখা যায়। তার কাজগুলো দেখে সহজে অনুমান করা যায় যে, তিনি আপন সংজ্ঞার বিরুদ্ধে জোর করে জ্যামিতিক আকারে ভাঙচুর করে বিমূর্তকরণের চেষ্টা করেছেন।

অনুরূপভাবে মা ও সন্তান শীর্ষক চিত্রকর্মে তিনি সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহ-আহ্লাদ ও ভালোবাসা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মায়ের মুখ অস্বাভাবিকভাবে একদিকে ঘুরানো । তার চেহারার মধ্যে মাতৃত্বের গৌরবে স্বর্গীয় আনন্দানুভূতির পরিবর্তে বিরক্তি ও হতাশা ফুটে উঠেছে ।

একইভাবে শিশুর মুখের ভেতর শিশুসুলভ নিঃষ্পাপ, পবিত্রতার অভাব রয়েছে। শিশুর মুখ না হয়ে তার পরিবর্তে বয়স্ক লোকের মুখ মনে হয় । এমন মনে হয় যে, একজন বয়স্ক বামন একজন মহিলাকে আলিঙ্গন করছে। এই শিশুর মুখাবয়ব কেবল দর্শকদের মর্মাহত করে ।

যাহোক, তার কাজগুলো পরীক্ষা করে বলা যায়, পাবলো পিকাসো ডোরা মারাকে কেন্দ্র করে যেসব প্রতিকৃতি এঁকেছেন এগুলোতে তার ব্যর্থ অনুকরণ চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু টকটকে লাল ও গাঢ় সবুজের ব্যবহার সটিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ।

এরপরে তিনি বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে গ্রাম্য দৃশ্য উপস্থাপন করেছেন, যার মধ্যে একজন মহিলা এবং পশ্চাদভূমিতে একটা হাঁস পুকুরে সাঁতার কাটতে দেখা যায় । কিন্তু বাংলাদেশের গ্রাম্য পরিবেশের বদলে পাশ্চাত্যের ভাব বেশি দেখা যায়, যার মধ্যে মহিলার স্তনের প্রতীক হিসেবে দু’টি বৃত্ত এবং ডিম্বাকৃতির চোখ ব্যতীত আর সবকিছু বর্গক্ষেত্র ও আয়তক্ষেত্রকারে গঠন করা হয়েছে।

ষাট দশকের প্রথমদিকে তার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি অথবা আত্মপরীক্ষা প্রবণতার সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটল। তখন থেকে তিনি পাশ্চাত্যের অনুকরণ প্রবণতা বা প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করে স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা অর্জনে যত্নবান হয়ে ওঠেন । কিন্তু প্যালেট একই থাকল; নিঃষ্প্রভ ও বিষাদগ্রস্ত ।

ফরাসি রাজনৈতিক চিন্তাবিদ বা দার্শনিক রুশো বলেছেন: “প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন জন্মাই । কিন্তু জন্মগ্রহণের পরে সে সর্বক্ষণ শিকলাবদ্ধ (Every where man is born free. but every where he is in chain ) । প্রকৃতপক্ষে, প্রত্যেক মানুষ বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই সত্য উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকে।

অধিকাংশ মানুষ এই অন্ধসুলভ বৈরী পরিস্থিতির সাথে সহিষ্ণুভাবে নিজেকে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতির সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে থাকে । কিন্তু যখনই তার ব্যতিক্রম ঘটে তখনই সংঘাত সৃষ্টি হয়। এমন কিছু লোক আছে যারা এই প্রচলিত বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। শতাব্দীর জরাজীর্ণ প্রচলিত সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় গোড়ামি, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়, সবরকম প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ।

বশীর তেমনি একজন প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। তার ধারাবাহিক দেয়াল শীর্ষক চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে। তার চারদিকে বেষ্টিত শতাব্দীর জরাজীর্ণ দেয়ালকে তার তুলির হাতুড় দ্বারা পুনঃ পুনঃ আঘাত হেনে ভাঙতে চেষ্টা করেছেন । এখানে তিনি জরাজীর্ণ দেয়ালটাকে সামাজিক রীতিনীতি, রক্ষণশীলতা, ধর্মীয় গোড়ামি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন । কিন্তু এই কঠিন দেয়ালের ফাটল নবযুগের জাগ্রত চেতনার ইঙ্গিত দেয়।

