চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

আজকে আমরা চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলাদেশের ১০ চিত্রশিল্পী গ্রন্থের অন্তর্গত।

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

নিবেদিত, সাধক, আত্মভোলা, প্রতিভাশালী, বহুমুখী প্রতিভাশালী, যত বড় শিল্পী তার চেয়ে বড় দার্শনিক, উদাসীন, আধ্যাত্মিক জগতে বসবাসকারী প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গুণবাচক বিশেষণগুলো আমাদের দেশের শিল্পরসিক, শিল্পানুরাগী এবং জনসাধারণ শেখ মুহম্মদ সুলতান ওরফে এস এম সুলতান সম্বন্ধে ব্যবহার করে থাকেন। সুলতান অদ্যাবধি অবিতর্কিত ও সমালোচনাহীন সুখ্যাতি উপভোগ করে আসছেন। ‘শুধু মেধা নয়, জনপ্রিয়তাই একজন শিল্পীর সৌভাগ্য ও নিয়তি গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। দ্য বাংলাদেশ অবজারভার-এর একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধের এই উদ্ধৃতি সুলতানের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য ।

আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে শিল্পীদের সম্বন্ধে কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে । আর এই ধারণার জন্যই লোকে উপর্যুক্ত বিশেষণগুলো ব্যবহার করে থাকেন। বস্তুত নাট্যকার ও গল্পকাররা নাটক ও গল্পের মধ্যে শিল্পীদের একধরনের কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করে। থাকেন, যা পাঠক ও জনসাধারণের অবচেতন মনের উপর ছাপ ফেলে থাকে। তাই শিল্পীদের সম্বন্ধে লোকে নানারকম কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করে থাকেন। আর এসব কাল্পনিক নাটকীয় চরিত্রের সাথে সুলতানের ব্যক্তিগত জীবনের হুবহু মিল পাওয়া যায় । আরেকটা বিষয় হলো, শিল্প সম্বন্ধে ভাসা ভাসা জ্ঞান ও প্রচলিত ধারণার ফলে লোকে

মনে করে যে, চিত্রকলার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা, পৌরাণিক, দার্শনিক, কিংবদন্তি, ধর্মীয় প্রভৃতি ব্যাপার-স্যাপার থাকে। অবশ্য এই ধারণা যে একেবারে অমূলক তা নয়। কারণ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চিত্রকলায় এসব বিষয়ই ছিল শিল্পীদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের উৎস ও অনুপ্রেরণা । কিন্তু ঊনবিংশ, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর চিত্রকলা ভিন্ন প্রকৃতির । যাই হোক, এ বিষয়টি এখানে স্থগিত রেখে মূল বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যাক ।

এদেশের মানুষ সুলতানকে প্রায় সাধু সন্ন্যাসীতে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন । এর কারণ হলো একদিকে শিল্প সম্বন্ধে তাদের অস্পষ্ট ধারণা এবং অন্যদিকে সুলতানের ব্যক্তিগত চরিত্র বৈশিষ্ট্য । বস্তুত তার ভবঘুরে জীবন, অস্থিরতা, খামখেয়ালি মেজাজ, আকস্মিক পরিবর্তন, বাগাড়ম্বর, বাকপটুতা, বাহ্যিক রূপ ও সচেতন উদাসীনতা এবং অন্যদিকে চিত্রকর্মের মধ্যে প্রায়ই হেয়ালিপনা সৃষ্টির চেষ্টা। এসব কিছু মিলিতভাবে তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে।

বলাবাহুল্য, কেবল জনপ্রিয়তা, বাহ্যিক রূপ ও আচরণের উপর নির্ভর করে তার কাজের মূল্যায়ন করলে অবশ্যই ভুল করা হবে । সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, তার কাজের চেয়ে সুখ্যাতি অধিক এবং বাস্তবতার চেয়ে ভান বেশি।

সুলতানের যথার্থ স্থান নির্ণয় করতে হলে শৈল্পিক ও মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তার কাজের দোষ-গুণ বিচার ও বিশ্লেষণ যেমন প্রয়োজন তেমন চরিত্র বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করাও অত্যাবশ্যকীয় । তার সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে এস এম সুলতান, কালিদাস কর্মকার, রশীদ চৌধুরী এবং মুর্তজা বশীর এই চারজন শিল্পীর কাজের ভেতর সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। প্রথমোক্ত দু’জনের মধ্যে অতিমাত্রায়, বিশেষ করে সুলতানের মধ্যে তো বটেই এবং অবশিষ্ট দু’জনের মধ্যে অল্পমাত্রায় ।

সুলতানের ভেতর সিজোফ্রেনিক প্রবণতার কারণ বিশ্লেষণ করলে মোটামুটি চারটি প্রধান শর্ত দেখা যায় যথা- ১. পারিবারিক পশ্চাদভূমি, ২. অতিরিক্ত গাঁজা সেবন, ৩. নিঃসঙ্গ একাকী জীবন এবং ৪. অসফল উচ্চাকাঙ্ক্ষা । এই শর্তগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্ত সিজোফ্রেনিয়া সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিশেষভাবে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন এবং গাঁজার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির ফলে তার মধ্যে ইতিবাচক বিঘ্নিত শারীরিক রূপকল্প (Positive body image disturbances) ঘটে ।

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

যে জন্য তার মধ্যে দৃশ্যমান বিভ্রম (Visual hallucination) হয়ে থাকে বলে মনে হয় । অবশ্য হাল আমলের কিছু কাজের মধ্যে বিঘ্নিত চিন্তন রূপকল্প (Thought image disturbances)-এর লক্ষণও দেখা যায়। যেমন স্মৃতি মন্থন উদাহরণস্বরূপ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ।

তার কাজ বুঝতে হলে এই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টি ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ করা অত্যাবশ্যকীয় । অন্যথায় তার সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক । এই কারণেই আমাদের দেশের শিল্পরসিক ও শিল্পানুরাগীরা তার সম্বন্ধে সব সময় ভুল ব্যাখ্যা করে থাকেন । তাই বিভ্রান্তি ও ভুল ধারণা এড়ানোর জন্য এখানে এই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টি আলোচনা করা হলো।

তার প্রথমদিকের কাজ সম্বন্ধে আমরা কোনো সূত্র থেকে কিছুই অবগত হতে পারি। না (অন্তত আমার জানা নেই। তবে লোক মুখে তার সম্বন্ধে অনেক কথা শোনা যায় কিন্তু এগুলো অধিকাংশ অতিরঞ্জিত ও কাল্পনিক বলেই মনে হয় । তাই জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে শিল্পের বিচার ও মূল্যায়ন করা যায় না। সেজন্য তার প্রথমদিকের কাজ সম্বন্ধে কোনো মতামত বা মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকে পঞ্চাশ দশক থেকে আলোচনা শুরু করাই যুক্তিসঙ্গত ।

জয়নুল আবেদিনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, তিনি কোলকাতা ইনস্টিটিউট থেকে দু’বছর অধ্যয়ন করার পর কোর্স অসমাপ্ত রেখে হঠাৎ নিখোজ হয়ে যান (তিনি কিছুদিন জয়নুল আবেদিনের ছাত্র ছিলেন)। তার সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে তা থেকে জানা যায়, চল্লিশ দশকের প্রায় মাঝামাঝি, ভারত বিভক্তির কিছুদিন আগে, আসামের রাজধানী শিলংয়ে তার একটি একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল। তারপরে তিনি আবার নিখোজ হয়ে যান এবং ভারত বিভক্তির পরে ১৯৪৮ সালে আকস্মিকভাবে কাশ্মির হয়ে পাকিস্তানের লাহোরে আবির্ভূত হন।

শোনা যায়, লাহোরে থাকাকালীন সময় তিনি কিছুদিন সুলতানের এক নবাবের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন । অল্প কিছুদিন পরে তিনি আবার লাহোর থেকে নিখোঁজ হয়ে হঠাৎ করাচিতে পৌঁছান । জয়নুল আবেদিনের কাছ থেকে তার প্রথম জীবন সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় (অবশ্য এ বিষয়ে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন মত থাকতে পারে) তা থেকে অনুমান করা যায় যে, শৈশবে দুঃখজনক পারিবারিক কারণে তার মধ্যে অস্থিরতা জন্ম নেয়।

তারই ফলস্বরূপ তার মধ্যে একদিকে বিভ্রান্তি ও ভারসাম্যহীন চিন্তার সৃষ্টি হয় এবং অন্যদিকে ভ্রমণের উগ্র আকাঙ্ক্ষা (Wanter lust ) জন্মায়। ফলে প্রথম জীবন থেকেই তিনি একাকী নিঃসঙ্গ ভবঘুরে জীবন শুরু করেন ।

১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে বৈদেশিক স্কলারশিপ দিয়ে ইউরোপ প্রেরণ করেন। ইউরোপ ভ্রমণকালে তিনি পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে রেনেসা যুগের ‘ওল্ড মাস্টার’দের এবং অন্য শিল্পীদের মূল শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ পান ।

ইউরোপ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর পাকিস্তানের জালাল উদ্দিন তার কাজ সম্বন্ধে মন্তব্য করেন And brought back with him the deep impression of the American painters like De Cuning and other well made on him. (আর্ট ইন পাকিস্তান, অধঃ ৪র্থ, পৃ. ৪৮. অনুঃ ৩) কিন্তু জালাল উদ্দিনের এই উক্তি সঠিক নয় । কারণ সুলতানের কাজগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তার উপর ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের ‘ওল্ড মাস্টার’দের বিশেষ করে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, রুবেন্স আংশিকভাবে রাফায়েল এবং ভ্যান গগের দারুণ প্রভাব রয়েছে। বিশেষভাবে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো এবং ভ্যান গগ ও রুবেন্স-এর প্রভাব প্রবল ও চিরস্থায়ী। প্রভাব বললেও ভুল হবে, উৎকট অনুকরণ প্রবণতা বলাই সঠিক হবে ।

সুলতান পাশ্চাত্যের এসব শিল্পীর কাজের সাথে তার নিজের কাজের সংমিশ্রণ ঘটালে কি হতো সে কথা আজ নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু সংমিশ্রণের চেষ্টা না করে সরাসরি তাদের অনুকরণের প্রবণতা স্পষ্ট ধরা পড়ে। উপরিউল্লিখিত পাশ্চাত্য শিল্পীদের মধ্যে বিশেষ করে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর দৃঢ়কায় নর প্রতিমূর্তি, রুবেন্স-এর ইন্দ্রিয় সুখবর্ধক নারী প্রতিমূর্তি এবং ভ্যান গগের অনুকরণ প্রচেষ্টা সুলতানের কাজের মধ্যে স্পষ্ট বিদ্যমান । সুলতানের নারীমূর্তির মুখাবয়বে রাফায়েলের ছায়া দেখা যায়।

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তার কাজ ও চরিত্র সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, ইউরোপ ভ্রমণের পর থেকে তিনি নিজেকে উপর্যুক্ত ‘ওল্ড মাস্টারদের সমতুল্য শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার সমর্থন দেয়নি । এই অসার্থক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলে তার অবচেতন মনে উত্তেজনা, হতাশা এবং সংঘাত সৃষ্টি হয়।

উচ্চাকাঙ্ক্ষার মোহজালে আবদ্ধ হয়ে তিনি সারা জীবন আত্মবিড়ম্বিত (Self-deception) ও আত্মবিতাড়িত (Self haunted) হয়ে বিশ্বখ্যাতির মরীচিকার পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন। সম্ভবত ইউরোপ ভ্রমণের পর থেকে এবং অতিরিক্ত গাজা আসক্তির কারণে ঐ সময় থেকে তার মধ্যে ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে মানসিক ভারসাম্য হ্রাস পেতে থাকে ।

উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলে তার মধ্যে অনুকরণ প্রবণতা সৃষ্টি হয় । ফলে ক্রমশ তিনি স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা হারিয়ে কেবল পাশ্চাত্যের ‘ওল্ড মাস্টার দের অনুকরণপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ঐ সময় থেকে তার কাজের মধ্যে ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের খ্রিস্টান ভাবধারা এবং পূর্বে উল্লিখিত কয়েকজন মহান শিল্পীর অনুকরণপ্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে।

অবশ্য পঞ্চাশ দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত তার অনেক কাজের ভেতর স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা অক্ষুণ্ণ থাকে । যেমন— গ্রামের দৃশ্য-১ ও ২, ওয়ালনাট গাছ, শ্রীনগরের হৃদ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অবলাবান্ত মজুমদার-এর প্রতিকৃতি প্রভৃতি মাত্র কয়েকটা শিল্পকর্ম এখানে তার স্বতন্ত্র ও মৌলিকতার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

 

পঞ্চাশ দশকের মধ্যভাগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ, প্রত্যাবর্তনের পর থেকে এদেশের জীবন ও দৃশ্য তার কাছে মুখ্য বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় । তার ঐ সময়ের আঁকা কাশ্মিরের শ্রীনগরের দৃশ্য এবং বাংলাদেশের ছবিগুলো সম্বন্ধে জালাল উদ্দিন ঠিকই বলেছেন “Being essentially a landscape painter with a feeling of colour he is idyllic, since from Kashmir and Bengal for the majority of his paintings.” (আর্ট ইন পাকিস্তান, অধঃ ৪র্থ, পৃঃ ৮৪. অনুঃ

কৃষকদের জীবনের বিভিন্ন দিক, গ্রাম্য মেয়ে, বনানী, আগাছা, তালগাছ, বটগাছ, ডোবা, জলাভূমি, নদ-নদী প্রভৃতি এক কথায় এদেশের ভূ-প্রকৃতি এবং গ্রাম্য পরিবেশ তার কাজের ভেতর প্রাধান্য পায় । বস্তুত গ্রাম্য সরলতা এবং প্রকৃতির বদান্যতা তাকে মুগ্ধ করে । এদিক থেকে তাকে একজন প্রকৃতিবাদী প্রকৃতিপ্রেমিক বলা যায় । এখানে আমরা কামরুল ও সুলতানের মধ্যে সুরের মিল পাই। কিন্তু তাদের মধ্যে পার্থক্য হলো, কামরুল ছিলেন সৌন্দর্যের উপাসক, কাল্পনিক । তাই তার কাজগুলো অধিক কাব্যিক ।

আর সুলতান হলেন অধিক বাস্তববাদী। বাস্তবের কাছে কাব্যের স্থান নেই। জালাল উদ্দিন কর্তৃক উদ্ধৃত সুলতানের নিজের কথায় বলা যায়। To make nature more natural, to add more autumn to autumn, more spring to spring ” এদিক থেকে বিচার করলে সুলতানকে এদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য অঙ্কনের প্রথম অগ্রনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

দূর অতীতের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা, নিঃসঙ্গ একাকী ভবঘুরে জীবন এবং অস্থির চিত্ততার কারণেই সম্ভবত তিনি প্রকৃতির মধ্যে শাস্তি খুঁজে ফিরেছেন । তাই তার কাজের মধ্যে প্রকৃতির প্রাধান্য এতো বেশি । জালাল উদ্দিনের কথায় “Born and brought up amidst strive, Sultan craved for peace, and he found it only in nature in deep-waters, still and even, in timeless mountains and valleys, in the carefree poise of trees and the transparent expressiveness of boundless fields. He contracted this inner peace of nature with the struggle and strive which is the essence of human life ”

সুলতান প্রকৃতিবাদী হলেও তার চারদিকের মানুষের প্রতি উদাসীন হন। প্রসঙ্গে বলা যায়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে লোকালয় অর্থাৎ গ্রাম ও প্রকৃতির মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা নির্ণয় করা যায় । কিন্তু আমাদের দেশের গ্রাম এমনভাবে সৃষ্টি যে পরস্পর পরস্পরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রামকে বাদ দিয়ে যেমন প্রকৃতি কল্পনা করা যায় না তেমন প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে গ্রাম চিন্তা করা যায় না । আর মানুষগুলোও যেন প্রকৃতির এক একটি অঙ্গ ।

শৈশব থেকে জন্মভূমি ছেড়ে স্রোতের শেওলার মতো স্থান থেকে স্থানে দীর্ঘদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন । তাই অনেক দিন পরে জন্মভূমিতে ফিরে এসে চারপাশে যা কিছু দেখেছেন সব কিছুই যেন দু’হাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেছেন । নমঃ নমঃ নমঃ সুন্দরী মম/ জননী জন্মভূমি / গঙ্গার তীরে স্নিগ্ধ সমীরে জীবন জুড়ালে তুমি’ এই কয়েকটি চরণের প্রতিধ্বনি যেন তার কাজের মধ্যে শোনা যায়।

পঞ্চাশ দশকের শুরুতে জলরঙে আঁকা ‘ওয়লনাট গাছ’ ও ‘শ্রীনগরে হ্রদ সুলতানের দু’টি সুন্দর শিল্পকর্ম । প্রথমোক্ত ছবিটির মধ্যে পাহাড়ের কোন এক নির্জন উপত্যকায় ওয়ালনাট গাছগুলো উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে। জলরং ব্যবহারে তার দক্ষতার প্রমাণ দেয়। ‘শ্রীনগরে হ্রদ’ ছবিটির মধ্যে অগ্রভূমিতে হাউজ বোটগুলো আগন্তুকের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে । হাউজ বোটগুলোর পশ্চাদভূমিতে বিস্তৃত হ্রদ চারদিকে পাইন গাছে ঘেরা। সারি সারি পাইন গাছের পেছনে গগনচুম্বী তুষারমণ্ডিত পর্বত শিখর রাজকীয় ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

তুষারাবৃত পর্বত শিখর উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে। পর্বতশৃঙ্গের ছায়া অংশে নীলাভ ও হালকা বেগুনি রং ব্যবহারের ফলে আলোকিত পীতাভ সাদা আরো বেশি হিমানি শুভ্র হয়ে উঠেছে। সূর্যরশ্মি তুষারের উপর পড়ে চারদিকে ঠিকরে পড়ছে।

ছায়াংশে স্বচ্ছ নীলাভ এবং মাঝে মাঝে হালকা বেগুনি রং ব্যবহারের ফলে স্বচ্ছ হিমানি যেন আরো টলটলে মনে হয় । গ্রীষ্মকালেও শীত শীত অনুভূত হয় ।

শরতের প্রায় শেষভাগ থেকে বসন্তের শেষ পর্যন্ত কাশ্মিরের শ্রীনগর উপত্যকা তুষারাবৃত থাকে । গ্রীষ্মকালে তুষার গলা জলে হ্রদ কানায় কানায় ভরে ওঠে। তুষারের উপর দিয়ে প্রবাহিত শীতল সমীরণ বইতে থাকে। গ্রীষ্মের আবহাওয়া ও প্রকৃতি দেখার জন্য উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত পর্যটক শ্রীনগরে এসে ভিড় জমায়। শ্রীনগরের চিত্তহরণকারী প্রাকৃতিক দৃশ্য আগন্তুকদের বিমোহিত করে হৃদয় কেড়ে নেয় । শ্রীনগরের প্রাকৃতিক দৃশ্য সুলতানের মনের উপর যে গভীর ছাপ ফেলে এই ছবিটির ভেতর তারই স্মৃতিচারণ করতে দেখা যায় ।

জলরঙের স্বচ্ছ নমনীয় ব্যবহার ও তুলির স্বতঃস্ফূর্ত কাজের ভেতর দিয়ে তার জলরং ব্যবহারে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিশেষ করে অন্য শিল্পীদের মতো বিষয়বস্তু আগে পেন্সিল বা কালি কলম দিয়ে অঙ্কনের পরিবর্তে সরাসরি জলরং দিয়ে আঁকতে শুরু করেন।

তিনি সর্বপ্রথম আকাশ থেকে আঁকতে শুরু করে ক্রমে ক্রমে বিষয়বস্তু অর্থাৎ গাছপালা, ঘরবাড়ি, মানুষ, জীবজন্তু আঁকতে আঁকতে একেবারে অগ্রভূমিতে এসে শেষ করেন । এটা তার দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের একটা দিক । অবশ্য প্রথমে বিষয়বস্তু এঁকে পরে জলরং প্রয়োগ করা অনেকের ব্যক্তিগত আঙ্গিক এবং অধিক ভাব প্রকাশক । তাই বলে তাদের দক্ষতার অভাব আছে বললে ভুল হবে ।

পঞ্চাশ দশকের মধ্যভাগে জলরঙে আঁকা মাইকেল মধুসূদন দত্তের এবং অবলাকান্ত মজুমদারের প্রতিকৃতি দু’টি তার অন্যতম প্রতিকৃতির দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করা যায় । প্রথমোক্ত প্রতিকৃতির ভেতর চোখের মণির উপর তীব্র আলোর বিন্দু টলটলে জলজ ভাগ, ঠোঁটের সুন্দর গঠন ও স্থির গভীর দৃষ্টির ভেতর দিয়ে মহান কবির প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে । দ্বিতীয়োক্ত প্রতিকৃতি ‘অবলাকান্ত’ যদিও কোনো খ্যাতিমান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা কবি ছিলেন না তবুও এটা সুলতানের একটা উল্লেখযোগ্য প্রতিকৃতি শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করা যায় ।

অবলাকান্ত মেঝের উপর বিছানো সতরঞ্জির উপর আসন দিয়ে বসে আছেন । দু’হাত আলতোভাবে কোলের উপর রাখা। কাঁধের উপর রাখা শালের পাড়ে সুই-সুতা দিয়ে ফুল, লতাপাতা নকশা করা, শান্ত চাহনি। এসব কিছু মিলিতভাবে তার সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশের হারানো আভিজাত্য ও আত্মতৃপ্তি ফুটে উঠেছে । তার পরিপাটি চেহারা, বসার ভঙ্গি এবং সার্বিক পরিবেশের ভেতর দিয়ে তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের বিশেষ ধরনের চরিত্র বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট অনুমান করা যায়।

এ দু’টি কাজ সুলতানের চরিত্র বিশ্লেষণের দক্ষতার সাক্ষ্য দেয়। ড. সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন “And in no time he won over the master painters like Mukul Dey. R N Chatterjee and also Zainul Abedin ” (কনটেমপরারি আর্ট সিরিজ অব বাংলাদেশ, অনুঃ ১)।

পঞ্চাশ দশকে আঁকা তেল মাধ্যমে কিছু সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন । যেমন- গ্রামের দৃশ্য-১ ও ২ উদাহরণ হিসেবে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে । ‘গ্রামের দৃশ্য-১ এর মধ্যে একটি ছইওয়ালা গরুর গাড়ি আম বাগানের ভেতর দিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে মন্থর গতিতে চলেছে। গরুর গাড়ির চাকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শান্ত প্রকৃতির নীরবতা ভঙ্গ করেছে। গরুর গাড়ির বিপরীত দিকে পশ্চাদভূমিতে প্রশস্ত মাঠ দেখে মনে হয় যে, এই গ্রামের শেষ সীমানা ছাড়িয়ে সামনে একটা প্রশস্ত মাঠ, তার ওপারে নিজ গ্রাম । তারা এ গ্রামের আত্মীয় বাড়ি থেকে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করছে ।

‘গ্রামের দৃশ্য-২’ এর মধ্যে দু’জন কৃষক ক্লান্ত হয়ে নদীর বাঁকে গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করছে । যেন ‘গঙ্গার তীরে স্নিগ্ধ সমীরে জীবন জুড়ালে তুমি’। রোদের মধ্যে মাঠে কাজ করে তারা ক্ষুত-পিপাসায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই কিছুক্ষণ কর্মবিরতি দিয়ে প্রাতঃরাশের জন্য গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করছে। বৃদ্ধ কৃষকের ছোট মেয়ে বাড়ি থেকে তাদের জন্য মাটির সানকিতে করে কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। এ দুটি ছবির মধ্যে হলুদ ও সবুজের ব্যবহার এবং তুলির ছোট ছোট আঁচড় থেকে

ভ্যান গগের অনুকরণ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা এবং সার্বিক ট্রিটমেন্টের ভেতর আংশিকভাবে তার স্বতন্ত্র ও মৌলিকতা বজায় থাকে। কিন্তু অগ্রভূমিতে ও গাছের কাণ্ডে তুলির ছোট ছোট আঁচড় এবং পশ্চাদভূমিতে রঙের মসৃণ ব্যবহার কিছুটা অসঙ্গতি সৃষ্টি করেছে । মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তার কাজ পরীক্ষা করলে দু’টি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে; প্রথমত, অস্থিরতা ও খামখেয়ালিপনা, দ্বিতীয়ত, পাশ্চাত্যের অনুকরণ প্রবণতাঅস্থিরতার জন্য তার অনেক তেল চিত্র অসমাপ্ত থেকে যায় ।

বিদেশ ভ্রমণের পর থেকে তার চিন্তার মোড় ঘুরে যায়, যা তার পরবর্তী কাজের ভেতর প্রতিফলিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মধ্যযুগের খ্রিস্টান চিত্রকলার মতো পরীর ব্যবহারের মধ্যে খ্রিস্টীয় চিত্রকলা থেকে ভাব অনুকরণের প্রবণতা ধরা পড়ে। পরীর ব্যবহার কখনো সঙ্গত আবার কখনো অসঙ্গত জোরপূর্বক আত্মপ্রয়োগ বলে মনে হয় । এমন মনে হয় যে, কেবল জনপ্রিয়তা অর্জনের চাবিকাঠি হিসেবে এবং জনগণকে হতবুদ্ধি করার উদ্দেশ্যে তিনি পরীর ব্যবহার করেন।

মধ্যযুগের খ্রিস্টান শিল্পীগণ তাদের কল্পনার উৎস ও অনুপ্রেরণা হিসেবে ধর্মগ্রন্থ বাইবেল ব্যবহার করেছেন। বাইবেলে বর্ণিত ফেরেস্তা চিত্রায়নে তারা শিশুকে ফেরেশতার কাল্পনিক রূপ হিসেবে ব্যবহার করেছেন । ফলে তাদের কল্পিত দেবদূতদের মধ্যে নিঃস্ব কলুষতা ও পবিত্রতা বজায় আছে ।

যার ভেতর তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং ধর্মের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সুলতান বাইবেলের গভীরে না গিয়ে বা সরাসরি বাইবেল থেকে অনুপ্রাণিত না হয়ে বা বাইবেলকে উৎস হিসেবে ব্যবহার না করে কেবল পশ্চিমা শিল্পীদের আঁকা দেবদূতদের ভাসা ভাসা অধ্যয়ন করেছেন । ফলে তার পরী বা দেবদূত স্বর্গীয় রূপের পরিবর্তে মনুষ্য রূপ পেয়েছে।

বিশেষ করে তিনি শিশুর পরিবর্তে পূর্ণ যৌবনা নারী প্রতিমূর্তি ব্যবহার করেছেন। তার কল্পিত নারী চিত্রায়নে তিনি নারী দেহের যৌনাঙ্গ অতি যত্নসহকারে এঁকেছেন । সে জন্য তার পরী বা দেবদূতদের মধ্যে নিষ্কলুষতা ও পবিত্র ভাবের অভাব লক্ষ্য করা যায় ।

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

তার কল্পিত নারী বা দেবদূত বিতর্কিত । কারণ তার পরী বা দেবদূত পূর্ণ যৌবনা নারী- স্বর্গীয় অশরীরি বলে মনে হয় না, তেমন ভাবেরও অভাব রয়েছে। নারী দেহের সাথে কেবল দু’টি ডানা সংযুক্ত করা ছাড়া আর কিছুই নেই। সেজন্য এগুলোকে পরী বা দেবদূত বলা যায় না ।

বস্তুত সুলতানের সমস্ত নারী প্রতিমূর্তিগুলো পরীক্ষা করলে বোঝা যায়, নারীদের যৌনাঙ্গ অতি যত্ন সহকারে আঁকার প্রবণতা তার মধ্যে রয়েছে, যা সহজেই দর্শকচিত্তে কৌতূহলের উদ্রেক করে। অবশ্য তার নারী প্রতিমূর্তিগুলো কামোদ্দীপক না হলেও তার মধ্যে একটা প্রবণতা ধরা পড়ে। সেটা হলো, যৌন বিষয়ে দারুণ কৌতূহল । বিশেষ করে ইন্দ্রিয় রূপবর্ধনকারী নারীর প্রতি দুর্বলতা। বিশেষভাবে নারী দেহের নিম্নাঙ্গের উপর তিনি অধিক গুরুত্বারোপ করেন।

এ থেকে ধারণা করা ভুল হবে না যে, সম্ভবত একদিকে তার অতৃপ্ত কামনা আর অন্যদিকে কামুকতার আংশিক উপশম হিসেবে তিনি নারী প্রতিমূর্তির, বিশেষ করে নিম্নাঙ্গের প্রতি অধিক যত্নবান। অবশ্য এটা তার জনপ্রিয়তার একটা অন্যতম উপায় হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। এখানে আমরা সুলতান, কামরুল হাসান, রেনোয়াঁ ও রুবেন্স-এর মধ্যে ঐক্যতান খুঁজে পাই ।

বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের অল্পকালের মধ্যে এদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য, গ্রাম্য পরিবেশ এবং জীবন অর্থাৎ এক কথায় মানুষ ও মাটি তার কাজের মধ্যে প্রাধান্য পায় । তথাপি তিনি পাশ্চাত্যের খ্রিস্টীয় ভাবধারা এবং শিল্পীদের প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি । তার আঁকা বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে কলস কাঁখে তরুণীদের সিক্ত বসনে চিত্রায়ন রুবেন্স-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, কোলকাতা ইনস্টিটিউট অব আর্ট-এ দু’বছর প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ১৯৪৫ সাল থেকে কেউ তার খোঁজ পায়নি । শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাছ থেকে জানা যায়, আত্মগোপন থাকাকালীন সময় তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের নৈকট্য লাভ করেন । কয়েক বছর তিনি সন্ন্যাসীদের সান্নিধ্যে থাকাকালীন সময় একদিকে তিনি মাদক দ্রব্য, বিশেষ করে গাঁজায় আসক্ত হয়ে পড়েন এবং অপরদিকে হিন্দু শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন । বিশেষ করে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী তাকে বিশেষভাবে মোহিত করে । ঐ সময় থেকে তিনি রাধার প্রতি দারুণ অনুরাগী অর্থাৎ প্রেমিক হয়ে পড়েন ।

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, সম্ভবত দীর্ঘদিন সন্ন্যাসীদের সান্নিধ্যে থেকে অতিরিক্ত মাদক দ্রব্য, বিশেষ করে গাঁজা সেবন এবং রাধার প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগের ফলে তার মধ্যে মায়া বা দৃশ্যমান বিভ্রম (Visual Hallucination) সৃষ্টি হয়। আর রাধার সাথে অবাস্তব প্রেম, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘প্লেটোনিক লাভ’ সৃষ্টি হওয়ার কারণে বিভ্রম সৃষ্টি হয়েছে ।

এখানে একটা কথা উল্লেখ করা সম্ভবত অবান্তর হবে না যে, তাকে প্রায়ই দেখা যায়, তিনি অদৃশ্য কোনো ব্যক্তির সাথে কথা বলেন, হাসেন ইত্যাদি এবং রাধার নাম করেন। এ থেকে মনে হয় যে, তার মধ্যে দৃশ্যমান ও সম্ভবত শ্ৰুতি উভয় বিভ্রম ঘটে থাকে । এই বিভ্রম থেকেই সম্ভবত তার মধ্যে বিঘ্নিত শারীরিক রূপকল্প অঙ্কুরিত হয়, যা পরবর্তীতে পঞ্চাশ দশকের মধ্য ভাগ থেকে ক্রমশ সিজোফ্রেনিয়ায় পরিণত হয় ।

রাধার মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে তিনি সারা জীবন রাধার ব্যর্থ অনুসন্ধান করে ফিরেছেন, যা তার পরবর্তী অনেক কাজের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে তিনি অনেকগুলো বাঁশের বাঁশি খোদাই করেন । এই খোদাই কাজের মধ্যে রাধা প্রাধান্য পায়।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, তিনি সে সময় ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। এদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তার ভালো জ্ঞান আছে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মধ্যে ইমনকল্যাণ তাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। কারণ তার ভাষ্য মতে, ইমনকল্যাণের পটভূমি হলো রাধা- কৃষ্ণের প্রেম বিরহ । কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে রাধার মনে যে বিরহ জাগে বিশেষ করে সন্ধ্যার সময়, সেই বিরহই ইমনকল্যাণের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়।

বাঁশি খোদাই করে তিনি এই সুর ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এসব কাজ এখন কোথায় আছে সে সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। এখানে একটি কথা বলা দরকার যে, তাপমাত্রা যন্ত্রের পারদ যেমন তাপমাত্রা ওঠানামার সাথে সাথে ওঠানামা করে তেমন মানসিক রোগাক্রান্ত রোগী বা ব্যক্তিদের আচার-ব্যবহারে পার্থক্য দেখা যায় ।

অর্থাৎ সিজোফ্রেনিক রোগীরা কখনো কখনো স্বাভাবিক ব্যবহার করে থাকে । আবার কখনো কখনো তাদের মধ্যে বিভ্রম সৃষ্টি হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। আর এই পার্থক্যের জন্যই শিল্পরসিক ও শিল্পানুরাগীরা এবং জনসাধারণ সুলতানকে ‘আধ্যাত্মিক’ ‘উদাসীন’ প্রভৃতি ভুল বিশেষণে ভূষিত করে থাকেন। বলা বাহুল্য, তার কাজগুলো অধিক কাল্পনিক হওয়া সত্ত্বেও বিস্ময়কর নয় ।

পঞ্চাশ দশকের শেষভাগ থেকে তিনি আবার আত্মগোপন করেন । তবে এবার তার অবস্থানের কথা জানা যায় । তিনি তার মাতৃভূমি নড়াইলে বাস করতে থাকেন । তবে এদেশের শিল্প আন্দোলন ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড থেকে অনেক দূরে সরে থাকেন। বলাবাহুল্য, তিনি সব সময় দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে আপন কল্পজগতে বাস করেন । জনশ্রুতি আছে, সমস্ত ষাট দশক ধরে তিনি চরম আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন ।

সন্দেহের অবকাশ নেই যে, তিনি নিজেই আত্মদৃষ্ট আর্থিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। ঐ সময় মাদকাসক্ত একাকী নিঃসঙ্গ জীবনের সাথে আর্থিক বিপর্যয় যুক্ত হয় । ষাট দশক তার জীবনের এক দুর্যোগময় সময় বলা যেতে পারে। দারিদ্র্য ও হতাশা তাকে গ্রাস করতে থাকে । ফলে তার মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা তার পরবর্তী দশক অর্থাৎ স্বাধীনতা উত্তরকালের কাজের ভেতর স্পষ্ট পরিস্ফুটিত হয়ে উঠে ।

পঞ্চাশ দশকের শেষভাগ থেকে প্রায় এক যুগ পরে ১৯৬৯ সালে তিনি শিল্পরসিক ও শিল্পানুরাগী এবং জনসাধারণকে বিস্ময়াভিভূত করে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমীতে একটা একক চিত্র প্রদর্শনী করেন । এই প্রদর্শনীতে কেবল একটা পেন্সিল এবং কালি কলমে আঁকা একটা রেখাচিত্রসহ ছোট বড় আয়তনের ৪০টি তেলচিত্র প্রদর্শিত হয় । এস এম সুলতানের সত্তর দশকের কাজের মধ্যে রূপান্তর লক্ষ্য করা যায় ।

প্রথম বৃক্ষরোপণ ছাড়া অন্যান্য কাজের ভেতর পাশ্চাত্যের অনুকরণ প্রবণতা অনেকাংশে হ্রাস পায় এবং স্বতন্ত্র ও মৌলিকতার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। কিন্তু মনুষ্য প্রতিমূর্তির মধ্যে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর শেষ জীবনের কিছু অসমাপ্ত ভাস্কর্য, রুবেন্স, ভ্যানগগ, গোগার অনুকরণ এবং যামিনী রায়ের অনুগমন প্রবণতা দেখা যায় কেবল একটি ছবির মধ্যে । অবশ্য বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশ, প্রাকৃতিক দৃশ্য, বৃক্ষ-লতা প্রভৃতির সার্বিক ব্যবহারের ভেতর বাস্তববাদ এবং ঐতিহ্যবাহী মোগল চিত্রের মধ্যে অবচেতনভাবে সংমিশ্রণের প্রবণতা লক্ষণীয় ।

এরই মধ্যে তার নিজস্ব স্বতন্ত্র ও মৌলিকতার সূচনা দেখা যায় । তবে মনুষ্য প্রতিমূর্তিগুলোর ভেতর উপরিউল্লিখিত শিল্পীদের উৎকট অনুকরণ প্রবণতা সার্বিক পরিবেশের সাথে অসঙ্গত, পীড়াদায়ক ।

বাংলাদেশের গ্রাম্য জীবন ও পরিবেশভিত্তিক চিত্রকর্মগুলোকে প্রামাণ্যধর্মী (Documentary Nature) চিত্রকর্ম বলা যেতে পারে। যার মধ্যে ইলাস্ট্রেশনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান । এগুলোকে তথ্য ও বর্ণনামূলক চিত্রকর্ম বা ইলাস্ট্রেটিভ বলে মনে হয় । এগুলোর ভেতর শৈল্পিক সমস্যা ও উৎকর্ষের চেয়ে কারিগরি (Craftsmanship) অধিক গুরুত্ব পেয়েছে ।

পূর্বেই বলা হয়েছে, পঞ্চাশ দশকের শেষভাগ থেকে তিনি প্রায় এক যুগ সময় আত্মগোপন বা আত্মনির্বাসিত হয়ে থাকেন। ঐ সময় তিনি নগর ও শহরাঞ্চল ছেড়ে গ্রামে বসবাস করতে থাকেন । গ্রামের কৃষক সমাজ এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজ তাকে আকৃষ্ট করে ।

পরবর্তী দশকে অর্থাৎ স্বাধীনতা উত্তরকালে তার কাজের ভেতর দু’টি বিষয় বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে; একটি হলো, কৃষিভিত্তিক সমাজ ও পল্লী পরিবেশ, আর দ্বিতীয়টি হলো, সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতার লক্ষণগুলোর স্পষ্ট প্রমাণ । এই কাজগুলো তথ্য ও কাহিনীসমৃদ্ধ এবং বর্ণনামূলক বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার মধ্যে বিস্তৃত কাহিনী এবং বস্তুর অনুপুঙ্খ বর্ণনার চেষ্টা দেখা যায়।

শিল্পের দার্শনিক আবেদন এবং মনোবিজ্ঞানের বিচারে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা হলো, তার পঞ্চাশ দশকের কৃষি সমাজের সুখ-দুঃখ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে স্বাধীনতা উত্তরকালের কৃষি সমাজের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক, ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, হানাহানি প্রাধান্য পেয়েছে ।

এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ষাট দশকের শেষ এবং সত্তর দশকের শুরু থেকে তার মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতা চরম অবস্থায় পৌঁছায়, যা তার দানবীয় আকারের নর-নারী প্রতিমূর্তির মধ্যে প্রকাশ পায় ।

এই কাজগুলোর মধ্যে তিনি সমস্ত প্রকৃতিকে সিজানের মতো মোট তিনটি আকারে রূপান্তরিত করেছেন; বৃত্ত, নল ও ঘনক । গাছগুলো নলাকৃতি, ঘরবাড়ি ও জন্তু, বিশেষ করে গরু, ঘনক এবং মানুষগুলোর মাংসপেশী বৃত্তাকার । বৃক্ষ, গুল্ম-তলার প্রতিটি পল্লব পৃথক পৃথকভাবে এবং প্রতিটি পল্লবের পাতা এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে, প্রতিটি পাতা একটা একটা করে গোনা যায়। নর প্রতিমূর্তির প্রতিটি মাংসপেশীর একেকটি একক হিসেবে রেখা দ্বারা বৃত্তাকারে বেষ্টিত করেছেন ।

যেজন্য প্রতিটি মাংসপেশী একই অস্তিত্বের মধ্যে এক একটি পৃথক একক বলে মনে হয়, যা নিজের মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করেছে । তার এসব কাজের মধ্যে ইউরোপের উচ্চাঙ্গ চিত্রকলার প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু নারী প্রতিমূর্তিগুলো ভিন্নতরভাবে আঁকা হয়েছে। ফলে তার অঙ্কনের মধ্যে অসামন্ত্রস্য ও অসঙ্গতি সৃষ্টি হয়েছে। আবার লতাপাতার অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্যে মোগল চিত্রকলার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

সত্তর দশক থেকে তেল মাধ্যমে তার ক্রমোবনতি লক্ষ্য করা যায়। ঐ সময় থেকে রংগুলো মলিন, অস্বচ্ছ ঘোলাটে ও কাদাকাদা এবং কালছে ধরনের হয়ে যায়। সার্বিক ট্রিটমেন্ট ও অঙ্কনের মধ্যে অসামঞ্জস্য ও অসঙ্গতি সৃষ্টি হয়েছে। যার মধ্যে দিয়ে তার মানসিক বিপর্যয় বা অবনতি অর্থাৎ সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সত্তর দশকের মধ্য ভাগে আঁকা প্রথম বৃক্ষরোপণ-এর মধ্যে নরমূর্তিটি আদি মানবের প্রতীকী উপস্থাপনা । প্রথম মানব অর্থাৎ হযরত আদম (আ) মাটির উপর বসে অগ্রভূমিতে একটা গাছের চারা রোপণ করছেন। তার মাথার উভয় পাশে দু’টি পরীর অবতারণা স্বর্গীয় আশীর্বাদের প্রতীক। কিন্তু হযরত আদম (আ)-এর কপালের উপর ক্ষুদ্র কয়েকটি রেখা এবং মুখভঙ্গি দেখে মনে হয় যে, তিনি এই পৃথিবীর ভবিষ্যত সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত ।

তিনি যেন তার ভবিষ্যত বংশধরদের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত ও বৈরী । তাই অনিচ্ছা নিয়েই গাছটি লাগাচ্ছেন । চারাগাছের মলিন পাতাগুলো দেখে মনে প্রশ্ন জাগে যে, তিনি তার ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে গাছ লাগাচ্ছেন নাকি দুর্ভাগ্যের বিষবৃক্ষ রোপণ করছেন? আদম (আ)-এর পাশে রাখা শোভেল থেকে তার পাশ্চাত্যের অনুকরণপ্রিয়তা প্রমাণিত হয় । কারণ আমাদের দেশে মাটি খনন বা কোপানো গাছের চারা লাগানো ইত্যাদি কাজে কোদাল ব্যবহার হয়ে থাকে, শোভেল নিষ্প্রয়োজন ।

আদমের মাংশপেশীগুলো অতিশয় অতিরঞ্জিত করার ফলে দানবীয় রূপ ধারণ করেছে । অবশ্য এটা হযরত আদম (আ)-এর প্রতীক না আদি মানবের প্রতীক সেটা বিতর্কিত । কিন্তু শিরোনাম ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’ এবং নরপ্রতিমূর্তির উভয় পাশে পরী বা ফেরেশতার উপস্থাপনের জন্য হযরত আদম (আ)-এর প্রতীক বলা হলে ভুল হবে না । বিষয়বস্তু উপস্থাপনা থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পাশ্চাত্যের খৃস্টীয় ভাবধারা চুরির প্রবণতা প্রমাণিত হয়।

যাহোক, নর প্রতিমূর্তির উভয়পাশে পরী প্রতিমূর্তির যৌনাঙ্গগুলোর উপর গুরুত্বারোপ করার ফলে এগুলো সাধারণ নারীমূর্তি বলে মনে হয় । যার মধ্যে স্বর্গীয় পবিত্রতার অভাব অনুভব করা যায় । অতএব ভাবের দিক থেকে বিচার করলে এটা একটা বিতর্কিত ছবি । আবার ভাবের দিক থেকে এটা স্বৰ্গীয় আশীর্বাদ না অভিশাপ তাও ঠিক বোঝা যায় না, সে দিক থেকেও বিতর্কিত ।

নর প্রতিমূর্তিটি সমগ্র রচনা অর্থাৎ নিচ থেকে উপর পর্যন্ত সমস্ত পরিসর জুড়ে নিয়েছে, যা ছবির মধ্যে এক সতল (One plaine) সৃষ্টি করেছে । বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত ভাব, রচনা কৌশল এবং প্রত্যেকটি প্রতিমূর্তি পৃথক পৃথকভাবে এমনভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে যে, প্রত্যেকটি প্রতিমূর্তি নিজের মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে হয় । এদিক থেকে বিচার করলে এই ছবিটির মধ্যে পাশ্চাত্যের উচ্চাঙ্গ চিত্রকলার প্রভাব ধরা পড়ে ।

শ্রমের পরে কৃষক ছবিটির মধ্যে রচনার উভয় পাশে দু’টি খেজুরগাছ। তার মাঝে দু’জন কৃষক লাঙ্গল কাঁধে জলাভূমির মধ্যে দিয়ে একহাঁটু জল ঠেলে গরু তাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরছে । রচনার ডানদিকে দু’জন কৃষাণী ক্ষেতে কাজ করছে । বৃক্ষ-লতায় ঘেরা শান্ত পর্ণকুটির, সবকিছু মিলে একটা সুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি হয়েছে। সার্বিক পরিবেশের ভেতর আমাদের দেশের অজপাড়াগাঁয়ের দৃশ্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে ।

খেজুরগাছ, বৃক্ষ-লতা, তৃণভূমিতে ঘাসের প্রতিটি পাতা একটি একটি করে যত্নসহকারে এঁকেছেন। কোনোকিছুই তার দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি ।

শরতের গ্রাম্য জীবন, খাল, জল আনা, কৃষকদের মাছ ধরা, লাঙ্গলের পিছনে, শাপলা তোলা, মাছ ধরা, পাট ধোয়া, ধান উড়ানো প্রভৃতি ছবিগুলোর রচনাভঙ্গির মধ্যে পাশ্চাত্য এবং মোগল চিত্রকলার সংমিশ্রণের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। তবে তিনি সচেতনভাবে সংমিশ্রণের চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয় না। সেজন্য মোগল চিত্রকলার পরোক্ষ প্রভাব দেখা যায়।

শরতের গ্রাম্য জীবন একটি বহু দৃশ্য সম্বলিত আড়াআড়িভাবে সুদীর্ঘ চিত্রকর্ম (Panaromic View)। যার মধ্যে গ্রাম্য জীবনের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায় । বামদিকে অগ্রভূমিতে একজন বেদেনী কিছু টুকিটাকি পণ্য নিয়ে একটা ডোবার পাশে বসে আছে । পাড়ার কয়েকজন মহিলা পণ্য নিয়ে তার সাথে দর কষাকষি করছে। রচনার প্রায় মাঝখানে কলাগাছের ফাঁক দিয়ে ছোট ছোট কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে ।

কয়েকজন মহিলা ঘাটে স্নান করছে । একটা ছোট শিশু পানি দেখে ভয় পেয়ে পালাবার চেষ্টা করছে, তার মা তাকে ধরে নিয়ে স্নান করাবার চেষ্টা করছে। কেউ বাড়ির পাশে খাল থেকে কলসে পানি ভরে বাড়ি ফিরছে । একটা বোঝাই গরুর গাড়ি বাড়ি ফিরছে । রচনার একেবারে ডানদিকে দু’জন কৃষক ধানের আঁটি মাথায় নিয়ে গরুর গাড়ি অনুসরণ করছে ।

ঘরবাড়ি, গাছপালাগুলো ক্রমশ ছোট আকারে হ্রাস পেয়ে দিগন্তরেখায় মিশে গেছে। দূরে দিগন্তরেখার কাছে মসৃণভাবে প্রবাহিত নদীর ভেতর বনানীর প্রতিফলন দেখা যায় । বিস্তীর্ণ ভূমি দূরে দিগন্ত রেখায় থেমে গেছে ।

এটা একটা ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামের এক প্রান্ত বলে মনে হয় । অগ্রভূমি ও পশ্চাদভূমির মধ্যবর্তী জায়গা, রচনার একেবারে ডানদিকে, খোঁটায় বাঁধা কয়েকটি গরু । তার পেছনে একটা বাড়ির আঙ্গিনায় কয়েকজন কৃষাণীকে কর্মব্যস্ত দেখা যায়। রচনার প্রায় মধ্যভাগে, উপরের অংশে একটা শস্য ক্ষেত বাঁশের বেড়া দ্বারা ঘেরা রয়েছে ।

রচনা কৌশলের দিক থেকে বলা যায় যে, তিনটি দৃশ্য একত্রে সংযোজন করা। হয়েছে। যে জন্য সমগ্র রচনা তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছে; ডান পাশ, মধ্যভাগ ও বাম পাশ । মূল রচনার প্রত্যেকটি অংশ অন্যান্য অংশকে বিঘ্নিত না করে পৃথক করা যায় । প্রতিটি বস্তু এমনভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে যে, প্রতিটি অংশ ও বস্তু এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে হয়। তালগাছ ও নারিকেল গাছের পাতা যদিও দিগন্ত রেখা ছাড়িয়ে আকাশ পর্যন্ত উঠেছে তবুও আকাশের একঘেয়েমি ভাব অনুভব করা যায় ।

বিষয়বস্তুর তুলনায় আকাশ একেবারে সমতল ও হালকা মনে হয়। দূরের গাছগুলো অতিরিক্ত বর্ণনার কারণে দৃষ্টি বিঘ্নিত হয় এবং দিগন্ত রেখা অতিক্রম করে অসীমের মধ্যে মিলিয়ে যেতে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। সার্বিকভাবে বলা যায়, বিষয়বস্তুর চয়ন, উপস্থাপন এবং অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের, বিশেষ করে যশোর জেলার গ্রাম্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ স্পষ্ট পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে।

গ্রামের খাল শীর্ষক ছবিটি এদেশের আর একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গ্রাম্য দৃশ্যের উপস্থাপনা । রচনার একেবারে বামদিকে একটি ছৈওয়ালা গরুর গাড়ি কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে চলছে । রাস্তার সাথে আড়াআড়িভাবে একটি ছোট খাল বা নালা পানিতে টইটম্বুর । রাস্তাটা আংশিকভাবে নালার পানিতে নিমজ্জিত।

গরুর পাগুলো আংশিক কাদার মধ্যে পুঁতে গেছে । কোনোরকমে মন্থর গতিতে চলছে। গরুর গাড়ির পেছনে দুটো তালগাছ ও আমগাছ দেখা যায়। দর্শকের দৃষ্টি গাছের উপর দিয়ে দূরে চলে যায় । কিন্তু দূরে নদীর ভেতর ভাসমান ডিঙ্গি নৌকায় হঠাৎ বাঁধা প্রাপ্ত হয়।

রচনার ডানদিকে একজন মহিলাকে তার শিশু সন্তানকে স্নান করাতে দেখা যাচ্ছে । তার পেছনে একজন মহিলা হাঁটু পানিতে একটা কলস ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কলসটা পানিতে ভাসছে । খালের অপর পাড়ে তিনজন তরুণী পানিতে নামছে। অপর একজন কিনারায় কাপড় কাঁচছে । খালের পাড়ে ছোট বাড়িগুলো দেখে মনে হয় তারা ঐ বাড়ির বাসিন্দা। বাড়িগুলোর পেছনে আম বাগানের মধ্যে দিয়ে খালটা আঁকাবাঁকাভাবে প্রবাহিত । দূরে একজন মাঝি নৌকা বাইছে । অগ্রভূমিতে বাঁশের বেড়ার বা পাটার ফাঁক দিয়ে স্রোত বয়ে চলেছে। স্রোতের কুলকুল শব্দ কানে বাজে

কিন্তু এরকম একটা বিস্তারিত বর্ণনামূলক বাস্তবধর্মী চরিত্র হঠাৎ গরুগুলোকে বিকৃতভাবে অঙ্কন এবং পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহারে দ্বন্দ্ব ও বৈষম্য বা সংঘাত অমার্জনীয় ত্রুটি হিসেবে গণ্য হয় । ছবিটির উভয় পাশে বিষয়বস্তু ক্রমশ প্রসারিত হয়ে ক্যানভাসের উপরের কিনারায় কেটে গেছে। কিন্তু রচনার মধ্যভাগে আম বাগানের ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যমান দিগন্তরেখা অনেকটা নিচে স্থাপিত হয়েছে। ফলে দিগন্তরেখা সিঁড়ির ধাপের মতো ধাপে ধাপে উপরে উঠে গেছে মনে হয়। যেজন্য একই ছবির মধ্যে দু’টি দিগন্ত রেখা সৃষ্টি হয়েছে, যা অমার্জনীয় ত্রুটি হিসেবে গণ্য হতে পারে ।

পানি আনা ছবিটির উপস্থাপনার মধ্যে কিছুটা কাব্যিক ভাব পাওয়া যায়। অবশ্য পূর্বেই বলা হয়েছে, সুলতানের কাজগুলো কঠিন বাস্তবধর্মী। তাই কবিত্বের কোনো অবকাশ নেই । কেবল বিষয়বস্তু এবং পল্লী পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার জন্য কিছুটা কাব্যিক মনে হয় ।

পল্লী অঞ্চলে নির্জন জঙ্গলের মধ্যে একটা সুরু নালা দিয়ে সামান্য পানি ঝিরঝির করে প্রবাহিত হচ্ছে । নালার পানি শুকিয়ে গেছে। তলদেশে পানির শীর্ণ ধারা বয়ে যাচ্ছে । নালার দু’পাড় ঝোপঝাড়ে ঘেরা। দু’পাশে আম, জাম, নারিকেল, বাঁশ প্রকৃতির ঘন জঙ্গল। তার মাঝে কয়েকটা পর্ণকুটির। সার্বিক পরিবেশ যেন ‘ছায়া সুনিবীড় শান্ত

নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি/ পল্লবঘন আম্র কাননে, চরণ দু’টির চিত্রায়ন বলে মনে হয় । একজন মহিলা শীর্ণ স্রোতের ধারা থেকে কলসে পানি ভরে বাড়ি ফেরার জন্য প্রস্তুত, আর একজন পানি নিতে এসেছে। নালার ঢালু পাড়ের গা বেয়ে সতর্কভাবে নিচে নামছে।

বৃক্ষ, গুলু-লতার প্রতিটি শাখা-প্রশাখা, এমন কি প্রতিটি পাতা খুঁতখুঁতেভাবে যত্ন সহকারে এঁকেছেন সুলতান। কিন্তু সে তুলনায় পশ্চাদভূমিতে ঘরগুলো কিছুটা উপেক্ষিত হয়েছে বলে মনে হয় । এ কারণে কিছুটা ছন্দ পতন ঘটেছে ।

দিগন্তরেখা ক্যানভাসের অর্থাৎ রচনার একেবারে উপর অংশে স্থাপিত করে সুপ্রশস্ত অগ্রভূমি দেখানো হয়েছে। ঘরগুলো প্রায় দিগন্তরেখার উপর স্থাপিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটা তার রচনা ও উপস্থাপনার একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু পরিদৃশ্যানুযায়ী (Perspective) ঘরের চালগুলো নিমাভিমুখে ক্রমশ ঢালু হয়ে দিগন্ত রেখার সাথে এক বিন্দুতে মিলিত হওয়ার পরিবর্তে ঊর্ধ্বাভিমুখে উঠে গেছে। ফলে পরিদৃশ্য ব্যবহারে দ্বিধা ও অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য এমনও হতে পারে যে, অন্যমনস্কতার কারণে এই ত্রুটি দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে ।

কিন্তু এটা বিতর্কিত। কারণ তার সমস্ত, বিশেষ করে হাল আমলের, কাজগুলো পরীক্ষা করলে সমস্ত চিত্রকর্মের মধ্যে এই ত্রুটি ধরা পড়ে। সুতরাং বলা যায়, পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে তার ভালো জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তার মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব দেখা যায় ।

লম্বভাবে দণ্ডায়মান সোজা গাছগুলো, অগ্রভূমিতে নারী প্রতিমূর্তিগুলোর দেহের বাঁক এবং অর্ধাবৃত্তকার নারিকেল গাছের বক্ররেখাকে গতিশীল করে তুলেছে। গতিশীল বক্ররেখা (Dynamic curve line) এবং নিশ্চল সরলরেখার (Static) সুন্দর সমন্বয় তার কাজের আর একটি বৈশিষ্ট্য।

বর্ষা শেষে শরতের আগমনের সাথে সাথে খাল-বিল, নদী-নালার পানি শুকাতে শুরু করে । গ্রামগঞ্জের আশপাশে মাছ ধরার হিড়িক পড়ে যায়। গ্রামের পাশে কাঁচা রাস্ত তার ধারে কয়েকজন কৃষক বা গ্রামের লোক মাছ ধরছে। এমন একটা দৃশ্য আমাদের কাছে অতি পরিচিত । এ নিয়েই ছবি এঁকেছেন সুলতান।

রচনার একেবারে বামদিকে কয়েকজন লোক পোলো দিয়ে মাছ ধরছে। রাস্তার অপরপাশে মাঠের মধ্যে একজন কৃষক ধান কাটছে এবং আর একজন ধানের আঁটি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছে। উঁচু নিচু কাঁচা রাস্তার কোনো কোনো জায়গা এখনো আংশিকভাবে জলমগ্ন রয়েছে। রচনার ডানদিকে নালার গা ঘেঁষে একটা পায়ে চলা পথ আম গাছের নিচে রাস্তার বামদিকে আর একটা রাস্তার সাথে মিশে আঁকাবাঁকাভাবে দূর-দূরান্তে চলে গেছে। ডানদিকের রাস্তা দিয়ে একটা গরুর গাড়ি ধান বোঝাই করে বাড়ি ফিরছে। সবকিছু মিলে সুন্দর বর্ণনার ভেতর দিয়ে পল্লী জীবন ও পরিবেশের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় ।

এসবের ভেতর আসন্ন নবান্নের পদধ্বনি শোনা যায় । যার মধ্যে কৃষকদের বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে এবং শিল্পীর কল্পিত ‘সোনার বাংলা’র শুধু শিল্পী নয়, সমস্ত বাংলাদেশীদের চিরকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের প্রতিফলন রয়েছে। সৈয়দ আলী আহসান তার কৃষিভিত্তিক চিত্রকর্ম সম্বন্ধে লিখেছেন ‘তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন: শস্য বপণের মধ্য দিয়ে একজন কৃষক একটি প্রত্যয়ের জন্ম দেয়, একটি বিশ্বাসের জন্ম দেয়, জীবনে জয়যাত্রার একটি অহঙ্কারের জন্ম দেয়।’

গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ ধরে দৃষ্টি আঁকাবাঁকাভাবে দূর থেকে দূরত্তে চলে যায় । কিন্তু অগ্রভূমিতে নরমূর্তিগুলোর পেছনে রাস্তার পাশে দু’টি ছোট আকারের নরমূর্তি অনুপাত বহির্ভূত । ফলে অনুপাতহীনতার জন্য দৃষ্টি-ইন্দ্ৰীয়ে ঝাঁকুনি সৃষ্টি হয়। শাপলা তোলা-এর মধ্যে একজন নারী একটা ডোঙ্গায় চড়ে পানি থেকে শাপলা তুলছে। অপর একজন মহিলা পানির কিনারায় শাপলা নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তারা শাপলা তুলছে সৌখিনতার জন্য নয়— খাবারের জন্য তুলছে। আর একজন লোক ডোঙ্গায় করে কিছু ধান নিয়ে বাড়ি ফিরছে।

সার্বিক পরিবেশের মধ্যে আসন্ন বন্যার ভয়াবহতা অনুমান করা যায়। এ ছবিটি কাগজের উপর কয়লা দিয়ে আঁকা । বাড়ির চারদিক জলমগ্ন, ক্রমশ পানি বাড়ছে । তাই সতর্ক কৃষক বন্যার ভয়াবহতা অনুমান করে। আগেই যতটা সম্ভব ধান কেটে নিয়ে বাড়িতে তুলছে। অন্যথায়, সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যাবে।

সার্বিক পরিবেশের ভেতর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা ও আর্থ-সামাজিক অসচ্ছলতার প্রকাশ পেয়েছে। এমন মনে হয় যে, তারা যেন জল- কেলির জন্য শাপলা তুলে আনন্দ উপভোগ করছে। ফলে ভাবের দিক থেকে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।

আলোচিত চিত্রকর্মগুলো সুলতানের কারিগরি দক্ষতার প্রমাণ বহন করে । আগেই বলা হয়েছে যে, বিশেষভাবে তার এসব কাজ গ্রামবাংলার প্রামাণ্যধর্মী চিত্রকর্ম। যার মধ্যে ইলাস্ট্রেশনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। সার্বিকভাবে বলা যায়, এগুলো গ্রামবাংলার প্রতিনিধিত্বশীল চিত্রকর্ম । কিন্তু তার নারী মূর্তিগুলোর দৈহিক গঠন এবং শাড়ি পরার ভঙ্গির ভেতর দক্ষিণ ভারতীয় এবং অজন্তা গুহ্য চিত্রের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

বিশেষভাবে বলা যায়, নারী মূর্তিগুলোর যৌনাঙ্গগুলো স্পষ্টভাবে দেখানোর দিকে দারুণ ঝোঁক রয়েছে । যার মধ্যে একদিকে তার যৌন বিষয়ে দারুণ কৌতূহল প্রকাশ পেয়েছে অন্যদিকে এদেশের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বহির্ভূত । এটাকে পাশ্চাত্যের প্রভাব বা অনুকরণ প্রবণতা হিসেবে বিবেচনা করা যায় ।

পঞ্চাশ দশকের শেষ অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে তার পেন্সিলে আঁকা কয়েকটি রেখাচিত্রের ভেতর পাশ্চাত্যের রোমান্টিকবাদ এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন- ‘The Chased’-এর ভেতর রোমান্টিকবাদী দেলাক্রোয়া’র আঁকা ‘Hercules and the Lion’ এবং আমেরিকার জন কোপলের ‘Captain Watson & the Shark’ শীর্ষক ছবিগুলোর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

কিন্তু সত্তর দশকের মধ্যভাগ অর্থাৎ ১৯৭৬ সাল থেকে তার মধ্যে দারুণ পরিবর্তন দেখা যায়, যা তার পূর্ববর্তী সমস্ত কাজ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বললে ভুল হবে না । ঐ সময় থেকে তার মানুষ্য, বিশেষ করে নর মূর্তিগুলো, হঠাৎ দানবীয় আকার ধারণ করে ।

উদাহরণস্বরূপ বোঝা, প্রথম বৃক্ষ রোপণ, চর দখল, শস্য সংগ্রহ, স্মৃতি মন্থন প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম বৃক্ষরোপণ সম্বন্ধে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং এর পুনরাবৃত্তি না করে অন্যগুলো এখানে আলোচনা করা হলো। এই কাজগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে নর মূর্তিগুলো অতিশয় শক্তিশালী ও বিশালকায় (Colossal) দেখানো হয়েছে।

মাংসপেশীগুলো মাত্রাতিরিক্ত অতিরন্বিত করার প্রবণতা দেখা যায়। প্রতিটি মাংসপেশী এমনভাবে গঠিত হয়েছে যে, এগুলো রক্ত-মাংসের শরীরের অঙ্গ না হয়ে কঠিন পাথরের নুড়ি মনে হয় । ফলে এগুলো বর্তমান যুগের মানুষের পরিবর্তে কল্পিত বা গুহা যুগের মানুষ বলে মনে হয়।

দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে বলা যায়, তিনি জীবন সম্বন্ধে যে বাণী আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে, তার বিপরীতটাই স্পষ্ট উচ্চারিত হয়েছে। ‘বোঝা’র মধ্যে তিনি বলতে চেয়েছেন যে, মানুষের জীবনটা একটা মস্ত বড় বোঝাস্বরূপ । মানুষ জন্ম থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই বোঝা বয়ে নিয়ে চলে । সৈয়দ আলী আহসানের কথায় বলা যায়; ‘কর্ম জীবন ও জীবনবোধ মানুষের মধ্যে যে প্রত্যয়ের জন্ম দেয়, একটা বিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং একটা অহংকারের জন্ম দেয়। তাই মানুষের মধ্যে এই বোঝা বহনের শক্তি, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগায় ।

কিন্তু নরমূর্তির মুখভঙ্গি এবং অতিশয় শক্তিশালী, দৃঢ়কায় দানবাকৃতির দৈহিক গঠনের জন্য তিনি যে বাণী আমাদের দিতে চেয়েছেন তার বিপরীতটাই উচ্চারিত হয়েছে । নরমূর্তির মুখভঙ্গির ও চোখের চাহনির ভেতর দিয়ে হিংস্র, বর্বর ও দারুণ আক্রোশ ফুটে উঠেছে ।

এমন মনে হয় যে, একটা দানব বা দানবরূপী মানুষ একজন অসহায় নারীকে তার শিশুসহ জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। কোলের শিশুটি যেন মায়ের নিরুপায় ও অসহায় অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে কোল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। দু’হাত বাড়িয়ে সাহায্যের জন্য আকুলভাবে চেয়ে আছে— যদি কেউ তাদের এই দানবের হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে।

বস্তুত মানুষের মধ্যে যে হিংস্র, পৈশাচিক প্রবৃত্তি রয়েছে তার কাছে যেন নিষ্কলুষতা ও পবিত্রতা আত্মসমর্পণ করেছে। এক কথায় শক্তির কাছে সত্য পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করেছে। ‘বোঝা’ তারই প্রতীকী উপস্থাপনা ।

শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়, রচনাশৈলীর দিক থেকে জয়নুল আবেদিনের গুণ টানার অনুকরণ প্রবণতা বা প্রভাব বিদ্যমান। কিন্তু জয়নুলের গুণ টানার মধ্যে রচনা কৌশলের জন্য যে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে এবং ভারসাম্য রয়েছে। সুলতানের ‘বোঝা’র ভেতর সে উত্তেজনা ও ভারসাম্যের অভাব অনুভূত হয় । রচনা বা ক্যানভাসের একেবারে বামদিকে নরমূর্তিতে দৃষ্টি একেবারে আবদ্ধ হয়ে থাকে। ফলে ক্যানভাসের ডান দিকটা একেবারে হালকা, শূন্য পরিসর বলে মনে হয় ।

অনুরূপভাবে চরদখল-এর মধ্যে একদল আদি বর্বর জাতি তাদের নিরীহ প্রতিবেশীদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের ঘরবাড়ি সবকিছু দখল করে নিতে যাচ্ছে। একইভাবে ‘শস্য সংগ্রহ’র মধ্যে কৃষকদের আনন্দের এবং সৌহার্দ্যের পরিবর্তে আক্রোশ ও সংঘর্ষের উপক্রম প্রকাশ পেয়েছে। রচনার একেবারে বামদিকের দু’জন নরমূর্তির ভঙ্গি থেকে মনে হয় যে, একদল কৃষক (ডানদিকে) শস্য সংগ্রহ করার সময় অন্য দল তাদের ভীষণভাবে আক্রমণ করতে যাচ্ছে।

লাঙলের পিছনে ছবির মধ্যে কয়েকজন কৃষক গ্রীষ্মের দারুণ খরায় মাথাল মাথায় দিয়ে ক্ষেতে লাঙল চষছে। উত্তপ্ত রোদে গরুগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আর যে পা চলে না। তবুও অতিকষ্টে লাঙল টেনে চলেছে। লাওলের তীক্ষ্ণ ফলা শুষ্ক কঠিন মাটি চিরে চলছে। মাটি চেরার মৃদু শব্দ যেন কানে এসে বাঁজে। বিশেষভাবে তার এই চিত্রকর্মটি এবং সার্বিকভাবে অন্য সব কাজের মধ্যে ভ্যান গগের নরমূর্তি এবং আঙ্গিকের হুবহু অনুকরণ প্রবণতা স্পষ্টভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে । তার স্মৃতি মন্থন-এর মধ্যে বক্তব্য অস্পষ্ট, কিসের স্মৃতি মন্থন করছে তা বোঝা যায় না ।

অতএব বলা যায়, শিরোনামের সাথে বিষয়বস্তুর কোনো সম্পর্ক নেই । এমন মনে হয় যে, কোনো পূর্ব-পরিকল্পনা ছাড়াই অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে কিছু নর প্রতিমূর্তি এঁকেছেন এবং পরে এই শিরোনাম নির্ধারিত করেছেন ।

স্মৃতি মন্থন-এর অগ্রভূমিতে নিকটতম উপবিষ্ট নরমূর্তির মধ্যে গোগার তাহিতিবাসীর অনুকরণ প্রবণতা বা প্রভাব দেখা যায় । পশ্চাদভূমিতে কুঁজোভাবে উপবিষ্ট নরমূর্তিগুলোর মভেতর রোদা’র ভাস্কর্য দ্যা হিংকার এর অনুকরণ ধরা পড়ে, যার মধ্যে একই ভঙ্গি বারে বারে বিচ্ছিন্নভাবে অবতারণা করা হয়েছে। ফলে প্রতিমূর্তিগুলো পরস্পর পরস্পরের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে। সেজন্য এর ভেতর কোনো বাণী বা তথ্য পাওয়া যায় না ।

চরদখল-এর রচনা কৌশলের ভেতর কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা, সার্বিক ব্যবহার (ট্রিটমেন্ট), নর প্রতিমূর্তিগুলোর মুখাবয়ব ও দৈহিক গঠন এবং অস্ত্রশস্ত্র ঢাল, তড়কি, বল্লম-সবকিছু একত্রে মিলিতভাবে মনে হয় যে, এটা ইতিহাসভিত্তিক আদি যুগের কোনো ইলাস্ট্রেশন। ফলে নরমূর্তিগুলোর সাথে এদেশের কৃষক সম্প্রদায়ের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। উপরন্তু, এগুলোর সাথে আফ্রিকা ও ককেশীয় জাতির সাদৃশ্য দেখা যায় ।

ধান উড়ানো শীর্ষক ছবিটি হঠাৎ একটা ব্যতিক্রমধর্মী চিত্রকর্ম, যার সাথে তার পূর্বের এবং পরবর্তী কোনো কাজের সম্পর্ক নেই। দু’জন মহিলা আঙিনায় দাঁড়িয়ে কুলো দিয়ে বাতাসে ধান উড়াচ্ছে, অন্য দু’জন মাটির উপর বসে কুলো দিয়ে ধান ঝাড়ছে । আঙিনার ডানপাশে অর্থাৎ প্রতিমূর্তিগুলোর বিপরীত দিকে একটা ঝাটা ও একটা ঝুড়ি আভিনার উপর পড়ে আছে। দু’টি মোরগ-মুরগি ধান খুঁটে খাচ্ছে । আঙিনার অপর পাশে কুঁড়েঘরের বারান্দার উপর বসে একজন মহিলা কোলের শিশুকে স্তন দিচ্ছে। ঘরের পেছনে বড় একটা আম গাছ ।

খোলা আঙিনা থেকে বহিঃদৃশ্য দেখা যায়। বাড়ির পাশে ছোট ডোবার ভেতর কয়েকটা পাতি হাঁস সাঁতার কাটছে । ডোবার পাশে মাঝারি আয়তনের একটা জলাশয় ।

জলাশয় থেকে কলসেতে পানি ভরে তিনজন মহিলা বাড়ি ফিরছে । পশ্চাদভূমিতে গ্রামের শেষ প্রান্ত, তার পর প্রশস্ত খোলা মাঠ, দিগন্তরেখার কাছে আকাশে সাদা মেঘের ভিড় । সামনের চারজন মহিলা অর্থাৎ মূল প্রতিমূর্তিগুলোকে নিকটতম কোণ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এগুলোর ভেতর ঐতিহ্যবাহী রাজপুত চিত্রকলা এবং আংশিকভাবে যামিনী রায়ের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । নারী প্রতিমূর্তিগুলোর মুখাবয়ব ও দৈহিক গঠনের ভেতর রাজপুত মহিলা শাড়ি পরার ভঙ্গির ভেতর দক্ষিণ ভারতীয় ভাব লক্ষ্য করা যায় । অলঙ্কার ব্যবহারের ভেতর অজন্তা গুহার ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ছায়া বিদ্যমান ।

রচনার একেবারে ডানদিকের প্রতিমূর্তি দুটির দাঁড়ানো অবস্থায় এবং মধ্যভাগে প্রতিমূর্তি দু’টি উপবিষ্ট অবস্থায় দেখানো হয়েছে। আবার রচনার একেবারে বামদিকে অগ্রভূমিতে ঝাটা, ঝুড়ি, মোরগ-মুরগি এবং পশ্চাদভূমিতে তিনজন মহিলা এবং পাঁতি হাঁস দূরবর্তী কোণ থেকে অবতারণা করা হয়েছে। ফলে দ্বি ও ত্রি-আয়তন ধারণার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। রচনার মধ্যভাগের প্রতিমূর্তি দু’টি যেন শূন্যের মধ্যে বসে আছে মনে হয়

বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, প্রধান নারী প্রতিমূর্তিগুলো উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলার আঙ্গিকে, ঘরের পাশের বড় আম গাছটির পাতাগুলো কিছুটা বিমূর্ত ঢংয়ে এবং মোরগ-মুরগি, ঝুড়ি, ঝাটা, বহিঃদৃশ্য ও তার ভেতর তিনজন মহিলা এবং হাঁস প্রতিচ্ছায়াবাদী আঙ্গিক ব্যবহার করা হয়েছে। এমন মনে হয় যে, দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্রকর্ম একই ক্যানভাসে সুকৌশলে সংযুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে । এই চিত্রকর্মটি পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তার মধ্যে সমস্ত বিষয়ে দ্বন্দ্ব, বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা স্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে।

স্বাধীনতা উত্তরকালে অর্থাৎ সত্তর দশকের প্রথমদিকে তার কিছু কাজের ভেতর একটা বিষয় স্পষ্ট ধরা পড়ে। সেটা হলো, জয়নুল আবেদিনের প্রতি তার ঈর্ষা। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ষাট দশকের শেষ এবং সত্তর দশকের শুরুতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জয়নুল আবেদিন নবান্নভিত্তিক এবং ১৯৭০ সালে দক্ষিণাঞ্চলের জলোচ্ছ্বাসের উপর যে বহু দৃশ্যপূর্ণ সুদীর্ঘ চিত্রকলা রচনা করেন তা তার ৪৩ সালের সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পুনরায় নবায়িত করে তোলে। জয়নুলের এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবিতর্কিত সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা সুলতানের মধ্যে ঈর্ষার উদ্রেক করে । তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি কিছু বহু দৃশ্যপূর্ণ বৃহদায়তনের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা করেন

সুলতান বৃহদায়তনের ক্যানভাসে ঐতিহাসিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে মনুষ্য সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের বিষয়বস্তু উপস্থাপনা করেন (সচল সবাক ইতিহাস ছবিটি ১৯৮৭ সালে ঢাকাস্থ জার্মান সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রদর্শিত হয়) । কিন্তু এটাকে একটা বহু দৃশ্যপূর্ণ সুদীর্ঘ চিত্রকর্ম না বলে ঐতিহাসিক তথ্যমূলক পৃথক পৃথক কতকগুলো ইলাস্ট্রেশন একত্রে সংকলিত করা হয়েছে বললে ঠিক হবে। কারণ উপস্থাপনার ভেতর বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা পুনঃ পুনঃ ব্যাহত হয়েছে এবং ইলাস্ট্রেশনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

চিত্রকর্মটি পরীক্ষা করলে মনে হয় যে, একই বিষয়বস্তুকে সামান্য পরিবর্তন করে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং জোরপূর্বক বিবর্তনের ধারাবাহিকতা দেখানোর প্রচেষ্টা করা হয়েছে।

বিষয়বস্তুগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, বিষয়-বস্তুগুলোর মধ্যে সম্পর্কহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিবর্তনের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে। তাছাড়াও, বিশেষ করে এটা একটা বাস্তবধর্মী চিত্রকর্ম। এদিক থেকে বিচার করলে পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহারে ভুল-ত্রুটি ধরা পড়ে।

বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা ও বিবরণ থেকে বোঝা যায়, ইতিহাস এবং নৃতত্ত্ব সম্বন্ধে তার জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, এই চিত্রকর্মটি শুরু করার আগে কোনো পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়াই এবং ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব অধ্যয়ন না করে অত্যন্ত ভাসা ভাসা জ্ঞানের উপর নির্ভর করে কাজটি শুরু করেন।

বলাবাহুল্য, ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার কারণ অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, জয়নুল আবেদিনের প্রতি তার ঈর্ষা এবং তার উপর জয়নুলের প্রভাব জনসাধারণের কাছে গোপন করার জন্যই বৃহদায়তনের ক্যানভাসে এই বিষয়বস্তুর উপস্থাপন করা হয়েছে । কিন্তু ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কেবল ক্যানভাসের বৃহদায়তন ছাড়া আর কিছুই উল্লেখের দাবি রাখে না।

তার আরেকটি তুলনামূলক বৃহদায়তনের ক্যানভাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা দেখা যায়। (‘৭১-এর গণহত্যা ১৯৮৭ সালে জার্মান সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রদর্শিত হয়েছিল)। যার বিষয়বস্তু হলো, একটি বড় বট গাছের একটা অংশ-শাখা, প্রশাখা এবং কিছু পাতা সমস্ত ক্যানভাস বা পরিসর জুড়ে নিয়েছে । পাকবাহিনী অনেক মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করে পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে রেখেছে।

বিষয়বস্তুর চয়ন ও উপস্থাপনার ভেতর দিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আত্ম-বিসর্জনের ভেতর নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের মহত্ত্ব এবং অপরদিকে পাকবাহিনীর পৈশাচিকতা এবং যুদ্ধের বীভৎসতা ফুটে উঠেছে।

কিন্তু সুষ্ঠু চিন্তা, পরিকল্পনা ও দক্ষতার অভাবে এই ছবিটি রাজনৈতিক ও দার্শনিক আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে । সেজন্য দর্শকদের মনে দাগ কাটতে পারেনি । কারণ বট গাছটি সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীক নরমূর্তিগুলো জায়গার অভাবে অর্থাৎ যুক্তিসঙ্গত পরিসরের অভাবে ঝুলানো বা উপস্থাপনার কোনো অবকাশ ছিল না।

যেজন্য নরমূর্তিগুলোকে হঠাৎ এমনভাবে ক্ষুদ্রাকারে বিকৃত করে ঝুলানো হয়েছে। ফলে প্রথম দেখলে মনে হয় যে, বট গাছের ডালে কতকগুলো বাদুড় ঝুলছে। ফলে দর্শকদের এগুলোকে নরমূর্তি বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবিষ্কার করতে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়। সুলতান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীকী নরমূর্তিগুলো যেভাবে বিকৃত করে ঝুলিয়ে রেখেছেন তার তুলনায় পাক-সেনাদের পৈশাচিকতা অনেক লঘু মনে হয় ।

ছবিটি পরীক্ষা করলে মনে হয়, প্রথমে তিনি বট গাছটিকে প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন অর্থাৎ কেবল বট গাছটিই ছিল মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু কেবল জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে পরবর্তীতে অযৌক্তিকভাবে জোর করে কিছু নরমূর্তি উল্টো ঝুলিয়ে রাজনৈতিক ও দার্শনিক আবেদন সৃষ্টি করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেন। যার মধ্যে সুষ্ঠু চিন্তা, পরিকল্পনার দারিদ্র্য এবং অদক্ষতাই স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

সন্দেহের অবকাশ নেই যে, একমাত্র জনপ্রিয়তা অর্জনই যদি বুদ্ধিমত্তা কর্মকাণ্ডের মুখ্য উদ্দেশ্য হয় তাহলে এমন বিভ্রাট ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তবে তার প্রতি সহানুভূতি সহকারে এটুকু বলা যায়, তার মতো একজন অভিজ্ঞ শিল্পীর পক্ষে কোনো পরিকল্পনা ছাড়া এবং প্রচুর অধ্যয়ন না করে। উপরে আলোচিত বিষয়বস্তুগুলো উপস্থাপন করা সঠিক হয়েছে বলে মনে হয় না। অবশ্য তার মতো একজন মানসিক রোগগ্রস্ত শিল্পীর কাছে অপরিকল্পিত বিকৃত চিন্তার প্রকাশই স্বাভাবিক।

বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তরকালে সুলতানের কাজগুলো পরীক্ষা করলে পূর্ববর্তী দশক থেকে দ্রুত অবনতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এই সময় থেকে তার কলা-কৌশল জ্ঞান এবং দক্ষতার অভাব দারুণভাবে লক্ষ্য করা যায়। রংগুলো অস্বচ্ছ, মলিন কাদাকাদা হয়ে যায় । তবে বিষয়বস্তুর দিক থেকে গ্রাম্য পরিবেশ ও কৃষি সমাজের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ থাকে । এদিক থেকে বিচার করলে বি. কে. জাহাঙ্গীরের ভাষায় তাকে একজন কৃষক শিল্পী বা A peasant in the art world’ বললে ভুল হবে না।

তার সত্তর দশকের দানবাকৃতির নর-নারীর জন্য তাকে অনেক সময় সমালোচক ও জনসাধারণের কাছে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি এর ব্যাখ্যা যাই করুন না কেন, সেটা যুক্তিসঙ্গত ও সন্তোষজনক না। তিনি ঝুঝতে পারেন যে, এই দানবাকৃতির মনুষ্য প্রতিমূর্তির জন্য শীঘ্রই তাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে এবং জনপ্রিয়তা একেবারে না হারালেও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।তাই তার পরবর্তী কাজের মধ্যে মানব প্রতিমূর্তি দানবাকৃতির পরিবর্তে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে- তারা সুঠামদেহী, বলিষ্ঠ, স্বাস্থ্যবান মানুষ । এই সময়ের কাজের ভেতর তিনটি বিষয় বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।

প্রথমত, নর প্রতিমূর্তিগুলো স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান এবং নারীমূর্তিগুলোর ভেতর ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলা এবং অলঙ্করণের মধ্যে অজন্তা গুহা চিত্রের প্রভাব; দ্বিতীয়ত, হিংসাত্মক বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা এবং তৃতীয়ত, মানসিক রোগ বা সিজোফ্রেনিয়া প্রবণতার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন— চর দখল, Rural People With Lethal Weapon, Farmers in Confrontation, Confronting farmers. At Leisure প্রভৃতি কয়েকটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হলো।

উল্লিখিত কাজগুলো মনস্তাত্ত্বিক ও সাইকিয়াট্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে মনে হয় যে, তার মধ্যে নির্যাতন ও নিপীড়ন মনোভাব অর্থাৎ স্যাডিস্টিক প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে, যা সিজোফ্রেনিয়ার চরম অবস্থা বলা যায়। যেমন— ভ্যান গগের কথা উল্লেখ করা যায় যে, তিনি একদিন ধারালো খুর নিয়ে গোগাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে শেষ পর্যন্ত নিজের কান কেটে ফেলেন। অবশ্য সুলতানের তেমন বহিঃপ্রকাশ ঘটবে কিনা সে

কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে বলা যায় যে, চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে এই আক্রোশ বা প্রবণতা প্রকাশ পেলে হয়তো আক্রোশের কিছুটা উপশম হবে বলে আশা করা যায় । তার হাল আমলের কাজগুলো দেখে স্পষ্ট ভাষায় বলতে হয় যে, চরম অবনতি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। এগুলো দেখে মনে হয় যে, কোনো অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অনভিজ আনাড়ী ব্যক্তির বা অদক্ষ সাইনবোর্ড চিত্রকর অথবা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রছাত্রীর আঁকা চিত্রকর্ম ।

এতদ্বসত্ত্বেও বিভিন্ন শিল্পরসিক, বিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা যেসব শ্রেষ্ঠ গুণবাচক বিশেষণ তার সম্বন্ধে ব্যবহার করেছেন এবং মূল্যায়ন করেছেন তা কতটা যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য তা ভেবে দেখার বিষয়। এতে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তাদের বক্তব্যের সাথে সুলতানের কাজের কতটা সম্পর্ক আছে ও সঠিক সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

সুলতান সম্বন্ধে বিভিন্ন শিল্পরসিক ও অনুরাগীদের মন্তব্যের আংশিক উদ্ধৃতি আমি এখানে আলোচনা করতে চাই । বর্তমান ও গত দশক অর্থাৎ সত্তর ও আশি দশক পর্যন্ত সুলতানের আঁকা নর প্রতিমূর্তিগুলো সম্বন্ধে আনিসুজ্জামান লিখেছেন: “What Sultan brings about in these figures is essentially their inner vitality in which the artist has a great confidence. ”

কবীর চৌধুরীর মতে, “In their bulging muscels, their vigorous torso, their overpowering vitality, their well- rounded buttocks, and swelling breasts ready to come to grips with life without fear or hesitation of any kind. They were heroes and he painted them as such posed for struggle and victory, in his portrayal, the land and its people undergo a complete metamorphosis. human figures execute the fresh vigour and vitality of the virgin soil, strength and beauty contained in a poetic-harmony.”

সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, “সুতরাং বাস্তবের প্রতিচিত্রণ না করে তিনি একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন কৃষকদের আর্তমূর্তি আঁকেননি, জীবন সৃষ্টির সহায়ক রূপে কৃষককে দেখেছেন । তাই তার কৃষকগুলোর পেশীবহুল এবং বলিষ্ঠ এবং প্রত্যয়ী, রমণীরাও বলিষ্ঠ ও স্বাস্থ্যবতী” ।

উদ্ধৃত মন্তব্যগুলো পরীক্ষা করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শিল্পরসিক ও শিল্পানুরাগীরা সুলতানের নর প্রতিমূর্তিগুলোর মাংসপেশীর অতিরঞ্জিতকরণের কারণটি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেজন্য তারা শিল্পের দার্শনিক আবেদনের অযৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন।

বলাবাহুল্য, এসব ব্যাখ্যা সার্বিকভাবে শিল্পকর্মের জন্য প্রযোজ্য। এগুলোর ভেতর দিয়ে শিল্প সম্বন্ধে তাদের ব্যক্তিগত অভিমত বা কে কি ভাবেন বা বুঝেন সেটা প্রকাশ পেয়েছে । অতএব, নিঃসন্দেহে বলা যায়, এগুলো তাদের কল্পনাপ্রসূত । কেবল আবেগপ্রবণ হয়ে সুলতানের উচ্চ প্রশংসা করার জন্যই অতিরঞ্জিত করা হয়েছে ।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, কবি আল মাহমুদ, বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, মোহতার প্রমুখ শিল্পরসিক ও অনুরাগীদের মন্তব্যের ভেতর দিয়ে এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। অধ্যাপক রাজ্জাক বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে অসাধারণ করে দেখার ক্ষমতাই সুলতানের ছবির বৈশিষ্ট্য, সেগুলো দেশকালের গণ্ডি অতিক্রম করে সর্বমানুষের উজ্জ্বল উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছে । কবি আল মাহমুদ আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছেন, ‘তার সাথে তুলনা হতে পারে এমন শিল্পীরা পৃথিবীতে কোথাও আর বেঁচে নেই।’

মোহতারের ভাষ্য হলো, “And then the bathing soldiers for casino cartoon of Michael Angello, Rapheal drawing in and then stand before the paintings of S M Sultan you will recognize the affinity between the twentieth century painter and those giants of European renaissance, for Sultan is of the same breed, he is one of them.” আনিসুজ্জামানের মতে, “He belongs both to Bangladesh and the world.”

এসব উক্তির সাথে সুলতানের কাজের কতটা সম্পর্ক আছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। তবে এসব উক্তির ভেতর দিয়ে বক্তাদের সম্বন্ধে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেটা হলো শিল্পের বিচারে বক্তাদের জ্ঞানের দারিদ্র্য এবং শিল্প সম্বন্ধে নিজের গভীর জ্ঞান প্রচারের অপপ্রচেষ্টা। মোহতারের কথার ভেতর তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় “You are dull if you don’t find the glory and the presence of a dream ” বস্তুত ‘you are dull’ উক্তির ভেতর দিয়ে বক্তার বুদ্ধিভিত্তিক দুর্বলতা ও ভীতি, অপরদিকে জ্ঞানের ভান ও ভাড়ামি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

অনুরূপভাবে বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের কথা ধরা যাক। তার মতে “A concealed Picasso and obscure Van Gogh, he is both, perhaps more. ”

উক্তির ভেতর দিয়ে চিত্রকলা সম্বন্ধে তার নিজের জ্ঞানের অভাবই প্রমাণ করেছেন। তার উক্তি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, পিকাসো এবং সুলতান কারো কাজ সম্বন্ধেই তার সম্যক ধারণা নেই । যদি প্রশ্ন করা যায়, কবি আল মাহমুদ কি শেক্সপিয়র ও মিল্টনের সমতুল্য বা সমকক্ষ, তাহলে যেমন সাহিত্য সম্বন্ধে প্রশ্নকারীর নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ পাওয়া যায় তেমন জাহাঙ্গীর কেবল নিজের ভাবমূর্তিই নষ্ট করেছেন । তবে ভ্যান গগের সাথে তুলনা আংশিকভাবে সঙ্গত এজন্য যে, সুলতান তার অনুকরণকারী ।

একজন ভিখারি সারাদিন বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বিভিন্ন রকমের চাল সংগ্রহ করে একত্রে তার থলি ভর্তি করে রাখে, কিন্তু তার নিজের বলতে কিছুই নেই । সুলতানের ঠিক তেমন অবস্থা । কথাটা রুঢ় হলেও সত্য ।

সুলতানের কাজগুলো পরীক্ষা করে বলা যায়, জয়নুল আবেদিন ও হামিদুর রহমানের ভেতর সৈয়দ আলী আহসানের কথায় বলা যায় ‘আকৃতিগুলো বিশিষ্ট তাৎপর্য উদ্ঘাটিত হয় এবং রেখা বর্ণের সামঞ্জস্য অথবা বিভঙ্গে শিল্পীর বিশ্বাসকে প্রকাশিত করে। কিন্তু সুলতানের ভেতর বিশ্বাসের ও আশাবাদের তেমন কোনো আভাস পাওয়া যায় না।

তবে ‘বাস্তবের প্রতিচিত্রণ না করে তিনি একটি আদর্শকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন’— আলী আহসানের এই উক্তির মধ্যে কোনো যুক্তি আছে বলে মনে হয় না । পরোক্ষভাবে শিল্পের বিচারে তার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ বাস্তবধর্মী হলে যে কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না বা করা যায় না, এটা ঠিক নয়। মিলেও করবে বাস্তবধর্মী কাজের ভেতর দিয়ে আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

পাশ্চাত্য বাদ দিয়ে উপমহাদেশের জয়নুল আবেদিন এবং অন্যান্য শিল্পী আছেন, যারা বাস্তব প্রতিচিত্রণের মধ্য দিয়ে একটা আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বিশেষ করে সুলতান ব্যক্তিগত জীবনে যাই হোন না কেন, কাজের দিক থেকে তিনি কঠিন বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তববাদী। একইভাবে আলী আহসানের রমণীরাও উর্বরা স্বাস্থ্যবতী আংশিকভাবে যুক্তিতে টেকে না ।

উক্তিটা পৃথিবীর অন্য দেশের রমণীদের জন্য ঠিক হলেও এদেশের জন্য সম্পূর্ণভাবে সঠিক না । তবে এদেশের রমণীরা স্বাস্থ্যবতী না হলেও উর্বরতার অভাব একেবারেই নেই। জন্ম বিস্ফোরণই তার প্রমাণ। তবে যে বিষয়টা আলী আহসানের বিশেষ করে দৃষ্টি ফাঁকি দিয়েছে, সেটা হলো, যৌন বিষয়ে সুলতানের দারুণ কৌতূহল । তার রমণীরা শাড়ি পরিহিতা হওয়া সত্ত্বেও যৌনাঙ্গগুলো স্পষ্ট ও অতি যত্নসহকারে আঁকার মধ্যে দিয়ে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ।

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

এর দু’টি সম্ভাবনা দেখা যায়, একটি হলো অতৃপ্ত যৌন জীবন; অন্যটি হলো, অতিরিক্ত কামার্ততা। কবীর চৌধুরীর ভাষায়, “Well rounded buttocks and swelling breasts ready to come to grips, ” উক্তির মধ্যে তার সমর্থন পাওয়া যায় । এই দু’কারণেই তার রমণীরা ইন্দ্রীয় সুখবর্ধনকারী হতে বাধ্য। তবে সামাজিক ও নান্দনিক দিক থেকে বলা যায়, রমণীরা শাড়ি পরিহিতা না হয়ে বিবসনা হওয়াই ভালো ছিল । কারণ শাড়ি ভেদ করে যৌনাঙ্গগুলো স্পষ্ট দেখানোর ফলে অশ্রীল না হলেও শালীনতার অভাব অবশ্যই রয়েছে। এ কথা বলা হয়তো অন্যায় হবে না যে, রমণীদের শাড়ি পরানোর ভেতর দিয়ে সুলতানের সামাজিক মূল্যবোধ প্রকাশ পাইনি । বরঞ্চ, সুকৌশলে সমাজের চোখকে ফাঁকি দেয়া হয়েছে বলা যায়। অতএব, উদ্ধৃত মন্তব্যগুলো গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

সন্তোষ গুপ্ত কিছুটা ভিন্নভাবে দার্শনিক আবেদনের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, “The meaning of beauty appears to artists Sultan with forceful representation of man and world in the context of thought it should be there is no beauty in weakness. Cowardice and crawling life may evoke pity, but can’t command respect and which it not respectful can’t be said to be beautiful to look at.

সন্তোষ গুপ্তের ব্যাখ্যাটা প্রণিধানযোগ্য, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই । কিন্তু ভুল ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে । তার ব্যাখ্যার ভেতর অসঙ্গতি এজন্য দেখা যায় যে, কি হওয়া উচিত আর কি হওয়া উচিত নয়, কি হলে ভালো হবে আর কি হলে ভালো হবে না, সেটা শিল্প ও শিল্পীর বিচারের বিষয় না । প্রকৃতপক্ষে এসব প্রশ্ন এবং সমস্যা দর্শন ও নীতিশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয় ।

শিল্পী যে পরিবেশের মধ্যে বাস করে সেই পরিবেশ থেকে যে অভিজ্ঞতা হয় এবং জীবনবোধের সৃষ্টি হয় তাই তার কাজের ভেতর প্রতিফলিত হয় । আর পরিবেশ থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং জীবনবোধ থেকে যে দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয় তা থেকে দু’টি দার্শনিক মতবাদ জন্ম নেয়; একটি হলো জীবনের জন্য শিল্প অথবা শিল্পের জন্য শিল্প, আর অন্যটি হলো, নৈরাশ্য ও হতাশা অথবা আশাবাদ।

এদিক থেকে বিচার করে আগেই বলা হয়েছে যে, সুলতানের কাজের মধ্যে জীবনের জন্য শিল্প এই মতবাদ বা বিশ্বাস প্রতিফলিত হয় । সুতরাং সন্তোষ গুপ্তের ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যায় না ।

‘There is no beauty in weakness’ ‘Can not set to be beautiful to look at’ কথাটি সন্তোষ গুপ্ত কি অর্থে বুঝিয়েছেন? তিনি কি দৈহিক শক্তি নাকি মানসিক শক্তি বুঝিয়েছেন, তা স্পষ্ট না । তবে সুলতানের যে সব কাজের প্রেক্ষিতে তিনি এই উক্তি করেছেন তাতে মনে হয় যে, তিনি দৈহিক শক্তি বুঝিয়েছেন । তাহলেও তার এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যায় না। কারণ দুর্বল শীর্ণ দেহ হলে যে তার ভেতর সৌন্দর্য নেই, তা ঠিক না।

আর যদি সন্তোষ গুপ্তের কথাই স্বীকার করে নেয়া হয় তাহলে জয়নুল আবেদিনের ‘৪৩ সালের মহামন্বন্তরের দুর্বল, শীর্ণদেহী, বুভুক্ষু কঙ্কালসার মানুষগুলোর রেখাচিত্রগুলো দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করে সর্বজনীনতা লাভ করতে পারে না, বিশ্ব-স্বীকৃতি ও নন্দিত হতে পারে না ।

অসুন্দরকে সুন্দর করে উপস্থাপন করাই হলো শিল্পকর্ম, এখানেই শিল্পীর কৃতিত্ব ও সার্থকতা, যা তার কল্পনা, নন্দনবোধ, কলাকৌশল জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে । যেজন্য একটা বহুল প্রচলিত কথা আছে, ‘শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখা’ ও ‘মন দিয়ে গড়া’। সুতরাং সন্তোষ গুপ্তের কথা মেনে নেয়া যায় না।

তবে সন্তোষ গুপ্তের ‘Cowardice and crawling life may evoke pity but can’t command respect’ কথাটা সমর্থন করা যায়। কিন্তু সুলতানের যেসব প্রেক্ষিতে তিনি একথা বলেছেন, সেদিক থেকে বিচার করে সমর্থন করা যায় না। কারণ সুলতানের ঐ সব কাজের ভেতর মানসিক বা নৈতিক শক্তির পরিবর্তে দৈহিক পশুশক্তিই অধিক প্রকাশ পেয়েছে ।

যেমন— প্রথম বৃক্ষরোপণ-এর মধ্যে আশাবাদ ও আশীর্বাদের পরিবর্তে হতাশা প্রকাশ পেয়েছে (অবশ্য এটা বিতর্কিত হতে পারে), আর বোঝা, চরদখল, ফারমার্স উইথ ল্যাথেল উইপন, ফারমার্স ইন কনফ্রন্টেশন, কনফ্রন্টিং ফারমার্স প্রভৃতি কাজের ভেতর নৈতিক শক্তির পরিবর্তে পশুশক্তি, দারুণ আক্রোশ ও হিংস্রতাই প্রাধান্য পেয়েছে ।

অতএব, এদিক থেকে বিচার করলেও সন্তোষ গুপ্তের ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যায় না। সুতরাং বলা যায়, সন্তোষ গুপ্ত ভুল ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন ।

তবে সন্তোষ গুপ্ত যে একজন বাস্তববাদী ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী সে কথা অনুমান করতে কষ্ট হয় না । আর এ কারণেই তিনি সুলতানের পেশীবহুল কৃষকদের বাহ্যিকভাবে বিচার করে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বস্তুত তিনি খুব বুদ্ধির সাথে *দেয়ার ইজ নো বিউটি ইন উইকনেস’ এবং কাওয়ার্ডিস এ্যান্ড ক্রলিং লাইফ মে ইভোক পিটি, বাট কান্ট কমান্ড রেসপেক্ট’ কথার ভেতর দিয়ে পরোক্ষভাবে একটা রাজনৈতিক মতবাদ বা আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রচারের চেষ্টা করেছেন ।

সুলতানের নিজের ভাষ্য হলো যে, এদেশের কৃষক সম্প্রদায় প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে সেজন্য তাদের খুব শক্তিশালী হওয়া বলে তিনি মনে করেন । কিন্তু তার ব্যাথার মধ্যে স্বপক্ষ সমর্থনযোগ্য যুক্তি নেই। কারণ এদেশের কৃষকরাই শুধু প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে নেই । অনুর্বর উত্তপ্ত মরুভূমি, তুষারাচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ ভূমি এবং সংকীর্ণ পার্বত্য উপত্যকা, সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ, গভীর অরণ্যে হিংস্র জীবজন্তুর সাথে লড়াই করে বসবাস, ঝড়, তুফান, আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা কোনো সহজ ব্যাপার নয়।

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

বস্তুত তিনি সত্য গোপন করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন । প্রকৃতপক্ষে, এসব ব্যাখ্যা দ্বারা তিনি জনগণকে মুগ্ধ ও বেকুব বানিয়ে থাকেন। আসল কথা হলো যে, তিনি নিজের মানসিক রোগ বা সিজোফ্রেনিয়া সম্বন্ধে সচেতন না এবং দ্বিতীয় কারণ হলো, তিনি মাইকেল অ্যাঞ্জেলোকে, বিশেষভাবে তার শেষদিকের অসমাপ্ত ভাস্কর্য অনুকরণ এবং ভ্যান গগের অনুকরণ করেছেন।

এই সত্যটি তিনি জনসাধারণের কাছে গোপন রাখার জন্য এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন । বলাবাহুল্য, আমাদের দেশের জনগণ কবি ও শিল্পীদের কাছ থেকে এরকম আবেগপ্রবণ কথা শুনতে চায় ও পছন্দ করে। যেমন- আল মাহমুদ তার সম্বন্ধে এক জায়গায় মন্তব্য করেছেন, ‘তার আঁকার জন্য গোধূলির আলো ও নির্জনতামাত্র দরকার হয়। শুধু সুলতান নয়, সব শিল্পীই আঁকার সময় নির্জনতা চায়।

কারণ সৃজনশীল কাজের জন্য নির্জনতা বিশেষভাবে প্রয়োজন। তা না হলে মনোযোগ ও নিবিষ্টচিত্তে ছবি আঁকা যায় না । তবে আল মাহমুদের গোধূলির আলোতে কবিতা লেখা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু ছবি আঁকা যায় না অবশ্যই । গোধূলির আলোতে ছবি আঁকলে রঙগুলোও ধূলি হয়ে যায়। আর সেজন্যই বোধ হয় সুলতানের রঙগুলো কাদাকাদা হয়ে গেছে। সুলতানের বেশভূষা ও আচরণের সাথে সেসব আবেগপ্রবণ সংলাপ জনগণকে সহজে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে। কিন্তু বাস্তবতার সমর্থন দেয় না ।

এদেশের শিল্পরসিক, শিল্পানুরাগী ও জনগণ সুলতান সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করে । তার সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তার কারণ বিশ্লেষণ করলে দু’টি প্রধান কারণ দেখা যায়; প্রথমত, তার অতীত পঞ্চাশ দশকের সুখ্যাতি; আর অন্যটি হলো, তার ব্যক্তিগত চরিত্র বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ বেশভূষা ও আচার-ব্যবহার এবং বাকপটুতা। তবে দ্বিতীয় বিষয়টি তার জনপ্রিয়তার একমাত্র কারণ বলা যায়।

কবি শামসুর রাহমানের কথায় বলতে হয়, “Unconventional life style, his passion for birds, beasts, cats and the occult have shunt an era to his biography” শামসুর রাহমানের কথার প্রতিধ্বনি কবির চৌধুরীর ভেতর শোনা যায়: “With his long stringy hair coming down to his shoulders, his penetrating eyes, his kindly face and moral gesture, he looked like a mendicant of the baul sect, a religious mystic rather than a great painter with a fiery creativity sitting in his breast.” একই কথার পুনরাবৃত্তি আবু হেনা মোস্তফা কামালের কাছে শোনা যায়, “Attired in a long black robe, he sometimes resembles a traditional Darvish of the East.”

যা হোক, এক কথায় বলা যায়, সকলের উক্তির মধ্যে দু’টি সাধারণ দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি হলো তার উপরিউল্লিখিত চরিত্র বৈশিষ্ট্য, আর অন্যটি হলো, পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ যুগের মহান শিল্পীদের উল্লেখ । তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দ্বিতীয়োক্ত বিষয়ে সবাই যেটুকু ভুল করেছেন সেটা হলো যে, তাকে রেনেসাঁর মহান শিল্পীদের অনুকরণকারী হিসেবে আখ্যায়িত করার পরিবর্তে তাদের সাথে সুলতানকে সমতুল্য মনে করেন ।

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

পূর্ব আলোচিত বিষয়ের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, এদেশের শিল্পরসিক ও সমালোচকদের শিল্পকর্ম এবং মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের অভাব রয়েছে । ফলে তারা শিল্পকর্মকে মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন ।

অবশ্য মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা আর চিত্রকর্ম পরীক্ষা করে বিশ্লেষণ করা- এ দুয়ের ভেতর অনেক পার্থক্য আছে। আর এ কারণেই তারা শিল্পকর্ম, চিত্রকর্ম এবং মানসিক রোগী অর্থাৎ সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের চিত্রকর্ম, ইংরেজিতে যাকে বলা হয়।

Psycholic art -এর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম নন। সুতরাং বলা যায়, সুলতানের, বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তরকালের কাজগুলো বুঝতে হলে যেমন ” Psycholic art” সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার তেমন শিল্পকর্মের ভেতর অনুকরণ এবং মৌলিকতা ও স্বতন্ত্র সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। তা না হলে শিল্পের বিচারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না ।

পূর্বেই বলা হয়েছে, সুলতানের হাল আমলের কাজগুলো মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে তার মধ্যে ইতিবাচক বিঘ্নিত শারীরিক-রূপকল্প এবং মাঝে মাঝে বিঘ্নিত-রূপকল্পের লক্ষণগুলো স্পষ্ট ধরা পড়ে। তার এসব কাজ মনোবৈজ্ঞানিকদের গবেষণামূলক কাজে যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে। তার হাল আমলের কাজগুলো শিল্পকর্মের শ্রেণীভুক্ত করলে অবশ্যই ভুল করা হবে। অতএব, এগুলোকে ‘সাইকোটিক আর্ট’-এর অন্তর্ভুক্ত করাই অধিক যুক্তিসঙ্গত ও শ্রেয়।

তবে ইদানীং বিভিন্ন সমালোচকের বক্তব্য থেকে মনে হয় যে, সুলতানকে কে কত বেশি উচ্চ প্রশংসা করতে পারেন সে বিষয়ে এদেশের শিল্পরসিক ও শিল্পানুরাগীদের মধ্যে দারুণ প্রতিযোগিতা চলছে। আমাদের দেশে ‘হুজুগে মাতা’ বলে অতি জনপ্রিয় একটা প্রবাদ আছে ।

উদ্ধৃত মন্তব্য থেকে মনে হয় হয় যে, সুলতানকে নিয়ে শিল্পরসিক যেন হুজুগে মেতে উঠেছে। তবে হুজুগ কখনোই চিরস্থায়ী হয় না । আর এই হুজুগ যখন থেমে যাবে তখন সুলতানের অবস্থা কোথায় দাঁড়াবে সে কথা তাড়াহুড়ো করে নিশ্চিতভাবে কিছু না বলাই ভালো। ভবিষ্যতের উত্তর পুরুষরা দোষ-গুণ বিচার করে তার সঠিক স্থান নির্ণয় করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করি ।

তবে ইতোমধ্যেই অনেকেই সুলতান সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। Whether he will remain sufficiently meaningful to the common viewer of art connoisseur to taste and degree সাদেক খানের এই উক্তির মধ্যে দিয়ে একথার ইঙ্গিত পাওয়া যায় ।

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment