আজকে আমরা চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী গ্রন্থের অন্তর্গত।
চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন
অনেক শিল্পানুরাগী ও শিল্পরসিক মনে করেন এবং জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে প্রায়ই বলে থাকেন যে, যেহেতু তার বাড়ি ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে ছিল এবং তিনি গ্রামে জন্মগ্রহণ করে গ্রাম্য পরিবেশে লালিত-পালিত হয়ে ওঠেন সেহেতু তিনি ছিলেন প্রকৃতিবাদী বা প্রকৃতিপ্রেমিক । আমাদের দেশের লোকদের মধ্যে শিল্পীদের সম্বন্ধে একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে, শিল্পী হলে অবশ্যই তিনি প্রকৃতিপ্রেমিক বা প্রকৃতিবাদী হবেন । এটা আংশিক সত্য হলেও বাস্তবতার সাথে এই ধারণার কোনো সম্পর্ক নেই । শিল্পীর মধ্যে সৌন্দর্যপ্রীতি থাকা প্রাকৃতিক নিয়ম। তাই বলে সব শিল্পীই প্রকৃতিপ্রেমিক হবেন বা সৌন্দর্যের উপাসক হবেন এমন কোনো নিয়ম নেই ।
সৌন্দর্যবোধের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। সৌন্দর্য সম্বন্ধে প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব একটা ধারণা আছে। এটা একটা সম্পর্কীত শব্দ (Relative term ) । নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে জয়নুল আবেদিনকে প্রকৃতিপ্রেমিক বলে আখ্যায়িত করা যায় না । তিনি সৌন্দর্যের উপাসক ছিলেন না। কিন্তু তার সৃষ্টিগুলো সুন্দর । প্রকৃতির জয়গান করা তার শিল্পকর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। বরঞ্চ, তিনি ছিলেন তার উল্টো। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-কষ্ট এবং বাঁচার জন্য অবিরাম জীবন। সংগ্রাম, এটাই ছিল তার শিল্পকর্মের মূল মন্ত্র।
তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্ষণিকের জন্য তাকে মোহিত করলেও শিল্পকর্মের মধ্যে তা প্রাধান্য পায়নি। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-দুর্দশা তার কাজের মধ্যে পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত হলেও নৈরাশ্যবাদের ছায়া দেখতে পাওয়া যায় না তার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো দুঃখ-বেদনার প্রতিফলনও তার কাজের মধ্যে নেই। উপরন্তু, আশাবাদ পুনঃ পুনঃ স্পষ্ট উচ্চারিত হয়েছে। বস্তুত তিনি ছিলেন মানবতাবাদী মানবপ্রেমিক, এক আশাবাদী শিল্পী।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার শিল্পকর্মগুলো সামগ্রিকভাবে মোট দুই শ্রেণীতে ভা করা যায়— প্রথমত, বাঁচার জন্য অবিরাম সংগ্রাম এবং অন্যায়, অবিচার ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দারুণ সংগ্রাম ও প্রতিবাদ এবং দ্বিতীয়ত, মানুষ ও প্রকৃতিকে মিলিতভাবে এর অস্তিত্ব, এক অখণ্ড সত্ত্বা ও সত্য হিসেবে উপলব্ধি করার চেষ্টা ।
‘জীবনের জন্য শিল্প’ এবং ‘বাঁচার জন্য সংগ্রাম’ এই শিল্পদর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন বলে। সবসময় জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ দুর্দশা তার জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তা নয় । তিনি বিভিন্ন সময় জীবনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন । মানুষ ও প্রকৃতিকে বিভিন্নভাবে উপলব্ধি করেছেন। যার ফলে বিষয়বস্তুর মনোনয়ন, আঙ্গিকের ভিন্নতা তার কাজের মধ্যে অভিনবত্ব ও বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে । “একজন শিল্পীর বিভিন্ন ডাইমেনশন থাকে । একজন শিল্পীর ডাইমেনশন অনেক বেশি” – সৈয়দ শামসুল হকের এ উক্তির সত্যতা জয়নুল আবেদিনের কাজের মধ্যে প্রমাণ পাওয়া যায় ।
দেশাত্ববোধের প্রবল চেতনা, আপন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও তার মধ্যে রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণতা ছিল না। উপরন্তু, কোনো কিছুর উৎসর বিচার না করে যার মধ্যে যা কিছু ভালো উপাদান দেখেছেন তাই গ্রহণ করে নিজের মতো করে আপন করে নিয়েছেন। তাই বলে তিনি বিরোধীদের মতো আপন স্বাতন্ত্র্য ও মৌলিকতা যেমন ক্ষুণ্ণ করেননি তেমনি আপন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পবিত্রতাও কলুষিত হতে দেননি ।
তুলনামূলকভাবে অনেক অল্প বয়সে তিনি সফলতা অর্জন করেন। এটা স্বাভাবিক যে, এত অল্প বয়সে সফলতা অর্জন করলে অনেক শিল্পী গর্বিত হয়ে বিপথগামী হয়ে পড়েন এবং নিজেকে ধ্বংস করেন। কিন্তু তিনি সব সময় আত্মসচেতন ছিলেন এবং কোনোরকম গর্ব ও অহমিকা তার মনে স্থান পায়নি। ব্যক্তি ও শিল্পী হিসেবে তার মধ্যে বহুগুণের সমাবেশ হওয়া সত্ত্বেও তার বিরোধীরা তার নিন্দা ও সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি । এতে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তার গগনচুম্বি সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা তার বিরোধীদের মধ্যে ঈর্থার উদ্রেক করে।
বিরোধীদের সাথে আদর্শগত পার্থক্য শীঘ্রই ব্যক্তিগত সংঘাতে পরিণত হয় । তার বিরোধীরা তার প্রতি বৈরী ও শত্রুভাবাপন্ন হলেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে কারো প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করেননি। উপরন্ত আদর্শগত পার্থক্য, পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ব্যক্তিগত বৈরী সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তিনি সমস্ত মতবাদ ও আঙ্গিক প্রবর্তনকারী ও চর্চাকারী শিল্পীদের উষ্ণ অনুপ্রেরণা যোগান। যা হোক, তার ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্র বৈশিষ্ট্য যাই থাকুক না কেন, শিল্পকর্মের বিচারে দোষ-গুণ বিচার করে মূল্যায়ন করতে হবে এবং তার যথার্থ স্থান নির্ণয় করতে হবে।
তার প্রথম দিকের অর্থাৎ ত্রিশ দশকের প্রথম দিকে পেন্সিল এবং কালি-কলমে আঁকা কিছু রেখাচিত্র (স্কেচ)-এর মধ্যে ভবিষ্যতের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পেন্সিল মাধ্যমে আঁকা বিশ্রামরত কয়েকজন রাখাল বালক এবং ১৯৩৩ সালে কালি-কলমে আঁকা ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে বনানী রেখাচিত্রের মধ্যে তার পরিবেশ সচেতনতা অপরদিকে রৈখিক বৈশিষ্ট্যের ভবিষৎ বাণী লক্ষ্য করা যায় । শরতের উজ্জ্বল সূর্যালোকে নদীর তীরের বনানী ঝলমল করছে। নদীর স্বচ্ছ নীল পানিতে বনানীর প্রতিফলন অঙ্কনের মধ্যে আলো-বাতাসের সূক্ষ্মানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে, যার মধ্যে তিনি ব্যয়বহুল রেখা (Expensive lines) ব্যবহার করেছেন ।
১৯৪২ সালে কালি-কলমে আঁকা তার সমসাময়িক শিল্পী আনোয়ারুল হকের প্রতিকৃতির মধ্যে চরিত্র বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বিশেষ ব্যক্তির প্রতিকৃতি অঙ্কনের পরিবর্তে সার্বিকভাবে মানব প্রতিকৃতি বা রূপকল্প আঁকার দিকেই তার ঝোঁক ছিল বেশি। ১৯৫৬ সালে কালো কালি (মার্কার কলম) দিয়ে আঁকা মেক্সিকোর শিল্পী হোমবার্টোর প্রতিকৃতিতে ভ্যানগগের আঁকা ‘ম্যান ইন হ্যাট’ বা ‘আত্ম-প্রতিকৃতি’ বলে ভুল হয় । বিশেষ করে এই রেখাচিত্রের মধ্যে জয়নুলের ওপর ভ্যানগগের দারুণ প্রভাব বা অনুকরণপ্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
১৯৩৫ থেকে ১৯৪৬ সাল বিশেষভাবে ইউরোপ এবং সার্বিকভাবে সারা বিশ্বের জন্য এই এক যুগ চরম দুর্যোগের সময় ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি বিভাজিকা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকবে। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়নুলের মধ্যে শৈল্পিক চেতনা ও জীবনবোধের উন্মেষ ঘটায়, যা তার ভবিষ্যতের শিল্পকর্মের প্রথম ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে ।
নাৎসি ফুয়েরার হিটলারের আগ্রাসন নীতির ফলে সমস্ত ইউরোপ বিধ্বস্ত হয়, যা মানব ইতিহাসে চিরদিন বর্বরতা ও নৃশংসতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হয়ে থাকবে । হিটলারের এই আগ্রাসনে ইউরোপ ও জাপানের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনলেও বিশেষ। করে উপমহাদেশ এবং তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের জন্য স্বাধীনতা ও সাম্যবাদের পথ উন্মুক্ত করে দিল। কারণ জার্মান আগ্রাসনের ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি ধসে পড়ে। কিন্তু নাৎসি নৃশংসতা কেবল ইউরোপের মাটিতেই সীমাবদ্ধ রইল না। তার ঢেউ মহাদেশ ও মহাসাগর অতিক্রম করে উপমহাদেশের তৎকালীন বাংলার সুদূর পূর্ব সীমান্তের গ্রাম পর্যন্ত এসে পৌঁছাল ।
তৎকালীন সমগ্র বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) ব্রিটিশ সরকারের খাদ্য গুদামে পরিণত হলো। এদেশের কতিপয় মহাজন খাদ্যশস্যর কালোবাজারি করে রাতারাতি ফুলে ফেঁপে উঠল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শত সহস্রাধিক টন খাদ্যশস্য বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত হলো। দেশে মহামস্বত্ত্বর দেখা দিল ।
এক মুঠো খাবারের আশায় লাখ লাখ মানুষের মিছিল তৎকালীন বাংলার রাজধানী কোলকাতা অভিমুখে রওনা হলো। রাজধানীর রাজপথে, অলিতে-গলিতে, গৃহহীন আশ্রয়হীন বুভুক্ষু মানুষের ভিড় ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো। মানুষ কুকুরের মুখের খাবার কেড়ে খেতে লাগলো । তারা রাস্তার উপর পাশাপাশি এক সাথে ঘুমাত। মানুষ কুকুরের মধ্যে কোনো পার্থক্য রইল না। রাজপথের উপর ছিন্নমূল মানুষের শবদের স্তূপাকারে জমে উঠল । শত সহস্রাধিক মৃতদেহ নদীর স্রোতে ভেসে গেল। আরো কত মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হলো। চিল-শকুন ছিঁড়ে খেল অনেক লাশ ।
জয়নুল তখন প্রায় ২৪ বছরের যুবক । বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার তরুণ হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করল । তিনি আর বেশি দিন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারলেন না । তিনি বুভুক্ষুদের সাথে সুর মিলিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন । চাপা আক্রোশে ফেটে পড়লেন। তিনি শক্ত হাতে তুলি ধরলেন। এরিক নিউটনের ভাষায় “When the famine was lifted, two thousand sketches were ready ” কালো কালি ও কলমের বলিষ্ঠ আঁচড়ে বুভুক্ষুদের আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল, যা সারা বিশ্বের মানুষের সুপ্ত চৈতন্য জাগরিত করল । এখানে দুর্ভিক্ষের কেবল কয়েকটি রেখাচিত্রের উল্লেখ ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো :
১. একজন ভিখারিণী তার শিশুকন্যাকে সাথে নিয়ে সাহায্যের আশায় ব্যাকুলভাবে পথচারীদের দিকে তাকিয়ে আছে। শিশুকন্যা তার জীর্ণ শীর্ণ ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে মাকে অনুসরণ করছে। অনাহারে ক্লান্ত শিশুকন্যা হাঁটতে অক্ষম । তবুও ছোট ভাইকে কোলে তুলে নিয়ে মায়ের হাত ধরে হেঁটে চলেছে।
২. একজন লোক তার মৃত স্ত্রী ও শিশুসন্তানের যুগল মৃতদেহের সামনে বসে অসহায়ভাবে কপাল চাপড়ে বিলাপ করছে। তাদের ভরণ-পোষণের অক্ষমতার জন্য অনুশোচনায় তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে ।
৩. একটি ক্ষুধার্ত দম্পতি তাদের শিশুসন্তানকে নিয়ে লোভাতুরভাবে ডাস্টবিনের আবর্জনার মধ্যে খাবার সন্ধান করছে। সে তার স্ত্রীর আগেই আবর্জনার ভেতর থেকে কিছু বাঁশি-পঁচা খাবার মুঠো ভরে নেয়ার চেষ্টা করছে ।
৪. এক ভিখারিণী তার শিশুকন্যাকে নিয়ে কোনো এক মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারের বহিঃদরজার সামনে এক মুঠো খাবার আশায় ব্যাকুলভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু তার আকুল আবেদন গৃহকর্তার কানে পৌঁছাল না, বন্ধ দরজা কখনো খুললো না ।
৫ একজন অনাথিণী মা তার শূন্য মাটির থালায় লেগে থাকা সামান্য ঝোল আঙুল দিয়ে মুছে তার শিশুসন্তানকে সয়েহে খাওয়াচ্ছে ।
৬. একজন ছোট ছেলে লোভাতুরভাবে জিহ্বা দিয়ে মাটির শূন্য থালা চাটছে। তার বোন লোলুপ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে, খাবারের তলানির একটু ভাগ যদি সে পায়। কিন্তু তার ছোট ভাই সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে এক নিঃশ্বাসে থালাটা চেটে চলেছে ।
৭. কে যেন একটা কলার খোসা রাস্তার আবর্জনার উপর ছুড়ে ফেলল । একজন ভিখারী বৃদ্ধ অন্য কারো দেখার আগেই তাড়াতাড়ি খোসাটা আবর্জনা থেকে তুলে নিয়ে চাটতে আরম্ভ করল।
৮. একটা অবুঝ শিশু রাস্তার পাশে পড়ে থাকা সদ্য মৃত মায়ের শুষ্ক স্তন চুষছে । বিশেষ করে এই মা ও সন্তান বা ‘দ্য ম্যাডোনা’ রেখাচিত্রটির ভেতর দিয়ে সমস্ত মানব সমাজের প্রতি দারুণ কটাক্ষ করেছেন।
৯. আরেকটা রেখাচিত্রের মধ্যে দেখা যায়, একজন ভিখারিণী মা তার দু’সন্তানকে নিয়ে ভিক্ষার আশায় পথের পাশে বসে অপেক্ষা করছে, যদি কোনো সংবেদনশীল পথচারী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সে তার শূন্য থালাটা এক হাত দিয়ে উঁচু করে সামনের দিকে প্রসারিত করে বসে আছে ।
তারা দর্শকের দিকে পিছন ফিরে বসে আছে। তাদের বিপরীত দিকে সামনে উন্মুক্ত পরিসর। এই চরম দুর্দিনেও তারা সাহায্যের আশায় অপেক্ষমাণ । তাদের এই আশা একেবারে বৃথা যায়নি । অবশেষে সাহায্য ভোগ করতে পারেনি। কিন্তু মরণের পরে তাদের আশা পূর্ণ হলো । এখানে জয়নুলের ভেতরে সুপ্ত আশাবাদের স্বর প্রথম বেজে উঠল ।
জয়নুলের দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রগুলোকে এরিক নিউটনের ভাষায় ‘গয়ার মতো ক্ষুব্ধ’ (angry like Goya) আখ্যায়িত করা হয়েছে। যার মধ্যে শুধু তার নিজ জাতি নয়, বরঞ্চ সমগ্র উৎপীড়িত ও নিপীড়িত মানবজাতির প্রতি যে অবিচার, শোষণ, অত্যাচার চলছে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে, যা মানব ইতিহাসে দলিল হয়ে থাকবে।
বস্তুত ১৯৪৩ সালের মহামন্বন্তর তার শৈল্পিক ও নন্দন এবং মানবিক চেতনার এবং সূক্ষ্ম জীবনবোধের উন্মেষ ঘটায়। এখান থেকেই তার বুদ্ধিমত্তা কর্মকাণ্ড ও জীবন অনুসন্ধিৎসার যাত্রা শুরু হয়। কোনো ‘গ্র্যান্ড ম্যানার’, মতবাদ বা আঙ্গিকের চেয়ে ভাব প্রকাশই ছিল তার কাজের মুখ্য উদ্দেশ্য। ঐ সময় থেকে তার স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা দানা বাঁধতে শুরু করে ।
বলাবাহুল্য, ১৯৪৩ সালের মহামন্বন্তর তার ক্লেশ মনে যে গভীর রেখাপাত করে তা তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একেবারে মুছে ফেলতে পারেননি । কিন্তু তাই বলে তিনি জীবনবিমুখ হননি। উপরন্তু, তিনি বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন পরিবেশে, বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনকে বিভিন্নভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন । তাই সামগ্রিকভাবে তার কাজগুলো অভিনব ও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে।
তিনি সংক্ষিপ্ততার চেয়ে অধিক সংক্ষেপ ছিলেন। সংক্ষিপ্ততা তার কাজের সৃষ্টতা, তেজস্বিতা ও সজীবতা আরো বৃদ্ধি করেছে। কালো কালির দৃঢ় এবং কদাচিৎ ভঙ্গুর রেখা, মুখ ও পেশীতে এখানে-সেখানে তুলি মাঝে-মধ্যে ঘষে দেয়ার ভেতর দিয়ে একদিকে যেমন মানুষের জীবনীশক্তি ফুটে উঠেছে, অপরদিকে তেমন পেশীবিদ্যা (anatomy) সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান ও চরিত্র বিশ্লেষণের দক্ষতা প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি কখনো কাজের মধ্যে জটিলতর আকার ব্যবহার করেননি বা বুদ্ধির অহেতুক মারপ্যাচ দেখিয়ে শিল্পরসিক ও দর্শকদের হতবুদ্ধি করার চেষ্টা করেননি। উপরন্ত কাজগুলো সহজ সরল, যা সরাসরি দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে । সরোজিনী নাইডু। দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র সম্বন্ধে বলেন, “They are more eloquent in their poign: appeal than the most eloquent and emotional words.
জয়নুলের রেখাচিত্রগুলোর মধ্যে একদিকে যেমন বাঁচার জন্য সংগ্রাম, দুঃখ-দুর্দ নিঃস্ব, নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের হৃদয়ের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে; অপরদি তেমনি অন্যায়, অবিচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ স্পষ্টভাবে উচ্চাি হয়েছে, যা স্থান, কাল-পাত্র নির্বিশেষে দেশ-কালের সীমানা অতিক্রম করে শিশু সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে তা কাজগুলোকে বাস্তবতার চেয়ে অধিক বাস্তব বললে অত্যুক্তি হবে না ।
সার্বিকভাবে তার কাজগুলো বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায়
১. রেখা রং ব্যতীত আর সবকিছুই ধারণ করে ।
২. রেখা আকারের অংশ না হয়ে ভাব প্রকাশের জন্য স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লাভ করে ।
৩. কালো কালো হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে তার প্রকাশক রং হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪. অল্প বিষয় অধিক বক্তব্য ।
৫. আলো-আঁধারের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার ।
৬. অধিক ছায়াংশ সামান্য আলো । এবং
৭. বিষয়বস্তুর রম্য নাটকীয় উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে আশাবাদ প্রকাশ ।
শিল্পের আবেদনের দিক থেকে তার কাজগুলো মোটামুটিভাবে পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করা যায়
১. ১৯৪৩ সালের মহামন্বন্তরের রেখোচিত্র (স্কেচ)।
২. বাস্তবধর্মী প্রতীক (Realistic Symbolism)।
৩. প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে সংযোজন ।
৪. মানুষ ও প্রকৃতিকে এক সত্ত্বা হিসেবে উপলব্ধির চেষ্টা । এবং
৫ বিমূর্ত ।
তার ব্যক্তিগত চরিত্র এবং কাজের প্রধান উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে, তিনি চরম দুঃখ-দুর্দশা ও বিপর্যয়ের মধ্যে কখনো হতাশ হননি। হতাশা ও নৈরাশ্য তার মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। উপরন্তু, আশাবাদ স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে ।
কোলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য পিপলস্ ওয়ার’ পত্রিকায় ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারির এক প্রতিবেদনে বলা হয়। জয়নুল বাংলার ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্প সংঘের একজন সদস্য। এই সংগঠনই হচ্ছে নিখিল বঙ্গের শিল্পী ও লেখকদের সংগঠন । যারা বিশ্বাস করেন যে, তাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে বর্তমান সংকটের সম্মুখীন মানুষের সেবা করা । এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি হবেন তাদের অগ্রসেনানীদের অন্যতম ।
যা হোক, মহামন্বন্তরের ক্ষত ক্রমে ক্রমে শুকিয়ে গেল। সাঁওতালদের আদি সরলতা, উন্মুক্ত প্রকৃতির বদান্যতা, নদীর কুল কুল ধ্বনি, এসব কিছু তার চিত্ত আকর্ষণ করল। তার প্রিয় জল রং এবং কালি-কলম মাধ্যমে তিনি সাঁওতালদের জীবনভিত্তিক বিষয়, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে ময়মনসিংহ জেলা, সম্ভবত তার জন্মভূমি কিশোরগঞ্জের কিছু দৃশ্য চিত্রায়িত করেন ।
তিনি বহু বছর ভারতে বাস করেন। অতীতের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে সাঁওতালদের জীবনভিত্তিক কিছু সুন্দর ছবি তিনি আমাদের উপহার দেন, যার মধ্যে “সাঁওতাল দম্পতি’, ‘মুইজন সাঁওতাল মেয়ে’, ‘সাঁওতাল মেয়েরা কৃষ্ণচূড়া তুলছে প্রভৃতি মাত্র কয়েকটি ছবির কথা এখানে উল্লেখ করা হলো ।
‘সাঁওতাল দম্পতি’-এর মধ্যে দেখা যায়, পুরুষটি তালপাতা দিয়ে তৈরি বড় একটা ছাতা মাথায় দিয়ে ধীর পদক্ষেপে চলেছে। মেয়েটি তরি-তরকারি ভর্তি একটা ঝুড়ি মাথায় করে রোদের মধ্যে লম্বা লম্বা পা ফেলে তার স্বামীকে অনুসরণ করছে। তাদের চলার ভঙ্গি ও দৈহিক গঠন থেকে তাদের শারীরিক শক্তি ও সজীবতা ফুটে উঠেছে।
পুরুষটির উপজাতীয় প্রচলিত নিয়মে কাপড় পরার মধ্যে যদিও কিঞ্চিৎ অশালীনতা ও নগ্নতা প্রকাশ পেয়েছে তবুও যৌন বিষয়ে তাদের উদাসীনতা ও আদি সরলতা ফুটে উঠেছে। কিন্তু মহিলাটির শাড়ি পরার ভঙ্গি থেকে বোঝা যায় যে, হাটে-বাজারে সভ্য মানুষের সংস্পর্শে এসে তার মধ্যে শালীনতাবোধ ও যৌন সচেতনতা জেগেছে ।
এই দম্পতির পেছনে অর্থাৎ রচনার ডানদিকে একেবারে নিচে দিগন্ত রেখার কাছে আরেকটা দম্পতিকে গো-চারণ ভূমিতে গরু চরাতে দেখা যায় । এ থেকে সাঁওতালদের দৈনন্দিন জীবন ও পেশা সহজে অনুমান করা যায়। বিষয়বস্তু থেকে মনে হয় যে, সাঁওতাল মেয়েরা কঠোর পরিশ্রমী এবং তুলনামূলকভাবে পুরুষরা অলস ও নিষ্ক্রিয় ।
ছাতার অর্ধেক ক্যানভাসের উপরের প্রান্তে কেটে গেছে এবং হাতাটা আংশিক বাম প্রান্তে কেটে গেছে । মহিলাটি আংশিকভাবে পুরুষের আড়ালে ঢেকে গেছে, যা বিষয়বস্তুর উপস্থাপনায় নাটকীয় ভাব সৃষ্টি করেছে। নর-নারীর দীর্ঘাকৃতি মূর্তি অসীম প্রশান্ত আকাশের শূন্যতা ও একঘেয়েমি ভাব ভঙ্গ করেছে, যা রচনাকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছে ।
পীত বর্ণের পশ্চাদভূমির বিপরীতে তাদের দেহে ‘বার্ট আম্বার’ ও ‘কোবাল্ট ব্লু’ রং ব্যবহারের ফলে তাদের কৃষ্ণাঙ্গ মনে হয় । ছাতার হলুদ রং কৃষ্ণাঙ্গদের আরো কৃষ্ণাঙ্গ করে তুলেছে । কিন্তু ছাতার কেন্দ্রবিন্দু কিছুটা কেন্দ্রচ্যুত হওয়ায় এবং পুরুষের ভাঁজ করা বাম হাতটা বাহুর উপরের দিক থেকে দেখানোর ফলে দৃষ্টিতে কিছুটা বিঘ্ন সৃষ্টি হয় ।
‘দুইজন সাঁওতাল মেয়ে’ ছবিটির মধ্যে দু’জন সাঁওতাল যুবতি নির্জন অরণ্যের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের কোমরে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। ডানদিকের মেয়েটি এক হাত দিয়ে শালগাছের উপর সামান্য হেলান দিয়ে মাড়িয়ে আছে। তার বান্ধবী এক হাত দিয়ে একটা খালি ঝুড়ি কোমরের উপর ধরে আছে। এবং অপর হাত বান্ধবীর কাঁধের উপর রেখে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে।
তারা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করতে। তার প্রিয়জন দূরে কোথাও গেছে। ফিরতে দেরি হচ্ছে। তাই তার প্রিয়জনের ফেরার প্রতীক্ষায় তার পথের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে আছে। তার মন উদাস হয়ে গেছে। আর কিছুই তার ভালো লাগে না। তার চাহনীর মধ্যে ব্যাকুলতা, উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা ফুটে উঠেছে।
মানুষের মধ্যে প্রিয় বিচ্ছেদের যে চিরন্তন বিরহ ব্যথা এবং ফিরে পাওয়ার যে আকুলতা ও প্রত্যাশা তাই এই ছবিতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের মধ্যে যে স্নেহ-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-ব্যথা-বেদনা সেটাই এ ছবির মূল সুর, যা সহজে দর্শকদের মন স্পর্শ করে।
পীত বর্ণের পশ্চাদভূমির বিপরীতে তামাটে রং (Burnt Siena) দ্বারা গাছের প্রান্ত রেখা (Contour) এবং কালো রেখা দ্বারা নারীমূর্তি দু’টি আঁকার ফলে বিষয়বস্তু ও পশ্চাদভূমির মধ্যে উন্মুক্ত প্রশস্ত জায়গা এবং আকাশের অসীমতা অনুভূত হয় । গাছ ও মানুষ অঙ্কনে তিনি কোনো আকার ব্যবহার না করে কেবল রেখা দ্বারা দূরত্ব ও গভীরতা সৃষ্টি করেছেন।
একই ভাবের উপর তিনি কিছু তেলচিত্রও এঁকেছেন, যার মধ্যে সাঁওতাল মেয়েরা কৃষ্ণচূড়া ফুল তুলছে’ উল্লেখযোগ্য। মেয়েদের কেউবা ফুল ছিড়ছে, কেউবা খোপায় ফুল শুঁজছে, পুষ্পায়িত পল্লবগুলো মৃদু মন্দ বসন্ত সমীরণে মৃদু মৃদু দোল খাচ্ছে। অদৃশ্য ফুলের সৌরভে চারদিকের বাতাস সুগন্ধে মোহময়, অদৃশ্য কোকিলের কুহুতান, ছোট ছোট পাখির কিচিরমিচির কলকাকলিতে চারদিকের পরিবেশ মুখরিত হয়ে নির্জন অরণ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছে।
এসব কিছু একত্রে মিলিতভাবে অচেনা আগন্তকের চিত্ত মুহূর্তের জন্য বিমোহিত করে । এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই অপরূপ রূপ, সৌন্দর্য উপভোগ করার বাসনা জাগে। তিনি অকলুষিত প্রকৃতির রূপ, রস ও গন্ধ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। উজ্জ্বল হলুদ পশ্চাদভূমির বিপরীতে টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া ও খয়েরি রং (Burnt Amber) এর নারীমূর্তিগুলো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। বিষয়বস্তুর মনোনয়ন ও রঙের ব্যবহার গোগার ভাহিতীবাসীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
১৯৪৮ সালে তার তেলরঙে আঁকা ‘গার্ল রিডিং ইন এ চেয়ার’ শীর্ষক ছবিটি তার কাজের বিদক পরিবর্তক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এটা তার পরবর্তী কাজগুলো থেকে ভিন্নতর প্রতিচ্ছায়াবাদী (Impressionism) আঙ্গিকে আঁকা, যার মধ্যে তিনি বস্তুর অনুপূর্ণ বর্ণনার পরিবর্তে কেবল বিষয়ের সামগ্রিক অনুভূতি ও ভাবের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
মেয়েটি গভীর মনোনিবেশ সহকারে একটা গ্রন্থ অধ্যয়নরতা। তার মনোনিবেশ থেকে মনে হয় যে, এই গ্রন্থের ভেতর সে এমন কিছু পেয়েছে, যা সে দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিষয়বস্তুর পেছনের দেয়ালের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ।
কিন্তু কেবল তার হাত ও বুকের উপর উজ্জ্বল আলো এবং কপালের উপর প্রতিফলিত আলোর আভা, চেয়ারের পায়ের উপর সামান্য আলো তীর্যকভাবে পড়েছে এবং পেছনের দেয়ালের সামান্য একটু আলোর আঁচড়, এসব কিছু মিলে আলো-ছায়ার সুন্দর নাটক সৃষ্টি করেছে । এ ছবিটি এবং পরবর্তী কাজগুলোর মধ্যে প্রায় একই রকম আলো-ছায়ার ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়, যা সপ্তদশ শতাব্দীতে নরওয়ের রেমব্রান্ড এবং বিংশ শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্ড্রু ওয়াইখ-এর সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ।
এই বিশেষ ধরনের আলো-ছায়ার খেলায় তিনি কিছুটা ‘চেয়ারেঞ্চুরো পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু গাঢ় রঙের অন্ধকার স্থান ব্যবহার না করে কেবল ‘মিডিল টোন’ ব্যবহার করেছেন । সেজন্য আলো ও ছায়া বা অন্ধকারের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় সৃষ্টি হয়েছে। আলো- ছায়ার ব্যবহার দ্বারা তিনি বস্তুর কাঠামোগত আকার সৃষ্টি করেছেন ।
তুলির ছোট ছোট সামান্য কয়েকটি আঁচড়ে বেতের চেয়ারের বুনন অনুভব করা যায় । তিনি সবকিছু মাত্র তিনটি আকারে ভাগ করেছেন, আয়তক্ষেত্র, চতুর্ভুজ ও অর্ধ- বৃত্ত। পশ্চাদভূমিতে লক্ষ সরলরেখা অর্ধাবৃত্তাকার চেয়ার ও মেয়েটার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ার ভঙ্গির মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, যা বক্ররেখার একঘেয়েমি দূর করেছে ।
১৯৫১ সালে জলরঙে আঁকা ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ‘ফেরি পারাপার’ শিরোনামের ছবিটির মধ্যে একজন মধ্যবয়সী কৃষক তার ছেলেকে সাথে নিয়ে হাট থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য নদীর ঘাটে ফেরির অপেক্ষারত। মাঘের মাঝামাঝি অর্থাৎ ইংরেজি জানুয়ারি মাসের শেষ, শরতের পড়ন্ত বেলা। হিমেল বাতাস বইছে। শীতের হিমেল বাতাসে পিতা-পুত্র কাঁপছে, যেন ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে। কনকনে হাড় কাঁপানো শীত । সূতির চাদর গায়ে জড়িয়ে নদীর ঘাটে বসে পড়ন্ত রোদে গা হেঁকে। একটা কেরোসিন এবং একটা সরিষার তেলের বোতল, একটা লাউ এবং পেছনে রাখা একটা ঝুড়ির মধ্যে কিছু তরিতরকারি রাখা আছে।
মনে হয়, সে একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক। তাদের সামনে বালির উপর পায়ের চিহ্ন দেখে বোঝা যায় যে, তারা ঘাটে পৌঁছাবার সামান্য একটু আগেই খেয়াটি ঘাট ছেড়ে চলে গেছে। তাদের বাম দিকে ঘাটে পোতা বাঁশের গোজা দেখে নদীর গভীরতা অনুভব করা যায়। শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। লোকটার বিপরীত দিকে নদীর মধ্যে জেগে ওঠা একটা চরে কয়েকটা নৌকা বাঁধা রয়েছে। চরের নির্জনতার ভেতর একাকিত্বের সামান্য বিষণ্ণতা অস্পষ্টভাবে অনুভব করা যায় ।
পঞ্চাশ দশকের শুরুতেই তার চিন্তা নতুন দিকে মোড় নেয় এবং এদেশের শিল্প- আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি নতুন অধ্যায়ের সংযোজন হয়। এখানে আমরা বাংলাদেশের লোকশিল্প, যা বুদ্ধিজীবীদের কাছে ‘পটুয়া’ নামে অধিক জনপ্রিয়, এবং পাশ্চাত্যের বিমূর্ত-এর সুন্দর সংযোজন দেখতে পাই । তিনি ঐতিহ্যবাহী লোক রূপবন্ধ (মটিফ) এবং বিশেষ করে মটিগ্লানির অতিমাত্রায় অলংকারিত (স্টাইলাইজড) মানব রূপকল্প থেকে রস গ্রহণ করে ব্যক্তিগত স্বতন্ত্র আঙ্গিকের সাথে সংমিশ্রণ ঘটান। ১৯৫৫ সালে লন্ডনে তার প্রদর্শিত শিল্পকর্ম দেখে ইংরেজ সমালোচক রিচার্ড উইলসন লিখেছেন:
*এক অর্থে তার সর্বশেষ ছবিগুলো আধুনিক বিশ্বে পাক-ভারতীয় শিল্পের উত্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে । ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম শিল্পী যিনি কেবল অনুকরণের উপর নির্ভর না করে সফলভাবে বিমূর্ত কৌশলকে দেশজ ঐতিহ্যের সাথে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। ১৯৫২ সালে এরিক নিউটন লিখেছেন । গুগুলো অদ্ভুত শিল্পকর্ম, যা এক সময় অনেকে মনে করতেন যে, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমন্বয় করাটা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করা হতো । এখানে ঘটেছে সেই সমন্বয়। মনে হয় প্রাচ্যের একটি হাত সম্পূর্ণ প্রাচ্যের কায়দায় তুলি ধরে আছে। একটি শোষক কাগজে কালো কালি ছড়িয়ে আছে মনে হয় । অথচ প্রকৃতপক্ষে সব কিছু পরিচালিত হয়েছে ইউরোপীয় চোখের নির্দেশে ।
তার এই সময়ের কাজের মধ্যে গ্রামবাংলার নম্র-লাজুক তরুণীরা অধিক গুরুত্ব পায়। যেমন— ‘কলস কাঁধে বধূ’ (Women with the pitcher), দুইজন স্নানরতা রমণী’ (Two bathing women), দুইজন মহিলা পানি আনতে যাচ্ছে’ (Two women going to fetch water), আয়নাসহ নববধূ’ (Bride with a mirror), ‘অরণ্যে একাকিনী’ (Alone in the woods), মা ও সন্তান’ (Mother and child), ‘বিশ্রামরতা তিনজন রমণী’ (Three women at rest) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য; যেগুলো তিনি অত্যন্ত যত্নসহকারে এঁকেছেন ।
তার এসব ধারাবাহিক কাজের মধ্যে কাব্যিক ভাব বিদ্যমান । নারী রূপকল্পগুলোর (Image) মুখাবয়বের ভাব চিত্রায়নে সার্বিক ব্যবহার (Treatment) অলঙ্কারিত্ব, ছন্দায়িত রেখাগুলো একত্রে মিলে সঙ্গীতের ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি করেছে… সঙ্গীতের চেয়ে অধিক সংগীত ।
বিষয়বস্তু চিত্রায়নে তিনি কখনো জলরং, কখনো গোয়াশ আবার কখনো মিশ্র মাধ্যম ব্যবহার করেছেন । তিনি অর্ধবৃত্ত, বৃত্ত ও আয়তক্ষেত্র ব্যবহার করে নারী মূর্তিগুলো অতিরিক্ত দীর্ঘায়িত করে অলঙ্করণ করেন। কালো, সাদা ও হলুদ রং আবার কখনো তুলির উল্টো পাশ দিয়ে আড়াআড়ি বা লম্বভাবে আছড় কেটে কেটে নকশা সৃষ্টি করেছেন, যা পটশিল্পের লোক আঙ্গিকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
লোক-আঙ্গিকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শোভাপ্রন প্যাটার্ন ও সারফেস ডিজাইন’ সৃষ্টি করা এই কাজগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্য । এখানে তিনি দৃঢ় পেশীর (Solid mass) পরিবর্তে সমতল ক্ষেত্র (Plain or Flat) সৃষ্টির ভেতর দিয়ে আকাশ গঠন করেছেন । এই প্রসঙ্গে আবুল মনসুর ‘তার শিল্প ভুবন’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন “বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহ বাঙালিত্বের যে ঐতিহ্য অনুসন্ধানের উদ্ঘাটন ঘটিয়েছিল তা জয়নুলকেও পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে প্ররোচিত করে ।
এদেশীয় লোক চিত্রকলার সাথে আধাবিমূর্ত জ্যামিতিক আকৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি অর্জন করতে চাইলেন স্বদেশী আধুনিক একটি শৈলী। কিন্তু নিজেই স্বস্তিবোধ করলেন না এই পরিকল্পিত রীতিবদ্ধ স্থানু স্বভাবের চিত্ররীতিতে। পুনরায় ফিরলেন তার স্বতঃস্ফূর্ত ও বেগবান অঙ্কনশৈলীতে” (সংবাদ, তারিখ: ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৯০)।
“আয়নাসহ নববধূ” তার কাব্যিক ভাবের একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত । নববধূ একাকী ঘরের মধ্যে বসে আছে। সে কেশবিন্যাস করতে করতে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে। বাসর রাতে স্বামীর উষ্ণ আহ্লাদের স্মৃতিচারণ করে তন্যয় হয়ে পড়ে, ভবিষ্যৎ জীবনে সুখী দাম্পত্য জীবনের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায় ।
একটা পা আড়াআড়ি ভাঁজ করে মেঝের উপরে এবং অপর পা লম্বভাবে ভাঁজ করে আসন দিয়ে বসে আছে। সোজা পায়ের হাঁটুর উপর হাত রেখে তার উপর মাথা কাত করে দুচোখ বন্ধ করে বসে আছে। তার চেহারা ও ভঙ্গির ভেতর দিয়ে সুখী দাম্পত্য জীবনের আভাস স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
তার সামনে মেঝের উপর রাখা আয়নার উল্টো দিকে অঙ্কিত গোলাপ ফুল এদেশের লোক রূপবন্ধে ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় লোক রূপবন্ধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
দুই রমণী’ ছবিটি গ্রামের পরিবেশে ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। যার মধ্যে দু’জন মহিলা গ্রামের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের অর্ধেক ঢেকে রেখেছে। যার মধ্যে তিনি এদেশের প্রচলিত গ্রামের শালীনতা ও মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে প্রকাশ করেছেন ।
তাদের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে। তাদের সাংসারিক কাজের ফাঁকে একটু অবসর সময়ে দু’প্রতিবেশিনী একটু মনের কথা বলে হাসি-ঠাট্টা ও কৌতুক করে আনন্দ উপভোগ করছে। তাদের সংসারে যা সামান্য কিছু আছে তাতেই তারা পরিতৃপ্ত, আনন্দিত। তাদের পরিহিত লাল ও কালো শাড়িতে হলুদ রেখা ও পশ্চাদভূমিতে নীলাভ-সবুজ পাতার রূপবন্ধ ঐতিহ্যবাহী পটশিল্পের সাথে সামাঞ্জস্য বজায় রেখেছে ।
পশ্চাদপটের নীল রং সমতল (Flat) ভাবে ব্যবহৃত নকশার সার্বিক আবেদন আরো বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু মুখাবয়বে বাঙালি নারীদের সাথে সাদৃশ্য আংশিকভাবে হ্রাস পেয়েছে । অবশ্য এটা নগণ্য, না ধরলেও চলে । কারণ বাঙালির আকৃতি এত ভিন্নতর যে, কেবল একটি বা দু’টি মুখাবয়বের মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে সমস্ত জাতির প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা সম্ভব না । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, এই বিষয় বা সমস্যা পরবর্তিতে কামরুল হাসান ও অন্যদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয় ।
‘গুণটানা’ ছবিটার মধ্যে নদীমাতৃক জীবনের উপস্থাপনা দেখা যায়। যার মধ্যে দু’জন লোক খুব পরিশ্রম করে উজান স্রোতে অতি কষ্টে গুণ টেনে চলেছে। বোঝাই নৌকা উজান স্রোতে চলতে চায় না, তবু তারা মরিয়া হয়ে গুণ টানছে । বস্তুত গুণ টেনে চলেছে সমস্ত রকম প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে জোড়াতালি দেয়া জীবনটা কোনোরকমে টেনে নিয়ে যাওয়া। এই অন্তর্নিহিতভাবে প্রতীক হিসেবে লোকগুলোকে অতিরিক্তভাবে সামনের দিকে ঝুকানো হয়েছে । তাদের মাথা নিচের দিকে ঝুলে পড়ার ভেতর দিয়ে শ্রমের ক্লান্তি ও অবসাদ প্রকাশ পেয়েছে ।
লোকগুলো অতিরঞ্জিতভাবে, প্রায় মাটির সাথে সমান্তরালভাবে, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এক হাত ভাঁজ করে গুণের দড়িটা বাঁধা ছোট লাঠিটা ধরে রেখেছে এবং অপর হাত পেছন দিকে প্রসারিত করে গুণের দড়ি শক্ত মুঠোয় ধরে রেখেছে। যা অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়া নরমূর্তিগুলোর এবং রচনাশৈলীর ভারসাম্য রক্ষা করেছে।
লোকগুলো ক্যানভাসের নিচে নামনিকে আংশিক কেঁটে গেছে, যা রচনাকে আরো নাটকীয় করে তুলেছে • উত্তেজনা (tention) বৃদ্ধি করেছে। পশ্চাদভূমিতে নীল রঙের দলীয় পানির বিপরীতে তামাটে ও হালকা পীত বর্ণের নরমূর্তি দু’টো সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে। কালো, গোলাপি ও সবুজ রঙের আড়াআড়ি রেখাগুলো নদীর ছোট ছোট ঢেউ ও গ্রোতে ভেসে যাওয়া শ্যাওলার প্রতীক হিসাবে ব্যবহার হয়েছে। শোভাপ্রদ Decorative Pattern) একত্রে সর্বময় উপরিভাগের নকশা (সারফেস ডিজাইন) সৃষ্টি করেছে। এই ছবিতে মাতিসের বিশেষ এক সময়ের কাজের সংমিশ্রণের করা যায়।
১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে জলরং ও কালি-কলম, গোয়াশ, টেমপারা এবং মিশ্র মাধ্যমে আঁকা খুব সুন্দর সুন্দর কিছু মূল্যবান শিল্পকর্ম তিনি আমাদের উপহার নিয়েছেন, যা এদেশের, বিশেষ করে শিল্প আন্দোলন এবং সার্বিকভাবে সংস্কৃতির ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকবে। তার ঐ সময়ের কাজগুলোকে বাস্ত – প্রতীকধর্মী (realistic Symbolism) শিল্পকর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় ।
পঞ্চাশ দশক তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ঐ সময়ের কাজগুলো শিল্পের দার্শনিক আবেদন এবং শিল্পশৈলী জ্ঞান, দক্ষতা ও উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছায়, যা তার জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতম কাজ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে, যার মধ্যে সমসাময়িক সামাজিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং জীবনের যে কোনো প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সুর স্পষ্ট উচ্চারিত হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই কাজগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবের দিক থেকে দু’টি মূল সুর ব্যক্ত হয়েছে : একটি হলো বিদ্রোহী ভাব, আর অন্যটি হলো আশাবাদ ।
ঐ সময়ের কাজগুলোর মধ্যে সংগ্রাম, বিদ্রোহী গাভী, প্রত্যাবর্তন, ঝড়, জমিতে মই দেওয়া প্রভৃতি কাজগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভাবের গভীরতা, বিষয়বস্তুর মনোনয়ন, উপস্থাপনা, কলা-কৌশল জ্ঞান ও দক্ষতা, উৎকর্ষ প্রভৃতি দিক দিয়ে বিচার করে এসব কাজগুলোকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে, তবে সত্যিকার অর্থে এগুলোকে মহৎ শিল্পকর্ম (master piece) হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় কিনা সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
বিশেষ ভাবে সংগ্রাম, গুণ টানা ও প্রত্যাবর্তন এই তিনটির যে কোনো একটিকে তার জীবনের মহৎ শিল্পকর্ম (মাস্টার পিস) হিসেবে বিবেচনা করলে হয়তো ভুল হবে না। অবশ্য কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে এই কাজগুলোকে সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে দোষ-গুণ বিচার করা বিশেষ.
নিঃসন্দেহে বলা যায়, তৎকালীন সার্বিক অবস্থা ও পরিবেশের প্রেক্ষাপটে আঁকা উপরিউল্লিখিত কাজগুলোকে ঐ যুগের এবং সার্বিকভাবে সর্বকালের দর্পণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। যার ভেতর বিশেষ করে ঐ সময়ের সামাজিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, ধর্ম, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি অবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রতিফলিত হয়েছে।
এই কাজগুলোর মূল ভাব হলো, বাঁচার জন্য সংগ্রাম এবং যে কোনো প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা । এই কাজগুলো নজরুল ইসলামের কবিতার কয়েকটি চরণ স্মরণ করিয়ে দেয়— আদি শৃংখল সনাতন শিষ্ট আচার / এ যে সর্বনাশী, এরে ভাঙব এবার’ । এখানে আমরা নজরুল ইসলাম ও জয়নুলের মধ্যে আবার ঐক্যতান খুঁজে পাই ।
এই কাজগুলোর মধ্যে সংগ্রাম ও বিদ্রোহী গাভী এই দু’টি ছবি বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় । সংগ্রাম ছবিটি ৮ ফুট বাই ২ ফুট আয়তনের ম্যাসোনাইড বোর্ডের উপর মিশ্র মাধ্যমে, তেল ও টেমপারা, আঁকা একটি বাস্তবধর্মী শিল্পকর্ম। সংগ্রামের মধ্যে কাঠের গুঁড়ি বোঝাই একটা গরুর গাড়ি থলথলে এঁটেল কাদায় আটকে গেছে। বলদ দু’টি শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে গাড়িটা টানছে এবং গাড়ির চালকও সমস্ত শক্তি দিয়ে গাড়ির ঢাকা সজোরে ধাক্কা মারছে।
উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় গাড়িটাকে কাদা থেকে উঠাতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে । কিন্তু চাকা এতটুকুও নড়ছে না । থলথলে এঁটেল কাদার ভেতর বলদগুলোর ও গাড়োয়ানের পা প্রায় হাঁটু পর্যন্ত পুঁতে গেছে। সজোরে গাড়ি টানার কষ্টে, ক্লান্তিতে ও উত্তেজনায় বলদের চোখ দু’টো যেন কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবার উপক্রম । ক্লান্তি তে নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।
বলদগুলোর সাথে একইভাবে গাড়োয়ানও হাঁপাচ্ছে । তার ঘর্মাক্ত শরীর গ্রীষ্মের রোদে চিক চিক করেছে। কিন্তু তাদের সমস্ত পরিশ্রম যেন বিফলে যায় । এই গরুর গাড়ি হয়তো কোনো দিন কাদা থেকে উঠতে পারবে না। এখানে হতাশা ও নৈরাশ্যের সুর ক্ষীণভাবে বেজে উঠেছে ।
কিন্তু পরমুহূর্তেই বলদ দু’টির বিপরীতে পীত বর্ণের কিছুটা উন্মুক্ত পশ্চাদভূমি রম্য নাটক সৃষ্টি করেছে। আর কিছুক্ষণ চেষ্টা অব্যাহত রাখলে গাড়িটা কাদা থেকে উঠে আসবে এবং গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতে পারবে। রম্য নাটক সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তার আশাবাদ প্রকাশ পেয়েছে। সমস্ত প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা উত্তীর্ণ হবে। অদূর ভবিষ্যতে সর্বক্ষেত্রে উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রগতিশীল সংস্কৃতির ইঙ্গিত দেয়, যা এখনো পর্যন্ত সুদূরপরাহত।
সাদা বলদের বুকের উপর তুলির দু-তিনটি আঁচড় পিঠ ও পেটের মধ্যবর্তী স্থান এবং পায়ের পেশীর গঠন থেকে বুকের পাজরের গঠন এবং কঠিন মাংসপেশী স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে । যা বলদের দৈহিক শক্তি ও তেজস্বিতা আরো বৃদ্ধি করেছে। যার মধ্যে তার পেশীবিজ্ঞান (anatomy) সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান প্রতিফলিত হয়েছে ।
ঐ সময়ের কাজগুলোর মধ্যে প্রত্যাবর্তন একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম (সম্ভবত বর্তমানে পাকিস্তানে রয়েছে), যার মধ্যে একপাল গরু ভীত সংকিত হয়ে নিজ গৃহ বা কোনো নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। নববর্ষের শুরুতে কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে। বড় বড় ফোটায় শিলাবৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। অল্প সময়ের ভেতর মুষলধারে বৃষ্টি নামবে।
ঘন ঘন বিদ্যুতের চমক ও মেঘের গুড় গুড় শব্দে গরুগুলো দারুণ ভয় পেয়ে দিশাহারা হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি,হুড়াহুড়ি করে ছুটছে । নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ হচ্ছে, ভয়ে গোঙাচ্ছে। রাখাল ছেলে লাঠি হাতে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে। কিন্তু গরুগুলো তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে । রচনার মধ্যে যদিও রাখালকে দেখানো হয়নি তবুও তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়।
সংগ্রাম ছবির মতো এটাও মিশ্র মাধ্যমে (তেল ও টেমপারা) আঁকা একটি সুদীর্ঘ চিত্র। ‘বার্ডস আইন ভিউ থেকে বিষয়বস্তুর উপস্থাপন করা হয়েছে। গরুর মাথা, ঘাড় ও পিঠের উপর সতর্কভাবে আলোর কয়েকটি আঁচড় গরুগুলোকে পরস্পর থেকে পৃথক করেছে। উজ্জ্বল আলোর আঁচড়ে বিদ্যুতের চমক অনুভব করা যায়।
আলোর ব্যবহার অতি অল্প জায়গায়, বাকি সবই অন্ধকারে রয়েছে। সেজন্য আলো-ছায়ার মনোরম নাটক সৃষ্টি হয়েছে । শিল্পের দার্শনিক আবেদন এবং শৈল্পিক দক্ষতা ও উৎকর্ষের দিক থেকে বিচার করলে এটাকে অবশ্যই একটা মহৎ শিল্পকর্ম হিসেবে তার জীবনের ‘মাস্টার পিস’ হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না।
জল রঙে আঁকা বিদ্রোহী গাতী আরেকটি জনপ্রিয় শিল্পকর্ম। একটি গাভী দড়ি দিয়ে ঘৌটায় বাধা রয়েছে। কিন্তু সে এই শৃঙ্খলিত অবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। সে এমনিভাবে সারা জীবন শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকতে চায় না, পরাধীনতা থেকে মুক্তি লাভের জন্য শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়ি ছিড়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছে।
এই ছবির ভেতর যে শুধু তৎকালীন বাংলাদেশের সমকালীন অবস্থার প্রতীকী প্রকাশ পেয়েছে তা নয়, বস্তুত তিনি শৃঙ্খলিত সমগ্র মানবজাতির মুক্তি কামনা করেছেন । রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি সবকিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত মানবসমাজের মুক্তি কামনা করেছেন । বিদ্রোহী গাভী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীকি ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে আখ্যায়িত করলে হয়তো ভুল হবে না ।
ভাবের দিক থেকে বিচার করে বলা যায়, নজরুল ইসলামের ‘জাগো অনশন বন্দি উঠরে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘অন্ন চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু/ চাই জল, চাই স্বাস্থ্য আনন্দ উচ্ছ্বল পরমায়ু এই দু’ভাবের ব্যঞ্জনা জয়নুল আবেদিনের বিদ্রোহী গাভীর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।
গাভীর সামনের পা ও কানের উপর উজ্জ্বল আলো পড়েছে এবং ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে ঘাড়, পিঠ, কোমর, পেছনের ঊরু এবং পেছনের খুরে মিলিয়ে গেছে । যেজন্য রচনার মধ্যে ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয় । অল্প আলো এবং অধিক ছায়া ব্যবহার দ্বারা আকার গঠন করেছেন এবং অনুপুঙ্খ এড়িয়ে গিয়ে ন্যূনতম বর্ণনার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক আবেদন সৃষ্টি করেছেন। এতদ্বসত্ত্বেও একনিকে দেহের কাঠামোগত গঠন অনুভব করা যায়, অপরদিকে গাভীটির মধ্য অনুর্দমনীয় শক্তি, তেজস্বিতা ও অন্তর্নিহিত সঞ্জীবনী শক্তি প্রকাশ পেয়েছে ।
স্বচ্ছ উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার এবং জলরঙের নমনীয়তা সব কিছু মিলিতভাবে তার দক্ষতার সাক্ষ্য দেয় । কিন্তু পশ্চাদভূমিতে গাভীর পিঠের উপর হঠাৎ গাঢ় রঙে তুলির কয়েকটি আঁচড় দৃষ্টিতে বাঁধা সৃষ্টি করে, কিছুটা ছন্দ পতন বলে মনে হয়। কিন্তু এই সামান্য ত্রুটি সহজে মাজনীয় একই ভাবের উপর ভিত্তি করে তিনি কালি-কলম দ্বারা আরো একটি রেখাচিত্র আঁকেন । যার মধ্যে একটি গাভী দড়ি ছিড়ে পালাবার চেষ্টা করছে এবং অন্যটি উদাসীন নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
সে যেন এই শৃঙ্খল জীবন মেনে নিয়ে অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে । যার ভেতর দিয়ে গরিব সমাজের মনস্তাত্ত্বিক ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। “The greatest curse of poverty is that it destroys the will power of the poor until they become the most ardent supporters of their own
poverty” বার্নার্ড শ-এর এই উক্তির প্রতিধ্বনি এই রেখাচিত্রটির মধ্যে পাওয়া যায় । এই রেখাচিত্রটি দেখে মনে হয় যে, এটা সম্ভবত বিদ্রোহী গাভীর পূর্ববর্তী প্রস্তুতির এটা খসড়া রেখাচিত্র। সম্ভবত ভাবের দিক থেকে বিচার করে তিনি অন্য বলদটি বাদ দিয়ে কেবল বিদ্রোহী গাভীটি উপস্থাপন করেছেন। অথবা একই ভাবের উপর ধারাবাহিক কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই রেখাচিত্র এঁকেছিলেন । কিন্তু ভাবের পুনরাবৃত্তি হতে পারে বিবেচনা করে অথবা ভাবের বৈপরীত্যের জন্য হয়তো তিনি এটা চিত্রায়িত করা থেকে বিরত থাকেন ।
পঞ্চাশ দশকে জলরঙে আঁকা ‘ঝড়’ তার আর একটি উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম । একজন পথচারী একাকী কালবৈশাখীর প্রবল ঝড় ও শিলা বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে অতিসন্তর্পণে প্রতিকূল অবস্থার বিপরীত দিকে অতিকষ্টে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝড়ের ঝাপটা যেন তাকে পেছন দিকে উল্টে ফেলতে চায়। সে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বাতাসের ঝাপটা সামলে নিচ্ছে, ছাতাটা সামনের দিকে কাঁত করে ধরে নিজেকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করছে। বাতাসে গায়ের জামা পত পত শব্দে পেছন দিকে উড়ছে।
পশ্চাদভূমিতে গাছের দোলায়িত পল্লব ও প্রবলভাবে আন্দোলিত নারকেল গাছের পাতা থেকে ঝড়ের তীব্রতা ও গতি সহজে অনুভব করা যায়। পথচারীর উপর তীব্র আলো থেকে বিদ্যুতের চমক অনুভূত হয় এবং বজ্রপাতের বিকট শব্দ ভীতি সঞ্চার করে। নরমূর্তির উপর উজ্জ্বল আলোকপাতের ফলে চারদিকের অন্ধকার প্রকৃতি আরো অন্ধকার মনে হয় ।
পঞ্চাশ দশকে সমসাময়িক সময়ের সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তিনি একাকী অগ্রনায়ক হিসেবে ব্যক্তিগত জীবন এবং শিল্প-আন্দোলনকে যেভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঝড় তারই প্রতীকী প্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে, এই ছবির ভেতর দিয়ে তিনি সব মানুষকে সাহসিকতা ও সতর্কতার সাথে যে কোনো প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করতে এবং প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আপন লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগান।
আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। ধানের ভূঁইয়ে মই দেয়া আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি বিষয়। ধান রোপণের সময় এলে গ্রামেগঞ্জে শহরের আশেপাশে প্রতিদিন এই দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে। কৃষকেরা কর্মব্যস্ত হয়ে বিষয়বস্তুর চয়ন ও অবতারণার ভেতর দিয়ে তিনি কৃষিভিত্তিক সমাজ ও কৃষকদের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনের প্রতি আলোকপাত করেছেন ।
দু’টি গরু স্বতঃস্ফূর্তভাবে মই টানছে। কৃষকটি হাত সামনের দিকে প্রসারিত করে জোয়ালের সাথে বাঁধা রশি দুটো শক্ত মুঠোয় ধরে পেছন দিকে হেলে পড়ে চলার গতি ভারসাম্য রক্ষা করে মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তার ছোট ছেলে তার পাশে মইয়ের উপর বসে সামনের দিকে ঝুঁকে জোয়ালের সাথে বাঁধা রশিটা শক্তভাবে ধরে রেখেছে। যেন পড়ে না যায় । জমিতে মই দেয়ার কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়ে এসেছে । কৃষকের কাঁধের গামছাটা বাতাসে পেছন দিকে উড়ছে ।
গরুর চলার গতি ও কৃষকের দাঁড়ানোর ভঙ্গির ভেতর দিয়ে শ্রমের আনন্দ ও আসন্ন ফসলের আশায় কৃষকের মনের আনন্দ ফুটে উঠেছে। আব্বাস উদ্দীনের গাওয়া একটা পল্লীগীতির কথা মনে পড়ে যায়— ‘বাজান চল যাই চল / মাঠে লাঙ্গল বাইতে / গরুর কাঁধে লাঙ্গল দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে । অগ্রভূমিতে তুলির শক্তিশালী চওড়া আঁচড় চলার গতিকে আরো গতিশীল করে তুলেছে । এক কথায় এ ছবির ভেতর এদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী কৃষক সম্প্রদায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে ।
কৃষকের গলগণ্ড, সাদা গরুর চিবুকের তলায় এবং কালো গরুর শিং ও কানের উপরে আলোর সামান্য ব্যবহার থেকে তার সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষক মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
তার গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে ষাট দশকের প্রথমার্ধে তেল মাধ্যমে আঁকা ‘গুণটানা’ একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ। পাঁচজন লোক প্রবল স্রোতের উজানে বৃহদাকার একটি বোঝাই বজরা গুণ টেনে চলেছে। চৈত্রের দারুণ খরায় ঝলসানো রোদের মধ্যে ক্ষুৎপিপাসায় লোকগুলো ক্লান্ত ও শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। গ্রীষ্মের রোদে তাদের ঘর্মাক্ত দেহ চিকচিক করছে। তবু তারা মরিয়া হয়ে গুণ টেনে চলেছে যতক্ষণ পর্যন্ত গন্তব্যে না পৌঁছায়।
এই ছবিটির মধ্যে একদিকে ব্যক্তিগত বা জাতীয় জীবনে মহান কিছু অর্জন ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অবিরাম প্রচেষ্টা ও বাঁচার জন্য কঠোর সংগ্রাম এবং অপরদিকে জাতীয় স্বার্থে ঐক্য ও পারস্পারিক সহযোগিতার বাণী প্রকাশ পেয়েছে। একইভাবে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র শ্ৰেণী যে কঠোর কায়িক পরিশ্রম করে এবং সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে তা প্রতিফলিত হয়েছে ।
এটা দীর্ঘায়তনের চিত্রকর্ম । লোকগুলো একেবারে ক্যানভাসের বামদিকে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে । এক হাত দিয়ে গুণের দড়ির সাথে বাঁধা ছোট লাঠি চেপে ধরে এবং অপর হাত পেছন দিকে প্রসারিত করে গুণের দড়ি শক্ত মুঠোয় ধরে রেখেছে।
নর মূর্তিগুলোর সামনের দিকে ক্যানভাসের একেবারে বামপাশে ঝুঁকে পড়া মূর্তিগুলোর উল্টো দিকে ক্যানভাসের একেবারে ডান দিকের উন্মুক্ত প্রশস্ত জায়গা ও গুণের দড়ি ফ্রেমে কেটে যাওয়ার ফলে রচনার মধ্যে দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। গুণের দড়িটা ডানদিকে কেটে যাওয়ায় একদিকে নরমূর্তিগুলো এবং অন্যদিকে রচনার ভারসাম্য রক্ষিত হয়েছে। হালকা নীল আকাশের বিপরীতে তামাটে রঙের নরমূর্তিগুলো বেরিয়ে এসেছে।
ফলে অনন্ত আকাশ ও নরমূর্তিগুলোর মধ্যে দূরত্ব এবং আলো-বাতাসের সুন্দর অনুভূতি জাগে।
বিষয়বস্তুর মনোনয়ন ও উপস্থাপনা, ভারসাম্য রচনা, স্বচ্ছ উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার, সাবলীল অঙ্কন প্রতিমূর্তিগুলোর সুন্দর ‘ওভারল্যাপিং’ প্রভৃতি সবকিছু মিলিতভাবে ভার দক্ষতা ও উৎকর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায় । কিন্তু ক্যানভাসের একেবারে ডানদিকে হালকা নীল আকাশের মধ্যে হঠাৎ উজ্জ্বল হলুদ রঙের ব্যবহার, যা ক্ষুদ্র মেঘের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, কিছুটা বিঘ্ন ও অসঙ্গতি সৃষ্টি করেছে ।
তিনি তেলরং ব্যবহারে তেল ও জলরং ব্যবহারের পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন । উভয় মাধ্যমে প্রচলিত পদ্ধতি লঙ্ঘন করে নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন, যা পরবর্তী দশকে উত্তরসূরিদের অনেকে অনুসরণ করেন ।
আলোচিত শিল্পকর্মগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহারে (Perspective) অস্পষ্ট ধারণার জন্য দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। প্রায়শ তিনি একই ছবির ভেতর দু’টি দিগন্ত রেখা ও দু’টি দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করেছেন, যা বাস্তবধর্মী চিত্রকলায় অমার্জনীয় ভুল হিসেবে গণ্য হয়। এ থেকে মনে হয় যে, পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে তার গভীর জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির অভাব ছিল।
অবশ্য কোনো কোনো ছবির মধ্যে মারাত্মক ভুল রয়েছে আবার কোনোটির মধ্যে সামান্য। কিন্তু শিল্পের মৌলিক দার্শনিক আবেদন এবং দক্ষতা ও উৎকর্ষের দিক থেকে এই কাজগুলো এত সাবলীল ও সমৃদ্ধ যে, এই ভুল শিল্পরসিক ও সমালোচকদের দৃষ্টি সহজে ফাঁকি দিতে সক্ষম এবং সহানুভূতিশীল বিবেচনার দাবি রাখে ।
পূর্ব আলোচিত তার সাঁওতাল দম্পতি ‘Ant’s eye view থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে । দিগন্তরেখা রচনার একেবারে নিচে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মনে হয় যে শিল্প যেন প্রায় মাটির উপরে শুয়ে ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে দেখছেন। কিন্তু ছাতা এবং বাম হাত ভাঁজ করা অবস্থায় বাহুর উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে। যেজন্য মনে হয় যে, তিনি একই সময়ে একই বস্তু কখনো একেবারে নিম্ন থেকে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখছেন আবার একই মুহূর্তে সেই বস্তু মাটির উপর দাঁড়িয়ে সোজাসুজি দেখছেন। ফলে কাগজের প্রায় মধ্যখানে আরেকটি কাল্পনিক দিগন্তরেখা সৃষ্টি হয়েছে।
সংগ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম। সম্ভবত এটা তার জীবনের ‘মাস্টার পিস’ হিসেবে গণ্য হতে পারত। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতের মারাত্মক ভুলের জন্য শিল্পের বিচারে অনেকাংশে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। এটাও সাঁওতাল দম্পতির মতে ‘অ্যান্টস আই ভিউ’তে নিকটতম (ক্লোজ-আপ) দূরত্ব থেকে উপস্থাপন করেছেন।
দিগন্তরেখা একেবারে রচনার নিম্নাংশে অর্থাৎ গরু গাড়োয়ানের হাঁটুর নিচের দিকে স্থাপিত করেছেন। কিন্তু একই সময় সাদা বলদের পিঠের উপর দিয়ে কালো বলদের পিঠ দেখা যাচ্ছে এবং জোয়াল ঊর্ধ্বমুখে ক্রমশ একবিন্দুতে মিলিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। যে জন্য ক্যানভাসের উপরে কিনারায় আর একটি কল্পিত দিগন্তরেখা সৃষ্টি হয়েছে।
বিষয়বস্তুর অবতারণা থেকে বোঝা যায়, দৃষ্টিকোণ (ভিউ পয়েন্ট) ক্যানভাসের একেবারে বামদিকে নির্ধারিত হয়েছে এবং গরুর গাড়ি ডান দিক থেকে তীর্যকভাবে সামনের দিকে আগত। আবার একই সময়ে গাড়োয়ানকে ঢাকা ধাক্কা মারা অবস্থার ক্যানভাসের বামদিকে উপর থেকে পিঠের তিন-চতুর্থাংশ দেখানো হয়েছে। সে হিসেবে ক্যানভাসের একেবারে ডানদিকে দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ নির্দিষ্ট হয়েছে। একইভাবে চাকাটা ডিম্বাকৃতি হওয়ার পরিবর্তে দর্শকের সোজাসুজি নিখুঁত বৃত্ত হয়েছে। ফলে একই ছবির মধ্যে তিনটি দৃষ্টিকোণ এবং দু’টি দিগন্তরেখা সৃষ্টি হয়েছে।
রচনা কৌশলের ফলে সুপরিকল্পিতভাবে দৃষ্টি সাদা গরুর মাথার উপর আকৃষ্ট হয়ে ধনুকের মতো বক্রাকার একটি কাল্পনিক রেখা অনুসরণ করে দৃষ্টি প্রবল গতিতে ক্যানভাসের ডানদিকের কিনারা দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু কাঠের গুড়িগুলো ডানদিকের কিনারা কেটে যাওয়ার ফলে দৃষ্টি ফ্রেমে হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে বিপরীত দিকে আবার ঘুরে আসে। সে জন্য দৃষ্টির নিজের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে, যা ইন্দ্রীয়ের উপর ঝাঁকুনি সৃষ্টি করে ।
শিল্পের মৌলিক দার্শনিক আবেদন, দক্ষতা, উৎকর্ষ প্রভৃতি দিক দিয়ে বিচার করে এই শিল্পকর্মটি সার্বিকভাবে একটি মহৎ শিল্পকর্ম (মাস্টার পিস) হতে পারত। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতের মারাত্মক ভুলের জন্য দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শিল্পের বিচারে অনেকাংশে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তবুও এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, সমস্ত দিক দিয়ে বিচার করে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ শিল্পকর্ম হিসেবে শিল্পরসিক ও সমালোচকদের সহানুভূতি উদ্রেক করে।
অনুরূপভাবে অন্যতম জনপ্রিয় বিদ্রোহী গাভী পরীক্ষা করলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ মুক্তির অভাব অর্থাৎ ত্রুটি ধরা পড়ে। গাভীটাকে ডানদিক থেকে কিছুটা তীর্যকভাবে দেখানো হয়েছে। সে সজোরে দড়ি ছেড়ার চেষ্টা করছে, যার দ্বারা রচনার মধ্যে দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু দড়িটা গাভীর সাথে এক সমান্তরাল রেখায় না হয়ে রচনার একেবারে ডানদিকের নিচের কোণা থেকে কিছুটা তীর্যকভাবে বামদিকে গিয়ে হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে একেবারে বাম দিকে ঘুরে গাভীর গলায় আবদ্ধ হয়েছে।
গাড়ীটা ডানদিক থেকে ভীর্যকভাবে দেখানো হলে দড়ি টানার সময় বামদিকে ঘাড় কাত করে দর্শকের দিকে মাথা ঘুরিয়ে আছে । বিশেষ করে পেছনের একটা পায়ে দড়ি কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ফলে রচনার মধ্যে তিনি যে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তা ব্যাহত হয়েছে এবং অন্তর্নিহিত ভাবের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায় । এতদ্বসত্ত্বেও এটার দার্শনিক আবেদন ও উৎকর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কিন্তু কম নয় । যে জন্য ত্রুটিগুলো শিল্পরসিক ও দর্শকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে ।
তার বাস্তব এবং বাস্তব প্রতীকধর্মী কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তিনি বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা ও রচনাশৈলীর দিক থেকে সমস্ত ক্যানভাসকে মোট দু’টি অংশে ভাগ করেছেন । নিম্নভূমি (Lower plain) ও ঊর্ধ্বভূমি বা ব্যয়বহুল আকাশ (Upper plain or Expensive sky format) । বিষয়বস্তুকে একেবারে ভূমি সংলগ্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, ইংরেজিতে যাকে ‘অ্যান্টস আই ভিউ’ বলে, নিকটতম দূরত্ব (ক্লোজ-আপ) থেকে উপস্থাপন করেছেন। দৃষ্টি কেন্দ্র (Focal point) ঊর্ধ্বভূমিতে স্থাপন করেছেন।
অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। তার এই বিশেষ রচনা কৌশলের দিক থেকে সিজান ও রোমান্টিক শিল্পীদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ও বৈপরীত্ব দেখা যায়। বিশেষ করে সিজান ও রোমান্টিক শিল্পীদের রচনার মধ্যে দেখা যায়, দৃষ্টি কেন্দ্র নিম্নভূমিতে নির্ধারণ করার ফলে দর্শকের দৃষ্টি নিম্নভূমিতে আকৃষ্ট হয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে থাকে। অবশ্য নিম্নভূমি বলতে সব সময় ক্যানভাসের নিচের অংশ বোঝায় না। কিন্তু জয়নুলের রচনার কৌশলের জন্য, দৃষ্টি-কেন্দ্র ঊর্ধ্বভূমিতে নির্ধারিত হওয়ার জন্য, দর্শকের দৃষ্টি প্রথমে ঊর্ধ্বভূমিতে আকৃষ্ট হয়ে ক্রমশ নিম্নভূমিতে নেমে এসে অনন্ত নীলিমায় বিলীন হয়ে যায় । অবশ্য ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয় ।
এখানেই সিজান ও রোমান্টিক শিল্পী এবং জয়নুলের মধ্যে মৌলক পার্থক্য। উপরিউল্লিখিত কাজগুলো থেকে স্পষ্ট অনুমান করা যায় যে, বুদ্ধিমত্তা কর্মকাণ্ডের সময় তিনি এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন যে, পরিপ্রেক্ষিতের ভুল তার দৃষ্টি এড়িয়ে যেত। বিশেষ করে যেহেতু তার প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ জলজ মাধ্যমে আঁকা সেহেতু পরবর্তীতে ভুল-ত্রুটি সংশোধন করা সম্ভব হয়নি, যা হোক, শুধু একুটুই বলা যথেষ্ট যে, আবেগ যুক্তিকে উপেক্ষা করে কেবল ভাবের উপর গুরুত্বারোপ করেছে ।
পূর্বেই বলা হয়েছে, তার বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে নানারকম প্রচারণা অব্যাহত রাখেন এবং তাকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি শিল্পী হিসেবে যতই মহান এবং ব্যক্তি হিসেবে যতই মহৎ হোন না কেন, রক্ত মাংসের শরীরের একজন মানুষ ছিলেন। তাই তার মধ্যে স্নায়ুবিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হওয়া খুবই স্বাভাবিক নিন্দা ও সমালোচনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তিনি কিছুদিন বিমূর্তবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ সময় তিনি তেল মাধ্যমে কখনো জ্যামিতিক আকারে বিষয়ভিত্তিক আবার কখনো কোনো বিষয় ছাড়াই নিরাকার বিমূর্ত কাজ করেন।
তার বিমূর্তবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণ, নিন্দা ও সমালোচনা ছাড়াও, বিশ্লেষণ করলে মনে হয় যে, বাস্তবধর্মী দেশজ শিল্পশৈলী ও পাশ্চাত্যের বিমূর্ত তার মধ্যে সংশয় ও সংঘাত সৃষ্টি করে । এই মর্মে আবুল মনসুরের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য “যুগের রুচি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ শিল্পীদের পাশ্চাত্য শিল্পরীতি বৈচিত্র্যের প্রতি ঝোঁক তার মধ্যেও একধরনের সংশয়ের জন্য দেয় । ক্ষণিকের জন্য তারও হয়তো বিশ্বাস হয়েছিল যে, ঐ পথ ছাড়া গত্যন্তর নেই । ষাটের দশক থেকে ক্রমবর্ধমান বিমূর্ততার প্রভাবে জয়নুলও একদা আধা-বিমূর্ত ও প্রায়-বিমূর্ত ঢঙের চিত্রনির্মাণের প্রয়াস চালিয়েছিলেন।” (তার শিল্প ভুবন, সংবাদ, তারিখ ১২ পৌষ, ১৩৯৭/ ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৯০)।
নিরপেক্ষভাবে তার ঐসব কাজ পরীক্ষা করলে দেখা যায়, জলজ মাধ্যমের তুলনায় তার তেল মাধ্যমের কাজগুলোর ভেতর জড়তা ও অদক্ষতা ধরা পড়ে। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, তেল মাধ্যম এবং বিশেষ করে বিমূর্ত তার মানসিকতার পরিপন্থী ছিল। রেখার স্বতঃস্ফূর্ত গতি ব্যাহত হয় এবং মাধ্যম ব্যবহারের পদ্ধতি ও আঙ্গিকের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে আবুল মনসুরের কথায় বলা যায়।
“কিন্তু শিল্পকলার এই বিমানবিকীকরণ (ডিহিউম্যানাইজেশন) বিষয়বস্তু হিসেবে চিত্রপট থেকে মানবের অবলুপ্তি জয়নুলের অভিন্না ও স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত” (তার শিল্প ভুবন, সংবাদ, তারিখ ১২ পৌষ, ১৩৯৭ বাংলা/ ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৯০)।
জয়নুল আবেদিন প্রায়শ ভূমির পরিবর্তে প্যালেট নাইফ বা স্পেচুলা ব্যবহার করতেন । রঙের স্বচ্ছতা ও উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলেন। ভাব প্রকাশের সময় তিনি অনেক সময় দশকের সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিমূর্ত চিত্রকলায় প্রায়ই যা হয়ে থাকে।
তেল মাধ্যমে বিমূর্ত কাজগুলো থেকে মনে হয় যে, বিমূর্তবাদের নিয়ম নিষ্ঠায় তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন । অবশ্য এ বিষয়ে তার মধ্যে সচেতন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা অনুমেয় যে, তিনি বৈরী বিমূর্ত ও তেল মাধ্যম থেকে তাড়াতাড়ি নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন । ফলে তিনি বিমূর্ত ধারা থেকে সরে পুনরায় জলজ মাধ্যম এবং স্বতন্ত্র ও মৌলিক আঙ্গিকে ফিরে আসেন।
এর কারণ হতে পারে যে, তিনি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলেন। আবেগপ্রবণতা ক্ষণস্থায়ী, দীর্ঘ দিন ধরে রাখা যায় না, যা তেল মাধ্যমের পরিপন্থী। বিশেষ করে তেল মাধ্যম পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন শাস্ত্রের বিষয়। অতএব, এ মাধ্যমে দক্ষতা, পারদর্শিতা ও উৎকর্ষ অর্জন করতে হলে দীর্ঘদিন অবিরাম প্রচেষ্টার প্রয়োজন ।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ, এদেশে শিল্প আন্দোলন গড়ে তুলতে এবং বিশেষ করে চারুকলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। যে জন্য তেল মাধ্যমে অবিরাম প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা বা আত্মনিয়োগ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
১৯৫১ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি কখনো স্কলারশিপ আবার কখনো রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাপক ভ্রমণ করেন, যা তার অভিজ্ঞতা ও শৈল্পিক উৎকর্ষর সহায়ক হয়।
পঞ্চাশ দশকে কিছু সময়ের জন্য তিনি ছাপচিত্রে, বিশেষ করে এচিং ও ড্রাই পরেন্টে, আগ্রহ প্রকাশ করেন। ঐ সময় তিনি তার দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র ড্রাই পয়েন্টে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন । উদাহরণস্বরূপ এখানে ‘৪৩ সালের একটি রেখাচিত্র উল্লেখ করা যায়। যার মধ্যে একজন মুর্ভিক্ষপীড়িত বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে আছে।
কিন্তু তার কালি-কলমে আঁকা রৈখিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ লোপ পায়, আকারগুলো অধিক বর্ণনামূলক হয়ে যায়। যার মধ্যে ইলাস্ট্রেশনের বৈশিষ্ট্য প্রাধান্য পায় এবং অদক্ষতা ধরা পড়ে শীঘ্রই তিনি নিজের অদক্ষতা ও অপারদর্শিতা উপলব্ধি করেন এবং কালবিলম্ব না করে এই মাধ্যম ত্যাগ করে স্বশৈলীতে ফিরে আসেন।
এখানে একটা কথা সকলের স্মরণ রাখা দরকার যে, একই শিল্পী সব সময় সব মাধ্যমে দক্ষতা ও পারদর্শিতা অর্জন করতে পারেন না, অকথ্য ভাবপ্রকাশক হতে পারেন না। বিশেষ বিশেষ শিল্পী বিশেষ বিশেষ মাধ্যমে পারদর্শী ও ভাবপ্রকাশক হয়ে থাকেন। কিন্তু তাই বলে তার বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিজ্ঞা কমে যায় না বা তার শিল্পকর্মের গুরুত্বও কমে যায় না বা অবমূল্যায়নও করা যায় না । প্রত্যেক শিল্পী আপন আপন বৈশিষ্ট্যে মহীয়ান মাধ্যমের পছন্দ স্বাচ্ছন্দ্য ও আঙ্গিক ব্যক্তিগত রুচি ও সংজ্ঞার ওপর নির্ভর করে ।
এ কথা সত্য যে, তার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করে ছিল এবং সমাজকে দেয়ার মতো তার ভাণ্ডারে অনেক ঐশ্বর্য সঞ্চিত হয়েছিল। যেখানে যখনই কেউ তার প্রয়োজন বোধ করেছেন তিনি অকুণ্ঠচিত্তে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন । ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের পেশোওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একটি চারুকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে তাকে উক্ত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে
যোগদান করার জন্য অনুরোধ জানান। তিনি সানন্দে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন । ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে চারুকলা বিভাগ উদ্বোধন ও প্রতিষ্ঠা করেন । প্রায় সাত মাস পেশোওয়ারে বাস করার পরে ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন।
একদিকে পেশোওয়ারের প্রচণ্ড শীত, তুষারাবৃত্ত পর্বত শৃঙ্গ, এবড়ো-থেবড়ো শুষ্ক নগ্ন পাহাড়, অমসৃণ কঠিন মাটি, কংকর ভূমি এবং অন্যদিকে রাইফেল কাঁধে পাঠানদের তীক্ষ্ণ চেহারা এবং বোরখা পরিহিতা সুন্দরী পাঠান রমণীদের অনাবৃত মুখাবয়ব, সবকিছু মিলিতভাবে তার মনের উপর যে গভীর রেখাপাত করে সেই স্মৃতি তিনি মৃত্যু পর্যন্ত রোমন্থন করেন ।
পেশোওয়ারের চরম শুষ্ক জলবায়ু, শীতকালে হিমানী শীতল আবহাওয়া এবং গ্রীষ্মকালে প্রখর রোদের জলসানো উত্তাপ, কঠিন বৃক্ষহীন নগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে শস্য- শ্যামল উপত্যকা, পাঠানদের সাহসিকতা, তেজস্বিতা, উগ্রতা ও নিষ্ঠুরতা অন্যদিকে স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা তাকে দারুণভাবে অভিভূত করে। মানুষ ও প্রকৃতির এই চরিত্র বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তিনি যে সামঞ্জস্য খুঁজে পান তাই তার মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধির নবদিগন্তের উন্মেষ ঘটায়।
ফলে তিনি মানুষ ও প্রকৃতিকে পৃথক ও বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে এক অস্তিত্ব, এক সত্ত্বা ও এক সত্য হিসেবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন, যা তার পরবর্তী কাজের ভেতর বারে বারে ঘুরে ফিরে পুনরাবৃত্ত হয়েছে । এ প্রসঙ্গে আবুল মনসুরের কথায় বলা যায় “তবে তার শিল্প-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু জুড়ে রয়েছে প্রকৃতি ও মানুষ। বিপুলা প্রকৃতির জঈম শক্তিময়তার বিপরীতে যুথবদ্ধ মানুষের সংগ্রামী অবয়বেই তিনি তার সকল বক্তব্যকে উপস্থাপিত করেন। বৈরী প্রকৃতির বিরুদ্ধে
লড়ে যাওয়া তার চিরচেনা মানুষেরা, যারা হাজারো বছর ধরে একই ভাবে যুদ্ধরত, তার কাছে মানবসভ্যতার সকল প্রতীক। তার মানব প্রেম ধর্ম, বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে সকল মানুষকে স্থাপন করেছে প্রকৃতির বুকে অবিরাম সংগ্রামী ভূমিকায়। এই মানবপ্রেম তারে 1 যেমন মুক্ত রেখেছে সকল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কলুষ থেকে, তেমনি সরাসরি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের প্রতি তাকে রেখেছে অনেকখানি নিস্পৃহ। অথচ এ ক অনস্বীকার্য যে, তার পক্ষপাত ও দায়বদ্ধতা সবসময়ই স্পষ্টভাবে অন্ত্যজ মানুষের প্রতি এবং এভাবেই রাজনীতি উচ্চকিত না হয়েও জয়নুল হয়ে ওঠেন বঞ্চিত মানুষে মুখপাত্র” (তার শিল্প ভুবন, সংবাদ, তারিখ ১২ পৌষ, ১৩৯৭/২৭ ডিসেম্বর, ১৯৯৩):
পেশোওয়ারের অবস্থানকালে তিনি বোরখা পরিহিতা গ্রাম্য পাঠান রমণীদের কিছু প্রতিমূর্তি তেল মাধ্যমে চিত্রায়িত করেন। এই কাজগুলোর মধ্যে রেখাচিত্রের বৈশিষ্ট্য অধিক বিদ্যমান। তেল মাধ্যমে কিছু কিছু অর্ধবিমূর্ত চিত্রের মধ্যে তিনি পাথর মানুষকে এক অস্তিত্ব হিসেবে কল্পনা করে পাঠান রূপকল্প চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেন। আকার গঠনে বৈসাদৃশ্য আলোছায়ার ব্যবহার করেন এবং ভঙ্গুর রেখা ও অমসৃণ বুনোট সৃষ্টির ভেতর দিয়ে পাথরের অনুভূতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সব সময় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাননি ।
পরবর্তীকালে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পর থেকে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত কেবল তুলি ও কালো কালি দিয়ে পুনঃ পুনঃ পাঠান রূপকল্প চিত্রায়িত করেন । এই সময় তিনি ব্যক্তিগত স্বশৈলীর সাথে রন্ট-এর আঙ্গিকের সংমিশ্রণ ঘটান। এই সময় থেকে রেখাগুলো অনেক স্থুল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়, যা পাথরের উপর অমসৃণ বুনোট এর অনুভূতি জাগায় । আলো- ছায়া ও আকারের অস্তিত্ব লোপ পায়।
তৎপরিবর্তে কেবল ‘সারফেস ডিজাইন’ সৃষ্টি করেন এবং প্রতিনিধিত্বশীল উপস্থাপনার পরিবর্তে আত্মিক অনুভূতি (Subjective feelings) সৃষ্টি করাই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সাথে ১৯৭০ সালে তিনি মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ করেন এবং আল-ফাতাহ গেরিলাদের সমরক্ষেত্র, উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শন করেন ।
ফিলিস্তিনি যুদ্ধ-উদ্বাস্তুরা যদিও তার দুর্ভিক্ষ-পীড়িতদের জীর্ণ শীর্ণ ছিল না, তারা ছিল স্বাস্থ্যবান সবলদেহী। তবুও তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও মানবেতর জীবন ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ-পীড়িতদের সমতুল্য ছিল। সকল ফিলিস্তিনি নর-নারী ও নিষ্পাপ শিশুদের মানবেতর জীবন তার আবেগপ্রবণতাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে । তিনি আবার অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
এখানে তার রৈখিক বৈশিষ্ট্যের রূপান্তর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্বের শক্তিশালী রেখাগুলো সহসা সুক্ষ্ম গতিশীল রেখায় রূপান্তরিত হয়ে ছন্দায়িতভাবে সর্বময় সারফেজ ডিজাইন’ সৃষ্টি করে । তার প্রিয় খাগের কলমের পরিবর্তে ধাতুর তৈরি নিব ছন্দময়ী রেখা সৃষ্টিতে কিছুটা অবদান রাখে । পূর্বের আকারগুলো ডিম্বাকৃতি ও বৃত্তাকারে রূপান্তরিত হয় । এখানে আমরা একই রেখাকে বিরতিহীনভাবে নানারকম তারতম্যের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে ছন্দায়িতভাবে সমস্ত কাগজ আবৃত্ত করতে দেখি । রৈখিক তারতম্যের ফলে
ব্যক্তি ও বস্তুর আলো-ছায়া, দূরত্ব, ঘনত্ব, দৃঢ়তা প্রভৃতি সহজে অনুভব করা যায়। ১৯৬৫ সালের পর থেকে রাজনৈতিক অবস্থার সাথে সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক চেতনা ও মূল্যবোধ ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করে। তিনি আঞ্চলিকতাবাদ ও সাংস্কৃতিক চেতনা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন। এই চেতনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ১৯৭০ সালে নবান্নর উপর ভিত্তি করে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করে ।
এই উপলক্ষে তিনি অতি দীর্ঘায়তনের একটি ছবি আঁকেন। আবুল মনসুর বলেছেন এ সময় ঊনসত্তরের গণজাগরণ বাঙালির সত্তায় প্রবলতম জাগরণের অভিঘাত হানলো। জয়নুলের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হলো ৬৫ ফুট দীর্ঘ ‘নবান্ন’ চিত্রে। বাঙালি জীবনের এক আদ্যোপান্ত চিত্র তুলে ধরলেন শিল্প জড়ানো পটের ঐতিহ্যে বাঙালির কান্না, হাসি, সংগ্রামের সেই চলমান ছবির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠলো তার আত্মঅনুসন্ধানের নির্যাস” (তার শিল্প ভুবন, সংবাদ, তারিখ ১২ই পৌষ, ১৩৯৭/ ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৯০)
প্রকৃতপক্ষে, নবান্ন প্রদর্শনীর ভেতর দিয়ে তিনি বিলুপ্ত কৃষিভিত্তিক গ্রাম্য উৎসব এবং ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি চেতনা ও মূল্যবোধের পুনরুদ্ধার ও পুনঃজাগরণের চেষ্টা করেন । অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে, সব বাঙালি শিল্পী কোনোরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বৈরী ভাব ভুলে এই প্রদর্শনীকে সফল করার জন্য নির্দ্বিধায় অংশগ্রহণ করেন। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ, এদেশের শিল্পীদের মধ্যে মতানৈক্য, মতভেদ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বৈরী ভাব (অনেকের মধ্যে) থাকা সত্ত্বে জাতীয় স্বার্থে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে দ্বিধা করেননি। এ উপলক্ষে তিনি বাংলাদেশের জীবন শিরোনামে জলরং এবং কালি-কলম মাধ্যমে ৬৫ ফুট দীর্ঘ নবান্নের ছবি আঁকেন, যার মধ্যে কৃষিভিত্তিক সমাজের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন
ক ধান কাটার পরে কৃষকেরা বিশ্রাম করছে,
খ. ধানের আঁটি মাথায় নিয়ে খামারে যাচ্ছে
গ. কৃষকের খামার,
ঘ. খামারে ধান মাড়াই,
ঙ. ঢেঁকিতে ধান ভানা,
চ ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেয়া প্রভৃতি বিষয়গুলো।
শীতের প্রারম্ভ অগ্রহায়ণ মাসে কৃষকদের বাড়ি নতুন ধানে ভরে ওঠে। বাড়িতে বাড়িতে হাসির ফোয়ারা ঝরে, আনন্দের ঢেউ ওঠে। গ্রামের পর গ্রাম আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে।
তার নবান্নভিত্তিক বাংলাদেশের জীবন শিরোনামের ছবিটির মধ্যে একদিকে যেমন এদেশের কৃষক সমাজের বিভিন্ন দিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা ফুটে উঠেছে অপরদিকে তেমনি তাদের বিশ্বাস, আশা ও আনন্দ প্রকাশ পেয়েছে । কিন্তু এই ছবির একেবারে বামনিকে একটি নিঃস্ব বাস্তহারা কৃষক পরিবারের গন্তব্যহীন অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা করার দৃশ্য অবতারণার ভেতর দিয়ে করুণ সুর বেজে উঠেছে ৷ এই
বিয়োগান্তক নাটক অবতারণার জন্য সমস্ত হাসি-আনন্দ এক মূহূর্তে থেমে গেছে। এখানে আমরা আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদের ভেতর দারুণ সংঘাত দেখতে পাই। সম্ভবত এটাই তার একমাত্র শিল্পকর্ম, যার মধ্যে হতাশা ও নৈরাশ্য প্রাধান্য পেয়েছে। উল্লেখ্য, একই ছবির অন্য সব কাজের মধ্যে আশাবাদ প্রতিফলিত হয়েছে । এদিক থেকে বিচার করলে এই ছবিটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী কাজ বলা যায়।
এই নিঃস্ব সর্বহারা পরিবারের সাথে একটা কুকুরের অবতারণা বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কুকুরটি এই কৃষক গৃহে জন্মগ্রহণ করে লালিত-পালিত হয়ে বড় হয়েছে । অভাব-অনটনের মধ্যেও কৃষক পরিবার তাকে যখন যা পেরেছে এক মুঠো খাবার দিয়েছে । তাই আজ এই চরম দুর্দিনেও সে তার প্রভুকে ত্যাগ করতে পারেনি । সেও প্রচুর সাথে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছে। এখানে কুকুরের চরিত্র অত্যন্ত মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে ।
পক্ষপাতহীনভাবে বলা যায়, নবান্নভিত্তিক রেখাচিত্রগুলো দেখে মনে হয় যে, ‘৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র এঁকে তিনি যে জনপ্রিয়তা ও বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাই পুনরায় নবায়িত করার জন্য এই নিঃস্ব পরিবারের অবতারণা করেছেন। রেখার সাবলীলতা বজায় থাকলেও স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব লক্ষ্য করা যায়। অনেকটা যেন জোরপূর্বক আত্মপ্রয়োগ মনে হয়। এ প্রসঙ্গে আবুল মনসুরের ব্যাখ্যা খুবই প্রণিধানযোগ্য।
তিনি লিখেছেন দ্রুত সঞ্চারণশীল ক্ষ ক্ষুব্ধ রেখার মোচড়ে মূর্ত হয়েছে বিপর্যস্ত মানুষের আর্তি ও সংগ্রাম । তারা আমাদের স্বজন, চিনতে অসুবিধা হয়। না- কিন্তু একই সাথে তারা হয়ে ওঠে সকলের প্রতিনিধি, দেশ ও কালের সীমানা অতিক্রম করে। এদের অবয়ব নির্মাণে যে রেখাটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি কিন্তু এদেশীয় নয়, সেটি পাশ্চাত্যের দ্রুত অবয়ব অঙ্কন প্রথার। এ রেখা প্রবহমান নয়, ভঙ্গুর; এ রেখা লীলায়িত ও ছন্দিত নয়, কৌণিক ও তীব্র। এ রেখা বস্তুকে বেষ্টনকারী বহিঃরেখা (কনটুর) নয়, বরং অস্থি-সংস্থান ও ত্রিমাত্রার আভাসদায়ী।
এ রেখা কোনোভাবেই প্রাচ্যদেশীয় নয়। এমন রেখা পাশ্চাত্যদেশীয় শিল্পীরা ব্যবহার করেছেন শুধু কোনো তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণের কাজে। খসড়া অনুশীলনের এই শৈলীকে ব্যবহার করে জয়নু প্রায় কালজয়ী চিত্র রচনা করতে পেরেছেন শুধু বিষয়ের সাথে তার প্রখর আত্মিক যোগের কারণে এবং তার অপরিসীম মানবিক সহমর্মী বোধের দ্বারা । এই শৈলীকেই যখন তিনি আরো বিস্তৃত করলেন রঙের সংযোজনে- তখন তাদের রেখার তাৎক্ষণিকতা ও বলিষ্ঠতাই প্রধান আকর্ষক উপাদান হয়ে রইলো, রঙের সংযোগ তাদের ঠিক ‘চিত্রগুণ’ দান করলো না ।
তবুও এগুলো দর্শকের চিত্তে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সমর্থ । কারণ এগুলোর উপাদান উঠে এসেছে একেবারে স্থানীয় জীবনের নির্যাস থেকে এবং তার দ্রুতগামী বলিষ্ঠ রেখা অপরিমেয় মমতায় মানুষে অজেয় সত্তাকে বিম্বিত করতে সক্ষম হয়েছে বলে । (তার শিল্প ভুবন, সংবাদ, তারিখ ১২ই পৌষ, ১৩৯৭/ ২৭শে ডিসেম্বর, ১৯৯০)।
অবশ্য এটা স্পষ্টত বোঝা যায়, তিনি অতীতে কৃষকদের আর্থ-সামাজিক সচ্ছলতা ও আনন্দমুখর দিন এবং বর্তমানে তাদের দারিদ্র্যের উপর আলোকপাত করার জন্যই সর্বহারা পরিবারের অবতারণার মধ্য দিয়ে বিয়োগান্তক নাটক সৃষ্টি করেছেন । তবুও বলা যায়, অন্যান্য বিষয়ের ধারাবাহিকতার মূল সুরের সাথে এই পরিবারটিকে হঠাৎ যেন ছন্দ পতন ও অসঙ্গত বলে মনে হয় ।
পালকিসহ বরযাত্রী বিষয়ের মধ্যে অতীতে নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের অসচ্ছলতার করুণ সুর অস্পষ্টভাবে বেজে উঠেছে এবং পল্লী বাংলার সামাজিক জীবনের একটা দিক প্রতিফলিত হয়েছে ।
ঢেঁকিতে ধান ভানা বিষয়ের মধ্যে পেছন দিকে পিঠ ফিরিয়ে মাটির উপর উপবিষ্ট নারী মূর্তিটির মধ্যে পরিপ্রেক্ষিতের অভাব লক্ষ্য করা যায়। রচনার প্রায় মাঝখানে সাদা জায়গা কাপড়ের পরিবর্তে শূন্য স্থান বলে মনে হয় ।
ধান কাটা বিষয়বস্তুর অগ্রভূমিতে সারি সারি ধানের আঁটি ও একই সরলরেখায় পাশাপাশি উপবিষ্ট কৃষকদের খুব সাজানো মনে হয়, যা একঘেয়েমি সৃষ্টি করেছে। তার নবান্নভিত্তিক ও পরবর্তী কাজগুলোর মধ্যে রৈখিক বৈশিষ্ট্য নতুনত্ব সৃষ্টি করেছে, যা সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাবলীল গতিশীল কালো রেখার সাথে ছন্দায়িত সাদা রেখা যুগ্ম ফলাফল সৃষ্টি করেছে, যা তার আঙ্গিককে অভিনবত্ব দান করেছে এবং উত্তরসূরিদের অনেককে, বিশেষ করে আব্দুর রাজ্জাককে অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করেছে ।
১৯৭০ সালে তুফান ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী দক্ষিণাঞ্চলে বিরাট এলাকা বিধ্বস্ত হয় । তিন লক্ষাধিক অধিবাসী ও সহস্রাধিক গবাদিপশু প্রাণ হারায়, যা তার মনে রেখাপাত করে । তিনি অনতিবিলম্বে একটি ত্রাণদলসহ বিধ্বস্ত এলাকায় পৌঁছান ।
ত্রাণ কাজ সম্পন্ন করে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। কিন্তু এই ধ্বংসাবশেষ তার মনে যে গভীর রেখাপাত করে তা তার স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে । এই স্মৃতি তিনি অনেক দিন পর্যন্ত মনের মধ্যে পোষণ করেন, যা পরবর্তীতে শিল্পকর্মের মধ্যে প্রকাশ পায় । এই বেদনাদায়ক স্মৃতি তিনি ৩০ ফুট দীর্ঘ ক্যানভাসের উপর চিত্রায়িত করেন।
শত সহস্রাধিক লাশ একত্রে জড়ো হয়ে আছে। ক্যানভাসের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত শুধু শবদেহ, শবদেহ আর শবদেহ। ধ্বংসাবশেষ স্তূপ হয়ে আছে। কিন্তু একেবারে ক্যানভাসের শেষ প্রান্তে একজন সুস্থ সবলদেহী লোক চুপ করে বসে আছে। তার সমস্ত আত্মীয়স্বজন, ঘর-সংসার মুছে নিঃশেষ হয়ে গেছে। কেবল সেই রক্ষা পেয়েছে ।
এখানে আমরা আবার রম্য নাটক দেখতে পাই। এত ক্ষয়-ক্ষতি ও ধ্বংসের মাঝেও আশাবাদের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। এখানে রবীন্দ্রনাথের দু’টি চরণ স্মরণে আসে: “যে নদী মরুপথে হারালো ধারা/ জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা” এই কবিতাটির মূল সুর জয়নুলের সমস্ত কাজের মধ্যে পুনঃ পুনঃ স্পষ্ট উচ্চারিত হয়েছে। আবুল মনসুর লিখেছেন সত্তরে ভয়াবহ ঘূর্ণিবার্তা তাকে আলোড়িত করেছে প্রবলভাবে অঙ্কিত হলো ৩০ ফুট দীর্ঘ মনপুরা চিত্র। এখানে আবার দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালার স্মৃতি যেন জাগরিত হলো।
প্রকৃতি ও মানুষের দ্বন্দ্বিত অবস্থানেই যেন জয়নুল সবচেয়ে ক্ষুরধার হয়ে ওঠেন। মনপুরা চিত্রে শেষবার ঝলসে উঠলেন মন্বন্তরের জয়নুল” (তার শিল্প ভুবন, সংবাদ, তারিখ ১২ পৌষ ১৩৯৭/২৭শে ডিসেম্বর ১৯৯০)।
স্বাধীনতা উত্তরকালে তিনি কিছুদিন তেল মাধ্যমে মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি আমাদের কিছু সুন্দর শিল্পকর্ম উপহার দেন। যেমন— ‘মহিলারা স্নান করছে স্নানরতা মহিলারা (বাদিং উইমেন’-এর কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। এই শিল্পকর্মের মধ্যে নারী ও প্রকৃতির রূপ লাবণ্যের বর্ণনা খুবই মনোমুগ্ধকর, যা রবীন্দ্রনাথের ‘বিজয়িনী’ কবিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ।
গ্রামের কয়েকজন তন্বী-তরুণী স্নান করে পুকুরের পাড়ে রোদে দাঁড়িয়ে কেউবা গামছা দিয়ে গা মুছছে, কেউ ভিজে শাড়ি দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে ধরে, ঈষৎ পেছনে দিকে হেলে, শাড়ির আঁচল দিয়ে চুল ঝাড়ছে, কেউবা ভিজে শাড়ি বদলাচ্ছে আবার কেউবা পুকুর ঘাটে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কাপড় ধুচ্ছে। পুকুরের চারদিক ঘন বৃক্ষ-লতায় ঘেরা। অগ্রভূমিতে নারীমূর্তিগুলোর ছায়া দেখে বোঝা যায়, বিকালের সূর্য পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়েছে। বছরের কোন ঋতু ঠিক বোঝা না উপস্থাপনা ও আবেদন আরো সাবলীল করে তুলেছে।
রোদের উজ্জ্বল আলোর বিপরীতে নারীমূর্তিগুলো এবং পশ্চাদভূমিতে ছায়াচ্ছন্ন গাছের কিছু কিছু জায়গায় উজ্জ্বল আলো পড়েছে। পুকুরের পানির কিয়দংশের উপর গাছের ছায়া পড়েছে এবং বাকি অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউগুলো সূর্যের আলোতে ঝিকমিক করছে। সবকিছু মিলে আলো-ছায়ার অপূর্ব নাটক সৃষ্টি হয়েছে । জয়নুলের নাটকীয় আলো-ছায়ার কাজ অনেক বেশি কাব্যিক মনে হয়, যা পশ্চিমা শিল্পীদের থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র ।
পশ্চাদভূমিতে ঘন বৃক্ষ-লতার নীলাভ সবুজ গাঢ় টোনের বিপরীতে হালকা পীত ও তামাটে টোনের নলের মতো আকারের চেহারা গঠনের নারীমূর্তিগুলো সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে । পশ্চাদভূমিত্তে ঘন গাঢ় টোন সূর্যের আলো উজ্জ্বলতর করেছে। যার মধ্যে আলো-বাতাসের অনুভূতি পাওয়া যায়। অলংকৃত নারীমূর্তির মধ্যে মোগল মিনিয়েচার চিত্রকলার কিছু বৈশিষ্ট্য এবং বিমূর্ত ধারার সংমিশ্রণের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। নারীমূর্তিগুলোর গঠন ও অঙ্গভঙ্গি সুখ গতিশীল রেখা সৃষ্টি করেছে, যা ছন্দায়িতভাবে লতিয়ে লতিয়ে উপরের দিকে উঠেছে। নীলাভ-সবুজ পানির মধ্যে পীতাভ-সাদা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউয়ের মধ্যে পানির স্বচ্ছ টলটলে ভাব অনুভব করা যায় ।
বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা ও রচনাশৈলীর দিক থেকে জিনকে মিল করো-এর কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং পুকুরের মধ্যে নারীমূর্তিটি ম্যানের ‘দ্য লাঞ্চিগুন অন দ্য গ্রিন’-এর নারীমূর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ।
নারীমূর্তিগুলোর ‘ট্রিটমেন্টে’ তেলরংকে জলরং পদ্ধতিতে রেখাচিত্রের ধরনে ব্যবহার করা হয়েছে । কিন্তু পুকুরের পানি ও পশ্চাদভূমিতে ঘন গাছপালা যত্ন সহকারে স্পষ্ট করে সম্পন্ন করার প্রচেষ্টা দেখা যায়। অর্থাৎ একই ছবির মধ্যে দু’রকম আঙ্গিক ও পদ্ধতি বিদ্যমান । যেজন্য কাজের মধ্যে কিছুটা অসঙ্গতি ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। তন্মধ্যে তার মধ্যে দ্বিধা ও সংকোচ প্রতিফলিত হয়েছে ।
জানা গেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ঢাকার কোনো এক চলচ্চিত্র নির্মাতা ইতিহাসভিত্তিক ঘটনাবিখ্যাত তিতুমীরের জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য জয়নুলের সাথে চুক্তি করেন। চুক্তি মোতাবেক ঐতিহাসিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে তিনি তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আক্রমণকে মূল বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করেন ।
বাঁশের কেলা রচনার তিন-চতুর্থাংশ পরিসর জুড়ে নিয়েছে। দুর্গের উঁচু প্রাচীর ক্যানভাসের ডান প্রান্তে কেটে গেছে। প্রাচীরের উপরের রেখা ডানদিক থেকে বামদিকে ভীষণভাবে চালু হয়ে নেমে গেছে এবং ভূমিরেখা ক্রমশ ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গেছে। ফলে দৃষ্টি প্রাচীরের নিকটতম জায়গা থেকে দ্রুতগতিতে ধাবিত হয়ে ক্যানভাসের বামদিকে মূল বিষয়বস্তু ওপর নিবদ্ধ হয়। রচনাকৌশল বিষয়বস্তুর উপস্থাপনাকে আরো স্বাবলীল ও সজীব করে তুলেছে।
আক্রমণকারী ব্রিটিশ সৈন্যরা আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত হয়ে চারদিক থেকে ঘিরে দুর্গ অবরোধ করে রেখেছে। তিতুমীরের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে চাল, সড়কি, বলুম এবং তীর-ধনুক দ্বারা আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ করছে। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ চলছে। তিতুমীরের বাহিনীর নিতীক তরুণ সেনারা বাঁশের লাঠি, ঢাল-সড়কি, বল্লম নিয়ে দুর্গের উপর থেকে নিচে ব্রিটিশ সেনাদের উপর বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
অগ্রভূমিতে কয়েকজন ব্রিটিশ সেনাদের মধ্যে একজন তীরবিদ্ধ হয়েছে। তীরটা তার শরীর প্রায় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে। পশ্চাদভূমিতে দিগন্তরেখার কাছে অন্ত গামী সূর্যের শেষ রশ্মি পশ্চিম আকাশে প্রায় মুছে যাচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে। তবুও অবিরাম তুমুল যুদ্ধ চলছে ।
দুর্গের উপর থেকে তিতুমীরের তরুণ সেনাদের লাফিয়ে পড়ার ভঙ্গির মধ্য দিয়ে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা চেতনায় উদ্দীপ্ত সেনাদের নির্ভীকতা, সাহসিকতা, তেজস্বিতা অর্থাৎ এক কথায় শৌর্য-বীর্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু অগ্রভূমিতে ব্রিটিশ সেনাদের নির্জীব জড়বস্তু বলে মনে হয় । বিশেষ করে তীরবিদ্ধ ব্রিটিশ সেনার মুখাবয়বে আহত হওয়ার যন্ত্রণা একেবারেই প্রকাশ পায়নি। উপরন্তু, ভাবলেশহীনভাবে পাথরের মূর্তির মতো তীরটি ধরে আছে বলে মনে হয় ।
প্রথমোক্ত সেনাদের মনস্তাত্ত্বিক চরিত্র বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তার ব্যক্তিগত দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। অপরদিকে অগ্রভূমিতে ক্যানভাসের নিচের প্রান্তে ব্রিটিশ সেনাদের কোমর পর্যন্ত কেটে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে সার্বিকভাবে ব্রিটিশ সরকার এবং বিশেষভাবে ব্রিটিশ সেনাদের প্রতি দারুণ বিষয়বস্তু এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, অগ্রভূমিতে যুক্তিসঙ্গত পরিসরের অভাবে এবং পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে ব্রিটিশ সেনা মূর্তিগুলো কোমর পর্যন্ত কাটতে বাধ্য, তৃতীয়ত, দুর্গ ক্যানভাসের তিন-চতুর্থাংশ পরিসর জুড়ে নিয়েছে। ফলে অবরোধকারী ব্রিটিশ সৈন্যরা রচনার মধ্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত । তাই ব্রিটিশ সেনাদের মাত্র কয়েকজনকে অবতারণা করা ছাড়া উপায় ছিল না।
সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, অগ্রভূমিতে ব্রিটিশ সেনাদের অবতারণা পরিপ্রেক্ষিত পরিপন্থী। অনেকটা জোরপূর্বক অবতারণা করা হয়েছে। তাছাড়াও রচনা ক্যানভাসের একেবারে ডানদিকে দুর্গ প্রাচীরের কালচে রং ব্যবহারের জন্য রঙ্গের অভাব অনুভূত হয় এবং রচনার মধ্যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চাদভূমিতে দিগন্তরেখার কাছে অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিতে উজ্জ্বল কাঁচা হলুদ রং ব্যবহার বিষয়বস্তুর সার্বিক ব্যবহারের সাথে অসঙ্গত ও অযৌক্তিক, যা হোক, সার্বিকভাবে বিচার করে বলা যায়, এটা তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ শিল্পকর্ম হতে পারত, কিন্তু তেলরং ব্যবহারের কলা-কৌশল জ্ঞান ও দক্ষতা এবং পরিপ্রেক্ষিতের অভাবের জন্য শিল্পের বিচার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে ।
সন্দেহের অবকাশ নেই যে, তিনি দেশাত্ববোধের চেতনায় এবং দেশবাসীর স্বাধীনতা কামনায় সারা জীবন উদ্দীপ্ত ও ব্যাকুল হয়েছিলেন। আবুল মনসুর লিখেছেন “তার মানবসত্তা প্রত্যক্ষ রাজনীতি চিহ্নিত পক্ষ গ্রহণে পরাঙ্মুখ, অথচ স্বদেশে ও মানুষের প্রতি অসীম মমতায় উদ্বেল’ (তার শিল্প ভুবন, সংবাদ, তারিখ : ১২ পৌষ ১৩৯৭/২৭শে ডিসেম্বর ১৯৯০)। এতদ্বসত্ত্বেও আশ্চর্যের বিষয় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তার কোনো শিল্পকর্ম (একটি রেখাচিত্র ব্যতীত) চোখে পড়ে না (অন্তত এখনও পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি) কিন্তু তাই বলে তার মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব ছিল বা মুক্তিযুদ্ধ তার মনে রেখাপাত করতে ব্যর্থ হয়েছিল, এ কথা বলা যায় না।
সম্ভবত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার স্নায়ুর উপর দারুণ চাপ সৃষ্টি করে, যা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে তিনি সময় নিচ্ছিলেন। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম তাকে সময় দিল না । মৃত্যু তার সময় গ্রাস করল, তার কাছ থেকে কিছু অমূল্য অবদান পাওয়া থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম । শুধু এটুকু বলা যায়, তিনি যদি আরো কিছুদিন জীবিত থাকতেন তাহলে হয়তো জাতির জন্য আরো কিছু অবদান রেখে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে অর্থাৎ বাংলা ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৩ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । তার মৃত্যুর সাথে সাথে বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলন নাটকের প্রথম অঙ্কের যবনিকা পতন হলো ।
সার্বিকভাবে এদেশে শিল্প আন্দোলন গড়ে তোলা এবং বিশেষভাবে চারুকলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জীবনের সমস্ত সময় ব্যয় করেছেন। এজন্যই নিবিষ্টচিত্তে শিল্পচর্চায় আত্মনিয়োগ করতে পারেননি । সে যাই হোক না কেন, এ কথা সত্য যে, এই জাতির নবজাগরণে এবং জনগণের মধ্যে শিল্প চেতনা ও শিল্পবোধ সৃষ্টি করার জন্য তার অবদান চিরদিন অম্লান, অক্ষয় হয়ে থাকবে ।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে উপমহাদেশের দু’জন ‘চির বিদ্রোহী বীর’, কাজী নজরুল ইসলাম এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ‘রণক্লান্ত’ হয়ে কাছাকাছি চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন । ‘উৎপীড়িতের ক্রোন্দন রোল’ আর কোনোদিন তাদের বিচলিত করতে পারবে না ।
আরও দেখুনঃ