এই ফাটল ভেদ করে একদিন নবযুগের সফলতার আলো বেরিয়ে আসবে। এখানে তিনি ভাবের দিক থেকে খুব সুন্দর একটা রম্য নাটক সৃষ্টির ভেতর দিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন । তার ধারাবাহিক দেয়াল চিত্রকর্মে কবি নজরুল ইসলামের এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবের ব্যঞ্জনা শোনা যায়: যেখানে কবি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন:

“আদি শৃঙ্খল সনাতন শিষ্ট আচার এ যে সর্বনাশী, এরে ভাঙিব এবার”

রবীন্দ্রনাথ সহসা আর্তনাদ করে উঠেছেন :

“চারিদিকে মোর একি কারা ঘোর ভাঙরে পাষাণ, ভাঙরে কারা…. কি জানি কি হল আজি জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, ওরে প্রাণের বেদনা প্রাণের আবেগ রুখিয়া রাখিতে নারী ।”

 

শিল্পী মুর্তজা বশীর

 

উপর্যুক্ত ভাবের দিক থেকে বলা যায়, সচেতনভাবেই হোক আর অসচেতনভাবেই হোক, এটা তার আত্ম-চেতনা ও আত্ম-উপলব্ধির প্রকাশ। তিনি যেন সহসা নিজের বিরুদ্ধে নিজেই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন। তিনি যেন হঠাৎ নিজের সংস্কারাচ্ছন্ন মন, সংকীর্ণতা, গোড়ামি, পাশ্চাত্যের অনুকরণ প্রবণতা প্রভৃতি অবচেতনভাবে উপলব্ধি করেছেন । তাই তিনি নিজের মুক্তির সন্ধানে পথ খুঁজেছেন, নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন ।

আত্ম-অনুসন্ধিৎসা ও আত্ম-মগ্নতার কারণে যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের মধ্যে এ রকম আত্ম-চেতনা ও আত্ম-উপলব্ধি ঘটে থাকে। বশীরের মধ্যেও সেই আত্ম-চেতনা ও আত্ম-উপলব্ধির উন্মেষ দেখা যায় ।

দেয়াল শীর্ষক চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে এখানে মাত্র কয়েকটা চিত্রকর্ম আলোচনা করা হলো। দেয়াল-২৮ এর মধ্যে একটা ধ্বংসন্মুখ দেয়ালের উপস্থাপন দেখা যায়, যার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ফাটল ধরেছে। এখানে সেখানে পলেস্তরা খসে পড়েছে, তামাটে- হরিদ্রাভ বর্ণের নোনা ধরা ইটের ভেতর একটা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। প্রচলিত পুরাতন।

রীতিনীতি, রক্ষণশীলতা, অজ্ঞতা এবং অবক্ষয় যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে নবযুগের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তার পতন শুরু হয়েছে। নবীনেরা পুরাতনকে বর্জন করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে নতুন সাজ গড়ার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছে। এ দেয়ালটা তারই প্রতীক ।

কিন্তু পশ্চাদভূমিতে সাদা রেখা, দেয়ালের মধ্যে ফাটল এবং দেয়ালের ডানদিকের গর্তটা তাৎপর্যের দিক থেকে একই ভাবের পুনরাবৃত্তি, যা শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ করেছে । সার্বিক ফলাফলও ম্রিয়মাণ ও বিষণ্ণ ।

দেয়াল-৭৪ এর ভেতর কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। এ ছবিটার মধ্যে ভাবের পরিপকতা এবং রঙ ব্যবহারের দক্ষতা অনেকটা উন্নত। সংক্ষেপে বলা যায়, সবদিক দিয়ে এটা সুপরিকল্পিত, যার মধ্যে টকটকে লাল ক্রমশঃ পিঙ্ক রঙে রূপান্তরিত হয়েছে । হালকা বেগুনি, বেগুনি এবং লালচে সাদা এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে, মনে হয় দেয়ালের এখানে ওখানে এখনো চুন-বালির তৈরি মূর্তির (স্টাকো) চিহ্ন রয়ে গেছে ।

ক্যানভাসের একেবারে নিচের অংশে গাঢ় রঙের দেয়ালের মধ্যে গর্ত বলে মনে হয় । হালকা বেগুনি এবং বেগুনি রং ব্যবহারের জন্য লাল রঙের উষ্ণতা আরো বৃদ্ধি পায় । দেয়াল-৯১তে অতিরিক্ত গাঢ় রঙ ব্যবহার করার ফলে কালচে হয়ে গেছে। ফলে দর্শকরা কিছুই আবিষ্কার করতে পারে না।

স্পষ্টত বোঝা যায়, ঘটনার ধারাবাহিকতা ও আঙ্গিকের স্বতঃস্ফূর্ততা বজায় রাখা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। দর্শকরা অনেক কষ্টে আবিষ্কার করতে পারে যে, কতকগুলো গাছ একটা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । এছাড়া আর কিছুই বোঝা যায় না। সবকিছুতে লালচে-তামাটে রঙ ব্যবহারের জন্য বস্তুগলো পরস্পরের সাথে জড়াজড়ি করে মিশে গেছে। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, ঘটনা ও আঙ্গিকের ধারাবাহিকতা বারে বারে ব্যাহত হওয়ার জন্য একঘেয়েমি দূর হয়েছে ।

এটা বোঝা যায়, কিছুসংখ্যক চিত্রকর্ম আঁকার পরে তার মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায় । কিন্তু কেবল সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যই তিনি জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন । যে জন্য স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব অনুভূত হয় ।

স্বাধীনতা উত্তরকালে, সত্তর দশকের মধ্যভাগ থেকে, তার কাজের ধারা ভিন্ন দিকে মোড় নেয় । এ সময় তার মধ্যে দেশাত্মবোধের ক্ষীণ চেতনা লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য দেশাত্মবোধের কাজের সংখ্যা খুবই নগণ্য এবং চেতনাও স্বল্পমেয়াদি। যেমন- শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভের জন্য উৎকীর্ণ লিপি মাত্র একটা এখানে উল্লেখ করা হলো ।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে শহীদ ছাত্রদের প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণের জন্য তিনি শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভের জন্য উৎকীর্ণ লিপি শীর্ষক চিত্রকর্মটি করেন। উৎকীর্ণ লিপির প্রতীক হিসেবে মাথা, হাত ও পা বিহীন স্থূলদেহী নারী মূর্তি (Torso) উপস্থাপন করা হয়েছে। পশ্চাদভূমিতে অত্যন্ত হালকা নীল ব্যবহার করার জন্য মূর্তিটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। কিন্তু নিতম্বের ডান পাশে কালো এবং উরুতে সামান্য কমলা রঙের আঁচড় দৃষ্টিকটু লাগে ।

কামনা-৫ এর মধ্যে তিনি একটা কাল্পনিক জ্যামিতিক আকার গঠন করার চেষ্টা করেছেন, যা আমাদের জন্য কোনো বাণী বহন করে না। কৃষ্ণবর্ণের পশ্চাদভূমির বিপরীতে তিনি প্রথমে কমলা রঙের আকার গঠন করেন । তার উপর হালকা হলুদ রঙ লাগানো হয়। এমনিভাবে শেষ পর্যায়ে ধূসর রং দিয়ে হালকা হলুদ রঙের সমস্ত আকৃতিটা ঢেকে দেয়া হয়েছে ।

ধূসর রঙ এত পাতলাভাবে লাগানো হয়েছে যে, কাচের মতো স্বচ্ছ মনে হয় । ধূসর রঙের আবরণ ভেদ করে কমলা রঙ দেখা যায়, অর্থাৎ ‘আন্ডার টোন’ সৃষ্টি করা হয়েছে, যা মিশ্র ফলাফল সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কলাকৌশলগত অভাব দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

ষাট দশকের মধ্যভাগে তার মধ্যে যে আত্ম-চেতনা এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে দেশাত্মবোধের চেতনা দেখা দিয়েছিল ১৯৭৬ সালে তা সম্পূর্ণ মুছে যায় । বস্তুতঃ ভাষা আন্দোলনভিত্তিক মাত্র একটা ছবি ছাড়া আর কোনো চিত্রকর্মের মধ্যে দেশাত্মবোধের চেতনা দেখতে পাওয়া যায় না। স্বাধীনতা যুদ্ধের তো কোনো আভাসই নেই ।

উপরন্তু, ১৯৭৭ সাল থেকে তার মধ্যে পাশ্চাত্যের অনুকরণ প্রবণতা আরো প্রবলভাবে নবায়িত হয়ে ওঠে। এ সময় তিনি ইউরোপ থেকে মুখ ঘুরিয়ে আটলান্টিকের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ফিরে তাকালেন। তখন থেকে মার্কিন আর্টের অনুকরণে কাজ শুরু করলেন । তার চিত্রকর্ম ও শিরোনাম সবসময় অর্থবোধক ও তাৎপর্যপূর্ণ হয় না । অর্থাৎ শিরোনাম ও কাজের মধ্যে সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না ।

 

শিল্পী মুর্তজা বশীর

 

তার অনেক শিরোনাম নির্বাচন থেকে মনে হয় যে, কেবল দর্শকদের হতবুদ্ধি করার জন্যই অথবা কি করবেন বা করেছেন সে সম্বন্ধে অস্পষ্টতার কারণে এরকম শিরোনাম নির্বাচন করেছেন । যেমন- অনন্তকাল এবং আলো মাত্র দু’টি ধারাবাহিক কাজ এখানে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হলো।

অনন্তকাল-১ এর মধ্যে পেঁপে সাদৃশ্য একটা বড় অর্ধ-পরিচিত আকার গঠন করা হয়েছে ৷ বৃহৎ আকারের অভ্যন্তরে বেগুনি, মৌনী সবুজ, টকটকে লাল দ্বারা স্থল আকার গঠন করা হয়েছে । পশ্চাদভূমিতে হালকা হলুদ ব্যবহার হয়েছে ।

অনন্তকাল-৪ এর মধ্যে একটা আয়তক্ষেত্রাকার ক্যানভাসকে মোট ২৪টা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেকটা বর্গক্ষেত্রের অভ্যন্তরে একই রকম আকার ও আকৃতি গঠন এবং একই প্যালেট ব্যবহার করা হয়েছে। লাল, নীল, হলুদ, মৌনী সবুজ বেগুনি এবং পর্যায়ক্রমে একটা বাদে একটা ঘরে ব্যবহার করা হয়েছে। মোট ফলাফলের দিক থেকে নিবিড়তার (Impactness) পরিবর্তে এলোমেলো ভাব রয়েছে। আশি দশকের প্রায় প্রথম থেকে তার মধ্যে ঘন ঘন পট পরিবর্তনের প্রবণতা দেখা যায়।

এ সময় থেকে তিনি পৃথক পৃথক চিত্রকর্মের পরিবর্তে ধারাবাহিক কাজে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন । এক একটা ধারাবাহিক কাজের ভেতর তিনি এক এক ধরনের শৈল্পিক সমস্যা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। যেমন- অনন্তকাল শীর্ষক কাজের মধ্যে তিনি আকার ও আকৃতি গঠন এবং চারটা মৌলিক রঙ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। আলো শীর্ষক কাজের মধ্যে তিনি পরিসর বিভাজন নিয়ে পরীক্ষা করেন ।

তার আলো শীর্ষক কাজের আলো-১ এর মধ্যে দেখা যায় যে, একটা চতুর্বর্গ ক্যানভাসকে মোট দু’টি আয়তক্ষেত্রে ভাগ করেছেন; উপরের অংশ ছোট এবং নিচের অংশ বৃহৎ আয়তক্ষেত্র। উপরের অংশটা রূপালি এবং নিচের অংশটা লাল রঙ দিয়ে বৈপরীত্য সৃষ্টি করা হয়েছে। উপরের রূপালি আয়তক্ষেত্রের ঠিক মধ্যভাগে লম্বভাবে লাল রঙের স্থূল রেখা দ্বারা দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং প্রতিটি আয়তক্ষেত্রের মাঝখানে কালো রঙ দ্বারা ত্রিভুজ গঠন করা হয়েছে ।

কালো ত্রিভুজের অভ্যন্তরে আকার খাঁটি লাল রঙ দিয়ে নিখুঁতভাবে বৃত্ত তৈরি করে কালো রঙকে ভাঙা হয়েছে । বৃহৎ সাদা বৃত্তটার উপরে তালগাছ সাদৃশ আকৃতি গঠিত হয়েছে। কালো আকৃতিটার অভ্যন্তরে লাল, হলুদ, বেগুনি, মৌনী সবুজও সাদা রঙের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃত্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করে । সাদা বৃত্তটা চার্লস ডিমুথ-এর আঁকা I saw the figure five in gold এবং রবার্ট ইন্ডিয়ানার Year of meteors-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

আলো-৫ এর মধ্যে দেখা যায়, ১৪৪x৯০ সেন্টিমিটার আয়তক্ষেত্রাকার ক্যানভাসকে আড়াআড়ি তিনটা রেখা দ্বারা চারটা আয়তক্ষেত্রে ভাগ করা হয়েছে। ক্যানভাসের ঠিক মধ্য ভাগের নিচের আয়তক্ষেত্রটা সর্বাপেক্ষা সংকীর্ণ এবং একেবারে নিম্নাংশ সর্বাপেক্ষা প্রশস্ত। উপর থেকে দ্বিতীয় আয়তক্ষেত্রের প্রায় মধ্যভাগে গাঢ় রঙের একটা ত্রিভুজ আকৃতি ।

ত্রিভুজের শীর্ষ উপরের আয়তক্ষেত্র ভেদ করে উপরে উঠে গেছে এবং রাজমুকুটের মতো শোভাপ্রদ করা হয়েছে । ফলে তৃতীয় সমতল ‘থার্ড প্লেইন’ সৃষ্টি হয়েছে। বৃহৎ ত্রিভুজের মাঝখানে আর একটা গাঢ় রঙের ত্রিভুজ গঠিত হয়েছে। একেবারে নিচের আয়তক্ষেত্রের নিচের দিকে একটা নিখুঁত বৃত্ত রয়েছে । বৃত্তের উপরে ইংরেজি অক্ষর ‘টি’-এর মতো গাঢ় রঙের একটা আকার বৃত্তের উপরিভাগের পরিধি ভেদ করে বৃত্তের সাথে মিশে গেছে। এমনিভাবে নিচের বৃত্ত দিয়ে উপরের বৃহদাকার ত্রিভুজের সাথে রচনার ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে ।

ত্রিভুজ আকৃতির শীর্ষ শোভাপ্রদকরণের ফলে আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের ঘর এবং ঘরের দরজা বলে মনে হয় ।

উপর্যুক্ত আলোক শীর্ষক কাজগুলো পরীক্ষা করলে বোঝা যায়, পরিসর বিভাজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল ও মুখ্য বিষয়। অর্থাৎ একটা শূন্য পরিসরকে কত রকমভাবে বিভক্ত করা যায় । তার পরিসর বিভক্তিকরণের ধরন থেকে মনে হয় যে, সচেতনভাবেই আর অসচেতনভাবেই হোক, বার্নেট নিউম্যানের পরিসর বিভাজন অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো যে, পরিসর নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেখানে মূল ও মুখ্য বিষয় সেখানে আলো শিরোনাম-এর কারণই বা কি, আর সার্থকতাই বা কি? আলো এবং পরিসর উভয়ই পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়। কিন্তু এ দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন ও পৃথক শাখা। তাছাড়াও যেখানে পরিসর বিভাজন মূল লক্ষ্য সেখানে আকার, আকৃতি, ঘনত্ব, দূরত্ব, প্রভৃতি সৃষ্টি করারই বা যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে, আর শোভাপ্রদ করাই বা কি প্রয়োজন? আর যদি ধরে নেয়া হয় যে, তিনি আলো অর্থাৎ রঙ নিয়ে পরীক্ষা করেছেন তাহলে শিরোনামের কিছুটা সার্থকতা পাওয়া যায় ।

কারণ রঙের মূল উৎস হলো আলো । তাহলেও প্রশ্ন হলো যে, রঙ নিয়ে পরীক্ষা করাই যদি মুখ্য উদ্দেশ্য হয় তাহলেও পরিসর বিভক্তকরণ, আকার, আকৃতি গঠন, ঘনত্ব, দূরত্ব প্রভৃতি গঠন করার উপর গুরুত্ব দেয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? যদি ধরে নেয়া যায় যে, তিনি রঙ নিয়ে পরীক্ষা করেছেন তাহলেও পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে রঙের কোনো বিষয় পরীক্ষা করেছেন অর্থাৎ রঙের বিন্যাস ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন তা স্পষ্ট বোঝা যায় না।

যে বিষয় নিয়ে রঙের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষা করেছেন (যদি করে থাকেন) সে সম্বন্ধেও কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। এমন মনে হয় যে, কোনো স্পষ্ট ধারণা ছাড়াই যখন যা খুশি তখন তাই করেছেন।

ইচ্ছা মতো যা খুশি তাই শিরোনাম দিলেই তো হবে না । শিল্পকর্ম বাস্তবধর্মী হোক আর বিমূর্ত হোক, মূল ভাব বা বিষয়ের সাথে শিরোনামের সম্পর্ক ও তাৎপর্য থাকতে হবে । কারণ শিরোনামের মধ্যেই মূল ভাব লুকিয়ে থাকে।

আসল কথা হলো, নগরসভ্যতাই সভ্য অত্যাধুনিক বা প্রগতিশীল বা বিজ্ঞানভিত্তিক হতে চাইলেই তো আর হওয়া যায় না। আগে নগরসভ্যতাকে ভাল করে জানতে হবে, বুঝতে হবে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তা না হলে সৃষ্টির চেয়ে অনাসৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই হবে না।

সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বশীর পপ বা অপ শিল্পের উদ্ভাবকও না বা প্রবর্তকও না। তাই পপ বা অপ চিত্রকর্ম সম্বন্ধে বলতে গেলে তার মৌলিকতা ও স্বতন্ত্রতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আর মৌলিকতার বিচার করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই মূল বা উৎস হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পপ ও অপ শিল্পের কথা এসে যায়। তার কাজ থেকে মনে হয় যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কোন শিল্পীকে অনুকরণ না করে বিভিন্ন শিল্পীর কাজের ধরন ও ভাব অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন । যে জন্য তার কাজের ভেতর ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় । আশি দশকের শুরু থেকেই এই প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে তথা বশীরের পপ বা অপ শিল্পের সূত্র ধরে টানলে দেখা যায়, আজ থেকে প্রায় চার যুগ আগে পঞ্চাশ দশকের শেষ এবং ষাট দশকের শুরুতে আমেরিকার স্টুয়ার্ট ডেভিস, চার্লস ডিমুথ, ম্যাক্স ওয়েবার, রবার্ট ইন্ডিয়ানা, অ্যান্ডি ওয়ারহোল, ক্লেইস ওল্ডেনবার্গ, টম ওয়াজেলম্যান, রয় লিচেনস্টেইন প্রমুখ শিল্পীগণ পপ শিল্পের উদ্ভাবন ও প্রবর্তন করেন ।

তাদের কাজ সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে জন উইলমার্ডিং লিখেছেন : “These artists consciously derived their style from the monotonous repetition of bill-board advertisement. glossy magazine reproduction, and mechanical means of information’s dominating contemporary culture. All together. this was an art well-suited to many blatant features of modern America, the post war consumerism, banal and exploitive commercialism, and the often self-indulgent vulgarity of mass media ” (আমেরিকান আর্ট, পূ: অনুঃ) ।

 

শিল্পী মুর্তজা বশীর

 

শিল্পী মুর্তজা বশীর

 

আলোচিত আমেরিকা পপ শিল্পের উৎস ও অনুপ্রেরণার আলোকে বলা যায়, বশীরের উৎস ও অনুপ্রেরণা কোথায়? তিনি ব্যক্তিগতভাবে এবং তার অনুরাগীরা এসব কাজ সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যাই করুন না কেন এবং যে যুক্তিই উত্থাপন করুন না কেন, আমাদের সামাজিক অবকাঠামো এবং শিল্প ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এসব চিত্রকর্ম যোগাযোগ স্থাপনই করা যায় না। তাছাড়াও পপ ও অপ শিল্পের বৈশিষ্ট্য এবং প্রকৃতি তার কাজের ভেতর খুঁজে পাওয়া যায় না।

এক কথায় বলা যায়, এগুলো না হলো পপ, না হলো অপ আবার না হলো দেশজ। এগুলো আসলে যে কি তা বলা কঠিন । অতএব, আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির ধারা ও ধরনের দিক থেকে বিচার করলে বশীরের পপ চিত্রকর্মগুলো আদৌ শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য হতে পারে কিনা এবং গ্রহণযোগ্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা, সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব না ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment