আজকে আমরা শিল্পী কালিদাস কর্মকার সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী গ্রন্থের অন্তর্গত।
শিল্পী কালিদাস কর্মকার
সত্তর দশকের তরুণ শিল্পীদের মধ্যে যে কয়জন শিল্পী জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তাদের মধ্যে কালিদাস কর্মকার একজন বহুল আলোচিত। তার কারণ হলো যে, তিনি এমন এক কল্পজগৎ সৃষ্টি করেছেন যে, সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ । তার এই জগৎ সম্বন্ধে সাধারণ দর্শক ও শিল্পানুরাগীদের কোনো কিছু স্পষ্ট ধারণা করা তো দূরের কথা এমন কি শিল্প সমালোচকদের পক্ষেও দুরূহ। এই দুর্বোধ্যতার জন্যই তাকে নিয়ে যত জল্পনা-কল্পনা, আলাপ-আলোচনা ।
এটাকে জনসাধারণের পক্ষে প্রকাশ্য বুদ্ধিবৃত্তিক অবমাননা বলা যায়, যা দেখা যায় তাই সবকিছু না, যা জানা যায় না তাই সত্য । এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে শিল্প সমালোচকরা যে যেমন পারে তার কাজের ব্যাখ্যা করেন । যে বস্তু, যে প্রতীক তিনি ব্যবহার করেন তার পেছনে কি রহস্য লুকিয়ে আছে, সেই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য অনেকেই চেষ্টা করেন।
সাঈদ আহমেদ মন্তব্য করেছেন যে দীর্ঘ যাত্রা তার শুরু হয়েছিল আমেরিকাতে তা এখনো শেষ হয়নি… তার চিত্রকর্মে বলিষ্ঠতা এবং গীতিময়তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট” (Contemporary Art Series of Bangladesh-18, অনু: ২)। সাঈদ আহমেদ- এর বক্তব্যের সাথে কালিদাসের কাজ মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, কিছু না বললে নয় তাই বলার জন্যই বলা । এটা খুবই সাধারণ ধরনের বক্তব্য, যে কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে । শিল্পজগতের কোনো শেষ নেই। এখানে যাত্রা করা যায় কিন্তু সে যাত্রার শেষ নেই । কিন্তু কালিদাসের ভূতের নাচের মধ্যে সাঈদ আহমেদ ‘গীতিময়তা’
কোথায় খুঁজে পেলেন বুঝলাম না। এখন সৈয়দ আলী আহসানের কথায় আসা যাক “বাংলাদেশের কোনো কোনো শিল্পী বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। তা তাদের শিল্পকর্মে ও ভাস্কর্যে প্রকৌশলগত নির্মিতিকে কাজে লাগিয়েছেন… তিনি তার চিত্রকর্মে এবং ভাস্কর্যে লোহা, তামা, দস্তা, টিন ইত্যাদি ধাতু বিভিন্ন কম্পোজিশনে ব্যবহার করেছেন, কখনো কোলাজ হিসেবে আবার কখনো সমন্বিত রূপ ব্যঞ্জনায়।
এই সমন্বয় সাধন তিনি করেছেন ধাতব বস্তুর উপর রং এবং বার্ণিশ ব্যবহার করে” (কনটেমপরারি আর্ট সিরিজ অব বাংলাদেশ-১৮, অনুঃ ২য়)। কালিদাসের কাজ যাই হোক না কেন তার মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান ‘প্রকৌশল’ ও ‘প্রযুক্তি’ কোথা থেকে কিভাবে আবিষ্কার করলেন, সেটাই বিস্ময়কর। কোনো ধাতব পদার্থের উপর রং লাগলেই যদি প্রকৌশল, প্রযুক্তি বা বিজ্ঞান হয় তাহলে তো বিজ্ঞান, প্রকৌশল, প্রযুক্তি বলে আর কিছু থাকে না।
উপর্যুক্ত মন্তব্যগুলো থেকে এটা সহজেই বোঝা যায়, কালিদাসের কাজ যে এদেশের শিল্প সমালোচক এবং সাধারণ দর্শকদের জন্য শুধু দুর্বোধ্য ও বিভ্রান্তিকর নয়, এটাকে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকাশ্য বলাৎকার হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় ।
ইংরেজি ভাষায় ‘ফ্যান্টাসি’ শব্দের যে কয়টা বাংলা পরিশব্দ আছে তার মধ্যে কেবল “উদ্ভট” শব্দটিই কালিদাসের জন্য সঠিক প্রযোজ্য হতে পারে । তার কাজগুলো উদ্ভট এই কারণে যে, তিনি যে কলাজগৎ সৃষ্টি করেন তা সাধারণের জন্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি বর্হিভূত। তার কল্প জগতের সাথে কারো যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব না । তার বক্তব্য যে শুধু অস্পষ্ট তা নয়, বরঞ্চ এমন জটিল এবং দুর্বোধ্য যে কারো পক্ষে সামান্য কোনো ধারণা করাও সম্ভব না। সেজন্যই তিনি বহুল আলোচিত ।
তার কাজগুলো আপাতভাবে পরাবাস্তবধর্মী বলে মনে হয় । তাই শিল্প সমালোচকরা পরাবাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তার কাজগুলো পরীক্ষা করলে তার কাজগুলোকে পরাবাস্তবধর্মী না বলে মানসিক রোগীর চিত্রকর্ম, ইংরেজিতে যাকে ‘সাইকোটিক আর্ট’-এর শ্রেণীভুক্ত করা শ্রেয়।
পরাবাস্তব ও সাইকোটিক আর্ট-এর মধ্যে অনেক সামাঞ্জস্য রয়েছে। সেজন্য শিল্প সমালোচকরা এবং শিল্পানুরাগী এগুলোকে পরাবাস্তব চিত্রকর্ম বলে ভুল করে থাকে এবং সেই মতো মন গড়া ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে হলে পরাবাস্তববাদ এবং সাইকোটিক আর্ট-এর উৎস এবং কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা বিশেষ প্রয়োজন । অতএব, শিল্প সমালোচক ও বিশ্লেষকদের সাইকোসিস ও সাইকিয়াট্রি সমস্যা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে পরাবাস্তববাদ এবং সাইকোটিক আর্ট-এর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব না।
অজ্ঞাত ও অবচেতন (Unaware & Unconscious) থেকে পরাবাস্তব শিল্পকর্ম এবং সিজোফ্রেনিয়া অর্থাৎ মানসিক রোগের প্রবণতা থেকে সাইকোটিক আর্ট-এর উৎপত্তি। ইন্দ্ৰীয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কিছু অংশ বা বিষয় অবচেতন মনে যে ছাপ ফেলে পরবর্তীতে অনেকে সেগুলো সচেতন মনে নিয়ে এসে চিত্ররূপ দেয়। আবার অনেকে স্বপ্নকেও চিত্ররূপ দিয়ে থাকেন, যেমন- রুশ, সালভেদর ডালি, মিরো, মার্ক শাগাল প্রমুখ শিল্পীদের শিল্পকর্মগুলো উল্লেখ করা যায়। সাইকোটিক আর্ট বা মানসিক রোগীর চিত্রকর্ম সিজোফ্রেনিয়া বা মানসিক রোগের প্রবণতা থেকে সৃষ্ট।
সিজোফ্রেনিক ব্যক্তিরা এমন এক জগৎ বা পরিবেশ কল্পনা করে বা বাস করে, যা সাধারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা বহির্ভূত। সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতা থেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা পরিবেশ সম্বন্ধে বিক্ষিপ্ত এলোমেলো ধারণা সৃষ্টি হয় (Disordered Visual Perception) ফ্রানসিন রাইটম্যান-এর কারণ এ ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন “The incongruity arises when the artist, through his individuality, differs from the social background the artists have attempted to visualize in a different direction which is not that of the established contemporary vision. This is intellectualization of aesthetic experience has allowed a perpetual appreciation of patterns of patterns suggestive of schizophrenia” (সাইকোটিক আর্ট, অধঃ ৮ম, পূঃ ১৬০, অনু ২)।
মনোবিজ্ঞানী ক্রিস বলেছেন: ‘That the art of psycholics is a means of adjustment to reality”। এর কারণ হলো যে, সিজোফ্রেনিয়া রোগীর মধ্যে তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে অসচেতনতা সৃষ্টি হয় । তাই ছবি আঁকার ভেতর দিয়ে সে তার নিজের অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করে। মনোবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন – “That the choice of theme in art is dependant on conflicts within the artists.” (সাইকোটিকস আর্ট, অধঃ ৭ম, পৃঃ ১৩২, অনু ২)।
গোল্ডস্টেইন-এর কথায়: “In content, the surrealists have exposed the sub-conscious state of external reality, schizophrenia reproduce their hallucination and the world of their own.” (সাইকোটিক আর্ট, অধঃ ৫ম, পৃঃ ১১৫, অনুঃ ৩)।
প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন যে, শিল্পীর মধ্যে মোটর অ্যাপটিউড এবং উচ্চমাস ক্ষমতা থাকা দরকার। কারণ ফ্রানসিস রাইটম্যানের কথায় বলা যায় ‘আইডিও মোটর অ্যাপ্রেকসিয়া ডিপেন্ডস অন এ লেসন ইন দ্য রিজিওন অব দ্য ব্রেইন হয়ার দ্য টেমপোরাল পেরিয়েটাল অ্যান্ড অকসিপিটাল লবস মিট…. ভিজুয়াল অ্যাগনোশিয়া, বডি- ইমেজ ডিসটার্বেনসে, অ্যাফাসিয়া, লস অব ওরিয়েন্টেশন ইন স্পেস, অ্যান্ড আইডিও মোটর অ্যাপ্রেকসিয়া রেজাল্ট ফ্রম লেসনস অব দিজ সেন্টারস
আগেই বলা হয়েছে, ‘মানিক ডিপ্রেশন’ এবং ‘হরর ভ্যাকু’ সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতা সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই সব রোগীদের মধ্যে বিঘ্নিত চিত্তন-রূপকল্প (ঘট ইমেজ ডিসটার্বেনসেস) এবং বিঘ্নিত শারীরিক-রূপকল্প (Body-image Disturbress) ঘটে থাকে । সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মধ্যে বিভ্রম (Hallucination) ঘটে থাকে । বিভ্রম দু’রকম হয়, যেমন— শ্রুতি বিভ্রম (Auditory Hallucination) এবং দৃশ্যমান বিভ্রম (Visual Hallucination ) ।
যাদের শ্রুতি বিভ্রম হয় তারা কোনো অদৃশ্য শব্দ শোনে অর্থাৎ কোনো অদৃশ্য ব্যক্তির নির্দেশ মতো আচার-ব্যবহার বা কাজ করে থাকে। একটা উদাহরণ দিলে এ বিষয়টা বুঝতে সহজ হবে। যেমন— আমাদের দেশে গ্রামগঞ্জে জ্বিন বা ভূতে ডুবিয়ে মারার কথা প্রায়ই শোনা যায়। বিশেষ করে বর্ষাকালে এমন ঘটনা ঘটে বলে শোনা যায়। বর্ষাকালে গ্রামগঞ্জের লোকে খাল-বিল, নদী-নালায় মাছ ধরতে যায়।
বিশেষ করে অনেকে রাতে খাল-বিলে মাছ ধরতে গিয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে অনেকে রাতে ঘুমের মধ্যে কোনো প্রতিবেশী বা পরিচিত লোকের ডাক শুনে ঘুম থেকে উঠে মাছ ধরতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ।
প্রকৃতপক্ষে, সে নিদ্রিত অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। পরে যখন ঘুম ভেঙে নিজেকে একাকী গভীর রাতে কোনো খাল বা বিলের মধ্যে দেখে তখন ভয় পেয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে পানির মধ্যে পড়ে যায় এবং মূর্ছিত অবস্থায় পানিতে ডুবে মারা যায়, যা গ্রামের লোকে জ্বিন বা ভূতে ডুবিয়ে মেরেছে বলে বিশ্বাস করে। আসলে শ্রুতি বিভ্রম হওয়ার ফলে এমন ঘটে থাকে ।
বিঘ্নিত শারীরিক-রূপকল্প বা বিঘ্নিত চিস্তন-রূপকল্প থেকে অনেকের মধ্যে দৃশ্যমান বিভ্রম (ভিজুয়াল হ্যালিউসিনেশন) হয়ে থাকে । আবার অনেক সময় মাদকদ্রব্য সেবনের কারণে দৃশ্যমান বিভ্রম হয়ে থাকে। কালিদাসের কাজগুলো পরীক্ষা করলে মনে হয় যে, তার মধ্যে বিঘ্নিত চিন্তন-রূপকল্প থেকে ভীতিকর দৃশ্যমান বিভ্রম লক্ষণ ধরা পড়ে। যা “হরর ভ্যাকু’ থেকে সৃষ্ট এবং দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকে বলে মনে হয় ।
মানসিক রোগীর আঁকা চিত্রকর্মের কিছু নমুনা এবং ফ্রানসিকো গয়ার সোপলা এবং ক্যাপ্রিকস শীর্ষক ছাপচিত্রের সাথে কালিদাসের কাজ তুলনামূলকভাবে পরীক্ষা করলে তার মধ্যে ভীতিকর দৃশ্যমান বিভ্রমের লক্ষণ ধরা পড়ে। অবশ্য গয়ার সাথে কালিদাসর তুলনাই হয় না । গয়া ছিলেন একজন মহান শিল্পী এবং তার উল্লিখিত শীর্ষক ছাপচিত্রগুলোর মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ বিদ্যমান থাকলেও ছাপচিত্র হিসেবে এগুলো শিল্পরসে উত্তীর্ণ । কিন্তু কালিদাসের কাজগুলো শিল্পের বিচারে টেকে না।
এসব রোগীর চিত্রকর্ম পরীক্ষা করে ফ্রানসিস রাইটম্যান কতকগুলো লক্ষণ লক্ষ্য করেছেন : “Exhibit a certain worldliness a tendency to avoid empty space, and a perseverative trend, together with a disordered choice of colour there is a tendency to curves instead of angles, figures may be contracted, or expanded and elongated.”
কালিদাসের কাজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ফ্রানসিস রাইটম্যানের ভাষায় বলা যায় “They attempted to adjust themselves to an altered comprehensive reality The disturbances in thinking in schizophrenic views by psycho analysts from a psychological stand-point with particular attention to body-image phenomenon because as a conceptual thing in linked with space and time The psycho-analyst also experimented that the body-image can be induced by administration of masculine by visual hallucination; and disordering in the conception systems of space and time leads to general disordering of conceptual thinking.
কালিদাসের প্রতীক বিষয়বস্তুর চয়ন সম্বন্ধে রাইটম্যানের কথায় বলা যায় “Components that evoke feelings other them the aesthetic satisfaction arising from the patterns, they may depict a situation that arises tenders. Pity, indignation, reverence, horror, disgust or emotion. The subject depicted may have association which are pleasurable in a particular cultural group, at a particular time and space, this applies to religious and erotic subjects having a mythological, historical, or literary allusion, and so on. Other additional components are possible in paintings but no such additional components Narrative prepositional, emotional, allusive or of any other kind. is other needed nor enough because they do not in themselves arose the feeling of satisfaction which is based on structuring into a pattern” (সাইকোটিক আর্ট, অধঃ ১ম, পৃঃ ৭ম, অনুঃ ১ম)।
উপর্যুক্ত ব্যাখ্যার আলোকে কালিদাসের কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তার কাজের ভেতর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ক সমস্যা ও জটিলতা, অর্থাৎ উপাদান ও উপকরণ প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন— ভালোবাসা, হতাশা, ঘৃণা, ধর্মীয় বিশ্বাস, কপটতা এবং ধর্মের নামে অবিচার, বিষাদ এবং মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ও সংকীর্ণতা। তার মধ্যে তার নিজস্ব ধর্ম, হিন্দু ধর্মের প্রতি বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে।
অবশ্য তার কিছু কাজের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্ম ও ইসলামের ছায়াও দেখা যায়। যেমন- যিশুখ্রিস্টের ক্রস-এর প্রতীক এবং অন্য কয়েকটি কাজের মধ্যে হিন্দুদের প্রধান দেবতা শিব এবং অন্য দেব-দেবীদের মধ্যে ‘আল্লাহ’ নাম ও ইসলামের প্রতীক ব্যবহার। এসব প্রতীকের ব্যবহার থেকে মনে হয় যে, তিনি কেবল জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার জন্যই এগুলোকে ব্যবহার করেছেন।
নিজেকে জোর করে ধর্মীয় গোড়ামি ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ‘আল্লাহ’ শব্দে স্বরবর্ণ অর্থাৎ “” কার ‘C’ কার আরবিতে যাকে বলে ‘যবর’, ‘ঘের’, ‘পেশ’ এবং যুক্তাক্ষর ধ্বনির সাংকেতিক চিহ্ন বাদ পড়েছে। ফলে ‘আল্লাহ’ বানানটি ভুল হয়েছে। এমন হতে পারে যে, আরবি ভাষা সম্বন্ধে অভ্যতার কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে এগুলো বাদ পড়েছে অথবা অবচেতন মনে সুপ্তাবস্থায় ধর্মীয় সংকীর্ণতার ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের জন্য ইসলামের প্রতি অনিচ্ছাকৃতভাবে অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে ।
এখানে তার কিছু কাজের নমুনা সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো। স্তিমিত প্রদীপ (প্যালেট-১) শীর্ষক কাজের মধ্যে দেখা যায়, কোনো অটোমোবাইলের একটা পরিত্যক্ত ভগ্নাংশ ম্যাসোনাইড বোর্ডের উপর সংস্থাপন করে ল্যাকার রং দিয়ে রং করা হয়েছে । এই খণ্ডাংশের উপরের দিকে সরু একটা নলের মতো অংশের উপর হলুদ ও লাল রং
দিয়ে অগ্নিশিখা আঁকা হয়েছে। হলুদ ও লাল রং মলিন হওয়ার জন্য শিখাটি নিষ্প্রভ মনে হয় । এটা একটা অতি পুরাতন ভাবের প্রতীকী উপস্থাপনা । শতাব্দী- দু’শতাব্দী আগের শিল্পীরা জীবনের মুমূর্ষাবস্থা অথবা বার্ধক্যের প্রতীক হিসেবে স্তিমিত প্রদীপ শিখা ব্যবহার করতেন । এখানে কবি জসিম উদ্দীনের ‘পল্লী জননী’ কবিতার দু’টি চরণ উদ্ধৃত করলে এই কাজের অন্তর্নিহিত ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠবে “পার্শ্ব জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায়ে খেল/ আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল” ।
শরাহত পাখি (প্যালেট-২) একটা পরাবাস্তবধর্মী কাজ। ভাবের দিক থেকে এটাও একটি অতি পুরাতন ভাবের উপস্থাপনা। ছবিটির বিষয় হলো রচনার উপরের অংশে একটা পাখি গাছের ডালে বসে আছে। গাছের ডালটা ডানদিকের ডিম্বাকৃত থেকে বেরিয়ে এসেছে। ডালের মাথাটা আক্রমণোদত সাপের মাথায় রূপান্তরিত হয়েছে। সাপটা একটি হৃদপিণ্ডের দিকে মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। তার নিচে কতকগুলো বক্ররেখা দ্বারা ডিম্বাকৃতির অর্ধবৃত্ত থেকে প্রসারিত মানুষের একটা হাত পাখির দিকে প্রসারিত করা। পাখির বিপরীত দিকে বামপাশে ডিম্বাকৃতি সাদৃশ একটি অপরিচিত আকার উপর থেকে নিচের দিকে ঝুলে আছে বা পড়েছে। একটা তীর একই সঙ্গে লম্বভাবে হৃৎপিণ্ড, সাপ ও পাখিটাকে এফোড় ওফোড় ভেদ করে বেরিয়ে গেছে ।
এটা যে প্রেম বিরহের প্রতীকী উপস্থাপনা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। উপরের দিকে প্রসারিত হাত থেকে বোঝা যায়, একজন ব্যর্থ প্রেমিক তার প্রেয়সীকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার আশায় চির-প্রতিক্ষমাণ। কিন্তু তীর দ্বারা একই সঙ্গে হৃৎপিণ্ড, সাপ ও পাখি হত্যা করা যেমন ভাবের দ্ব্যর্থকতা ও সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে তেমন এই ভাবের পুনরাবৃত্তি হয়েছে । তাঁর দ্বারা কেবল হৃৎপিণ্ড অথবা পাখি অথবা সাপটাকে মারাই যথেষ্ট ছিল। অথবা তীর বাদ দিয়ে কেবল হৃৎপিণ্ড অথবা পাখির দিকে আক্রোমণদ্যত সাপ হলেই ভালো ছিল। তাতে পুরনো ভাবের সাথে কিছুটা নতুনত্ব যোগ হতো ।
আবার এমনও হতে পারে যে, তিনি মহাভারতে বর্ণিত পঞ্চ-পাণ্ডবদের দ্বিতীয় ভাই অর্জুনের রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদার সাথে বিবাহের কাহিনী অবলম্বনে প্রতীকী উপস্থাপনা করেছেন । মহাভারতের এই কাহিনী হয়ত অনেকের জানা নেই, তাই এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো । অর্জুনের সমকালীন এক রাজার এক সুন্দরী কন্যার নাম হলো চিত্রাঙ্গদা। রাজা ঘোষণা করলেন যে, যে বীরযোদ্ধার লক্ষ্যভেদ অব্যর্থ তার সাথে রাজকুমারীর বিবাহ দেবেন। নির্দিষ্ট দিনে রাজ্যের সব বড় বড় যোদ্ধা তীরন্দাজ লক্ষ্যভেদ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।
লক্ষ্যভেদ পরীক্ষা করার জন্য রাজা একটা গভীর কুয়া বা ইন্দিরা খনন করালেন। ঐ কুয়ার ঠিক উপরে একটি পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখি ঝুলিয়ে রাখলেন। রাজা জানালেন যে, কুয়ার মধ্যে পানির ভেতর পাখির প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করে যে উপরে ঝুলানো পাখির বক্ষ তীর যারা বিদ্ধ করতে পারবে তার সাথে রাজকুমারীর বিবাহ দেয়া হবে । একে একে সকলে প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হলো। সবার শেষে অর্জুন এলেন । অর্জুন শর্ত মোতাবেক কুয়ার ভেতর পানির মধ্যে পাখির প্রতিচ্ছায়া দেখে লক্ষ্যভেদ করলেন । রাজকুমারীর সাথে তার বিবাহ হলো।
কালিদাস হয়ত এই কাহিনীর উপস্থাপন করেছেন। সাপটাকে অর্জুনের প্রতিযোগিদের প্রতীক এবং প্রসারিত হাতটাকে কামনার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন । এখানে লক্ষণীয় যে, মানুষ আপন কামনা চরিতার্থের জন্য নির্মম, নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখিটি মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকারের প্রতীক । সম্ভবত রামায়ণের এই কাহিনী কালিদাসের মনে হিন্দু ধর্মের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তাই এ ছবিতে প্রতীকী উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তিনি ধর্মের প্রতি পরোক্ষভাবে কটাক্ষ করেছেন ।
উপর্যুক্ত ছবিটির মধ্যে সালভেদর ডালির পরাবাস্তববাদ-এর অস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ডালি তার কাজের মধ্যে বাস্তব ও বিমূর্ত-এর সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে । কালিদাসের পাখি, হাত ও হৃৎপিণ্ড বাস্তবধর্মী এবং অর্ধ-পরিচিত। ডিম্বাকৃতিগুলো ধর্মীয়করণের মধ্যে সেই প্রচেষ্টা দেখা যায়।
কিন্তু বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা এবং প্রতীকের ব্যবহারের মধ্যে ভাবের দ্ব্যর্থকতা সৃষ্টি হয়েছে। পাখিটাকে তীরবিদ্ধ করার ফলে রামায়ণের একটা প্রসিদ্ধ কাহিনী বলে মনে হয় । কিন্তু তীরবিদ্ধ হৃৎপিণ্ড ও সাপ উপস্থাপনের জন্য সাধারণ প্রেম-বিচ্ছেদ বলে মনে হয়। বিশেষ করে তীর দ্বারা কেবল হৃৎপিণ্ড অথবা সাপ অথবা পাখির যে কোনো একটিকে তীরবিদ্ধ করাই যথেষ্ট ছিল । আবার একটা সাপ আক্রেমণোদ্যতভাবে হৃৎপিণ্ড- এর দিকে তাক করে আছে । এতগুলো প্রতীক ব্যবহারের ফলে দ্ব্যর্থকতা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় আবার শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যও ব্যাহত হয়েছে। মাধ্যম ব্যবহারেও অদক্ষতা স্পষ্ট ।
কম্পোজিশন-১ (প্যালেট-৩) শীর্ষক ছবিতে একটা অর্ধ-পরিচিত বা বিকৃত মানব রূপকল্প । তার চারদিকে ঘিরে কতকগুলো বৃত্তাকার রূপবন্ধ দেখানো হয়েছে। মানব রূপকল্পের মুখাবয়ব রবীন্দ্রনাথের আঁকা আত্ম-প্রতিকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে ।
ক্যানভাসের উপরে মাঝখানে ও ডানদিকে হলুদ ও সামান্য সবুজ মিশ্রিত সাদা ছাড়া সমস্ত ক্যানভাস লাল । কোথাও কোথাও রং থোকা থোকা জমিয়ে অমসৃণ বুনোট সৃষ্টি করা হয়েছে । অমসৃণ বুনোটের উপর কালচে রং ঘষে মানব রূপকল্প ও বৃত্তাকার সৃষ্টি করা হয়েছে । মানব রূপকল্পের বাম হাত থেকে একটা সরু রেখা উপরের দিকে উঠে গেছে, তার শীর্ষে একটি ডিম্বাকৃতি । মনে হয় যে, তিনি হিন্দুদের দেবতা বিষ্ণুর প্রতীকী উপস্থাপনা করার চেষ্টা করেছেন।
এখানে দেবতা বিষ্ণু সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করলে যাদের এ সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই তাদের পক্ষে বোঝা সহজ হবে । হিন্দু ধর্ম মতে দেবতা বিষ্ণু হলেন অন্যায়, অবিচার, ব্যভিচার অর্থাৎ এক কথায় অসামাজিক ও অমানবিক অকল্যাণকর কাজ প্রতিরোধ ও প্রতিহতকারী। যখন কোনো মানুষ চরম অত্যাচার, নির্যাতন এবং অকল্যাণকর কাজে লিপ্ত হয় অর্থাৎ পাপাচার করতে থাকে তখন মানবসমাজ রক্ষা ও কল্যাণের জন্য দেবতা বিষ্ণুর আবির্ভাব হয় । তার হাতে সব সময় একটা চক্র থাকে ।
তিনি আদেশ দিয়ে এই চক্রটাকে ছেড়ে দিলে চক্রটা অত্যাচারকারীর শিরশ্ছেদ করে। কিন্তু দুর্বল উপস্থাপনা ও দক্ষতার অভাবের জন্য বক্তব্য অস্পষ্ট।
অশুভ খেলা-এর মধ্যে তিনি যিশুখ্রিস্টের ক্রস-এর প্রতীক ব্যবহার করেছেন। ক্রুসের আড়াআড়ি বাহুর ডানদিক থেকে কলো রঙের একটা রেখা পানির ধারার মতো এঁকেবেঁকে ক্রসটা অতিক্রম করে বামদিকে নিচের দিকে প্রবাহিত। রেখাটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে রেখা দ্বারা একটা অর্ধ-পরিচিত আকার গঠন করা হয়েছে। রেখাটার মাথায় ক্রসের উপর মানুষের একটা হাত, যেটা যিশুখ্রিস্টের হাতের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত।
পরাবাস্তধর্মী উপস্থাপনা থেকে বুঝা যায়, যিশুখ্রিস্টকে ক্রসে ঝুলিয়ে শূল বিদ্ধ করে হত্যার জন্য যে ক্রসটা তৈরি করা হয়েছিল সেটা তিনি নিজেই বহন করে এনেছিলেন। হাতটা তারই প্রতীক। এবং রেখাগুলো রক্তের প্রতীক। সমস্ত ক্যানভাসটা লাল অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবী যিশুর রক্তে রঞ্জিত। সমস্ত ক্রসটা গাঢ় বা কালো রং দিয়ে ছোট ছোট চতুষ্কোণগুলো দেখে বুঝা যায় যে যিশুকে ক্রসের উপর শুইয়ে বড় বড় গজাল দ্বারা প্রথমে তাকে ক্রসের সাথে বিদ্ধ করে ঝুলানো হয় এবং পরে তার বুকে বল্লম বিদ্ধ করা হয়েছিল। এই ছিদ্রগুলো তারই প্রতীক।
মানবকল্যাণের জন্য যিশু আপন প্রাণ বিসর্জন দিয়ে এ পৃথিবীতে শান্তি, সম্প্রীতি ও সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ শান্তি, সম্প্রীতি ও সত্যের পথ বর্জন করে আপন স্বার্থ, কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য পরস্পর পরস্পরের সাথে হানাহানি, কাটাকাটি করে সমস্ত পৃথিবী মানুষের রক্তে রঞ্জিত করেছে। এ কথাটাই কালিদাস বুঝাতে চেয়েছেন।
তার ধর্মবিষয়ক রূপবন্ধ ও প্রতীকভিত্তিক কাজগুলো পরীক্ষা করলে মনে হয় যে, তিনি নিজে ধর্মীয় গোড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা ও পরধর্ম অসহিষ্ণুতার ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টা করেছেন । অবশ্য তার ধর্মবিষয়ক কাজগুলো পরীক্ষা করলে তার নিজ ধর্মে (হিন্দু) গভীর বিশ্বাসও পুনঃ পুনঃ প্রমাণিত হয়েছে।
তাই বলে তার পরধর্ম সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতা অস্বীকার করা যায় না। তার এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় পাপেট-১ ছবিটা ভিন্ন ধরণের। ক্যানভাসের একেবারে নিচে একটা অর্ধ-বৃত্ত, তিন দিকে কেঁটে গেছে । তার মধ্যে কিছু পরিচিত ও অপরিচিত আকার ব্যবহার করা হয়েছে। নিচের অপরিচিত আকারটা খুব ভালোভাবে নিরীক্ষা করলে মনে হয় যে, অস্পষ্টভাবে একটা ধাবমান ঘোড়া অথবা চীনের বিখ্যাত প্রতীক ড্রাগন।
অর্ধ-বৃত্তের ঠিক মাঝখানে ধাতব পদার্থের একটা নকশা সংস্থাপন করা হয়েছে । তার উভয় পাশে দু’জন নর-নারীর রূপকল্প। পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে। তাদের পশ্চাদপটে লম্বভাবে সরু সরু খাদের মতো, হালকা মলিন সবুজ রং। এ ছবিটাতেও বক্তব্য অত্যন্ত দুর্বল, অস্পষ্ট, ভাবের স্বার্থকতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ঠিক কি বুঝাতে চান তা বুঝা মুশকিল। তবে অনেক চেষ্টা করে মোটামুটিভাবে একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হলো। নর-নারীর রূপকল্পর মাথার উপর অর্ধ-পরিচিত আকার আকৃতি, তাদের চোখ, নাক ও মুখের গঠন থেকে মনে হয় যে, প্রাচীন রোম সম্রাট ও
সম্রাজ্ঞীর কাল্পনিক প্রতিকৃতি। এ থেকে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন তা ঠিক বোঝা যায় না । তবে অন্তর্নিহিত স্বার্থকভাবে দু’টো ব্যাখ্যা দেয়া যায়। প্রথমত, রোমান সম্রাটগল এককালে সমস্ত পৃথিবীতে আপন সাম্রাজ্য বিস্তার করে। সমস্ত পৃথিবী এক সময় তাদের ভয়ে কম্পমান ছিল। কিন্তু কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের শৌর্য, শক্তি, পরাক্রম, ধন-সম্পদ সব কিছুই বিলীন হয়ে গেছে।
একদিন যারা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধশালী ও পরাক্রমশালী ছিল আজ তারা বিলুপ্ত। মৃত্যুর পরে কিছুই যাবে না সাথে, এ কথাটাই যেন কালিদাস বলতে চেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, একদিন যে রোমান সভ্যতা সমস্ত পৃথিবীতে (প্রাচীন যুগে সমস্ত পৃথিবী বা বিশ্ব বলতে ইউরোপ থেকে এশিয়া মহাদেশ পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল। তখনও আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার হয়নি) ব্যাপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সময়ের সাথে সাথে একদিন তা বিলীন হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল । কিন্তু তাদের সৃষ্টি কীর্তি আজও মানবসভ্যতার ইতিহাসকে গৌরবময়, উজ্জ্বল করে রেখেছে। মানুষের ধৌর্য-বীর্য, ধন-সম্পদ সব কিছু একদিন শেষ হয়ে যায় । কিন্তু তাদের সৃষ্টি চিরন্তন অম্লান, অক্ষয় হয়ে সভ্যতার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে ।
উপর্যুক্ত যে কোনো একটি ব্যাখ্যা সঠিক হতে পারে বা দু’টোই যৌথভাবে হতে পারে অথবা কোনোটাই নাও হতে পারে । তবে উপযুক্ত ব্যাখ্যা দু’টো দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে গতিবাদের আভাস পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ কাব্যের ‘শাহজাহান’ কবিতার কয়েকটি চরণ এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন, যৌবন ধন মান,
শুধু থাক এক বিন্দু নয়নের জল
কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জল
এ তাজমহল।
এতদ্বসত্ত্বেও বলা যায়, কলা-কৌশল দুর্বলতা, বক্তব্যের অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা এবং ভাবের দ্ব্যর্থকতার জন্য গুরুত্ব ও তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে (প্যালেট-৫)। কম্পোজিশন-২-এর মধ্যে দেখা যায়, একটা চতুর্বর্গ ক্যানভাসের উপরে ডান দিকে একটা বড় চতুর্বর্গ । এই চতুর্বর্গকে আবার ছোট ছোট ১৬টি চতুর্বর্গে ভাগ করা হয়েছে ।
তিনটি ছোট বর্গক্ষেত্র বাদ দিয়ে অন্যগুলোর ভেতর একটা করে মানব রূপকল্প ব্যবহার করা হয়েছে । এই রূপকল্পগুলো দেখে মনে হয়, সম্ভবত পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির জাতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের রূপকল্প তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন । চতুর্বর্গের ঠিক নিচের হালকা হলুদ, কোথাও কোথাও খুব হালকা দ্বারা টোন সৃষ্টি করা হয়েছে । খুব সূক্ষ্মভাবে নিরীক্ষা করলে একটা মানুষের অর্ধ-প্রতিকৃতি বা রূপকল্প দেখা যায় । তার বিপরীত দিকে একই টোনের একটা ত্রিভুজ, তার শীর্ষে শালগম সাদৃশ্য একটা বৃত্ত ।
বৃত্তটা উভয় দিকে (ডান ও বাম) তীর্যকভাবে হালকা রং দিয়ে টোন ও রেখা অঙ্কন করা হয়েছে । এই বৃত্তের ঠিক মাঝখানে বেগুনি রঙের একটা ছোট বৃত্ত । ত্রিভুজাকৃতির মধ্যে একটা ছোট কাগজ এবং ক্যানভাসের একেবারে বাম দিকের কিনারায় একটা ধাতব পদার্থের কোলাজ ব্যবহার করা হয়েছে। ক্যানভাসের ডানদিকে নিচের কিনারায় অনুরূপভাবে আরেকটা ধাতব
পদার্থের কোলাজ ব্যবহার করা হয়েছে। পার্শ্ব প্রতিকৃতির মধ্যে আবার একই সরলরেখায় তিনটি বৃত্ত । বৃত্তগুলোতে আলো-ছায়া সৃষ্টির ফলে ঘনত্ব ও পরিধি সৃষ্টি হয়েছে । বৃত্তগুলোর মাঝে একটা করে ত্রিভুজ। বৃত্ত, ত্রিভুজ ও মানব রূপকল্পর মধ্যবর্তী জায়গায় ধূসর বর্ণ ব্যবহার করে আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে । কিন্তু মানব রূপকল্প ও রূপবন্ধগুলোর অর্থ বা তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায় না ।
কম্পোজিশন-৩-এর মধ্যে অনুরূপভাবে ধাতব পদার্থ ও কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে । ধাতব পদার্থের মাথাটা চওড়া এবং নিচের দিকে সরু হয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে আড়াআড়িভাবে একেবারে ক্যানভাসের ডান কিনারায় কেটে গেছে। ধাতব পদার্থের আকৃতি অনেকটা জাত সাপের প্রতীক মনে হয় । এই প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ করা যায় যে, তার পরবর্তী অনেক কাজের মধ্যে প্রায়ই সাপ ও বিষাক্ত পোকা-মাকড় প্রভৃতির রূপবন্ধ ও রূপকল্প ব্যবহার করতে দেখা যায় ।
উপরে আলোচিত উভয় কাজে খুব হালকাভাবে উষ্ণ স্পন্দনশীল রং ব্যবহার করা হয়েছে । উভয় কাজের মধ্যে রঙের চয়ন ও বিন্যাস দৃষ্টিনন্দনের দিক থেকে সন্তোষজনক বলা যায় । বিভিন্ন ধরনের রূপকল্প, রূপবন্ধ ও প্রতীক ব্যবহার করে সমস্ত ক্যানভাসটাকে শোভাপ্রদ করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় । কিন্তু প্রতীকগুলো পরস্পর সম্পর্কহীন ও অর্থহীন বলে মনে হয় । এগুলোর ঠিক তাৎপর্য পাওয়া যায় না ।
জং ধরা মাছ শীর্ষক কাজের মধ্যে কোনো অটোমোবাইল-এর ভগ্ন পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়েছে । যন্ত্রাংশটা আরেকটা ধাতব পদার্থের উপর ওয়েল্ডিং করে সংস্থাপন করা হয়েছে । নিচের অংশের ডানদিকের বক্ররেখাগুলো পানির ঢেউয়ের প্রতীক এবং বামদিকের অপরিচিত আকারগুলো মাছের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে । উপরের মূল যন্ত্রাংশকে মাছের প্রতীক হিসেবে শিরোনাম নির্বাচন করা হয়েছে । সমস্ত টাই তামাটে রং । আলো পড়ে কোথাও চিকচিক করছে এবং কোথাও টোন ও গভীরতা সৃষ্টি হয়েছে । তবে শিরোনামের অর্থ ও তাৎপর্য অস্পষ্ট । ঠিক কি বোঝাতে চান বোঝা যায় না এবং দৃষ্টিনন্দন ও শিল্পশৈলীর দিক থেকেও সন্তোষজনক না ।
আলোচিত কাজগুলো দেখলে বোঝা যায়, সৈয়দ আলী আহসান কেবল ধাতব পদার্থ ও খণ্ড যন্ত্রাংশের ব্যবহার দেখেই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল’ আখ্যায়িত করেছেন । এই উক্তির মধ্য দিয়ে তার একদিকে শিল্পকর্ম এবং অন্যদিকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল সম্বন্ধে জ্ঞানের দারিদ্র্যই প্রকটভাবে প্রমাণিত ।
পরিবেশ-৭১ এবং পরিবেশ-৭২ কালি-কলম ও গোয়াশ মাধ্যমে আঁকা । সমস্ত কাগজ খুব হালকা এক রঙের প্রলেপ দিয়ে পটভূমি তৈরি করে তার উপর গাঢ় ও খয়েরি রং দিয়ে কিছু অপরিচিত আকার আকৃতি গঠন করা হয়েছে। প্রথম ছবিটি ভালো করে পরীক্ষা করলে কখনো মনে হয় একজন উপবিষ্ট মানব রূপ—
আবার কখনো মনে হয় বন্ধুর পাহাড় পাত্র। তার শীর্ষে একটা অপরিচিত জন্তুর মাথা । মাথার নিচে পাহাড়ের ঢালুতে একটা কঙ্কালসার নর-মূর্তির রেখাচিত্র । মনে হয়। কালিদাসের আত্ম-প্রতিকৃতি ।
দ্বিতীয়ত, ছবিটার মধ্যে গাঢ় খয়েরি রং দিয়ে কাগজের বামদিকে কয়েকটা বক্ররেখা ঢালুভাবে নিচের দিকে নেমে গেছে এবং বামদিকে দু’টি রেখা প্রায় লম্বভাবে উপরের দিকে উঠে গেছে। উভয় দিকের রেখাগুলো ক্রমশ নিচের দিকে একবিন্দুতে মিলিত হওয়ার প্রবণতা। উভয় রেখাগুলোর সঙ্গমস্থলে, অনেক চেষ্টা করলে দেখা যায় একটা মানুষের মাথার রূপকল্প। বামদিকের রেখার শীর্ষের বক্ররেখা প্রায় কাগজের শীর্ষ ছুঁয়ে গেছে। শীর্ষের বক্ররেখার কাছে একটা রূপকল্প। আপাতভাবে দেখলে মনে হয় যেন একটা মাছরাঙা পাখি একটা মাছ ঠোঁট দিয়ে ধরে একটা গাছের উপর বসে আছে। ভাল ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, একজন মানুষ উপরে উঠে যাচ্ছে
উপরে আলোচিত উভয় ছবির মধ্যে ঢালুতে দণ্ডায়মান মানব রূপকল্প সাধারণ পাওয়া যাচ্ছে । ছবি দু’টো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, একজন মানুষ বসে বসে চিন্তা করছে যে সে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে শীর্ষে উঠে যাচ্ছে। আবার পরিবেশ-৭১- এর মধ্যে মানব রূপকল্পর মাথার উপর একটা অপরিচিত জন্তুর মাথার রূপকল্প থেকে হিন্দু ধর্মানুযায়ী দো-আঁশলা জীবে বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন— হিন্দু দেব গণেশ মূর্তির মানবদেহের উপর হাতির মাথা ।
উভয় ছবিতে প্রথমে জলরঙের হালকা প্রলেপ দিয়ে তারপর গাঢ় খয়েরি রং দিয়ে কাগজের একেবারে নিচ থেকে উপর পর্যন্ত অর্ধ-পরিচিত আকার গঠন করা হয়েছে। গাঢ় রঙের ভেতর কোথাও কোথাও কেবল পানি দিয়ে প্রলেপ দেয়ার ফলে রং ফেটে গিয়ে অমসৃণ বুনোট সৃষ্টি হয়েছে । দ্বিতীয় ছবিটার মধ্যে কিছু জায়গায় অনুপঙ্খ অঙ্কন থেকে মনে হয় যে, তিনি গাছের শিকড়, ডাল-পালা, লতা-পাতা, মাটি প্রভৃতি বোঝাতে চেয়েছেন । কোথাও কোথাও তুলির উল্টো পাশ দিয়ে আঁচড় কেটে কেটে সরু রেখা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা বুনোট ও অনুপঙ্খর আভাস দেয় । পরিবেশ-৭৪-এর মধ্যে হাত ও মাথা বিহীন একটা নারী রূপকল্প দেখা যায় । কিন্তু পরিবেশ-৭৩ ও ৪৮-এর মধ্যে বিশেষ কিছু অনুমান করা সম্ভব না ।
মিশ্র মাধ্যমে আঁকা কম্পোজিশন-৪ ও ৫ ভিন্ন ধরনের কাজ। প্রথমোক্ত কাজের মধ্যে দেখা যায়, একটা চতুর্বর্গ ক্যানভাসের একেবারে নিচে থেকে একটা রেখা বামদিকে বক্রভাবে ঘুরে গেছে, রেখার মাথাটা একটা বৃত্তে রূপান্তরিত হয়েছে । উপরের ডান দিকের কালো বৃত্তের মধ্যে একটা ছোট লাল চতুর্বর্গ। মধ্যখানের কালচে লাল বৃত্তের মাঝখানে লাল তারা, তার মাঝে ধূসর রঙের ছোট বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু দেখানো হয়েছে ।
একেবারে ডানদিকের কালো বৃত্তের মধ্যে দ্বিতীয়া বা তৃতীয়ার চাঁদ । তার বামদিকে লাল বৃত্তের মাঝে দু’টো ছোট ত্রিভুজ। ত্রিভুজ দু’টোর মাথা বৃত্তের কেন্দ্রে একবিন্দুতে মিলিত হয়েছে। বক্ররেখার উপর একটা অপরিচিত আকারের মাঝখানে মধ্যযুগের পারস্য চিত্রকলার একটা ক্ষুদ্রাংশ কোলাজ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে । তার উপরে ক্যানভাসের একেবারে ডান কোণায় কালো রঙের দ্বিতীয়ার চাঁদের মাঝে লাল তারা কালো রেখা দ্বারা বেষ্টিত, যা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হয় । কিন্তু স্পষ্টভাবে কিছু বোঝা সম্ভব না ।
কম্পোজিশন-এ শীর্ষক ছবিটা সম্পূর্ণ লাল রং দিয়ে আঁকা। একেবারে উপরে ডানদিকের কোণা থেকে বাম দিকে লাল রংকে গাঢ় রং দিয়ে কেটে দেয়া হয়েছে কিছুটা অংশ। এখান থেকে হালকা সবুজ মিশ্রিত সাদা রং নিচের দিকে গড়িয়ে এসে লাল পটভূমির আংশিক ঢেকে দিয়েছে।
মনে হয় যেন পানির উত্তাল তরঙ্গ সব কিছু ধুয়ে মুছে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসছে। বামদিকের কালচে রঙের একটা বৃত্তের অর্ধেকাংশের বেশি সাদার নিচে ঢেকে গেছে। ক্যানভাসের একেবারে নিচের ডানদিকে কিনারায় একটা অর্ধ-পরিচিত আকার গঠন করা হয়েছে। ক্যানভাসের নিচের একেবারে বামদিকের কোণায় একটা অর্থ-বৃত্তের মাঝে একটা তারার আংশিক দেখা যাচ্ছে ।
বড় আকারটাকে মাঝখানে থেকে একটা রেখা লম্বভাবে উপরের দিকে উঠে গেছে। তার মাঝখানে সম্ভবত পারস্য বা মোগল চিত্রকলার আংশিক সংস্থাপন করা হয়েছে। এই আকারের ডানদিকে নিখুঁত একটা বৃত্ত। বৃত্তের ঠিক মাঝখান থেকে একটা ভঙ্গুর রেখা সজোরে ডানদিকের লাল পটভূমিতে আঘাত করে ভঙ্গুর হয়ে চারদিকে ছিটিয়ে গেছে ।
এ ছবিটা পৃথকভাবে দেখলে কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু পরবর্তী প্যালেট অশ্রু শীর্ষক ছবিটির সাথে যুক্ত করলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক উপস্থাপনা দেখা যায়। সমস্ত লাল ক্যানভাসটাকে এদেশের অসংখ্য নর-নারীর এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে রঞ্জিত এদেশের মাটির প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে । কালো রেখা ভঙ্গুর হয়ে চারদিকে ছিটিয়ে যাওয়াকে পাকসেনাদের মেশিনগান, কামানের গোলা প্রভৃতির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ক্যানভাসের নিচে একেবারে বামদিকের কোণায় আংশিক তারাকে পাকিস্তান শাসনামলের পতন এবং পাকসেনাদের পরাজয়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কালচে বৃত্তের আংশিক সাদা রঙের নিচে ঢেকে যাওয়া ‘৭১-এর ঘোর দুর্দিন কেটে যাওয়ার আভাস দিচ্ছে এবং সাদা ঢেউ আসন্ন স্বাধীনতার ইঙ্গিত।
অশ্রু ছবিটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপনা বিষয়বস্তুকে আড়াআড়িভাবে লম্বা ক্যানভাসে উপস্থাপন করা হয়েছে। ক্যানভাসের উপরি অংশে একটা রাইফেলের রূপবন্ধ । ক্যানভাসের মাঝখানে দিয়ে আড়াআড়িভাবে একটা লম্বা তক্তা বিষয় বা সমস্ত পরিসরকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। উপরের অংশে ডানদিকে একটা রাইফেল, তার বিপরীত দিকে ছোট ছোট কতকগুলো ডিম্বাকৃতি রাইফেলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে । রাইফেলের বিপরীত দিকে একটা হৃৎপিণ্ড, তার মধ্যে একটা চোখ। আড়াআড়ি তক্তা খোদাই করে লাল রং দিয়ে লেখা ‘আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ’।
বর্ণিত বিষয়বস্তু যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপনা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু সুষ্ঠু রচনাশৈলী ও মাধ্যম ব্যবহারে দক্ষতার অভাবের জন্য শিল্পরসে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। ‘আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ’ এই উৎকীর্ণ লিপি থেকে বোঝা যায় যে, কেবল জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য হামিদুর রহমানের অনুকরণে মুখরোচক শ্লোগান দেয়া হয়েছে । কারণ যেখানে রূপবন্ধ ও রূপকল্প এবং প্রতীকের মধ্য দিয়ে মূল বক্তব্য প্রকাশ হয়েছে সেখানে এই শ্লোগানের কোনো যৌক্তিকতা নেই, প্রয়োজনও হয় না।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, জনগণের আবেগকে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অর্জনের কাজে লাগানো হয়েছে, শিল্পীর আন্তরিকতা নেই। অবশ্য এমনও হতে পারে যে, দৃষ্টিনন্দনের দিক থেকে বিষয়বস্তু কেমনভাবে উপস্থাপন করলে আকর্ষণীয় হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণার অভাবে এবং অদক্ষতার জন্য এ কাজটা শিল্পের গুরুত্ব হারিয়েছে। শ্রদ্ধার্ঘ্য-১-এর মধ্যে ভাবের জটিলতা এবং বহু অর্থবোধকতা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ
বিষয়বস্তু ও শিরোনামের মধ্যে যুক্তি সঙ্গত সম্পর্ক ও তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায় না। উপরন্তু, বৈষম্য ও বৈপরীত্য রয়েছে। এখানে বিষয়বস্তুর বর্ণনা দিয়ে আলোচনা করলে সকলের বুঝতে সুবিধা হবে। কালো কাপড় দিয়ে একজন বৃদ্ধ লোকের চোখ বেঁধে তাকে তক্তার সাথে বড় বড় গজাল দিয়ে বিদ্ধ করে গলায় ফাঁসির দড়ি লাগানো হয়েছে। তক্তার একেবারে ও ডানদিকে একটা পাখি একটা ফুল ঠোঁট দিয়ে ধরে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তার গলার নিচে অনেকগুলো ছোট ছোট আকার দেখে মনে হয়। যে, অনেকগুলো নির্বাপিত মোমবাতি বা প্রদীপ।
ঠিক তার নিচে আড়াআড়িভাবে সাইনবোর্ডের আকারে একটা আয়তক্ষেত্র উভয় পাশে দু’টো খুটির উপর সংস্থাপন করা হয়েছে । তার মধ্যে একটা সাবেক আমলের রিভলভার । রিভলভারের নিচের দিক থেকে ধোঁয়া নির্গত হয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার মধ্যে মায়ের গর্ভে কয়েক মাসের একটা শিশু দেখানো হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো যে, মৃত্যুর মুখোমুখি অপেক্ষমাণ এই বৃদ্ধার সাথে রিভলভার ও মায়ের গর্ভে জরায়ুর মধ্যে শিশুর কী সম্পর্ক? আর বিষয়বস্তুর সাথে শিরোনামেরই বা সম্পর্ক ও তাৎপর্য কোথায়? অবশ্য বৃদ্ধের চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা, গজাল দ্বারা বিদ্ধ করে ফাঁসির দড়ি গলায় এবং পাখির ঠোঁটে ফুল এবং গলার নিচে মোমবাতি বা প্রদীপ-এর সাথে শিরোনামের সম্পর্ক স্থাপন করা যায় তাহলে মোটামুটিভাবে একটা অর্থ বা তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়। দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধার্পণ।
কিন্তু গজাল দ্বারা তক্তার সাথে বিদ্ধ করা এবং একই সাথে ফাঁসিতে ঝুলানোর কী দরকার ছিল? এর যে কোনো একটাই তো যথেষ্ট ছিল । বিশেষ করে তক্তার সাথে গজাল মারার ফলে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব দেখা যায়। যদি যিশুখ্রিস্টের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হয়ে থাকে তাহলে স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক থাকে না। আর যদি স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক বোঝানো হয় তাহলে যিশুখ্রিস্ট থাকে না ।
উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা যদি মোটামুটি ঠিক ধরে নেয়া হয় তাহলে রিভলভার ও শিশু বৈষম্য ও বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে । উপরন্তু, এর তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায় না । আর যদি বৃদ্ধার সাথে শিশু ও রিভলভারের সম্পর্ক স্থাপন করা হয় তাহলে মনে হয় সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে । তাহলে উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা একেবারেই অর্থহীন। শৈশবে শোনা আমার একটা গল্প মনে পড়ে গেল । প্রাচীনকালের কোনো এক শিল্পী সম্বন্ধে এই গল্পটা শুনেছিলাম । গল্পটা হলো : কোনো এক শিল্পী ফেরেস্তার ছবি আঁকবেন বলে মনে করলেন । ফেরেস্তার চেহারা কেমন হবে বা হওয়া উচিৎ সেজন্য তিনি উৎস ও অনুপ্রেরণা
খুঁজতে বের হলেন। সারা দেশ ঘুরলেন। অবশেষে একজন শিশু তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। যার চেহারার মধ্যে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ, নির্মল পবিত্র রূপ দেখলেন । তিনি অতি যত্নসহকারে ঐ শিশুর প্রতিকৃতি আঁকলেন । এই ছবি প্রদর্শিত হলে সম্রাট তাকে দেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে পুরস্কৃত করলেন। একই শিল্পী বহু বছর পরে সংকল্প করলেন যে, এবারে তিনি শয়তানের প্রতিকৃতি আঁকবেন ।
শয়তানের রূপ কেমন হবে সেই উৎস খুঁজতে তিনি এবারও সারা দেশ ঘুরলেন। কিন্তু কোথাও তেমন কোনো মুখ তার চোখে পড়ল না। অবশেষে তিনি রাষ্ট্রীয় কারাগারে গেলেন। কারাগারে বন্দি একজন প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত খুনি আসামি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল । তিনি তার প্রতিকৃতি আঁকলেন। এবারেও সম্রাট তাকে দেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সম্মানে ভূষিত করলেন। পরে ঐ শিল্পী জানতে পারলেন যে, তিনি যে শিশুকে ফেরেস্তার প্রতীক হিসেবে এঁকেছিলেন পরবর্তীতে সেই শিশুই ভয়ংকর দুষ্কৃতকারীতে পরিণত হয়েছিল ।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কালিদাস কি বলতে চান যে দুষ্কৃতকারীরা মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকেই দুষ্কৃতকারী হয়ে জন্মায় । নাকি মানুষ ফেরেস্তার মতো নিষ্পাপ হয়ে জন্মায় । কিন্তু পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন কারণে সে দুষ্কৃতকারীতে পরিণত হয় ।
এখন প্রশ্ন হলো, কালিদাস কি তাহলে সমাজবিরোধী দুষ্কৃতকারীদের প্রতি শ্রদ্ধার্থ অপর্ণ করছেন? তাতো কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বা সমর্থন করা যায় না। তাছাড়াও, দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক দিক থেকে এটাকে শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা সঠিক হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য এ নিয়ে বিভিন্ন শিল্প-সমালোচক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য ও মতবিরোধ হওয়া স্বাভাবিক (প্যালেট-১৬)।
এচিং মাধ্যমে আঁকা শ্রদ্ধার্ঘ্য-২ একটি ছাপচিত্র। এ ছাপচিত্রটা প্রচলিত আয়তন ও রচনাশৈলীর দিক থেকে কিছু ভিন্ন । উপরের অংশ একটা নিখুঁত বৃহৎ বৃত্ত, তার সাথে সংযুক্ত নিচের অংশ কিছুটা আয়তাকার। ছবির একেবারে নিচের প্রান্ত থেকে একটা আয়তক্ষেত্র লম্বভাবে বৃত্ত ভেদ করে কেন্দ্র পর্যন্ত উঠে গেছে, তার মাথায় সিঁড়ির ধাপের মতো কয়েকটা স্তর, তারপর একটা ত্রিভুজ বৃত্তের শীর্ষ পর্যন্ত উঠে গেছে।
অর্থাৎ একটা মন্দির ও তার চূড়া । মন্দিরের চূড়ার নিম্নাংশে একজন বৃদ্ধের মাথা, মুখে দাড়ি, মাথায় মুকুটের মতো অলঙ্করণ করা । বৃদ্ধের পোশাকের হাতের আস্তিন ও গলায় কারুকার্য দেখে রাজকীয় পোশাক বা কোনো ধর্মযাজকের মূল্যবান পোশাক মনে হয় । মন্দিরের চারদিকে নানা রকম অলঙ্করণ করা ।
বৃদ্ধের চেহারা ও পোশাক থেকে মনে হয় হিমালয় অঞ্চলীয় কোনো দেশের প্রাচীন, বিশেষ করে চীন, সম্রাট বা দেবতার কাল্পনিক রূপকল্প উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে যেহেতু মন্দির রয়েছে সেহেতু কোনো দেবতা বা ধর্মযাজক হিসেবে ধরে নেয়াই যুক্তি সংগত।
বৃত্তের নিচের অংশে মন্দিরের গায়ে কিছু অপরিচিত রূপবন্ধ দ্বারা অলঙ্করণ করা হয়েছে । তার মধ্যে ছাগল সাদৃশ একটা জন্তু, তার পিঠের উপর ছোট একটা প্রাণী । এটা সংলগ্ন একটা মানব রূপকল্প, মনে হয় কালিদাসের আত্ম-প্রতিকৃতি। প্রতিকৃতি সংযুক্ত একটা মানুষের নগ্ন নিম্নাঙ্গের পেছন দিকের দৃশ্য ও পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ একটা জন্তুর পায়ে রূপান্তরিত হয়েছে।
মন্দিরের বাম দিকে একজন পশ্চিমা নারীর বিকৃত রূপকল্প এবং তার বিপরীত দিকে নিচের ডান কোণায় একজন স্ফীতকায় পেটওয়ালা পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাত পেছন দিকে এবং অন্য হাত উপরের দিকে প্রসারিত, অনেকটা উদ্ধত ভঙ্গিতে উপরের দিকে দেবতার বা ধর্মযাজকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ।
বর্ণিত ছবির মধ্যে কার প্রতি এবং কি কারণে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হচ্ছে তা অনুমান করা সম্ভব না (প্যালেট-১৭)।
ছাপচিত্র-২-এর মধ্যে দেখা যায় একটা কাঠের বড় বাতা। তার ঠিক মাঝখানে একটা বড় বৃত্তের মধ্যে একজন নারীর হাতের ছাপ। হাতের সব রেখাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পটভূমিতে অপরিচিত রূপবন্ধ দ্বারা শোভাপ্রদ করা হয়েছে। বাক্সের নিচের বাম কোণায় ছোট বৃত্তের মাঝে একজন বিদেশিনী নারীর প্রতিকৃতি। মনে হয় কালিদাসের নিজের ও তার স্ত্রীর প্রতিকৃতি। নারী প্রতিকৃতির উপরে একটা কুকুর বৃত্তের মাঝে হস্তরেখার দিকে তাকিয়ে হা করে আছে।
বাক্সের উপরের উভয় কোথায় অর্থহীন কিছু বিমূর্ত রূপবন্ধ। বাক্সের উপরের সমতলে অনেকগুলো তারকাটা পোতা বাক্সের উপর থেকে একটা নল উঠে গেছে, নলের উভয় পাশে দু’টো জি থেকে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। মলের মুখ দিয়ে কুণ্ডলী আকারে ধোঁয়া মেঘের মতো ছেয়ে গেছে। এই ধোঁয়ার মধ্যে শিশু চিত্রকলার ধরনে কিছু মানব রূপকল্পর রেখাচিত্র এবং অপরিচিত রূপবন্ধর রেখাচিত্র। একেবারে উপরে ডান কোণায় মনে হয় শিশুদের আঁকা মোটরগাড়ি (প্যালেট-১৮)।
ছাপচিত্র-৩-এর মধ্যে দেখা যায় উপরের অংশে বড় একটা অর্ধবৃত্ত। অর্ধবৃত্তের নিচের অংশে বক্রাকারে কয়েকটা অংশে বিভক্ত। ফাটলের মধ্যে দিয়ে দৃষ্টি ভেদ করে পেছনের পটভূমি দেখা যায়। অর্ধবৃত্তের বিপরীতে একজন কালো দণ্ডায়মান নর-মূর্তি। কালোর মধ্যে সাদা সরুরেখা দ্বারা হাতের ও পেটের মাংসপেশী, বুকের পাঁজর এবং কাপড়ের ভাঁজ অঙ্কন করা হয়েছে ।
নরমূর্তির ডান হাত উপরের দিকে প্রসারিত করা। হাতে রেঞ্জ ধরে আছে । রেঞ্জের শীর্ষে সংযুক্ত একটা অর্ধচন্দ্র। নরমূর্তির দেহের উপর একটা সিংহের মাথা । অর্থাৎ দো-আঁশলা প্রাণী। নরমূর্তির বামপাশে একটা ঘোড়া সাদৃশ জন্তুর দেহের সাথে মানুষের মাথা ও হাত এত দো-আঁশলা জীবের পিঠের উপর একজন রাজা উপবিষ্ট। রাজা এক হাত দিয়ে একটা মোমবাতি বা রাজদণ্ড ধরে আছে। তার বিপরীত দিকে, ডানপাশে দু’জন বিকৃতদেহী নগ্ন উপবিষ্ট নারী।
দো-আঁশলা জীবের ঠিক লেজের জায়গায় একজন নারীর রূপকল্প এবং পেছনের পায়ের ঠিক নিচে একজন নর রূপকল্প। মনে হয় কোনো উপজাতীয়দের কাল্পনিক দেবতার কাঠ খোদাই করা ভাস্কর্য (প্যালেট-১৯)।
আলোচিত কাজগুলো সামগ্রিকভাবে সাইকিয়াট্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করলে কালিদাস কর্মকারের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতার লক্ষণগুলো ধরা পড়ে। লক্ষণগুলো পরীক্ষা করলে মনে হয়, ‘ম্যানিক ডিপ্রেশন ও হরর ভ্যাকু’ থেকে তার মধ্যে বিঘ্নিত চিন্ত ন-রূপকল্প এবং নেতিবাচক বিঘ্নিত শারীরিক-রূপকল্প অথবা দুঃস্বপ্ন থেকে তার মধ্যে ভীতিকর দৃষ্টি-বিভ্রম অথবা দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকে। যে কারণে তার ভেতর সিজোফ্রেনিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
অতএব, কালিদাস কর্মকারের কাজগুলোকে পরা বাস্তবধর্মী শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হলে ভুল করা হবে। সুতরাং, তার চিত্রকর্মকে সাইকোটিক আর্ট বা মানসিক চিত্রকর্ম হিসেবে গণ্য করা শ্রেয়।
আরও দেখুনঃ