আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় চারু ‘ও কারুকলা ইনস্টিটিউট
চারু ‘ও কারুকলা ইনস্টিটিউট
পূর্ব-পাকিস্তান বা বাংলাদেশে ছবি আঁকার প্রতিষ্ঠান চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫ই নভেম্বর ১৯৪৮ সালে। প্রতিষ্ঠাতা শিল্পীদের মধ্যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল কলকাতা থেকেই। চারুকলার প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমদ, খাজা শফিক আহমেদ, শফিকুল আমিন, মোহাম্মদ কিবরিয়া এঁরা সবাই চিন্তায় ও চেতনায় ছিলেন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন।
তাঁরা শুধু ছবি আঁকা বিষয়টি হাতে-কলমে শিখবে সেজন্যে শিল্পী বানাবার জন্য চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেননি। তাঁরা চেয়েছেন এই চারুকলা ইনস্টিটিউটকে কেন্দ্র করে ছবি আঁকা, ভাস্কর্য ও অন্যান্য শিল্পের মাধ্যমে নানারকম সংস্কৃতি ও ভাষার চর্চা ও সম্মান ইত্যাদিও প্রসারিত হবে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়বে।
চারুকলা চর্চার প্রথম দিক থেকেই যাঁরা ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রতিষ্ঠাতা শিল্পীদের চিন্তা ও চেতনাকে ধারণ করেই শিল্পচর্চা করেছেন। তাই দেখা যায়, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিবর্তন, ষাটের দশকের শুরুতেই আইউব খানের মার্শাল ল-বিরোধী আন্দোলন ও চাপিয়ে দেওয়া হামিদুর রাহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন,
১৯৬৮ ও ৬৯-এ বিশাল গণআন্দোলন করে স্বৈরাচারী আইউবের পতন ঘটানো ইত্যাদি সব সংগ্রামে দেশের ছাত্র-জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন এদেশের চিত্রশিল্পীরা। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগ তথা বাংলার মানুষ পাকিস্তানের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। তারপর বাঙালির হাতে পাকিস্তানের কর্তৃত্ব না দেওয়া ও পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলন, এবং সবশেষে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ— সর্বত্রই চিত্রশিল্পীরা প্রত্যক্ষভাবে কখনো কখনো পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছে।
শিল্পগুরু জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানসহ কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, নিতুন কুণ্ডু, ইমদাদ হোসেন, প্রাণেশ মণ্ডল, প্রফুল্লরায়, রফিকুন নবী, আনোয়ার হোসেন, গোলাম সারোয়ার, বিজয় সেন, মাহমুদুল হক, নাসির বিশ্বাস, বীরেন সোম, মঞ্জুরুল হাই, আবুল বারক আলভী, রেজাউল করিম, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালেদ, এম এ খালেদ, শাহাদত চৌধুরী, মাহবুবুল আমিন, স্বপন চৌধুরী, শাহাবুদ্দিন প্রমুখ শিল্পীরাই আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছেন।
একদিকে তাঁরা তাঁদের তুলিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন আবার কোনো কোনো শিল্পী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েও সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’, শিল্পী প্রাণেশ মণ্ডলের আঁকা বাংলার মায়েরা- মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’ কিংবা শিল্পী দেবদাস চক্রবর্ত্তীর আঁকা ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’ । এই পোস্টারগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও প্রেরণার অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
আরও দেখুন :