আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মাটির তৈরি শিল্পকর্ম
মাটির তৈরি শিল্পকর্ম
মাটির তৈরি শিল্পকর্ম
মাটির তৈরি জিনিস আমরা সব সময়ই দেখি। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারও করি। মাটির হাঁড়ি-পাতিল, সরা, গামলা, কলস, সোরাই, খোরা, সানকি, চাড়ি, মটকি ইত্যাদি অসংখ্য জিনিস আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। সভ্যতার আদিযুগ থেকে মানুষ মাটির পাত্র ও বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে শিখেছে। সেগুলোর গঠন ও গড়নপদ্ধতি অবশ্যই ছিল আদিম ধরনের।
যুগ যুগ ধরে মানুষ পুরুষানুক্রমিক অর্জিত জ্ঞান, বুদ্ধি, সৌন্দর্যবোধ ও কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে মাটির শিল্পকর্মের রূপ সেই আদিম এবড়ো- থেবড়ো অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছে। আজকাল আমরা চীনামাটির তৈরি যেসব সুন্দর সুন্দর জিনিসপত্র ও বাসন-কোসন ব্যবহার করি তা তো আসলে মাটি দিয়েই তৈরি। তা অবশ্য নিখুঁত বিশুদ্ধ সাদা মাটি, যার মধ্যে মাটির মৌলিক উপাদান ছাড়া অন্য কোনো উপাদান বা ভেজাল নেই।
মাটি সম্পর্কে পরে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারব। মানুষ আদিমকাল থেকে এ পর্যন্ত মাথা খাটিয়ে মাটির জিনিস তৈরি করার যতরকম কলাকৌশল আবিষ্কার করেছে তার মধ্যে চাকার ব্যবহার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। মাটির পাত্রে তৈরি করার ক্ষেত্রে কুমারের চাকা যে কী প্রচণ্ড গতি সঞ্চার করেছে একটু চিন্তা করলেই তা বুঝতে পারব । ইতোমধ্যে কয়েল পদ্ধতিতে মাটির পাত্র তৈরি করতে শিখেছি। একটি পাত্র তৈরি করতে আমাদের প্রায় সারাদিন লেগে যায় ।
কুমাররা কিন্তু ঘুরিয়ে ঐ সময়ে এরকম কয়েকশো পাত্র তৈরি করতে পারে। কুমারবাড়ি গেলে দেখতে পারব চোখের নিমেষে কেমন করে তারা এক-একটি পাত্র তৈরি করতে পারে। তাই বলে কি মাটির শিল্পকর্ম তৈরিতে কয়েল পদ্ধতি অপ্রয়োজনীয় ও অকেজো হয়ে পড়েছে? মোটেই না। ছোট-বড় অনেক জিনিসই আছে যা কয়েল পদ্ধতিতেই তৈরি করতে হয়, ঢাকা দিয়ে করা যায় না। তাই এই পদ্ধতির গুরুত্বও কম নয়।
কাজের মধ্য দিয়ে এই পদ্ধতি ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারলে আমরা মাটির পাত্র ছাড়াও অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করতে পারব। ইতোমধ্যে মাটির কয়েল দিয়ে আমরা যেসব পাত্র তৈরি করেছি সেগুলোর ভেতরদিকই শুধু মসৃণ করেছি, বাইরের দিক রয়েছে খাঁজকাটা। আমরা হয়তো মনে করতে পারি মাটির A কয়েল দিয়ে কোনোকিছু তৈরি করলে বাইরের দিকটায় কয়েলের খাঁজ রাখতেই হয়।
না, এরকম কোনো নিয়ম নেই। ইচ্ছা করলেই ভেতরে বাইরে দুদিকেই মসৃণ করতে পারি। তবে এক্ষেত্রে কয়েল তৈরির জন্য মাটির লতাটি পেনসিলের চেয়ে সামান্য একটু মোটা রাখতে হবে। মাটি থাকবে যথাসম্ব নরম। এবার মাটির কয়েল দিয়ে ভেতর-বাহির মসৃণ একটি পাত্র তৈরির চেষ্টা করি ।
উপকরণ ও হাতিয়ার
যেহেতু মাটির পাত্র তাই মাটিই তার মূল উপকরণ। পাত্র তৈরির জন্য অতি সাধারণ সামান্য কিছু হাতিয়ারের প্রয়োজন, যা এর আগেও আমরা ব্যবহার করেছি। এবার অতি সাধারণ দু-একটা জিনিসের নাম যোগ হচ্ছে। প্রয়োজনীয় হাতিয়ারের তালিকা জেনে নিই।
১) কাঠের মসৃণ বেলোন অথবা বাঁশের একটা চোঙা।
২) বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি ছুরি।
৩) কাঠের পাতলা চটা দিয়ে তৈরি ‘মডেলিং টুল ।
৪) কাঠ বা বাঁশের কাঠির মাথায় তার লাগিয়ে তৈরি ‘মডেলিং টুল’।
৫) চোখা মাথার একটি ছোট ছুরি বা চাকু। ছুরিটি লোহা কাটার করাতের ভাঙা টুকরো দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে।
৬) একটি স্কেল।
৭) লোহা কাটার করাতের ছোট-বড় টুকরো ।
৮) এক টুকরো স্পঞ্জ বা ফোম ৷
৯) এক টুকরো মোটা পুরনো কাপড় ।
এই হাতিয়ারগুলো জোগাড় করা আমাদের জন্য মোটেই কঠিন হবে না। এর মধ্যে কয়েকটি তৈরি করে নিতে হবে ।
মাটির শিল্পকর্ম তৈরির জন্য কিছু হাতিয়ার
মাটির কয়েল দিয়ে মসৃণ পাত্র তৈরি
মাটি দিয়ে কয়েল কীভাবে তৈরি করতে হয় তা তো আমরা জানি। পাত্র তৈরির কাজ আরম্ভ করার আগে কাগজে পাত্রটির ছবি ও নকশা এঁকে নিই। পাত্রটি যত বড় হবে ছবি ও নকশা ঠিক তত বড় করে আঁকব। তাতে কাজের সময় কিছুক্ষণ পরপর মাপ ও গড়ন নকশার সাথে মিলিয়ে দেখতে সুবিধা হবে। এবার কী ধরনের পাত্র তৈরি করব তা ঠিক করে নিই। একটা ফুলদানি করি, তবে সাদামাটা চোঙার আকৃতি নয়।
ফুলদানির গড়ন নিচের দিক থেকে আস্তে আস্তে মোটা হয়ে ওপরের দিকে উঠবে। বেশ উঁচু হওয়ার পর আবার ছোট হয়ে একটা গলার মতো হবে। মুখের ব্যাস হবে গলার থেকে সামান্য বেশি। সব মিলিয়ে ফুলদানিটির গড়ন হবে লম্বাটে । গলায় একটা মালা এঁকে দিলে বেশ লাগবে। ফুলদানির ছবি ও নকশা এঁকে নিই, তারপর তৈরির কাজ আরম্ভ করি। প্রথমে পরিমাণমতো মাটি বেলোন অথবা বাঁশের চোঙায় বেলে এক সেন্টিমিটার রুটির মতো তৈরি করে নকশার মাপ অনুযায়ী ফুলদানির তলার জন্য কাটি।
এবার মাপমতো একটি মাটির কয়েল তৈরি করে ডলার কিনারা বরাবর বসাই। বসাবার আগে কয়েলের নিচ ও তলার কিনারা পানি দিয়ে স্যাঁতসেঁতে করে নিতে ভুলব না। প্রথমে কয়েলের বাইরের দিকে বাম হাতের মাঝের আঙ্গুল দিয়ে হালকা চাপ রেখে ডান হাতের তর্জনীর মাথা দিয়ে একটু একটু করে ভেতরের দিকের মাটি নিচের দিকে টেনে নামিয়ে তলার সাথে কয়েলটি জোড়া দিই। কয়েল যেন সম্পূর্ণ গোল থাকে।
এবার বাম হাতের মাঝের আঙ্গুলটি কয়েলের ভেতরের দিকে বসিয়ে ডান হাতের তর্জনীর মাথা দিয়ে কয়েলের বাইরের দিকের মাটি টেনে নামিয়ে তলার সাথে জোড়া দিই। কয়েলটি ভেতর-বাহির দুদিকেই তলার সাথে যুক্ত হয়ে গেল। নকশা দেখে মাপ অনুযায়ী দ্বিতীয় কয়েল তৈরি করে প্রথম কয়েলের ওপর বসাই এবং একই নিয়মে ভেতর ও বাইরের মাটি টেনে নামিয়ে তলার সাথে জোড়া দিই। কয়েলটি ভেতর-বাহির দুদিকেই তলার সাথে যুক্ত হয়ে গেল।
নকশা দেখে মাপ অনুযায়ী দ্বিতীয় কয়েল তৈরি করে প্রথম কয়েলের ওপর বসাই এবং একই নিয়মে ভেতর ও বাইরের মাটি টেনে নামিয়ে জোড়া দিই। এভাবে একটির ওপর আরেকটি কয়েল বসিয়ে নকশা অনুযায়ী ফুলদানিটি তৈরি করি। কয়েকটি কয়েল বসানোর পর এক এক বার কাঠের মডেলিং টুল দিয়ে টেনে ও ঘষে ফুলদানির ভেতরের ও বাইরের অসমান মাটি সমান করে নেব।
একটি বিষয়ে অবশ্যই খুব সজাগ থাকতে হবে, তা হলো প্রত্যেকটি কয়েল তৈরির সময় নকশা অনুযায়ী মাপ দেখে নিতে হবে। নিচ থেকে প্রত্যেকটি কয়েলে ব্যাস একটু একটু করে বেড়ে বেড়ে ওপরের দিকে উঠেছে আবার একটু একটু করে কমে কমে গলার
মাটির কয়েল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম
মাঝামাঝি গিয়ে একট একট বেড়েছে। প্রত্যেকটি কয়েল বসানোর সময় জোড়ার জায়গাটা পানি দিয়ে অবশ্যই স্যাঁতসেঁতে করে নেব। গড়ন শেষ করার পর এবার ফুলদানিটি মসৃণ করার পালা। লোহা কাটার করাতের ভাঙা টুকরো দিয়ে খুব সহজেই ফুলদানির বাইরের দিকটা মসৃণ করে নিতে পারি। করাতের কাঁটা-কাঁটা দিক দিয়ে চারদিক থেকে টেনে টেনে চেঁছে ফুলদানির গায়ের উঁচু-নিচু মাটি প্রথমে সমান করে নিই।
এবার করাতের টুকরোর সোজা দিকটা একটু কাত করে ধরে টেনে পাত্রের ওপরটা হালকাভাবে চেঁছে মসৃণ করি। ভেজা স্পঞ্জ বা ফোম চিপড়ে নিয়ে তা দিেেয় স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় পাত্রটির গা ঘষে দিই। দেখি পাত্রটি আরও মসৃণ হয়ে গেছে। সবশেষে ছুরির চোখা মাথা দিয়ে খোদাই করে ফুলদানিটির গলার নিচে মালার মতো একটি অলঙ্কার এঁকে দিই। একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন— ফুলদানি তৈরির কাজ এক দিনে শেষ করতে না পারলে পলিথিন দিয়ে জড়িয়ে রাখব ।
ফুলদানিটি এখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভালো করে লক্ষ করি। দেখব তৈরি ফুলদানি হয়তো আমার আঁকা ছবি ও নকশা সাথে হুবহু মিলছে না। হয়তো গড়নে পার্থক্য হয়ে গেছে, কোথাও কোথাও বাঁকা হয়ে গেছে। হোক না এরকম, তাতে কী আসে যায়? একটা ফুলদানি যে তৈরি করতে পারলে সেটা কি কম কথা, কম আনন্দের? প্রথম প্রথম এরকম হবেই, ঘাবড়াবার কিছুই নেই।
অনেকদিন চর্চার পর সবই ঠিক হয়ে যাবে। তবে ধৈর্য ধরে কাজ করতে হবে। কয়েল পদ্ধতিতে যে কোনো আকৃতির যত খুশি বড় জিনিস তৈরি করতে পারব। সবার আগে প্রয়োজন পদ্ধতিটিকে ভালোভাবে আয়ত্ত করে নেওয়া। ছবির নকশা ও নমুনা দেখে পাত্রগুলো তৈরি করতে চেষ্টা করি।
শহিদমিনার
মাটির ফলকের নকশা
পোড়ামাটির ফলকে শিল্পকর্মের জন্য আমাদের দেশ এক সময় খুবই বিখ্যাত ছিল। দেশের প্রাচীন শিল্পকর্মের যেসব নিদর্শন আমরা এখনও দেখতে পাই, বলতে গেলে তার প্রায় সবকিছুই পোড়ামাটির ফলকচিত্রের মধ্যে পড়ে।
পাহাড়পুর ও ময়নামতির বৌদ্ধবিহারে প্রাপ্ত ফলকচিত্রে যেসব হাজার বছরের পুরনো শিল্পকর্মের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় তেমনি বগুড়ার মহাস্থানগড়, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ ও দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে প্রায় তিনশো বছর আগে পর্যন্ত, ক্রমানুসারে পরবর্তী বিভিন্ন সময়ের শিল্পকর্মের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় পোড়ামাটির এই ফলকচিত্রের মধ্যেই।
ছবি বা অন্য কোনো মাধ্যমে শিল্পকলা বিষয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের তেমন কোনো নিদর্শন আমরা দেখতে পাই না। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি আমাদের কাছে ঐতিহ্যগতভাবে পোড়ামাটির চিত্রের গুরুত্ব কত বেশি। তাহলে মাটির ফলকে একটি ছবি তৈরি করি। উপকরণ ও হাতিয়ার লাগবে ফুলদানি তৈরি করার সময় যা ব্যবহার করেছি তাই। নতুনের মধ্যে এক সেন্টিমিটার পুরু স্কেলের মতো লম্বা দুটি কাঠের রুল হলে কাজের সুবিধা হবে।
মাটির ফলকে ছবি তৈরি করার আগে ছবিটি কাগজে এঁকে নিতে হবে। মানুষ, পশু, পাখি আমাদের যা খুশি তা আঁকতে পারি। মাটির ফলকে যত বড় ছবি করব ঠিক তত বড় ছবি আঁকি। তরকারির ঝুড়ি মাথায় লুঙ্গি পরা একটি গাঁয়ের লোক আঁকি। খুব ভালো হবে। লোকটির চারপাশে কিছু জায়গা রেখে ছবির ফ্রেমের মতো বর্ডার দিই। একটু পাতলা কাগজের ওপর কার্বন কাগজের সাহায্যে বর্ডারসহ ছবির একটি অনুলিপি বা কপি করে বর্ডার বরাবর মাটির ফলকে চিত্র ও নকশা তৈরির কিছু নমুনা চারদিকে কেটে রাখি।
এবার পাঁচ ছয় সেন্টিমিটার ব্যাসের এক দলা নরম মাটি নিই। সিমেন্টের মেঝের ওপর কিংবা পিঁড়ির ওপর রেখে প্রথমে হাত দিয়ে চেপে একটু চ্যাপ্টা করে নিই। বেলোন অথবা বাঁশের চোঙা দিয়ে এই চ্যাপ্টা করা মাটি বেলে, এক সেন্টিমিটার পুরু রুটির মতো মাটির
মাটির ফলকে চিত্র তৈরির কিছু নমুনা
স্ল্যাব বা ফলক তৈরি করি। মাটি বেলার সময় এক সেন্টিমিটার পুরু কাঠের রুল দুটি মাটির দুপাশে বসিয়ে, তার ওপর আমার ছবির কার্বন কপি বসাই। স্কেল ধরে কাগজের বর্ডার- বরাবর ছুরির মাথা দিয়ে চারদিকেরও বাড়তি মাটি কেটে দিই, এবার চোখা করে কাটা পেনসিলের মাথা হালকাভাবে ছবির ওপর দিয়ে চালিয়ে যাই, যাতে নিচের মাটিতে হালকা দাগ পড়ে। সম্পূর্ণ ছবির ওপর দিয়ে পেনসিল চালানো শেষ হয়ে গেলে কাগজটি মাটির ওপর থেকে তলে নিই।
দেখি, মাটির ফলকের ওপর ছবির সুন্দর ছাপ পড়ে গেছে। প্রথম যখন মাটির কাজ শিখতে আরম্ভ করেছিলাম তখন নরম মাটির ঢেলা খালিহাতে চেপে, টেনে ও টিপে টিপে কীভাবে বিভিন্ন আকৃতির পুতুল, হাতি, ঘোড়া তৈরি করেছি তা আমাদের মনে আছে। এখন মাটির ফলকে ছবি তৈরির সময় তোমার সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। কাগজে প্রথম যে ছবিটি এঁকেছি তা সামনে রাখি।
এবার নরম মাটি নিই এবং ছবি দেখে টিপে টিপে পর্যায়ক্রমে মানুষটির মাথা, শরীর, হাত, পা, লুঙ্গি ইত্যাদির আদলে এক-একটি অংশ তৈরি করে মাটির ফলকে বসাবার পর আরেকটি অংশ তৈরি করে বসাব। এগুলো যাতে ফলকের ওপর ভালোভাবে মিলেমিশে বসতে পারে তার জন্য নিচের দিকটা চ্যাপ্টা বা সমান করে নিই, ওপরের দিকটা শরীরের গড়ন অনুযায়ী হবে।
ফলকের যেখানে যখন এক-একটি অংশ বসাব তখন ছবির ছাপ অনুযায়ী ফলকের ঐ জায়গাটায় একটুখানি পানি লাগিয়ে বাঁশের চোখা ছুরি দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে কিছুটা কাদা কাদা করে নিয়ে তবে বসাব । বসিয়ে একটু চাপ দিই যাতে অংশটি ভালোভাবে বসেও নিচে বাতাস থাকতে না পারে। লক্ষ করি চাপ দেওয়ার সময় নিচ থেকে কিছু-কিছু কাদা বেরিয়ে আসছে।
বাঁশের ছুরির চোখা মাথা দিয়ে টেনে কাদাটুকু সমান করে দিই। এভাবে ফলকের ওপর মাটি বসিয়ে ছবি তৈরির কাজ সম্পন্ন করে নিই। এবার দেখি, মাটির ফলকের ওপর তরকারির ঝুড়ি মাথায় লুঙ্গি পরা গাঁয়ের লোকটির ছবি কেমন সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ছবি তৈরির কাজ কিন্তু এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। ছবিটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুব ভালো করে দেখি । কোথাও একটু মাটি লাগিয়ে কিংবা লাগাতে হলে জায়গাটা পানি দিয়ে একটু স্যাঁতসেঁতে করে মাটি লাগাই ।
গড়ন ঠিক করার পর ছবির চারদিকে ফলকের কিনারা বরাবর দুই সেন্টিমিটার চওড়া ও প্রায় এক সেন্টিমিটার উঁচু করে মাটি বসিয়ে ফ্রেমের মতো করি। এবার বাঁশের ছুরি দিয়ে খুব সাবধানে একটু একটু করে চেঁছে ফ্রেমসহ ছবিটিকে মসৃণ করে নিই। মসৃণ করার পর ছুরির চোখা মাথা দিয়ে খোদাই করে লোকটির চোখ, মুখ ও লুঙ্গির চেক এঁকে দিই। মাথার ঝুড়িতে ও কয়েকটি আঁচড় দিয়ে বুনন দেখাতে পারি ।
মাটির ফলকে ছবি তো তৈরি করলাম। এবার ছবিটাকে ঝুলানোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। মাটি দিয়ে হাতের আঙ্গুলের মাথার সমান দুটি মালা তৈরি করি। ঝাড়ুর শলা বা এরকম সরু কিছু দিয়ে মালার ভেতরে মোটা সুতা ঢোকাবার মতো ছিদ্র করি। মালা দুটির এক পাশ সামান্য কেটে একটু সমান করে নিই।
এবার ছবির পেছন দিকে ওপরে দুই কোনায় মালা দুটি বসিয়ে ভালো করে জোড়া দিই। মালা দুটির ছিদ্র যেন বন্ধ না হয় এবং লম্বালম্বিভাবে বসে। মালা দুটির ভেতর দিয়ে শক্ত সুতা পরিয়ে এ – ছবি দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে পারি আবার কোনোকিছুর সাথে ঠেস দিয়ে কোনো মানানসই জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি। যেভাবেই রাখি খুব সুন্দর দেখাবে । মাটি দিয়ে কিছু পাত্র ও ফলকচিত্র তৈরি করা তো শেখা হলো। মাটির তৈরি এসব জিনিস ভালো করে শুকিয়ে পোড়ানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
ছায়ায় রেখে ধীরে ধীরে শুকোতে হবে তা তো জানা আছে। এতে সময় লাগবে সত্যি কথা, কিন্তু বাঁকা হওয়ার বা ফেটে যাওয়ার ভয় থাকে না। ভালো করে শুকাল কি না, তা বুঝব কী করে? একটা শুকনো জিনিস হাতে নিয়ে তার তলায় বা পেছনের দিকে নখ দিয়ে একটু আঁচড় দিলে যদি দেখি আঁচড়ের জায়গাটা সাদাটে হয়ে গেছে তাহলে বুঝবো জিনিসটি ভালোভাবেই শুকিয়ে গেছে।
তা না হলে আরও শুকাতে হবে। শুকনো জিনিস ভেজা হাতে ধরলে বা পানি লাগলে ফেটে যাবে তাই খুব সাবধান থাকব । আশেপাশে কোথাও কুমারবাড়ি থাকলে কুমারদের কাছ থেকে আমাদের তৈরি জিনিসগুলো পুড়িয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। তা না হলে কাঠের ভুসি অথবা ধানের তুষ দিয়ে নিজেই পোড়াতে পারি ।
আরও দেখুন :